সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০


ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২১ ১৮:১৩

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৪ ১৬:১৮

ছবিঃ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

 

বর্তমানে চারিদিকে কান পাতলে শোনা যায় সাজ সাজ রব। বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে মানব সভ্যতা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে উন্নত থেকে উন্নত হওয়ার লক্ষ্যে। শুধুমাত্র সময়কে কিনে নেওয়ার পালা। একে অপরের কাধে পা রেখে চাঁদকে ছুঁয়ে ফেলার  স্বপ্নে বিভোর। প্রতিযোগিতার ভারে ঝুঁকে পড়ছে বিবর্ণ মুখ। তাতে কি, আমার আমিত্ব অহমিকায় জীবনটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে। এতে যদি কারো ক্ষতি হয় হোক, সে ভাবনাটুকু ভাবার সময় বোঝার মানুষের আজ নেই। বিশ্ব আজ তালুবন্দি। তাই এ সময়ে মানব সভ্যতার কাজে অবসরের নাম হলো কুঁড়েমি। কারণ যে সময় তুমি অবসর এর মধ্যে কাটাবে, হয়তো সে সময় কেউ তোমার পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাবে প্রথম হওয়ার লক্ষ্যে। তবুও তো শরীর, তারও অবসরের দরকার হয়। বিনোদনের দরকার হয়। কারন মানুষ নিজেকে সভ্য করে তুলতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছে জীবনের অমূল্য স্মৃতি কথা। পরিবারের সাথে সময় কাটাতে ভুলে যাচ্ছে। যার ফলে দূরত্ব বাড়ছে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর। শুধু তাই নয় দূরত্ব বাড়ছে নিকট আত্মীয় সহ বন্ধু বান্ধব দের মধ্যে। এক সময় মানুষ জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে হাতিয়ার করেছিল বিনোদনকে। যে সময় মানুষ নিজেদের অবসরের সময়টুকু কফিনবন্দি করে চলেছিল, ঠিক সেই মুহুর্তে সমাজের একশ্রেণীর বিদ্বজন এরা সেই একঘেয়েমিকে আরো বেশি আনন্দময় করে তোলার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নেন। সমাজের বাস্তব চিত্র গুলো নিজেদের পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করে চলত টিভির পর্দায় কিংবা নাটকের মঞ্চে। আর মানুষ সেই গুলো দেখে আনন্দ উপভোগ করত। শুধুমাত্র মানুষজনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে শুটিং করে বেড়াতো। সমাজের বুকে তারা নিজেদের কর্মকৌশলের প্রমাণ দিয়ে পথ প্রদর্শক হয়ে ওঠেন। সেই সমস্ত কলাকুশলী জাগতিক নিয়মের কাছে ধরা দিয়ে ফিরে গেছেন আপন পথ ধরে। কিন্তু তাদের সেই শিল্পীসত্তার নিদর্শন আজও যুগ যুগ ধরে অন্ধকার সমাজব্যবস্থার আলোয় ফিরে আসার মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরা শুধু মৃত্যুবরণ করেছিল, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে চিরকাল  বিরাজমান। যতদিন মানব সভ্যতা টিকে থাকবে তারাও এই সভ্যতার কান্ডারী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবেন। এমনই বেশকিছু পরিচালক ছিলেন যারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সিনেমা বানিয়ে দর্শকদের হৃদয়কে কখনো উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত ও কখনো ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলেন। একের পর এক নতুন সৃষ্টি তুলে ধরেছিলেন জনসমক্ষে। যার ফলে সাধারণ জনগণ অবসর সময়কে শুধুমাত্র উপভোগ করে গেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তরুণ মজুমদার, অঞ্জন চৌধুরী সহ বহু প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। আবার বর্তমানে প্রবাদপ্রতিম পরিচালকদের এ দেখানো পথের দিশায় হেঁটে চলেছেন নবীন পরিচালকরা। তারাও এ সময়ে দাঁড়িয়ে বেশ সুন্দর সুন্দর বাংলা ছায়া ছবি উপহার দিয়ে চলেছেন। এক্ষেত্রে কারো সঙ্গে কারো তুলনা করা চলে না। কারণ প্রতিটি পরিচালক তাদের নিজস্ব চিন্তা ধারায় সফল। যে সমস্ত পরিচালকরা সমাজের বুকে  উর্বর ভূমি তৈরি করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ১৯৬৮ সালে ১০ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র "The contient of love" দিয়ে নিজের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। এরপর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে "দূরত্ব" দিয়েই তার চলচ্চিত্র অভিযান শুরু হয়। তবে তিনি পরিচালক হিসেবে পরিচিত হলেও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল লেখক হিসাবে। তিনি খুব ভালো কবিতা লিখতেন। কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কলমে উঠে এসেছে বহু কবিতা যা নিয়ে  আজও চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলির নাম হল "রোবটের গান", "ছাতা কাহিনী", "গভীর আড়ালে" ইত্যাদি।

