সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১


নাট্য ব্যক্তিত্ব চন্দন সেনের জীবন যুদ্ধের লড়াই যুবসমাজের কাছে অনুপ্রেরণা : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
১৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৩৯

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৬:০৯

  ছবিঃ চন্দন সেন

 

বাঙালি মানে ভোজন রসিক, আড্ডা প্রিয়, বইপড়া, তার সঙ্গে যাত্রা সিনেমা, হৈ হুল্লোড় এবং অবশ্যই নাটক। ইতিমধ্যেই বাঙালির ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় জগতের কলাকুশলীরা বিদেশে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক সময় বিশ্বের দরবারে বাঙালিয়ানার জাত চিনিয়েছেন, স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন রায়, বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস। বিশ্বে বাঙালি জাতির হাত ধরেই এসেছে নোবেল, অস্কারের মতো পুরস্কার, যে ইতিহাস বিশ্বে বিরল।এবার সেই পথেই হাঁটলেন বাংলার অসামান্য প্রতিভাবান নাট্য ব্যক্তিত্ব অভিনেতা চন্দন সেন। চন্দন সেন অভিনীত সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম "শর্টকাট"। সমান দক্ষতার সঙ্গে সিরিয়াল, সিনেমা, এবং অবশ্যই নাটকের জগতে তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই মুহূর্তে জনপ্রিয় সিরিয়াল "এক্কা দোক্কাতে" অভিনয় করছেন। কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে অন্যতম জনপ্রিয় ধারাবাহিক "খড়কুটো"।তার ক্ষুরধার, বৈচিত্র্য পূর্ন অভিনয়ের সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত।এবার বিদেশের মাটিতেও নিজের অভিনয় দক্ষতার মাপকাঠি ছাড়িয়ে পুরস্কার লাভ করলেন। ২০২১ সালে মুক্তি পাওয়া অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত 'দ্য ক্লাউড অ্যান্ড দ্য ম্যান' (মানিকবাবুর মেঘ) ছবিতে অভিনয়ের জন্য রাশিয়ায় প্যাসিফিক মেরিডিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পুরুষ অভিনেতার পুরস্কার পেলেন।
প্রসঙ্গত, রুপোলি পর্দা হোক কিংবা মঞ্চ অথবা টেলিভিশনের পর্দা সবেতেই সমান বচন ভঙ্গিমায় সাবলীল ৫৯ বছরের অভিনেতা চন্দন সেন। ১৯৭৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে থিয়েটারে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে তার শিল্পীজীবনের সূচনা। ১৯৯৭ সালে ‘নাট্য আনন’ থিয়েটার গ্রুপে অভিনয় শুরু করেন। এরপর পা রাখেন চলচ্চিত্রের আঙিনায়। তাঁর অভিনীত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বো ব্যারাকস ফরএভার’ (২০০৪), ‘ম্যাডলি বাঙালি’ (২০০৯), ‘টান’ (২০১৪) ইত্যাদি।
ঋতুপর্ণ ঘোষের 'বাড়িওয়ালি' তে ছোট্ট একটি চরিত্রে চমকে দেওয়ার মত অভিনয়।ব্যোমকেশের একাধিক ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে বাঙালি দর্শকের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন।
২০১০ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন অভিনেতা।কিন্তু মারণ রোগও থামাতে পারেনি তাঁকে। অদম্য জেদ ও মনোবলে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।ফলিকিউলার লিম্ফোমা রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে দীর্ঘদিন কেমোথেরাপি চলেছে। সেই সময়ও কেমো দিয়ে এসে অভিনয় করতে হাজির থেকেছেন মঞ্চে। অবশেষে রাশিয়ার মাটি থেকেও নিজের কাজের জন্য পেলেন এমন অসামান্য স্বীকৃতি।বাঙালির সব থেকে প্রাণের উৎসব আসন্ন, চারিদিকে সাজ সাজ রব, এমন সময়ে চন্দন সেনের পুরস্কারের খবর নতুন ভাবে প্রাণের সঞ্চার করবে এমনটা আশা করা যায়।
