সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১


মহানায়ক উত্তম কুমারঃ আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
১২ আগস্ট ২০২০ ২১:৫৬

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৩৭

ছবিঃ মহানায়ক উত্তম কুমার

 

বিনোদন শব্দটি বর্তমান সময়ের সাথে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সময়কে কিনে নেবার প্রয়াস ঘরে ঘরে। এর ফলে মানুষ ভুলে যাচ্ছে প্রিয়জনদের সাথে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটাতে। আধুনিক সভ্যতায় মানুষ হাতিয়ার করেছে মোবাইল, ল্যাপটপ কম্পিউটার। এসবে বাড়ছে হতাশা ও একঘেয়েমি। একঘেয়েমি কাটাতে জনগণ বেছে নেয় বিনোদনের জগৎ। বিনোদনের জগৎ মানবজীবনে আলাদা মাত্রা রাখে। সেই বিনোদনের জগতে এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কের নাম মহানায়ক উত্তম কুমার। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির মুনশিয়ানা। বাঙালি জাতির সত্তাকে বিশেষ রূপ দিয়েছিলেন ভারত বর্ষ তথা বিশ্বের দরবারে। আজও তাঁর শিল্প সত্ত্বা একইভাবে সমাজের বুকে সমাদৃত হয়ে আছে। তার জনপ্রিয়তা আজও একই রকম আছে বর্তমান যুব সমাজের চোখে। এটা একটা বিশেষ কারণে যে যুবসমাজ আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও ভুলে যায়নি বাঙালি জাতির মুন্সিয়ানা উত্তম কুমারের নাম। বাঙ্গালী জাতি বরাবর আড্ডা প্রিয়। চায়ের দোকান পাড়ার মোড়ে সেলুন কিংবা কফি হাউসে বসে আড্ডা দিতে গিয়ে প্রিয় অভিনেতা উত্তম কুমার প্রসঙ্গে আলোচনা হয়নি এমন দিন বোধ হয় নেহাত খুব কম আছে। কথা প্রসঙ্গে জানা-অজানায় উত্তম কুমারের বহু অজানা তথ্য সামনে আসে। এমন এক অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গেও আমি পরিচিত হই কলকাতার প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই এক জনৈক অধিবাসী তাপস কুমার বৈদ্য বাবুর কাছ থেকে। এক সময় কর্মসূত্রে তিনি উড়িষ্যাতে থাকতেন। বার্ধক্যের ভরে সালটা ঠিক মনে করতে পারলেন না।সরস্বতী পূজার সময় উত্তম কুমার সে সময় সি বিচের কাছে শুটিং করছিলেন। বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছিল তার শুটিং। সিনেমাটার নাম ও তিনি মনে করতে পারলেন না। প্রতিদিন সেখানে বহু মানুষের ভিড় লেগে থাকত মহানায়ক উত্তম কুমার কে দেখার জন্য। বিচের পাশে একটা স্কুল থেকে একদল ছাত্র রোজ সেখানে যেতেন। উদ্দেশ্য মহানায়কের  থেকে সরস্বতী পূজার চাঁদা তুলতে হবে। কিন্তু ছাত্র গুলোর সাহসে কুলালো না তাঁর সামনে গিয়ে পূজার চাঁদার কথা বলবে। এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। শুটিংয়ের শেষ দিন। পড়ন্ত বিকেল, সবকিছু গোছগাছ চলছে। ছেলেগুলো শেষ অব্দি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কেয়ারটেকার ছেলেগুলোকে ভিতরে নিয়ে এলো। সামনে মহানায়ক উত্তম কুমার দাঁড়িয়ে। মহানায়ক জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা রোজ রোজ এভাবে স্কুল পালিয়ে শুটিং দেখতে কেন আসো? স্কুল শিক্ষক তোমাদের বকাবকি করে না? তাদের মধ্যে একটা ছেলে উত্তর দেয়, আমরা শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে এসেছি, কারণ আমাদের স্কুলের সরস্বতী পূজা, শিব পূজার জন্য আপনার থেকে চাঁদা নিতে এসেছি। মহানায়ক বললেন চাঁদা নিতে এসেছ, তা আগে বলনি কেন? তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে ছেলেদের হাতে ধরিয়ে দেয়। বলল যাও ভালো করে পূজার আয়োজন কর। এই হল মহানায়ক উত্তম কুমার।

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ৪০টি বছর। তথাপি বাংলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের মনের মণিকোঠায় তিনি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে বিরাজমান। তাঁর অভিনীত ছায়াছবির স্মৃতি রোমন্থন করে আমরা পাই নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দ। বাংলা ছবির এই আঙ্গিঁনায় মহানায়ক এক জনই....তিনি উত্তমকুমার। তাঁর সমন্ধে নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা থাকে না। কেননা তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। মহানায়কের এই তিরোধান তিথিতে তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। ভোলাময়রা ছবির এই দৃশ্যায়নে মহানায়কের অভিব্যক্তি এক অনন্য সাধারন আবেশের সৃষ্টি করে। আর সেই অনুভূতি থেকেই এই স্মৃতি তর্পণ।

