সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১


আমাদের অপু: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ২২:৪০

আপডেট:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ২৩:১৪

ছবিঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

 

তিনি থামলেন। ছিয়াশির কাছে এসে ত্যাগ করলেন নশ্বর মায়া । বহুমাত্রিক ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’ চলে গেলেন পারত্রিক পরিবেশে। বাংলার শেকড় থেকে অঙ্কুরিত হলেও এই ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র-অভিনেতা সমস্ত বাংলার বাঙালি প্রাণ। অভিনয় দিয়ে বাংলাকে জয় করলেও একই সাথে এই গুণী মানুষটি নাট্যকার, নির্মাতা, প্রথিত যশা আবৃত্তি শিল্পী, স্বনামে খ্যাত কবি। সর্বপরি ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’ শিল্পাঙ্গনে উজ্জ্বল নক্ষত্র ও সাহিত্যের কাব্যধারায় নিভৃতে বহমান এক কবিয়াল। প্রতি ও প্রান্তের সবার শ্রদ্ধাবনত মনে এই মানুষটির স্থান। তাঁর প্রয়াণে স্মৃতিকাতর সোনালী পর্দার শতো ভক্ত। সাহিত্যের মানুষও তাঁর স্মরণে সজল।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক সত্যজিত রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ‘অপু’র চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চিত্রাভিনেতার খাতায় নাম লেখান ও সুপরিচিত হয়ে উঠেন। পড়াশোনা চলাকালীন সময়েই তাঁর মাথায় প্রবেশ করে পর্দায় অভিনয়ের নেশা। বাংলা সাহিত্য, মঞ্চ নাটক, সংগঠন-চর্চা তাঁকে পাছে প্রস্তুত করে তোলে দক্ষ অভিনয় কর্মীরূপে। সত্যজিৎ রায় প্রথমে তাঁকে কাস্ট করতে না চাইলেও ‘অপুর সংসার’ এর পর নিজেই তাঁর মোট চলচ্চিত্রের চৌদ্দটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করান। আর অভিনয় পাগল সৌমিত্র চলচ্চিত্রতে আটকে থাকেননি শুধু। তিনি বহু নাটক, যাত্রা, টিভি ধারাবাহিককেও চালিয়ে গিয়েছেন দুর্দান্ত অভিনয়। গায়ের রঙ. সুন্দর মুখোমন্ডল, উচ্চতা সৌমিত্রকে তারকার খ্যাতি জড়িয়ে দেয়নি আপনা থেকে; একাগ্র পরিশ্রম, শিল্পের প্রতি তার অঙ্গিকার, প্রতিশ্রুতি, প্রতিফলন তাঁকে এনে দিয়েছে জনপ্রিয়তা। তাঁর গায়ে গেঁথে দিয়েছে প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি।
১৯৫৯ সাল। প্রথম অভিনয়। তারপর সৌমিত্রকে আর তাকাতে হয়নি পেছন ফিরে। মৃণাল সেনের সাথে ‘আকাশ কুসুম’, তপন সিংহের সাথে ‘ক্ষুধিত পাষাণ-১৯৬০, ঝিন্দের বন্দী-১৯৬১’, অসিত সেনের সাথে ‘স্বরলিপি-১৯৬১’, অজয় করের সাথে ‘সাত পাঁকে বাঁধা-১৯৬৩, পরিণীতা-১৯৬৯’, তরুণ মজুমদারের সাথে ‘সংসার সীমান্তে-১৯৭৫, গণদেবতা-১৯৭৮’ চলচ্চিত্রের কাজ করেছেন। সেই থেকে আজোব্দি। হাল কালের নির্মাদের হয়ে সর্বশেষ কাজ করেছেন সৃজিত, পরম ব্রতের সাথেও। অভিনয় তাঁর রক্তে, মঞ্চ তাঁর শিরায়, কবিতা তাঁর চর্চায়, বাচিকতা তার শখে। যৌবন পেরিয়ে বার্ধ্যক্যে এসেও পড়ে যাবার বদলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় উঠি দাঁড়িয়েছেন বলবানের মতো। উজ্জ্বল হয়েছেন আরও। চালিয়ে গিয়েছেন টেক, কাট, অ্যাকশন। জ্বলজ্বল করে উঠেছে তাঁর প্রতিটি চরিত্রের প্রস্ফুটন। এই তো, কিশোর প্রজন্মও দেখেছে তাঁর অভিনয়ের যৌবন রূপ। রথ এসে থেমে গেলো অদৃশ্য ইশারায়।
অভিনয়কে সামনে রেখে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাক্ষত্রিক শিল্প-জীবন অগ্রসর হয়েছে। এ সবার জানা। জানার অগোচরে এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কখন প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী রূপেও নিজের অবস্থান পোক্ত করেছেন তা অনেকেরই অজানা। কিন্তু এ সত্য। সৌমিত্রের উচ্চারণ মানেই ভরাট গলা, সাবলিল প্রক্ষেপণ, প্রমিত বয়ান। কোনো শব্দে, কোনো বক্যে নেই জড়তার আঁশ। ছোট ছোট বলা। সত্যের মতন অকৃত্রিম প্রকাশ। সৌমিত্রের আবৃত্তি অনেক ক্ষণ, দীর্ঘক্ষণ শুনতে থাকলেও কোথাও কোনো অন্যমনোস্কতা আসে না। এক টানা শুনে যেতে ইচ্ছে করে যতক্ষণ না শ্রবণ শক্তিতে ব্যাথা ধরে। রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ সৌমিত্রের খুব পছন্দের ছিলো। ঘুরে ফিরে এই দুই কবির কবিতায় তিনি দিয়েছেন ভিন্ন মাত্রা। অন্যদের কবিতাও পড়তে আনন্দ পেতেন। সিডি প্লেয়ার যুগে তাঁকে শোনা যেত অনেক অভিজাত বাড়ির বসার ঘরে। আবৃত্তি প্রেমিদের সংগ্রহ টেবিলে। আকাশ মিডিয়ায় রাখা আছে সে প্রমাণ। চাইলেই দেখে নেয়া যেতে পারে একটি সার্চ বাটন টিপে।