দক্ষিণ পুরুলিয়ার আনাড়াতে পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের জন্ম। অর্থনীতি নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা ও সাহিত্য জগৎ থেকে পরিচালক হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি। আর সেখানেই চার্লি চ্যাপলিন,ইঙ্গমার বার্গম্যান আকিরা, কুরোসাওয়ার মত পরিচালকদের সিনেমা দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হন।তার পরিচালিত "স্বপ্নের দিন" ও "উত্তরা" ছায়াছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর আরো পাঁচটি ছায়াছবি সেরা ছবির শিরোপা পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রতিযোগিতায়। বাংলার সেরা ফিচার ফিল্ম এর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর আরও দুটি ছবি "দূরত্ব" এবং "তাহাদের কথা"। জন্মভূমির টানে ছবি বানানোর জন্য বারবার ফিরে গেছেন পুরুলিয়ার ল্যান্ডস্কেপে। আড্ডায় বারবার পুরুলিয়ার কথা টেনে আনতে। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত স্পেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, এথেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড,বারলিং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা সিনেমা ও বাংলা কবিতার দুই জগতের ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি পরিচালনা করেছিলেন "বাঘ বাহাদুর", লাল দরজা, চরাচর, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, কালপুরুষ, উত্তরা, স্বপ্নের দিন, তাহাদের কথা'র মত ছবি। তাহাদের কথায় যেমন এক অন্য মিঠুন চক্রবর্তীকে আমরা নতুন চমক হিসেবে পেয়েছিলাম। ঠিক তেমনি শেষ বয়সে ও আনোয়ার কা আজিব কিসসা ছবিতে নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীকে ব্যবহার করে চমকে দিয়েছিলেন। এবং সে দিক থেকে তিনি সফল।এমন সব ভাবনা বোধ হয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মাথা থেকে বের হয়। তাইতো তিনি নতুন ছায়াছবি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন।

২০২০ মার্চ মাস থেকে শুরু করে, ২০২১ এর এখনো পর্যন্ত পৃথিবী বিধ্বস্ত  অতি মারি করোনার  দাপটে। এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। এ সময় মানব সভ্যতার কাছে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে স্বজন হারানোর কান্না। আমরাও হারিয়েছি বহু মহীরুহকে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমস্ত জায়গায় নক্ষত্রদের ছন্দপতন ঘটেছে। এবার আমরা হারালাম আমাদের খুব কাছের মানুষ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে। সাহিত্য ও শিল্পজগতের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান হয়ে গেল। বর্তমানে এই লকডাউন এর সময় বহু মানুষ তাঁর আত্মার শান্তি কামনার জন্য সভা করে চলেছেন। তার পরিবার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কলাকুশলী শিল্পীরা বিভিন্নভাবে স্মৃতিচারণা করছেন। ঠিক তেমনি শিল্প নি পড় পত্রিকায় তাদের স্মৃতির কথা তুলে ধরলেন। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম অত্যন্ত প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে এই মুহূর্তে বড্ড অসহায় বোধ করছেন। তাদের প্রতি রইল আমাদের পত্রিকার তরফ থেকে গভীর সমবেদনা।