তিনি একজন কিংবদন্তি অভিনেতা, চিত্রপ্রযোজক এবং পরিচালক। তাঁর পিতৃদত্ত নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। জন্ম কলকাতায়, ৩ রা সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে। কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং পরে গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হন। কলকাতার পোর্টে চাকরি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের মধ্যে উত্তম কুমার ছিলেন সবার বড়। তার পিতার নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম চপলা দেবী।

ছবিঃ অরুন কুমার

তার ছোট ভাই তরুণ কুমার একজন শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন। তারা একত্রে বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচিত্রে অভিনয় করেছেন (যেমনঃ মায়ামৃগ, ধন্যি মেয়ে, সপ্তপদী (চলচ্চিত্র), সোনার হরিণ, জীবন-মৃত্যু, মন নিয়ে, শেষ অঙ্ক, দেয়া-নেয়া, সন্ন্যাসী রাজা, অগ্নীশ্বর ইত্যাদি)। উত্তম কুমার গৌরী দেবী কে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান।

ছবিঃ গৌরব চট্টোপাধ্যায়

গৌরব চট্টোপাধ্যায়, উত্তম কুমারের একমাত্র নাতি, বর্তমানে টালিগঞ্জের জনপ্রিয় অভিনেতা।

তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ছিল দৃষ্টিদান। এই ছবির পরিচালক ছিলেন নিতীন বসু। এর আগে উত্তম কুমার মায়াডোর নামে একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন কিন্তু সেটি মুক্তিলাভ করেনি। বসু পরিবার চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষন করেন। এরপর সাড়ে চুয়াত্তর মুক্তি পাবার পরে তিনি চলচ্চিত্র জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেন। সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে তিনি প্রথম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়।

ছবিঃ উত্তম-সুচিত্রা জুটি

তাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অনেকগুলি ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং একই সাথে প্রশংসিত চলচ্চিত্রে মুখ্য ভূমিকায় একসাথে অভিনয় করেছিলেন। এগুলির মধ্যে প্রধান হল - হারানো সুর, পথে হল দেরী, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃষ্ণা এবং সাগরিকা। উত্তম কুমার নিজেকে সু-অভিনেতা হিসেবে প্রমাণ করেন'এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ছবিতে স্বভাবসুলভ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। কারণ এই ছবিতে উত্তম কুমার তার পরিচিত ইমেজ থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছিলেন। এতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। উত্তমের সেই ভুবন ভোলানো হাসি, প্রেমিকসুলভ আচার-আচরণ বা ব্যবহারের বাইরেও যে থাকতে পারে অভিনয় এবং অভিনয়ের নানা ধরন, মূলত সেটাই তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে 'এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ও 'চিড়িয়াখানা' ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন(তখন এই পুরস্কারের নাম ছিল 'ভরত')। অবশ্য এর আগে ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত 'হারানো সুর' ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন সমগ্র ভারতজুড়ে। সেই বছর 'হারানো সুর' পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট। ইংরেজি উপন্যাস 'রানডম হারভেস্ট' অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করা হয়। প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার নিজেই। কমেডি চরিত্রেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। 'দেয়া নেয়া' ছবিতে হৃদয়হরণ চরিত্রে অভিনয় করে সেই প্রতিভার বিরল স্বাক্ষরও রেখে গেছেন।

উত্তম কুমার বহু সফল বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত, অমানুষ এবং আনন্দ আশ্রম অন্যতম। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটি নায়ক এবং দ্বিতীয়টি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা চলচ্চিত্রে তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। রোমান্টিক ছবির ফাঁকে দু'একটা ভিন্ন সাদের ছবিতেও অভিনয় করছেন তিনি। এর মধ্যে একদিন সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে ডাক পেলেন উত্তম 'নায়ক' ছবিতে অভিনয়ের জন্য।

উত্তম কুমার রোমান্টিক নায়ক ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রেও তিনি ছিলেন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। মঞ্চের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা। যার প্রমাণ হিসেবে পাওয়া যায় ১৯৫৫ সালে যখন তিনি বাংলা ছবির সুপার হিরো। শত ব্যস্ততার মাঝেও মঞ্চের ডাকে সাড়া দিয়ে 'শ্যামলী' নাটকে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি কয়েকটি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭), দেশপ্রেমী (১৯৮২) ও মেরা করম মেরা ধরম (১৯৮৭) অন্যতম। উত্তম কুমার পরিচালক হিসেবেও সফল। কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭৩) ও শুধু একটি বছর (১৯৬৬) ছবির সাফল্য তাই প্রমাণ করে।সঙ্গীতের প্রতিও ছিল তার অসীম ভালবাসা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় , মান্না দে এবং শ্যামল মিত্রের গানেই সবচেয়ে বেশি ঠোঁট মিলিয়েছেন উত্তম। ছবির গান রেকর্ডিংয়ের সময় শিল্পীর পাশে বসে তার অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন তিনি। এর ফলে গানের সাথে পর্দায় ঠোঁট মেলানো তাঁর পক্ষে খুবই সহজ হতো। সঙ্গীতপ্রেমী উত্তম ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির সবগুলো গানের সুরারোপ করেন। ছবিটি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। অভিনেতা, প্রযোজক এবং পরিচালক - সব মাধ্যমেই তিনি ছিলেন সফল।

