সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো (পর্ব- ৩) : কাজী জাকির হাসান


প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০২০ ২১:১৮

আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ০২:০৪

কাজী জাকির হাসান

 

রণাঙ্গনে

গীতালদহের প্রকৃতি তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে অন্ধকারে। এরই মধ্যে হুস হুস শব্দকরে সামরিক ট্রাকগুলো ঢুকে পড়লো গীতালদহ পুরনো রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের কাছে। ত্রিপলের আবরণ মুক্ত হয়ে নেমে এলাম একে একে। অনেকের চোখে ঘুমের আবেশ লেপ্টে আছে তখনও। ঝাড়া দিয়ে হাত পা পায়চারি করতে লাগলাম প্লাটফর্মের এদিক ওদিক। মনে হলো অনেকদিন পর এলাম বাড়ির কাছাকাছি। ধরলার রেলওয়ে ব্রীজ পার হলেই ওপারে মোগলহাট, ফুলবাড়ি। আর একটু এগিয়ে গেলে পাটেশ্বরী। আমার বাড়ি। এত কাছে তুবুও-সিক্ত হয়ে উঠলো দু'চোখের পাতা। অদৃশ্য দেয়াল চোখের সামনে। সাধ্য নেই টপকানোর। তাকাতে গিয়ে হা হা করে উঠলো বুকের ভেতর। আসাম বাংলার সংযোগস্থল এই গুরুত্বপূর্ণ ষ্টেশনটি পয়ষট্টির পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের পর পরিত্যক্ত হলেও এর বর্তমান অবস্থা মোটেই অনুপযুক্ত হয়নি ট্রেন চলাচলের জন্য। দেখলে মনে হয় এখনো এই বুঝি ট্রেন আসছে। ষ্টেশন ঘর, পাতানো বেঞ্চ, টিকেট ঘর, সিগন্যাল রুম, যাত্রি বিশ্রামাগার ঠিকঠাক আছে সব আগের মতই। ঝাড়-জঙ্গলে নির্বিঘ্নে হয়েছে সাপ-খোপের আস্তানা স্টেশন ঘরের বাইরের দিকটায়। ঝুলে আছে গাছ-গাছালির শাখা-প্রশাখায় তিতপলা আর ধুন্দুলের লতাগুল্ম।

সূর্য উঠছে। ষ্টেশন থেকে দূরে মানুষ-জনের হাঁটা চলায় সরব হয়ে উঠলো এলাকা। কাস্তে, কোদাল, বেয়নেট দিয়ে পরিষ্কার করা হলো গাছ-গাছালি, ঝোপ-ঝাড়। উঠে গেল তাঁবু ফটাফট। বিশ্রামাগার হলো স্টোর রুম ট্রাকে নিয়ে আসা আটা, চালের বস্তা আর আনাজ দিয়ে। সিগনাল ঘরের পাশে তৈরি করা হলো রান্না ঘর।

দুপুরের আহার সেরে যার যার তাঁবুতে গিয়ে বিশ্রাম নিতে আদেশ দিলেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম। উইলিয়াম কমান্ডিং অফিসার আমাদের। ক্যাপ্টেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর। লম্বায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। মাঝারি স্বাস্থ্য। গোড়া গায়ের রং। মেহেদী রাঙ্গা চুল মাথার। ব্যবহার অমায়িক। তবে কৃত্তিম গাম্ভির্য্যরে আস্তরণে মুখটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন সব সময়।

বিশ্রামের আদেশ দিয়ে সকলকে ক্যাপ্টেন নিজে বায়নেকুলার হাতে টু আই সি সিরাজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভারত-বাংলাদেশ সংযোগ রেল সেতুর দিকে। দু'জন গাছ-গাছালির আড়াল হতেই বেরিয়ে পড়লাম আমিও তাঁবু থেকে।