তিনি কবিতাও লিখেছেন। সামাজিত দায়বোধের চেতন নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা। খ্যাতির প্রভাবে শখের বশে এ কবিতা লেখা নয়। বাংলায় পাঠ নেয়া সৌমিত্র তারুণ্যেই কবি হয়ে উঠেছেন তাঁর মধ্যে পূর্বেই পোঁতা কাব্যবীজের যত্ন করে। ফলিয়েছেন কবিতার এক এক ফসল। তিনি কবিতায় করেছেন অমিয় পথের অনুসন্ধান। যে পথে আলোকবর্তিকার মতো জ্বলে থাকে জীবনের যাপন-সুখ, প্রকৃত বেঁচে থাকার পথ্য। নিয়মিত না হলেও প্রায় নিয়মিত তিনি চালিয়েছেন কবিতার হাত। জড়ো করেছেন কবিতা। প্রকাশও করেছেন। সুনীল আর শক্তি চট্টেপাধ্যায়ের হৃদ্যতায় এগিয়েছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যয়ের প্রথম কবিতার বই ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’। তারপর ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা, শব্দেরা আমার বাগানে, পড়ে আছে চন্দনের চিতা, হায় চিরজল, হে সায়ংকাল, পদ্মবীজের মালা, জন্ম যায় জন্ম যাবে, হলুদ বোদ্দর’ ইত্যাদি তাঁর সচেতন পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি, জীবন বোধের থেকে উৎসারিত প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ। অভিনয়ের আড়ালে কবি সত্ত্বা লুকিয়ে থাকলেও তাঁকে কবি হিসাবে অস্বীকারে পথ নেই ডানে বাঁমে। আট’শ পৃষ্ঠার কবিতা সমগ্র সৌমিত্রকে কবি স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে।
অভিনয়ে আত্মপ্রাণ এ সব্যসাচী অভিনয়কে আক্রে এক পথ দিয়ে পাড়ি দেননি জীবনকাল। সমানতালে চালিয়েছেন নাটক লেখা, নির্দেশনা, নির্মাণ। এই তো কয়েক বছর আগে তার মঞ্চ নাটকের দল দিয়ে শিল্পকলার আমন্ত্রণে গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবে ঘুরে গেলেন প্রোপিতামহের দেশ বাংলাদেশ। ‘নামজীবন, রাজকুমার, নীলকন্ঠ ইত্যাদি তাঁরই লেখা আলোচিত নাটক। নাটক সমগ্র-১ ও নাটক সমগ্র-২ নামে তাঁর দুটি নাটকের গ্রন্থ। তাঁর নির্দেশিত ও অভিনিত নাটকের মধ্যে তাপসী, ফেরা, ঘটক বিদায়, দর্পণে শরৎশশী, চন্দনপুরের চোর, টিকটিকি, প্রাণতপস্যা উল্লেখযোগ্য।
এতো কর্মের, এতো শ্রমের, সাদা এ সৌমিত্রের কাজের প্রতিদানও কম মিলেনি। প্রথম জাতীয় পুরষ্কার পান ‘অন্তর্ধান’ চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষ জুরি বিভাগে। মধ্য বিরতীর পর ‘দেখা’ চলচ্চিত্রের জন্য ফের পান এ পুরষ্কার। শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কারও পান ‘পদক্ষেপ’ চলচ্চিত্রের জন্য। আরও সম্মানিত হন ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরষ্কার লাভ করে। পদ্মভূষণ সম্মানেও ভূষিত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই কিংবদন্তির ঝুলিতে রয়েছে ফরাসি সরকারের দেয়া সম্মানও।
সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে উঠে এসে যে শিল্পের পরিবারে নিজেকে সামিল করেছেন বহু রঙে রঙিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সে পরিবার অঙ্গনকে অবহেলা করেননি এক ফোঁটা; ইচ্ছা, চেষ্টা, নিষ্ঠা, শ্রম, মেধা, মনন আর মগ্নতা দিয়ে উৎকৃষ্ট করেছেন প্রাণেপন আগ্রহে। মেধা আর মননকে দশদিকে ঘুরিয়ে শিল্প আর সাহিত্যের অঙ্গনকে সাধ্যমতো করেছেন উর্বর। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন কৃর্তী। সে কৃর্তীতেই তিনি, নিভৃতে শিল্পসাধক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকবেন অনেক অনেক দিন তাঁর পাঠক, দর্শক, শ্রোতা, মঞ্চ শিষ্যদের মনের মন্দিরে। আর আমরা স্মরণ কররো, যেমন স্মরণ করি মনুষ্য আকাশের উজ্জ্বল সব নক্ষত্রগুলোকে।

 

জোবায়দুর রহমান মোল্লা (জোবায়ের মিলন)
সহকারী বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি। বিএসইসি ভবন, ৭ম তালা, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top