দৃষ্টিদান (১৯৪৮), কামনা (১৯৪৯), মর্যাদা (১৯৫০), সহযাত্রী (১৯৫১), ওরেযাত্রী (১৯৫১), নষ্টনীড় (১৯৫১), সঞ্জীবনী (১৯৫২), বসু পরিবার (১৯৫২), কার পাপে (১৯৫২), সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), নবীন যাত্রা (১৯৫৩), লাখ টাকা (১৯৫৩), বৌ ঠাকুরানীর হাট (১৯৫৩), সদানন্দের মেলা (১৯৫৪), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), মনের ময়ূর (১৯৫৪), মরণের পারে (১৯৫৪), মন্ত্র শক্তি (১৯৫৪), কল্যাণী (১৯৫৪), গৃহপ্রবেশ (১৯৫৪)

, চাঁপাডাঙার বউ (১৯৫৪), ব্রতচারিনী (১৯৫৪), বকুল (১৯৫৪), বিধিলিপি (১৯৫৪), অনুপমা (১৯৫৪)

অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৫৪), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী (১৯৬৭), গৃহদাহ (১৯৬৭)

ভোলা ময়রা (১৯৭৭), ওগো বধূ সুন্দরী (১৯৮১) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

উত্তম কুমার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্র, ছোটিসি মুলাকাৎ (১৯৬৭), দেশপ্রেমী (১৯৮২), মেরা করম মেরা ধরম। তিনি ছিলেন একজন ক্ষুরধার পরিচালক। উত্তম কুমার পরিচালিত চলচ্চিত্র গুলি ছিল কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), শুধু একটি বছর (১৯৬৬) ।

উত্তম কুমার প্রযোজিত চলচ্চিত্র গুলি হচ্ছে গৃহদাহ (১৯৬৭), ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭), হারানো সুর (১৯৫৭)। উত্তম কুমার সুরারোপিত চলচ্চিত্র গুলি হচ্ছে কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬) সহ বহু হিট ছবি।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাট দশককে বাঙলা রোম্যাণ্টিক সিনেমার স্বর্ণযুগে পৌঁছে দিয়েছিল একটি সুবিখ্যাত জুটি - সুচিত্রা সেন (রমা দাশগুপ্ত, জন্ম: ১৯৩১) এবং উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, ১৯২৬ - ৮০)।

এই দুর্ধর্ষ জুটির প্রাধান্য এবং জনপ্রিয়তার মূলে ছিলো দুজনের সুন্দর চেহারা, নাট্য-ক্ষমতা এবং ভারতীয় (বিশেষ করে বাঙালী) দর্শকদের 'যেমনটি চাই তেমনটি' পুরুষ ও নারীর চরিত্র-চিত্রণ। সেই চরিত্র দুটি হল সুকুমার কৌমার্যের প্রতীক সত্যপরায়ণ আদর্শ পুরুষ এবং অতি-আদর্শবাদী, সহ্যশীলা, দয়ালু, স্নেহময়ী মাতৃসমা নারী যে জীবনের মূল্য খুঁজে পায় কোনও বীর যুবকের স্ত্রী, মা বা তার উপদেষ্টার ভূমিকায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, নীতি-পরায়ণ এবং সর্বদা আত্মোত্সর্গ করতে বা ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত নারীর চরিত্রে অভিনয় করে সুচিত্রা জনপ্রিয় করে তোলেন হিন্দুনারীত্বের সারসত্যকে। উত্তমের চরিত্র যেন কঠোর-তপস্বী অ্যাডোনিস - এমনিতে সংযত, কর্তব্যপরায়ণ, কিন্তু পৌরাণিক শিবের মত আদিম যৌনপুংগব ।

একদা হলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক বিলি ওয়াইল্ডার রোমান হলিডে-র (১৯৫৩) নায়িকা অড্রে হেপবার্ন সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে, বিধাতা ওকে সৃষ্টি করে ওর দুই কপোলে চুম্বন করেছিলেন। এই প্রশস্তিটা রূপসী সুচিত্রারও প্রাপ্য। সুচিত্রা সেনের জয়যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৩ সালে সাড়ে চুয়াত্তর মুক্তি পাবার পর থেকে। অভিনয়-জীবনে তিনি লক্ষ লক্ষ পুরুষের হৃদয়হরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে আমাদের দেশে, বিশেষ করে বাংলার মাটিতে যা হয় - তাঁর জীবনীকারেরা, যেমন সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায় (সুচিত্রার কথা) পূর্ব-বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) পাবনার এই চিরন্তন নারীকে (femina perennis) প্রায় পুজোর আসনে বসিয়েছেন।

সোমা চ্যাটার্জীর মার্জিত, কিন্তু অতিকথন দুষ্ট সুচিত্রা-জীবনীতে সুচিত্রার স্বর্গীয় ও আলোকোজ্জ্বল সৌন্দর্য, রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, দরদী হৃদয় এবং সর্বোপরি নিগুঢ় আধ্যাত্মিকতার বর্ণনা - নিতান্তই হাস্যকর উচ্চ-প্রশংসা। স্তুদিবাদ ও মামুলি উক্তির আধিক্যে ঘোমটার আড়ালে গ্রাম-বাংলার নব-বিবাহিত কনেবৌয়ের মত আসল রমাই ঢাকা পড়ে গেছে।