আমাদের ক্যাম্প থেকে হাজার বার'শ গজ পশ্চিমে বিএসএফ ক্যাম্প। পূর্ব দিকে কাঁচা টিনের ঘর কয়েকটি মাটির উঁচু ঢিবিতে। তার তিনদিক ঘিরে ছড়ার পানি বয়ে চলেছে উত্তর মুখে। কলাগাছের ঝোপ রেখেছে আড়াল করে সম্পূর্ণ বাড়িটাকে। করছে চলাফেরা কর্মব্যস্ত মানুষ। ভ্রুক্ষেপ নেই কোনদিকে। ব্যস্ত সবাই যার যার কাজে। হাল বইছে জমিতে কৃষকের দল। ঘর এবং উঠোনে ভেতর-বাইর করছে মহিলারা গৃহস্থালির কাছে। ডাংগুলি খেলছে বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা পাটক্ষেত ঘেঁষে সরু একটি রাস্তার ওপরে। জীবন এখানে স্বাভাবিক। দেখছি সবই নিরাপদ দূরত্বে বসে।

এমনি অলস ব্যস্ততায় কেটে গেল প্রথম দিনটি।

রাত্রি বাড়ছে যত-তত সুনসান হচ্ছে পরিবেশও। আছি সবাই-মনে হচ্ছে তবুও কেউ নেই তারপরও। সূর্য ঢোবার সাথে সাথে পাল্টে গেল সবকিছু। কোলাহল মুখর পৃথিবী থেকে যেন ভিন্ন হয়ে গেল আমাদের পৃথিবী। ভীতিকর একটি পরিবেশ মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি করলো ভেতরে। এসেছে যারা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখলাম সেই সহযোদ্ধাদের কারো কারো মুখে চোখে মৃত্যুভীতি জাগছে স্পষ্ট হয়ে। মানিয়ে যাবে সব কিছু সময়ের সাথে সাথে ভাবতে ভাবতে ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো কেবল দু'চোখের পাতা। হঠাৎ দূরে কোথাও প্রচণ্ড শব্দ হলো বোমা ফাটার। আতংকে দ্রুত বেরিয়ে এলাম তাঁবু থেকে। অন্যরাও বেরিয়ে এসে জড়ো হয়েছে প্লাটফর্মে। নাইট ড্রেসেই ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর তাঁবুর সামনে। বোম্বিং-এর শব্দটা আসছে ভুরুঙ্গামারীর দিক থেকে। একটার পর একটা বোমবিংয়ের শব্দটা হিসেব করছেন তিনি বিড় বিড় করে। বললেন ক্ষোভের সঙ্গে, ‘গুণে রাখো, এর জবাব দিতে হবে একটা একটা করে'। কথা শেষ হয়নি ক্যাপ্টেনের এর মধ্যেই হইচই শোনা গেল ছড়ার দিক থেকে। পুরুষ মহিলার সম্মিলিত চিৎকার, ‘আদমী ভাগ গিয়্যা'।

: ফলিন করো।

হুংকার ছাড়লেন ক্যাপ্টেন। ভরকে গেলাম আমরা। ছুটলাম তাঁবুর দিকে। ফলিন করে দ্রুত রোলকল করতে লাগলাম মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রথম রাত্রেই পড়ে গেলাম ভয়ংকর এক বিপর্যয়ের মুখে। রাজু, সাজাহান, আব্দুল জলিল এবং নায়েব আলী মাস্টার পালিয়ে গেছেন ক্যাম্প থেকে। ছুটে এলেন বি এসএফ মেজর ও কিছু জোয়ান। তাদের সহায়তায় ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিলেন ইপি আর জোয়ান ঈমান আলী, আকবর আলী ও আমাকে খুঁজে বের করে আনতে পলাতকদের। যারা রইল নির্দেশ দিলেন তাদের নিরাপত্তার কারণে রাতের মধ্যেই তাঁবু সরিয়ে নিতে অন্যত্র।

ঢুকে পড়লাম লোকালয়ে। ঘর-বাড়ি তছনছ করে ফেললাম আশ-পাশের। চিরুনী তল­াসীতে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্ক ঘরে ঘরে। পাওয়া গেল না কাউকে। ছুটলাম রেল স্টেশনের দিকে। দৌড়াতে গিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল উল্টে গেল রেল লাইনের স্লিপারে উস্টা খেয়ে পরে। রক্ত ঝরছে-দাঁড়াবার উপায় নেই তবুও।