মমতা শংকর:_চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম প্রতিবাদ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সর্ব প্রথম ছায়াছবির নাম দূরত্ব। এই ছবি করার জন্য তিনি  মমতা শঙ্করের কাছে যান অভিনয় করার জন্য। তবে  বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একদম আনকোরা। তাঁর ডাকে কেইবা সাড়া দেবে,এমন ভাবনা ভুলে ছুটে গিয়েছিলেন অন্যতম প্রবাদপ্রতিম মৃণাল সেনের মৃগয়া ছায়া ছবির অন্যতম নায়িকা মমতা শঙ্করের কাছে। মৃণাল সেন পরিচালিত ও বাংলার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র মিঠুন চক্রবর্তী  অভিনীত প্রথম ছবি তখন সুপার ডুপার হিট। মিঠুন চক্রবর্তী ও মমতা শঙ্কর অভিনীত এই সিনেমা পশ্চিম বাংলার বুকে তখন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাঙালি দর্শকদের মুখোমুখি ঘটছে সিনেমার গল্প। ইতিমধ্যেই মমতা শংকর তার অনবদ্য অভিনয় করে বাঙালির হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত কে কেউ কেউ না চিনলেও তখন চলচ্চিত্র জগতের মধ্যমণিতে বিরাজমান মমতা শংকর। হয়তো মৃগয়া সিনেমা দেখেই তিনি মমতা শঙ্করের কাছে গিয়েছিলেন তার প্রথম সিনেমা দূরত্ব তে অভিনয় করার জন্য। জীবনের কাছে হার না মানা এক আগন্তুক যুবক নায়িকার খোঁজে মমতা শঙ্করের দরজায় কড়া নাড়েন। এর একমাত্র কারণ ছিল যদি মমতা শংকর কেনে নায়িকা হিসেবে পাওয়া যায় তাহলে হয়তো দর্শক পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে হলে সিনেমা দেখতে যাবে। নইলে কে নতুন পরিচালকের সিনেমা দেখতে যাবে হলে? যে সময় টালিগঞ্জ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তরুণ মজুমদারের মত মত তুখোড় পরিচালকরা। এমন এক প্রস্তাব পাওয়ার পর প্রথমের দিকে মমতা শংকর কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন। কারণ তিনি যে মৃণাল সেনের অত্যন্ত স্নেহ ধন্য। মমতা শঙ্কর ও মৃণাল সেনকে অভিভাবক হিসেবে ভাবতেন। আর মৃণাল সেন মানে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম অলংকার। তাঁর অভিনয় জগতে শুরুটা হয়েছিল মৃণাল সেনের হাত ধরে।নতুন কোন কিছু কাজ করতে গেলে আগে মৃণাল সেনের পরামর্শ দিতেন। এক্ষেত্রেও সেই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। মমতা শংকর সম্পূর্ণ ঘটনা মৃণাল সেনকে জানালেন। বললেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নামে একজন ভদ্রলোক এসেছেন তিনি তার প্রথম ছায়াছবি দূরত্ব তে আমাকে অভিনয় করার জন্য। জিজ্ঞেস করলেন আমি কি এই ছায়াছবিতে অভিনয় করতে পারি? পরিচালক মৃণাল সেন মমতা শংকর কে বললেন_আগে গল্পটা ভালোভাবে শুনতে হবে তারপরে এগিয়ে যেতে হবে। ব্যাস যেমন কথা তার তেমনি কাজ। চিত্রনাট্য শুনে মমতা শংকর রাজি হয়ে যান। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দূরত্ব ছায়াছবির সিমানা ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। আনকোরা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত পরিচালক হয়ে উঠলেন টালিগঞ্জের বুকে।তাঁর প্রথম ছবি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে তিনি প্রথম সারির পরিচালক হিসেবে উঠে এলেন।এরপর তাঁর দ্বিতীয় ছবি "গৃহযুদ্ধ" তে অভিনয় করার সুযোগ পান মমতা শংকর। তৎকালীন সময়ে এই দুটি ছায়াছবি সমাজের বাস্তব প্রেক্ষাপট নিয়ে তৈরি করার ফলে বাঙালি সিনেমা প্রেমীদের  হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। এই দুটি সিনেমা সেই সময়ে অত্যান্ত সাহসের পরিচয় দিয়ে গেছেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একদম নতুন পরিচালক, মমতা শংকর অভিনয় এর দিক থেকে জনপ্রিয়তা লাভ করলেও তখনো তিনি অভিনয় জগতের সব কিছুটাই শিখে উঠতে পারেন এমন টাই বিবৃতিতে জানিয়েছেন। তাই কাজের ক্ষেত্রে কখনো কখনো দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে। তবে মনোমালিন্য হলেও দুজনের উদ্দেশ্যই ছিল একটা সফল সিনেমা দর্শকদের উপহার দেওয়া। আর এই জন্যই কোথায় টানাপোড়নের মাঝেও পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও অভিনেত্রী মমতা শংকর  উভয়েই তাদের নিজস্ব কর্ম ক্ষেত্রে দুটি সফলতম চরিত্র।এক্ষেত্রে অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর অকপটে স্বীকার করেছেন যে এই দুটি সিনেমা তে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেছেন।সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তিনি পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কে দিয়েছেন।