ছবিঃ সুচিত্রা সেন

কলকাতার চলচ্চিত্রজগতে সুচিত্রা সেনের আত্মপ্রকাশকে বিচার করতে হবে উত্তর-স্বাধীনতা কালে ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির নিরিখে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অভিবাসি ও উদ্বাস্তুর তুমুল স্রোতে শহুরে ভদ্রলোক সমাজে পাশ্চাত্য মনোভাব তেমন করে দানা বাঁধতে পারে নি; বাঙালীদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ তখনও পুরুষ-দমিত গোষ্ঠীতন্ত্রের ঐতিহ্যকে আঁক ড়ে ধরে রেখেছে। ফলত, আদর্শ নারীর গুণাবলী অপরিবর্তীত রয়ে গেছে পুরুষ-শাসিত সমাজের ব্যবস্থা মত - সহনশীলতা, আত্মোত্সর্গ এবং আত্মত্যাগের নিগড়ে। সৌভাগ্যক্রমে সুচিত্রার পরিচালকেরা, যেমন অগ্রদূত (বিভূতি লাহা, ও সহযোগী), যাত্রিক, অজয় কর, নির্মল দে, প্রভৃতি এই আদর্শ নারীর চরিত্রেই সুচিত্রা সেনকে উপস্থাপন করলেন। যে ছবিটি সুচিত্রা সেনকে সাধারণের কাছে প্রসিদ্ধি আনলো, সেটা হল অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪)। ছবিটি চিরাচরিত নারীবিদ্বেষী গল্পর উপর ভিত্তি করে - যেখানে স্বামীকে অর্পণ করা হল সবরকমের সুযোগ-সুবিধা; রামায়ণের রামের মত তাঁকে দেওয়া হল হারানো স্ত্রীকে নানান কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাবার অধিকার। এই ভাবেই শুরু হল সুচিত্রা সেনের ফিল্ম-ব্যক্তিত্ব, যেটি পরে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে।

১৯৫৬ সালে একটি রাত ছবিতে সুচিত্রা অভিনয় করলেন একটি সরলমতী ফ্লার্ট সান্ত্বনার ভূমিকায়। ভাগ্যচক্রে সান্ত্বনা তাঁর পূর্বপরিচিত সুশোভনের সঙ্গে গ্রামের এক পান্থনিবাসে রাত কাটাতে বাধ্য হলেন। সেখানে সান্ত্বনা মাঝেমধ্যে সুশোভনকে প্রেম-প্রেম ভাবভঙ্গী দেখালেও সুশোভন যখন ঘরের একটা মাত্র বিছানায় শোবার প্রস্তাব দিলেন, সান্ত্বনা সজোরে জানালেন ওটা অন্যায়, --- 'এটা ওদেশ নয়, এটা বাংলাদেশ।' বলাবাহুল্য সুচিত্রার বেশীর ভাগ পছন্দসই চরিত্রই যৌন-অনুভূতি প্রকাশে অপারগ ধর্মধবজী নারীর।

উত্তম কুমার যে সময়ে মহানায়ক হন, সে সময়ে তাঁর প্রতি জনসাধারণের আকর্ষণের বড় কারণ ছিলো লোকের চোখে তিনি আদর্শ শহুরে ভদ্রলোক । যেসব ছবিতে উনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন, চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকদের প্রসাদে সেই চরিত্রগুলি ছিলো আদর্শবান পুরুষের, যাঁরা নারীর আকর্ষণে বিচলিত হন না, কিন্তু নায়িকাদের উপর শিশুর মত নির্ভরশীল। এটি বিশেষকরে সত্য ৫০ ও ৬০ দশকে - সুচিত্রা সেন নায়িকা হলে।

ছবিঃ উত্তম-সুচিত্রা

অগ্নিপরীক্ষা ( ১৯৫৪), শাপমোচন (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হোল দেরি (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭) রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা ৯১৯৬২), গৃহদাহ (১৯৬৭), হার মানা হার (১৯৭১), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২) এবং প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫) ছবিগুলিতে উত্তমকুমারের রোম্যাণ্টিক আবেদনের মূলে রয়েছ একটি অবিবাহিত রক্ষণশীল পুরুষ (আলো আমার আলো এর ব্যতিক্রম), যিনি যৌন ব্যাপারে উদাসীন - অর্থাত্, নিরীহ বাঙালী হিন্দু আদম (Adam)। এই ধরণের চরিত্রের যেটা প্রয়োজন, সেটা হল তাকে দেখভাল করা, অসুস্থ হলে সেবা দিয়ে সুস্থ করা, এবং পরিশেষে ধীরে ধীরে সূক্ষ্মভাবে প্রিয়ার নজরে আনা। উত্তমের এই চরিত্রের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের মুখের মর্মস্পর্শী ভাব, নিখুঁত সৌন্দর্যের ডালা এবং ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে সৃষ্টি হল রোম্যাণ্টিক জুটির ম্যাজিক-মশলা - যা উদ্বেল করল সেই সময়ের (ঔপনিবেশিকোত্তর) বাংলা তথা ভারতীয় হৃদয়কে।