নিউ গীতালদহ স্টেশন। প্লাটফর্ম গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়ে। ওরই মধ্যে ট্রেনিং সেন্টারে দেয়া সতরঞ্জিতে পুরো মাথা ঢাকা দুটো পরিচিত চোখ ভীত সন্ত্রস্ত তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। মায়া হলো খুব। সৈনিকের কর্তব্য ভুলে চলে গেলাম পাশ কাটিয়ে। কিন্তু ধরে ফেললো ঈমান আলী। গ্রেফতার করা হলো নায়েব আলী মাস্টারকে। আশ-পাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া গেলনা অন্যদের। স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনের ইঞ্জিন খুলে রওয়ানা হলাম গীতালদহ পুরনো রেল স্টেশনের দিকে।

ইঞ্জিন তুলে বিএসএফ জোয়ানরা পৈচাশিক নির্যাতন শুরু করলো নায়েব আলী মাস্টারের ওপর। মরণ যন্ত্রণায় কাতর নায়েব আলী দু'হাতে জড়িয়ে ধরলেন আমার পা। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আমি পালাতে চাইনি। বাঁচাও আমাকে। কথা শোন আমার।'

নিরূপায়। বাকরুদ্ধ আমি। সেই মুহ‚র্তে শক্তি নেই আমার কোন কথা বলার। রক্তাক্ত অবস্থায় নামিয়ে আনা হলো নায়েব আলীকে স্টেশন প্লাটফর্মে। চললো আবারও আমানুষিক অত্যাচার। মুখ দিলে গল গল করে রক্ত পড়তে লাগলো সুবেদার হনুমান সিংয়ের লাথির আঘাতে। মৃত প্রায় নায়েব আলীকে সরিয়ে নেয়া হলো ভিন্ন একটি তাঁবুতে। রাখা হলো পাহারায় ঈমান আলীকে।

পরদিন সকালে কেউ চিন্তে পারলাম না নায়েব আলী মাষ্টারকে। বিভৎস চেহারার মাঝে ধুক ধুক করছে জীবনের স্পন্দনটুকু।

বসলো কোট মার্শাল। বিচারকের আসনে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম। নিয়ম রক্ষার এই আদালতে উকিল আমি আসামী পক্ষের। অকাট্য যুক্তিও অগ্রাহ্য হলো। রায় হলো মৃত্যুদণ্ডের। সন্ধ্যার কিছু পরে পাকিস্তানী পতাকা বুকে জড়িয়ে নির্জন পাথারে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলো ঈমান আলী। মৃতদেহটা পরে নৌকায় তুলে নিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হলো ধরলার স্রোতে।

আমি কাঁদিনি। কাঁদতে পারিনি চিৎকার করে। চোখের পানি শুধু গড়িয়ে পড়েছে বুক ফেটে।

স্বল্পভাষী, অসম্ভব শান্ত প্রকৃতির এই স্কুল মাষ্টার নায়েব আলী বড় ­েহ করতেন আমাকে। সব কিছু থেকে এতদিন আগলে রেখেছেন সযত্নে। বলতেন দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, ‘এদেশ স্বাধীন হবেই'। মনোবল অটুট রাখতে শোনাতেন স্বদেশী বিপ্লবীদের কথা। হরিদাস, প্রফুল­ চাকী, ফজলুর রহমান, সূর্যসেন থেকে শোনাতেন মাও সেতুং, চে গুয়েভারার, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দুঃসাহসিক সব অভিযানের কথা। কথা যখন বলতেন মনে হতো আগুন ঝরছে যেন দু'চোখ দিয়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আমরা সেই চোখের দিকে।

৩১ মে লালমনিরহাট সাব-সেক্টরের প্রধান ঘাঁটি গীতালদহের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্মরণীয় একটি দিন। এই দিনে কাঁকিনাকে বেছে নেয়া হলো প্রথম অপারেশনের স্পট হিসেবে। বাদ পড়ে গেলাম আমি পায়ে আঘাতজনিত কারণে। আঠারো জনের দল। নেতৃত্বে আকরাম। শামসুল কিবরিয়া তার টু আই সি। কাঁকিনা কিবরিয়ার বিশেষ পরিচিত জায়গা। সোর্সও পাওয়া যাবে স্থানীয়ভাবে। এমন বিশ্বস্ত লোকদের সঙ্গে পরিচয় আছে ওর।