তিনি বুঝিয়ে দিলেন এভাবেও ফিরে আসা যায়।তবে বাঙালি বলেই সম্ভবপর হয়েছে। বরাবর বাঙালিরা বুক চিতিয়ে চোখে চোখ রেখে সামনাসামনি লড়াই করে এসেছে। জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, এমন নজির ভুরি ভুরি আছে ইতিহাস কিন্তু তাই বলে।দুরারোগ্য ক্যানসার জয় করে মঞ্চের ময়দানে ফিরে আসা এবং শুধুমাত্র ফেরাই নয় একেবারে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছিনিয়ে আনা এ কৃতিত্ব হাজারে নয়,বলব লাখে একটা সম্ভব। তবে সৌরভ গাঙ্গুলি এক সময় দল থেকে বাদ পড়েন, পরে কঠিন পরিশ্রমের ফল আর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের কারণে পুনরায় নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তা নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস কম ছিল না,তবে আর এক বাঙালির অন্যতম মুখ উজ্জ্বলকারী সন্তান চন্দন সেনের এ হেন কৃতিত্ব প্রচারের আলো তেমন ভাবে পেলো না কেন এ প্রশ্ন কি আমরা সমাজের কাছে রাখতে পারি না?
তবে কি এর পিছনে রাজনৈতিক পরিচয়ের কাজ করছে,এমনটা যদি হয় সেটা খুবই দুঃখজনক। স্বাধীন ভারতের কে কোন রাজনৈতিক দলকে সাপোর্ট করবে সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত। ঠিক বিপরীত দিকে একটা রাজনৈতিক দলকে ভারতবর্ষের মানুষ সবাই পছন্দ করবে এমনটাও কিন্তু নয়। তবে বলতে কুন্ঠা নেই, নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেন অনমনীয় বাম মানসিকতার মানুষ। কিন্তু তিনি স্বভাবত ব্যক্তি নিজের স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কখনোই ব্যবহার করেননি, এমনকি পুরস্কারের জন্যও নয়। বর্তমান সময়ে যেখানে পুরস্কারের লোভে নিজের ব্যক্তিসত্তা বিকিয়ে দিচ্ছেন, সেদিক থেকে চন্দন সেন সম্পূর্ণ স্বার্থহীন চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ ব্যাক্তিত্ব। এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে অবগত হওয়া দরকার, তিনি বিদেশের মাটিতে পুরস্কৃত হয়েছেন শিল্পী হিসেবে, সেখানে তার রাজনৈতিক পরিচয় একেবারেই অজানা বিষয়।
শিশু শিল্পী হিসেবে গ্রুপ থিয়েটারে পথ চলা শুরু চন্দন সেনের। উৎপল দত্ত, রমাপ্রসাদ বণিকের মত ব্যক্তিত্বদের গুরু হিসেবে পেয়েছেন। খেলেছেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও। ইচ্ছে ছিল খেলোয়াড় হবেন কিন্তু ভালোবেসে আপন করে নিলেন বাঙালি জাতের অন্যতম সংস্কৃতি থিয়েটারকেই। নান্দীকার-এর মত বিখ্যাত গ্রুপ থিয়েটার দল থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন বলে ওনার একটি সাক্ষাৎকারে শোনা গিয়েছিল।
তবে চন্দন সেনের পুরস্কারের খবরে অবশ্যই বাঙালি হিসেবে নিজেদের গর্ববোধ হওয়া উচিত বলে মনে করি। এক সময় বাঙালি ও বাংলা সিনেমা কে নকল করতো বলিউড আর দক্ষিণ ভারতের সিনেমা গুলো। এ তথ্য কারো অজানা নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমার এখন নকল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।তবে বস্তা পচা এই ধারণা এবার নিশ্চয়ই পরিবর্তন হবে। চন্দন সেন পুনরায় প্রমাণ করলেন বাঙালি ঝরা পাতা নয়,অবশ্যই বসন্তের আহ্বান।যারা বলে দক্ষিণের ছবি এখন বলিউডকে ছাপিয়ে গেছে, বাংলার কোন ভবিষ্যতই নেই তাদের সেই ধারণায় ইতিমধ্যে ছেদ পড়ে গেছে। তাইতো উচ্চস্বরে আবার আমরা বলতে পারি বাংলা ভাষার মতো, বাংলার অভিনয় জগত বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ আসন জয় করবে আগামী ভবিষ্যতে। এজন্য সমস্ত বাঙালিকে এক সুরে প্রাণের কথা বলতে হবে,একই সুরে গান গাইতে হবে।
পুরস্কার লাভের পর চন্দন সেনের নিজস্ব অনুভূতি: একজন অভিনেতার কাছে অভিনয় করে পুরস্কার পাওয়ার মধ্যে আলাদা অনুভূতি কাজ করে।সেই পুরস্কার যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয় তার আলাদা মানে, মর্যাদা থাকে। এর থেকে বড় পাওনা আর কি বা হতে পারে? নিজের খুব ভালো লাগে। তবে তার সঙ্গে অবশ্যই দায় ভার অনেক বেড়ে যায়। স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে মানে দর্শক দের আরো বেশি চাহিদা পূরণের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। এই গুরু দায়িত্বের কথা কখনোই ভুলে গেলে চলবে না।তবে আমি যখন কোন কাজ করি, পুরস্কারের জন্য নয়, শুধু অন্তর থেকে নিজের কাজ টুকু করার চেষ্টা করি। ব্যাস এই টুকু। মনে রাখতে হবে দর্শক খুশি হলেই তবে আমার পরিশ্রম স্বার্থক লাভ করবে বলে আমি মনে করি। এটাই আমার এই মুহুর্তের অনুভূতি।

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top