সুচিত্রা-উত্তম জুটির প্রধান বিশেষত্ব হল ওঁদের পরস্পরের কথোপকথনের ধারা। এটাকে বাংলা ভাষায় বলে 'রোম্যান্স অন এ টি-পট'। এখানে চা হল প্রেমের তরল ওষধি - যেটিকে আরও মধুরতর করা হয় যখন প্রথমজন বলেন 'আর চিনি লাগবে কি?' অথবা 'চিনি যথেষ্ট হয়েছে তো?' আরেকটা পরিচিত দৃশ্য হল, মধ্যরাতে নায়কের বেডরুমে নায়িকার আগমন এবং নায়িকার এই অসংগত আচরণে রুষ্ট হয়ে নায়কের ক্রোধপ্রকাশ। সম্ভবতঃ এই ধরণের দৃশ্য প্রথম দেখা যায় প্রমথেশ বড়ুয়ার (১৯০৩-৫১) দেবদাস ছবিতে। কলকাতার শিক্ষিত বাঙালী বাবুর নিজের পুরুষত্ব সম্পর্কে ভীতি মূর্ত হয়ে ওঠে যখন ছেলেবেলার সাথি পার্বতী গভীর রাত্রে ঘরে এসে হানা দেয় প্রেমিকের কাছে ধরা দিতে। প্রেমিকার এই আত্মসমর্পণে হতবুদ্ধি নপুংসকের প্রত্যুত্তর হল মেয়েটির মাথায় ছিপের বাড়ি মারা ! পার্বতীর কপালে রক্তের ধারাকে দেখানো হল মাথার সিঁদূরের প্রতীক হিসেবে।

উত্তমকুমারের রূপালী পর্দার চরিত্র নারীদের প্রতি পুরুষদের এই ধরণের আচরণের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। ওঁর বেশীর ভাগ রোম্যাণ্টিক ছবিতে দেখা যায় নারীর সৌন্দর্য ও আকর্ষণের প্রতি নিস্পৃহতা এবং প্রেমের কোনও প্রস্তাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিরূপভাব প্রদর্শন। ওঁর এই প্রায়-নারীবিদ্বেষী আচরণ, অতি-ন্যায়বান, অতি-রক্ষণশীল চরিত্রের জন্যেই উনি টলিউডের একজন অসাধারণ জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠেন, কারণ এগুলোই আদর্শ বাঙালী ভদ্রলোকের চরিত্রগুণ বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্যপক্ষে, উত্তমকুমার বলিউডের নায়ক-চরিত্রে, যেখানে পুরুষসিংহ নায়ক নেচে গেয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন নি।

বাস্তবে বাংলা ছবিতেও যেখানে নায়ক সতেজ সাহসী মিশুকে প্রেমিক পুরুষ, নিজের পুরুষত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে প্রেম নিবেদন করতে দ্বিধাগ্রস্ত নন - সেইসব চরিত্রে ওঁকে মানাতো না। উনি চিরস্মরণীয় ওঁর চিত্তাকর্ষক চেহারা, মৃদুমন্দ্র স্বর, বাংলা কথা বলার ধরণ ও নিখুঁত উচ্চারণ জন্যে - যদিও ওঁর ইংরেজি উচ্চারণ দুষ্ট ও প্রায়শই হাস্যকর (জয়জয়ন্তী, ১৯৭১, আলো আমার আলো, নবরাগ)। মাঝ চল্লিশ থেকে ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত উত্তমের উচ্চারণ তার সুস্পষ্টতা হারাতে থাকে (গুজব উনি মদ্যপানে আসক্ত হয়েছিলেন - হয়তো সেই কারণে), ওঁর শরীরটাও আর টানটান ছিলো না এবং পরচুলা যে পড়তেন সেটাও বোঝা যেতো। উনি তখন অভিনয় করতেন হালকা হৃদয়ের বয়স্ক পুরুষের ভূমিকায় (ধন্যি মেয়ে, ১৯৭১, জয় জয়ন্তী, মৌচাক, ১৯৭৫), অথবা ভিলেনের চরিত্রে (বাঘবন্দি খেলা, ১৯৭৫, স্ত্রী, ১৯৭২, আলো আমার আলো, রাজা সাহেব, ১৯৮০), কিংবা আত্মঘাতি বিশ্বপ্রেমী (অগ্নিশ্বর, ১৯৭৫) হিসেবে।

সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করে যে অসামান্য সাফল্য উত্তম পেয়েছিলেন, সেইরকম সাফল্য অন্য কোনও নায়িকার সঙ্গে পান নি। অন্য সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী, যেমন, সুপ্রিয়া চৌধুরী (পূর্ব-পদবী মুখার্জী) বা অপর্ণা সেনের (পূর্ব-পদবী দাশগুপ্ত) বিপরীত রোলও ওঁকে তেমন সাফল্য দিতে পারে নি। সুচিত্রা সেনই উত্তমকে ম্যাটিনি আইডল করে তুলেছিলেন। সুচিত্রা না থাকলেও উত্তম কুমার নিশ্চয় সুদক্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেন - যদিও অভিনয়জীবনের প্রথমে এক পরিচালক ওঁকে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল নাম দিয়েছিলেন। রূপলী পর্দায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধেই উনি বাংলা সিনেমা য় নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন।