ক্যাপ্টেনের সর্বশেষ ব্রিফিং নিয়ে রওয়ানা হলো আকরামের দল রাতের প্রথম প্রহরে। শিহরণের মধ্যেও খারাপ হয়ে গেল মনটা বিচ্ছিন্ন হওয়ার দুঃখে। কারণÑ প্রতিজ্ঞা ছিলো মোজাম্মেল, আকরাম, কিবরিয়া ও আমার মধ্যে যা কিছু করার চারজন মিলেই করবো।

২ জুন দুপুর গড়িয়ে গেল। কোন সংবাদ নেই দলের। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম সবাই। চিন্তিত হয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন উইলিয়ামও। খারাপ কিছু ঘটলো না তো।

বিকেল চারটা প্রায়, ফিরে এলো আকরামের দল বিজয় গৌরব নিয়ে।

১ জুন কাঁকিনা শত্র“ মুক্ত হয়েছে। স্বস্তি পেলাম। কিছুটা হলেও কলংক মুছে গেল প্রথম রাত্রের।

২ জুন রইসাগ অপারেশনের দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। সম্পূর্ণ অপিরিচিত জায়গা। পূর্ব পরিকল্পনাও নেই কোন। গন্তব্যে পৌঁছে বাস্তব পরিস্থিতি দেখে আক্রমণ পরিকল্পনা সাজাতে হবে এই নির্দেশ আমার ওপর ক্যাপ্টেনের। ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। এমন সময় বিএসএফ এর দুই জোয়ান দু'চোখ বাঁধা অবস্থায় ধরে নিয়ে এলো এক যুবককে আমাদের ক্যাম্পে। ধরা পড়েছে সীমান্তে সন্দেহজনক ঘোরাফেরা করার জন্য। স্পাই হতে পারে পাকিস্তানের এমনই সন্দেহ বিএসএফ জোয়ানদের। ক্যাম্পের স্পাই একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখা হলো তাকে মেঝেতে ঘণ্টা খানেক। পরে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম স্বয়ং জেরবার শুরু করলেন তাকে। জিজ্ঞাসাবাদের পর বুঝা গেল আসলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য নিয়ে গীতালদহে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আসার জন্যই যুবক ঘোরাফেরা করছিলো সীমান্তে।

যুবকের নাম, মোজাহার আলী মেকু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সাদাসিদা স্বভাবের মেকুকে প্রথম দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে সে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি মোগলহাট। স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতই পুলকিত হয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন। প্রস্তাব দিলেন মেকুকে মুক্তিযোদ্ধার গাইড হিসেবে কাজ করার জন্য। প্রস্তাব গ্রহণ করলেন মেকু সানন্দে। এমন একটি কাজই বোধকরি খুঁজছিলেন তিনি। (এই মেকু ভাইকেই পরে টু আই সি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম এবং উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন মুরতী ক্যাম্পে)।

মেকু ভাইয়ের গাইডেই রইসবাগ, দূরাকুটির হাট, স্বর্ণমতি ব্রীজ, রতœাই রেলওয়ে রোড ব্রীজ, কালিগঞ্জ, দরিয়ার হাট, গোরপমন্ডলসহ আশে-পাশের অনেক এলাকায় সাফল্যের সঙ্গে অপারেশন করি।

