সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


জন্মশতবর্ষে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় : শিবব্রত গুহ


প্রকাশিত:
২৭ আগস্ট ২০২০ ২১:০৭

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৫১

ছবিঃ উত্তম কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সোমিত্র চট্টোপাধ্যায়

 

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় - এই নামটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। বাংলা সিনেমার সোনালী যুগের এক অনবদ্য অভিনেতার নাম হল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ওনার অভিনয় দক্ষতা প্রশংসাতীত। উনি যে কোন চরিত্র ওনার অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আর তাই দেখে, মুগ্ধ হয়ে যায় আজো
বাংলা সিনেমার দর্শকেরা।
মানুষকে হাসানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর মুখ ও শরীরের নানা রকমের অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসতে হাসতে আজো বাংলা সিনেমার দর্শককুলের পেট ফেটে যাবার জোগাড়। তাঁর সংলাপ বলা, হাঁটাচলা - সবকিছুর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এক অভিনবত্ব। তাই, তাঁর অভিনয় দেখতে দেখতে মন কখনো
হয় না একঘেয়েমির শিকার। মন চায়, তাঁর অভিনয় বারংবার দেখতে।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল, ১৯২০ সালে, অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। তিনি ছিলেন একধারে অভিনেতা, অন্যদিকে কৌতুকাভিনেতা ও কন্ঠশিল্পী। তাঁর গুণের নেই কোন শেষ। এই চলতি বছর অর্থাৎ ২০২০ সাল হল তাঁর জন্মশতবর্ষ। দেখতে দেখতে একশোটা বছর গেল কেটে। তাঁর ভালো নাম ছিল সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাম্পত্য সাথীর নাম ছিল নীলিমা মুখোপাধ্যায়। তাঁর বাবার নাম ছিল জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মায়ের নাম ছিল সুনীতি বন্দ্যোপাধ্যায়।


ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিস হাইস্কুল ও জগন্নাথ কলেজে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ঢাকা থেকে কোলকাতায় এসেছিলেন ১৯৪১ সালে। এখানে এসে তিনি আয়রন এন্ড স্টীল কোম্পানি নামে এক সরকারী দপ্তরে চাকরী করতেন।
তাঁর অভিনয় জীবন নানা রকমের অভিজ্ঞতায় ছিল পরিপূর্ণ।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, জাগরণ ছবির মাধ্যমে। সেই বছর তাঁর আর একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। তার নাম ছিল, অভিযোগ। এরপরে, আস্তে আস্তে তাঁর অভিনীত সিনেমার সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল। তার মধ্যে মন্ত্রমুগ্ধ, বরযাত্রী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৩ সালে, মুক্তি পেয়েছিল, এক দুর্দান্ত সিনেমা, তার নাম হল, সাড়ে চুয়াত্তর। এই সিনেমাতে, ভানুর অভিনয় দর্শকদের করেছিল মুগ্ধ।



ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি বিখ্যাত ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৮ সালে। ছবি দুটির নাম হল ভানু পেল লটারি ও যমালয়ে জীবন্ত মানুষ। ১৯৫৯ সালে, তাঁর আর একটি মুক্তি পাওয়া ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহ ঠাকুরতা। তাঁর অভিনয় এতটাই সুন্দর ছিল, যে, বোঝাই যেত না, যে, তিনি অভিনয় করছেন।
১৯৬৭ সালে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সিনেমা, যার নাম ছিল, মিস প্রিয়ংবদা, সেখানে তিনি চরিত্রের প্রয়োজনে এক মহিলার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। যা দর্শকদের অবাক করেছিল। তাঁর আর একটি বিখ্যাত ছবি, ৮০তে আসিও না, দেখলে মন এক অপূর্ব হাস্যরসে মুগ্ধতা লাভ করে। যার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
তাঁর শেষ ছবির নাম কি ছিল জানেন? সেই ছবির নাম হল শোরগোল। এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে। তাঁর সাথে জুটি ছিল আরেক বিখ্যাত অভিনেতা জহর রায়ের। ভানু ও জহর জুটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা কমেডিয়ান জুটি বলেই, আমি মনে করি।

তবে, এখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের এক অজানা কথা আপনাদের সামনে আমি তুলে ধরবো। তাঁর জীবনের আদর্শ কে ছিল জানেন? তিনি হলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিনয় - বাদল - দীনেশের, শহীদ দীনেশ গুপ্ত। তাঁর সাইকেলের পিছনে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক বছর কেটেছিল একসময়।
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। পল্লীকবি জসীমউদ্দিন, মোহিতলাল মজুমদার ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি যখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
তাঁর দেশাত্মবোধক কার্যকলাপের বিবরণ আমি এখন আপনাদের দেব। তিনি গোপনে বিপ্লবী বই প্রচার করা, প্রচারপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়া, রিভলভার পাচার করা - সব ধরনের কাজ করেছিলেন তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর বিপ্লবী রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন দীনেশ গুপ্তের কাছ থেকে। ভানুকে নিজের সাইকেলের পেছনে বসিয়ে, দীনেশ গুপ্ত, নানা জায়গায় নিয়ে যেতেন। ভানু তাঁর দীনেশদার জন্য, ঢাকার টাঙাওয়ালাদের কাছ থেকে গোপনে সংগ্রহ করে আনতেন ব্রিটিশ পুলিশের খবরাখবর, ভাবা যায়!
দীনেশ গুপ্ত শহীদ হবার পরে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল ইতিহাস খ্যাত অনুশীলন সমিতির। ঢাকার অনুশীলন সমিতি ছিল খুব শক্তিশালী। ঢাকার অনুশীলন সমিতির সাথে কাজ করতে গিয়ে, ১৯৪১ সালে, ব্রিটিশ পুলিশের নজরে পড়েছিলেন তিনি। একটা রাজনৈতিক হিংসায় নাম জড়ায় তাঁর। গ্রেপ্তারি এড়াতে, তিনি ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
এহেন একজন মহান মানুষ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের, জন্মশতবর্ষে, তাঁর প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা জানিয়ে, আমি এই লেখার ইতি টানছি।


শিবব্রত গুহ
কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top