জীবনের পরিসরে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছিলেন। শুধু পুরস্কার নয়, পেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা। মহানায়ক উত্তম কুমার ছিলেন বাঙালীর হৃদয়ের খুব কাছে। ১৯৫৫ সালে হ্রদ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান সপ্তপদী সিনেমার জন্য। এই পুরস্কার নিয়েছিলেন কিংবদন্তি film-maker দেবকী বসুর হাত দিয়ে। ১৯৬৭ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান। সিনেমার নাম নায়ক। ওই বছর তিনি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিশেষ অতিথি হিসেবে ডাক পান। ১৯৬৮ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান গৃহদাহ সিনেমার জন্য। ১৯৭২ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান এখানে পিঞ্জর সিনেমার জন্য। ১৯৭৩ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান, সিনেমার নাম স্ত্রী। তৎকালীন সময়ে প্রসাদ পত্রিকা থেকে স্ত্রী সিনেমার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কার নিয়েছিলেন কানন দেবীর হাত থেকে। ভারত সরকারের থেকে "মহানায়ক" পুরস্কার ২৫ শে নভেম্বর ১৯৭৭ সালে। পুরষ্কারের নগদ মূল্য ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। প্রসাদ পত্রিকা ও সাংস্কৃতিক সাংবাদিক সংস্থার থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার পান অমানুষ সিনেমার জন্য। আনন্দ আশ্রম সিনেমার জন্য "ever green"পুরস্কার পান ১৯৭৭সালে।

এটি একটি সাংবাদিকের মুখে শোনা। সেই ভদ্রোলোক উত্তমকুমারের শেষকৃত্য কভার করতে শ্মশানে গিয়েছিলেন। হঠাৎ উনি দেখলেন একটু দুরে অন্ধকারের মধ্যে এক বৃদ্ধা অঝোরে কাদছেন। বৃদ্ধার চেহারা দেখে তার কিরকম সন্দেহ হোল, জীবন যুদ্ধে লড়তে লড়তে এক ক্লান্ত ছাপ রয়েছে ঐ বৃদ্ধার মধ্যে। তিনি কাছে গিয়ে ঐ বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন "কিছু মনে করবেন না। আপনি কাদছেন কেন?  তাতে সেই বৃদ্ধা বললো কেন কাদছি জানেন? বলতে পারেন আমার খুব কাছের ভাই মারা গেছেন। আপনারা যাকে উত্তমকুমার বলে জানেন। আমরা তাকে জানি নিজের ভাই বলে। আমি ঐ স্টুডিওপাড়ার কাছেই এক বস্তিতে থাকি। স্বামী মারা যাওয়ার সময় আমার ছেলের বয়স মাত্র ছয়। বহু কষ্টে সংসার চালাই। লোকের বাড়িতে কাজ করে, ঠোঙা বানিয়ে কোনমতে সংসার চালাই। এরমধ্যে একদিন ছেলে পড়লো তুমুল জ্বরে। কিছুতেই কিছু করতে পারছিনা। একজন ভালো ডাক্টার দেখাবো তার পয়সা নেই। স্টুডিওপাড়াতেই একটা দোকানে ঠোঙা দিয়েছিলাম টাকা পাবো। দোকানটা একেবারে এন টি ওয়ানের পালেই। আমাকে দোকানদার একটার সময় আসতে বলেছিলেন। গিয়ে দেখি দোকানটা বন্ধ। আমার তো মাথায় হাত। খুব আশা করেছিলাম। এখন আমি কি করি। ওদিকে ছেলের জ্বর, টাকা নেই। দোকানের সামনে চুপচাপ দাড়িয়ে কাদছিলাম। ভাবছিলাম ভগবান আর কত কষ্ট করবো। ছেলেটাকে বোধহয় বাচাতে পারবোনা। এমন সময় হঠাৎ দেখি একটা কাচতোলা সাদা গাড়ি স্টুডিওর গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েও আমার সামনে দাড়িয়ে গেল। কাচটা একটু নামলো, দেখলাম উত্তমকুমার। আমাকে বললেন কাদছো কেন বোন?  আমি সব বললাম, উনি ভেতরে কার সঙ্গে যেন কথা বললেন। কাচটা উঠে গেল। এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে আমার ঠিকানা নিলেন।তারপর গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। কি আর করবো বাড়ি ফিরে চুপচাপ ছেলে নিয়ে বসে আছি। ভাবছি বিকেলে একবার দোকানটাতে গিয়ে দেখবো টাকাটা পাই কিনা। হঠাৎ শুনি বস্তিতে বেশ শোরগোল হচ্ছে।কে যেন এসেছে। তারপর কি বলবো আপনাকে বাইরে দেখি উত্তমকুমার। সঙ্গে ওনার ব্যক্তিগত ডাক্টার। আজ আমার ছেলে ইন্জিনিয়ার। ভালো জায়গায় চাকরী করে। কোন অভাব নেই। এসব কিছুই হয়েছে ওনার জন্যই। এমন মানুষকে ভগবান ছাড়া আর কি বলবো বলুন?কে  প্রথম কাছে এসেছি?