 

সৌম্য দীপ্ত দত্ত:_সৌম্যদীপ্ত দত্ত ছিলেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রথম ছবি দূরত্বর শিশু শিল্পী। যিনি মমতা শঙ্করের ছেলের অভিনয় করেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল এক বছর তিন মাস। হাওড়ার বেতাই তলা দূর্গা পূজা প্যান্ডেল ঢাকের তালে তালে একটা ছোট্ট ছেলেকে নাচতে দেখা গেছিল। ছেলেটি সেই বয়সে ছিল খুব জলি। সেই পূজা প্যান্ডেলে প্রতিবছর উপস্থিত হতেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তখন তিনি সবেমাত্র সিনেমা করার কথা ভাবছেন।ছোট্ট ছেলেটির নানান অঙ্গভঙ্গি দেখে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চোখে লেগে যায়।দূরত্ব সিনেমাতে এমনই এক শিশু শিল্পীর দরকার।এই ছেলেকেই তার চাই। ক্লাবের কয়েকটা ছেলে বলে কি নিয়ে সোজা তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ছেলেদের বাবা মাকে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বললেন।প্রথমদিকে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো গেল তার বাবাকে।অবশেষে শুটিং শুরু হলো।পাক্কা একদিনে শুটিং ছিল।তার মা সঙ্গে গিয়েছিলেন। সেই ছোট্ট বয়সে ছেলেটা শুটিং কি জিনিস জানতোনা। যেমন ভাবে তাকে যা করতে বলা হয়েছিল তখন সেটাই করেছিল।সম্প্রতি এই দূরত্ব সিনেমা পরিচালক মারা যান। এরপর নদীয়ার শান্তিপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক শিল্পী নী পড় পত্রিকার তরফ থেকে শিশুশিল্পী সৌম্য দীপ্ত দত্ত কে ফোন করে তার অভিব্যক্তি জানার চেষ্টা করা হয়।কারণ তিনি বর্তমানে মুম্বাইয়ে থাকেন। তার স্মৃতিচারণায় উঠে গেল অকপট হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি কথাগুলো। তিনি জানান মুম্বাই থাকলেও দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক আজ ও অটুট। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বাড়ির লোকজন সৌম্যদীপ্ত দত্তকে আজও খুবই ভালোবাসেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়,যখন সে বুঝতে শিখলে সিনেমা কি জিনিস আর নিজেকে  দূরদর্শনের পর্দা য় এভাবে দেখলে কেমন অনুভূতি হয়? তিনি উত্তরে জানান, যে সময় আমি ছবিটা করেছিলাম তখন খুবই ছোট ছিলাম। ধীরে ধীরে যখন বুঝতে শিখলাম সিনেমা কি জিনিস, নিজেকে যখন স্ক্রিনের পর্দায় দেখতাম বা আজও দেখি তখন উৎফুল্ল হয়ে পড়ি। তবে সেই সময়ে র ঘটনা এটুকু উপলব্ধি করতে পারি যে যিনি আমার মায়ের রোল করেছিলেন অর্থাৎ মমতা শংকর তিনি আমাকে একজন সত্যি কারের মায়ের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন। ওই একদিনের শুটিং চলাকালীন মুহূর্ত আমার মায়ের সঙ্গে তার কোনো তফাৎ খুঁজে পাইনি। উনি একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। ওনার সঙ্গে কাজ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। তবে ওনাকে আজও আমি খুব মিস করি। বুদ্ধদেব বাবু প্রসঙ্গে আসতেই তার গলাটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বলেন উনি তার সিনেমায় আমাকে নিয়েছিলেন। আমাকে সমাজের বুকে একটা পরিচয় তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন।এটা আমার কাছে অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। সিনেমা তৈরি করার পর আমার যখন জ্ঞান হয় তখন বহু লোকের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি হয় এই ছবিটা করার পর। উনি একজন খুব বড় মাপের প্রতিভাবান পরিচালক। বহু পুরস্কার পেয়েছেন দেশে বিদেশে। এমন এক পরিচালকের ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেই মানুষটা যে বাস্তব জগতে আর নেই, এ কথা শোনার পর হৃদয় এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল। তবে শুধু আমার নয় চলচ্চিত্র জগতের বহু মানুষ তার অভাব বোধ করবেন। কারণ এই বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অবদান কম নয়। তাঁর অবদানের আমরা ও সন্মানিত।