৬ নম্বর সেক্টরের সামরিক বিজয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো গীতালদহের নাম। জনপ্রিয় হতে লাগলাম আমরা সীমান্তের ওপারে আশ্রিত শরণার্থীদের কাছে। আমাদের অভ‚তপূর্ব এই সাফল্যে ঈর্ষানি¦ত হয়ে উঠলেন নেতৃস্থানীয় কিছু সামরিক কর্মকর্তা। বিশেষ করে সাহেবগঞ্জে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন নওয়াজেস উঠে পড়ে লাগলেন গীতালদহের মুক্তিবাহিনীর কমান্ড কি ভাবে একিভ‚ত করা যায় তাঁর নিজের কমান্ডে। কিন্তু কৌশলগত কারণে আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করতে লাগলাম। শংকিত হয়ে পড়লাম এই ভেবে যে, সময়ের পরীক্ষায় গড়ে ওঠা সুদৃঢ় অবস্থান ও পরিকল্পনা আমাদের ভেস্তে না যায় শেষ পর্যন্ত। দিনে দিনে অবস্থাটা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাল যে, সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম,কে বাশার (পরবর্তীতে বিমান বাহিনী প্রধান) সঙ্গে নিয়ে গীতালদহে আসেন। তাঁরা দু' জনই বাস্তব অবস্থা, আমাদের যুক্তি ও ধারাবাহিক সাফল্যে খুশী হয়ে একত্রিকরণের প্রস্তাব বাতিল করে ক্যাপ্টেন উইলিয়ামের নেতৃত্বেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গেলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন নওয়াজেস ছিলেন অত্যন্ত চতুর ও উচ্চাভিলাসী। এই অপমানের কথা তিনি মনে রেখেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে আহত হয়ে আমি হাসপাতালে চলে যাওয়ার পর সুযোগটা তিনি গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম সরিয়ে গীতালদহের মুক্তিবাহিনীর কমান্ড তুলে দেয়া হয় ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর দ্বন্দ¡ চরমে পৌঁছে। তিনি গেরিলা পদ্ধতির পরিবর্তে দিন দুপুরে সম্মুখ যুদ্ধে একের পর এক ছেড়ে দিতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এতে আহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গীতালদহের সকল কোম্পানি কমান্ডারদের সরিয়ে দেয়া হয় ফুলবাড়ি, বুড়িমারী ও হিমকুমারীতে। এইভাবে ক্যাপ্টেন নওয়াজেস ও ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের প্রতিহিংসার শিকার হয় বেছে বেছে শুধু ছাত্র মুক্তিযোদ্ধারাই।

মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ কারণে দূরাকুটিরহাট, রত্নাই রেল ও রোড ব্রীজ এবং গোরপমন্ডল অপারেশন উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে আমার জীবনে। রইসবাগের অপারেশন থেকে মেকু ভাইকে গাইড হিসেবে পেয়ে মনোবল এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে, যেকোন অপারেশন রওয়ানা দেবার পূর্বেই বুঝতাম জয়ি আমরা হবোই। তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন ও পরিশ্রমী মেকু ভাইয়ের সতর্ক পদক্ষেপে অবাক হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে। এলাকা ভিত্তিক আক্রমণ পরিকল্পনায় বুঝা যেত গোটা লালমনিরহাট নখ দর্পনে তার। পাকিস্তানী প্রতিটি সামরিক স্থাপনার ওপর ছিল তার অব্যর্থ অবজারভেশন। ফলে রেকির জন্য আলাদা সময় নষ্ট করার প্রয়োজন হতো না কোন।

 

দূরাকুটির হাট অপারেশন

বরাবরই ধরলা পার হয়ে গীতালদহের দড়িবাসের ভিতর দিয়ে ঢুকতাম আমরা বাংলাদেশে অপারেশন করতে। কিন্তু দূরাকুটিরহাট অপারেশনের সময় সে কৌশল পরিত্যাগ করে ঢুকে পড়লাম সোজা বাংলাদেশ সীমান্তের ভিতরে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। নদীর পাড় ধরে এক সারিতে চলেছি হেঁটে। কোন সাড়া শব্দ নেই ঝাড় জঙ্গলেও। গোটা এলাকা ডুবে আছে নির্বঘ্ন গভীর ঘুমে। বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে এ বোধ তখনো জাগেনি সীমান্তে কিছু এলাকার মানুষের মধ্যে। অন্তত আচরণ দেখে তাই মনে হয়। ঝুপঝাপ শব্দ করে ডিঙ্গি নৌকার গলুয়ে পাটের ভুতি জ্বালিয়ে ছড়ার পানিতে খোঁচা দিয়ে মাছ ধরছে দু'জন লোক আপন মনে। এদের নির্লিপ্ত চলাফেরায় মনেই হয় না একবারও ঘটছে কিছু দেশের ভিতরে। হাঙ্গামা না ঘটিয়ে চলে গেলাম আমরা পাশ কাটিয়ে নিজেদের মত।