মহানায়কের মৃত্যুর আগে বেশ কিছু ঘটনা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। গৌরীর দেবীর সঙ্গে মন কষাকষির পর এক কাপড়ে এই ময়রা স্ট্রিটের বাড়ির দরজায় যখন বিধ্বস্ত উত্তম দাঁড়ান, দ্বিধাধীন ভাবে আশ্রয় দিয়েছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। মামলা-মোকাদ্দমায় জর্জরিত।

ছবিঃ উত্তম-সুপ্রিয়া

ভাটা পড়েছে জনপ্রিয়তায়। সে সময় ‘ইন্ডাস্ট্রি উত্তম কুমারকে’ এড়িয়ে চলছেন অনেক পরিচালক। সামনে মুখ খোলার ধৃষ্টতা কারোর নেই, কিন্তু হাবভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন অনেকেই। মহানায়ক উত্তম কুমার সে আঁচ যে পাননি এমনটা নয়। অভিসন্ধি করে অনেক পরিচিত মুখ তাঁকে সাইডলাইন করার চেষ্টা করছে। এটা তিনি ভালভাবেই বুঝতেন। এ দিকে হাসপাতালে ভর্তি সুপ্রিয়া দেবী। তাতে মন আরও ভারাক্রান্ত। তবে, নিয়ম করে চালিয়ে যাচ্ছেন শুটিং। ২৩ জুলাই তেমনই একটি দিন ছিল। সকাল সকাল স্নান সেরে পূজা-অর্চনা করে বেরোচ্ছেন শুটিংয়ে। তাঁর বেরনোর সময় প্রতিদিন দরজা সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন সুপ্রিয়া দেবী। যতক্ষণ না কর্তার গাড়ির শেষ চিহ্নটুকু মিলিয়ে যাচ্ছে, দরজার সামনে থেকে নড়তেন না।  আজ সে দুয়ার শূন্য। পিছন ফিরে উত্তম তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই বেণু। এক স্মৃতিকথায়, উত্তম কুমার বলেছিলেন, ‘সেদিন বিস্ময়-মমতা দুই নিয়ে হাসি মুখে দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল বেণু।’ সেই থেকেই সতেরো বছর ধরে এই ময়রা স্ট্রিটে উত্তম রয়েছেন। আজ সেই বেণুর কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। ‘আমায় ওর অন্তরের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে, আমি জানি না, পরলোকের ডাকে সাড়া দিয়ে কে আগে যাবে’ আমি না বেণু!’ এ সব কথা ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। এমন মুহূর্তে উত্তমের জীবনে আকস্মিক একটি ঘটনা ঘটে গেল। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই ঘটনা তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছিল! গাড়িতে উঠতে গিয়ে যা দেখলেন, তাতে উত্তম স্তম্ভিত। বাকরুদ্ধ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রযোজক অসীম সরকার। তিনিও হতভম্ভ। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! শুটিংয়ে যাওয়ার সময় গাড়িতে যে জিনিসটা সতেরো বছর ধরে তাঁকে রিলিফ দিয়ে এসেছে, আজ তা উধাও! খোঁজ খোঁজ শুরু হলো। শেষে বোঝা গেল তাঁর প্রিয় টেপ রেকর্ডারটি চুরি গিয়েছে। ভেঙে পড়লেন উত্তম কুমার। এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, মনে হলো প্রিয়জন হারানোর থেকেও বেশি আঘাত পেয়েছেন এই টেপ রেকর্ডারটি চুরি যাওয়ায়।

উত্তমের জীবনের ভাঙা-গড়ার খেলায় এই টেপ রেকর্ডারটির অশেষ গুরুত্ব ছিল বলে জানা যায়। শুটিংয়ের আগে প্রতিদিন নিয়ম করে এই টেপ রেকর্ডারে কাছে নিজেকে মেলে ধরতেন। নানা স্মৃতি জড়িয়ে! উত্তম কুমারের এক সহকর্মীর কথায়, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে এভাবেই হয়তো আগেই তাঁর স্মৃতি ছেড়ে চলে যায়। সেই ইঙ্গিত ঘুণাক্ষরে বোঝা যায়নি। এত মন খারাপের মাঝেও সে দিন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির ফ্লোর সেটে হাজির হয়েছেন। টেপ রেকর্ডারের চুরি যাওয়াটা কোনওমতে মেনে নিতে পারছিলেন না উত্তম কুমার। অন্যমনস্ক ছিলেন সারাটা দিন। খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমতো করেননি। কিন্তু এ দিনই যে তাঁর জীবনের শেষ শুটিং কে বা জানতো!  তাঁর শেষ সংলাপ, “আমিও দেখে নেবো, আমার নাম গগন সেন...”। এই সংলাপ বলতে বলতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন উত্তম কুমার।অসুস্থ শরীরে বাড়ি এলেও নিজেকে বিছানায় ফেলে রাখেননি। বন্ধু দেবেশ ঘোষের কথা রাখতে সে দিন রাতে তাঁর বাড়িতে হাজির হন উত্তম কুমার। গাল জুড়ে অম্লান হাসি। যন্ত্রণার ছিটে ফোঁটাও নেই সেই মুখে। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে মাঝ রাতে যখন বাড়ি ফেরেন, ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তারপর একেবারে বিছানা শয্যায়। একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ-পাঁচটা ডাক্তারের নিরলস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরের দিন অর্থাত্ ২৪ জুলাই রাত ৮টা ৩২ মিনিটে মহানায়ক রিয়েল রঙ্গমঞ্চকে বিদায় জানালেন চিরদিনের জন্য।