 

সুশান্ত সমাদ্দার:_ বুদ্ধবাবুর কলাকুশলী ও কর্মজগতের বন্ধুবান্ধব যেমন স্মৃতিচারণা করে চলেছেন, ঠিক তেমনি তার পাড়ার বন্ধুরাও তেমনি ভাবে স্মৃতিচারণা করে চলেছেন। পাড়ার এই মানুষগুলো তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, চিনেছেন,জেনেছেন। যাকে প্রতিবছর পাড়া দূর্গা পূজা প্যান্ডেল দেখতেন এবং প্রচুর আড্ডা দিতেন তাদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে একজনের নাম হল সুশান্ত সমাদ্দার। বুদ্ধদা আমাদের পাড়ার কয়েক ভাইয়ের দ্বিতীয়।বাইরে চলে গেলেও প্রতিবার পূজোতে আসতেন,স‍্যূভেনীরে লেখা দিতেন।

আমরা ছিলাম প্রতিবেশী শিবপুরে, ব্যাতাইতলা। পড়তাম শিবপুর দীনবন্ধু স্কুলে। যাতায়াত ছিল এক সঙ্গেই বেশীরভাগ দিন। তখন উনি উঁচু ক্লাসে পড়তেন। ওনার পরের ভাই জয়দেব দাশগুপ্ত আমার ক্লাসমেট ছিল।ওদের বাড়িতে ছিল আমাদের আড্ডা। তখন থেকেই বুদ্ধদা কবিতা লিখতেন। ওনার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হল, "গভীর এরিয়েল" । তখনও ছবির জগতে আসেন নি। প্রথম দিকে তিনি ডকুমেন্টারী ছবি করতেন।এর পর বুদ্ধদা পূর্ন দীর্ঘের ছবিতে এলেন। ছবির নাম দূরত্ব। শিশু শিল্পী হয়েছিল আমার বাড়ির সামনে আমার আর এক বন্ধুর ছেলে বুবুল। করতেন। ওনার প্রয়ানে আমরা  খুবই বিষন্ন ও মর্মাহত। একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান এবং নির্ভীক চিত্রপরিচালক ও কবি হারালাম আমরা। বাঙলা সংস্কৃতি জগতে ঈন্দ্রপতন। অপূরনীয় ক্ষতি। প্রিয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম ব্যক্তিত্বকে হারালাম।ওনার সদ্য পিতৃহারা কন্যা মুম্বাই আছে এই মুহূর্তে।

 