রাত তিনটা। পৌঁছলাম দূরাকুটিরহাট। এমনিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার তার ওপর ঘন জঙ্গল আর বড় বড় গাছের বেষ্টনি। ঘিরে রেখেছে ক্যাম্পটাকে চারদিক থেকে। এর মধ্যে আক্রমণ চালানো দুরুহ ব্যাপার। বিশেষ করে মর্টার চালানোর মত সুবিধার পজিশন পাওয়া যাচ্ছিলো না। আমাদের বসিয়ে রেখে কোথায় যে গেলেন মেকু ভাই জানিয়ে যাননি তাও। আছি অপেক্ষায়। ফিরে এলেন কিছুক্ষণ পর। যার যার পজিশন ঠিক করে দিয়ে নিয়ে গেলেন আমাকে টিলার মত উঁচু একটি স্থানে। ক্যাম্প থেকে এ টিলার অবস্থান ঠিক উত্তর পূর্ব কোণে। ফাঁকা অনেকটা।

পৌণে চারটা রাত। পূর্ব পরিকল্পনা মত মেকু ভাই ভেরিলাইট পিস্তলের গুলি ছুড়লেন আকাশে। শুরু হলো সাঁড়াশি আক্রমণ। বুক চিঁড়ে অন্ধকারে গোলাগুলি আঘাত হানতে লাগলো পাকিস্তানী ক্যাম্পে। আচমকা হুলস্থুল রণক্ষেত্রে পরিণত হলো এলাকাটি। আগুনের লকলকে শিখা কুন্ডলী পাকিয়ে উঠতে লাগলো আসমানের দিকে। গোলার আগুন থেকে উদ্ভাসিত হতে লাগলো জঙ্গলাবৃত্ত স্থানগুলো। পাল্টা পাকিস্তান আর্মির গোলা বৃষ্টির মত পড়তে লাগলো এসে এলোপাতাড়ি। গুরু হলো সেই সাথে বিএসএফ' এর কভারিং ফায়ার। এগুচ্ছে সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক। ক্রলিং করে সরে যেতে লাগলাম নিরাপদ দূরত্বে।

জারি ধরলার পাড়ে এসে জড়ো হলাম আমরা। উঁকি মারছে তখন ভোরের আকাশে। পার হলাম নদী ডিঙ্গি নৌকা করে। হঠাৎ খেয়াল হলো দড়িবাসে পৌঁছে, তাজউদ্দিন তো নেই আমাদের সঙ্গে। তবে কি সে আসেনি? চিন্তিত হয়ে পড়লাম সবাই।

রংপুর কারমাইকেল কলেজের বি. এ ক্লাসের ছাত্র তাজউদ্দিন আহমেদ বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন আমাদের গ্র“পে। কিন্তু গজেন্দ্র গতিতে চলতে অভ্যস্ত এই কুমড়ো সাইজ ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন একেবারেই বেমানান। কোন দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন করতে পারতেন না। তারপরও উৎসাহের কমতি ছিলো না তার। এই অতি উৎসাহের কারণে বিপদে পড়তে হয়েছিলো কয়েকবার। একবার ভুল করে তো পাকিস্তানী ক্যাম্পেই পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রায়।

তেমন কিছু ঘটেনি তো এবারও।

সকাল হয়েছে। বেরিয়ে পড়ছে মানুষ জন নানা কাজে। কৌতুহলী দৃষ্টি উঁকি ঝুঁকি মারছে আমাদের দেখে। অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মরণপণ করে লড়ছে মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু কারা এই মুক্তিযোদ্ধা? কেমন দেখতে? এ রকম একটা কৌত‚হল আছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আজ প্রকাশ্যে অর্ধ উলঙ্গ কিছু তরুণকে একত্রে বসে থাকতে দেখে বিস্ময়ানুভ‚তিতে দাঁড়িয়ে পড়লো সকলে। কৌত‚হলে কম যান না গৃহবধূরাও। কাঁশিয়ার বেড়া ফাঁক করে তারাও তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। কেউ কেউ বেরিয়ে এসে গুড়-মুড়ির সানকি এগিয়ে ধরলেন মুখের সামনে।

সংশয় সত্যে দৃঢ়মূল হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। অন্যদিকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত হলো ক্যাম্পে। যাওয়ার আগে সেখানকার মানুষকে বিবরণ জানিয়ে দেয়া হলো তাজউদ্দিনের।