উত্তমের অসুস্থতা নিয়ে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল টলিউডে। গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছিলেন সাংবাদিকরা। নার্সিং হোম থেকে সোজা গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। বেশিক্ষণ চাপা রাখা যায়নি মহানায়কের মৃত্যুর খবর। ২৫ তারিখ ভোর বেলায় সে খবর ছড়িয়ে পড়ল মহানগর ছাড়িয়ে গোটা ভূ-ভারতে। বাঙালির মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। ভক্তদের বাধ ভাঙা আবেগ ভাসিয়ে দিল গোটা মহানগরকে। গুরু গুরু বলে রব তুললেন ভক্তরা।উত্তমের এভাবে চলে যাওয়ায় পরিচালক সত্যজিত রায় সে দিন বলেছিলেন, “উত্তমের মতো কোনও নায়ক নেই। কেউ হবেও না। আশ্চর্য অভিনয়ের ক্ষমতা। ওর ক্ষমতা আছে দর্শক টেনে রাখার...”। শোকবিহ্বল সুচিত্রা সেনের কথায়, “ও গ্রেট...তবু যেন মনে হয়, ওকে ঠিক মতো আবিষ্কার করা গেল না।” আড়াইশোর বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। বহুমুখী চরিত্রে নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন। নায়ক হিসাবে যখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা চূড়ায়, তখন খলনায়ক কিংবা বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে পিছুপা হননি। তাতেও তিনি দারুণভাবে সফল। তবে, কোথাও যেন এক ধারায় বয়েছে তাঁর সেলুলয়েডের জীবন। দেশ, কালের বেড়া ছাড়িয়ে 'বিশ্বনায়ক' হয়ে ওঠার খিদেয় একটা ভাল চরিত্র খুঁজে বেরিয়েছেন বার বার। পরবর্তীকালে সুচিত্রার মতো সত্যজিতকে উত্তম প্রসঙ্গে বলতে শোনা গিয়েছে, যে দেশে সত্ অভিনেতার সদ্ব্যবহার করতে জানা লোকের এত অভাব, সেখানে এটাই স্বাভাবিক! তাই বলাই যায়, বাঙালির জীবনে ‘মহানায়ক’ হয়েও আজও অনাবিষ্কৃতই থেকে গেলেন উত্তম!

 

বাঙালি বরাবরই রোমান্টিসিজম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বাগান অথবা বিশেষ কোনো ডায়লগ কে রমণী হৃদয় ঘা মেরে আবিষ্ট করার জন্য যে বাঁকা ভ্রু, অবিন্যস্ত কেশ, পুরু ওষ্ঠের কোনায় চোরা হাসি, অথবা উদ্ধত্য কন্ঠে খান খান হাসি হাত তুলে কপালের উপরে এসে পড়া কৃষ্ণকেশ অবহেলায় উল্টে দেওয়া এসব স্টাইলের জন্য আজও উত্তম কুমারের কোন বিকল্প নেই। এ সত্য আজও কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাঙালি ললনা আজ ও তার প্রেমিকের ভেতরে উত্তমকে খোঁজেন। একটু ভারী গোছের চাওড়া মুখ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট মোটামুটি উচ্চতা সব মিলিয়ে যেন এক গড়পড়তা আম বাঙালি। চোখে চোখে নির্নিমেষ প্রেম বিনিময় অপাঙ্গে তাকিয়ে কটাক্ষ করা, ক্যামেরায় যে আগের থেকে যে ভাবমূর্তি আমরা তাকে দেখি না কেন বুকের ভিতর তোলপাড় টুকু উপেক্ষা করার সাধ্য নেই কারো। দশকের পর দশক ধরে আজও তিনি জাগিয়ে তুলেছেন প্রতিটি নারীর হৃদয় থাকা অবদমিত শ্রীরাধা কে। তিনি যেন সেলুলয়েডের প্রতিটি চরিত্রেই প্রেমিক কৃষ্ণ অবতার হাজির। সেই রসায়নে বাঙালি মজেছেন দশকের পর দশক। তাই তো মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও প্রবীণ ও নবীন উভয় ক্ষেত্রে আজও সমানভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে একমাত্র মহানায়ক উত্তম কুমার। বিনোদনের জগতে যেটুকু স্তম্ভ তিনি তৈরি করেছেন তা যুগ যুগ ধরে সমানভাবে বেঁচে থাকবে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।

 

(তথ্য সংগৃহীত)

 

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
কবরডাঙ্গা,কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top