বিজেন সেন শর্মা:_প্রবাদপ্রতিম চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ক্যারিয়ার জীবনের প্রায় ৪০ বছরের বন্ধু বিজেন সেন শর্মা মহাশয় তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন। তিনি অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে ভীষণরকম মর্মাহত ও শোকে বিহ্বল।শুধু তাই নয় তিনি এমন অযাচিত দুঃসংবাদ শোনার পর থেকেই ঘুমোতে পারছেন না। তিনি স্বীকার করলেন এক নিঃসঙ্গতা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে এই মুহূর্তে। বিজন সেন শর্মা মহাশয় তিনি অল ইন্ডিয়া ফিল্ম ফেডারেশন সভাপতি ও দীর্ঘদিন তিনি ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটু ভেঙে পড়লেন। তাঁর কথায় বুদ্ধদেব বাবু কলেজে পড়াতেন। শনি-রবিবার হলেই তিনি কলকাতায় ফিরে আসছেন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য। কলেজটিতে বসে কফি হাউসের চা খেতে খেতে প্রচুর আড্ডা দিতেন। তার সঙ্গে চলত কবিতার চর্চা। ইতিমধ্যে তার বহু কবিতা আলোচনার শীর্ষে।বলতে গেলে কবিতা তাঁর প্রাণ ছিল।এর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে আপন করে নিলেন। প্রথম ছবি দূরত্ব জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। বন্ধু বিজেন সেন শর্মা র কথায় তিনি একটু জেদি ছিলেন। কখনো অন্যের সঙ্গে আপস করতেন না। সব সময় বুদ্ধদেব বাবু তার কবিতা ও সিনেমা জগৎ নিয়ে থাকতেন। সর্বদা সেসব বিষয়ে আলোচনা করতেন। তার সিনেমাতে তিনি কোন কিছু নকল করার চেষ্টা করতেন না। নিজস্ব চিন্তা ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কিভাবে একটা ছবি তৈরি করা যায় তার প্রচেষ্টা তিনি সর্বদা করতেন। তবে তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল যে ছায়াছবির মধ্যে তিনি কবিতার শৈলিক ছোঁয়া কে মিশ্রণ ঘটাতেন। তবে শেষের দিকে বন্ধুর কাছে আক্ষেপ করে বলে গেছেন ছোটদের জন্য সিনেমা না তৈরি করতে পারার জন্য। তিনি সত্যজিৎ  রায়ের ভূয়শী প্রশংসা করে বললেন, যেভাবে সত্যজিৎ বাবু ছোটদের জন্য সিনেমা তৈরি করে আমাদের উপহার দিলেন তা এককথায় অনবদ্য। এজন্যই উনি এতটাই মহৎ ও মহান। উনি ছোটদের জন্য যেভাবে সিনেমা তৈরি করে গেছে আমি তা কখনোই সেভাবে চিন্তা ভাবনা করি নি। এটা আমার দুর্বলতা।

 

পরিচালক কে জি দাস:_বহু রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক ও ভারত সরকারের চলচিত্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা  কেজি দাস মহাশয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বাবুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। যখনই যেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হতো সব সময় খোঁজখবর করতেন।ভালো-মন্দ খবরা খবর নিতেন। শুধু তাই নয় তিনি সমস্ত পরিচালকদের খোঁজখবর রাখতেন।তাঁরা দুইজনে দেশে ও বিদেশে বহু ফিল্ম ফেস্টিভাল অনুষ্ঠানে একসঙ্গে আসন গ্রহণ করেছেন। পরিচালক কে সি দাস মহাশয় এর কথায় তিনি ছিলেন এক অন্য ঘরানার পরিচালক। তার ছবিতে বরাবরই নতুনভাবে সমাজ দর্শনের কোন না কোন বার্তা দেওয়া থাকতো।ওনার প্রায় প্রতিটা সিনেমায় কে জি দাস মহাশয় দেখেছেন এবং দারুণ ভাবে উপলব্ধি করেছেন।তাঁর শেষ ছবি উড়োজাহাজ এককথায় অনবদ্য। এই ছবি সবাইয়ের দেখা উচিত তিনি মনে করেন। কারণ এই চলচ্চিত্রটি অসহায় ও স্বপ্ন ভাঙ্গা মানুষগুলোর নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করবে। সত্যজিৎ রায় মৃণাল সেন ঋত্বিক ঘটক পরবর্তী যে সমস্ত পরিচালক ছিলেন এবং বর্তমানের আরো নবীন পরিচালকরা আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তিনি আরো বলেছন  বুদ্ধদেব বাবু খুব ভালো কবিতা লিখতেন। এ জন্য তিনি ভালোভাবে পড়াশুনা করতেন। এই মুহূর্তে তিনি অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে মর্মাহত ও শোকে আচ্ছন্ন।

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
কবরডাঙ্গা,কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top