ধরলার ঢালুতে নৌকার পাটাতনে জড়িয়ে লুঙ্গি গায় গুটিগুটি মেরে বসে আছে দয়াল চাচা। নৌকার মাঝি। ধরমর করে উঠে দাঁড়ালো আমাদের দেখে। ঘুম জড়ানো চোখ দু'টো দু'হাতের তালু দিয়ে ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করলো, ‘খবর সউগ্ ভাল্ তো বাবারা?' আমাদের কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই আবার বলতে লাগলো, ‘তোমরা ফির কি কইবেন, মুঁই নিজেই আইত দুপুরোতে বন্দুকের ফাটাফাটি আওয়াজ গুনি বুঝছোঙ্গ কাজ হয়্যা গ্যেইছে। শালার বেটা শালার ঘর বুঝছে এইবার, হামার ছাওয়ার ঘরও কম যায় না।' প্রাণ খুলে হাসতে লাগলো শব্দ করে। গ্রামের সহজ সরল এই মানুষটির হাসির দমকে কান্না এসে গেল চোখে। নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলাম পাড়ে। কথা নেই মুখে কারো। ভাবছি মনে মনে যদি চমৎকার কিছু ঘটে যায়, যদি ফিরে আসেন তাজউদ্দিন—

: খাড়া হয়্যা থাকলেন ক্যা বাহে, উঠি আইসো নাওয়োতে।

দয়াল চাচার তাগাদায় উঠে বসলাম নৌকায়। কাচার ভাঙ্গছে ঢেউয়ের আঘাতে। তাতেই দুলে দুলে উঠছে নৌকা। টেনে তুললো কাদায় পোতা লগি। কাঁচি খুলবে নৌকার— ঠিক এমন সময় দূর থেকে চিৎকার ভেসে এলো মানুষের। ক'জন লোক দৌড়ে আসছে আমাদের দিক। কি যেন একটা কাঁধে তাদের। লাফিয়ে নামলাম নৌকা থেকে। অসাড় দেহ তাজউদ্দিনের। রক্ত ঝরে পড়ছে তখনও শরীরের ক্ষত স্থান থেকে। রগগুলো পায়ের ফুলে উঠেছে কালো হয়ে। ভ্র“র ওপর কাটা দাগ একটা ডান কানের লতি পর্যন্ত লম্বা। ধরাধরি করে উঠানো হলো নৌকায়। পানির ঝাপটা আর খোলা বাতাসে তাকালেন চোখ মেলে।

তাজউদ্দিনের আহত হওয়ার ঘটনাটা এই রকম।

পজিশন নেয়ার সময় বুঝা যায় নি অনেক কিছুই অন্ধকারে। টের পাওয়া যায় নি হাঁটা চলার সময়েও। পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্যাম্পের চারদিকে বড় বড় গর্ত করে ঢেকে রেখেছিলো তা ঘাসের আচ্ছাদন দিয়ে। ক্রলিং করে ফিরে আসার সময় সেই গর্তেরই কোন একটায় পড়ে গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন।

গত রাত্রের প্রচণ্ড গোলাগুলির পর কৌত‚হলী স্থানীয় কিছু মানুষ বের হয়ে আসে সকালে ঘটনা দেখার জন্য। তাদেরই একজন গোঙ্গানীর শব্দ শুনে গর্ত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে তাজউদ্দিনকে। কিন্তু গর্তে ফেলে আসতে হয় রাইফেলটা নিরাপত্তার কারণে।

 

রত্নাই রোড ও রেল ব্রীজ অপারেশন

লালমনিরহাট সাব-সেক্টরের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারী এলাকায় জুনের প্রথম থেকে আমাদের তীব্রতর আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানী সৈন্যের হতাহতের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে কৌশল পরিবর্তন করে তারা বেশির ভাগ পকেট ক্যাম্প গুটিয়ে নেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নতুন ক্যাম্প স্থাপন করে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। এ কারণে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রী ট্রেনের অতিরিক্ত আরো তিনচারটি ট্রেন প্রতিদিন চলাচল শুরু করে লালমনিরহাট-মোগলহাটের মধ্যে।

কৌশল হিসেবে প্রতিটি ট্রেনের সামনে এবং পেছনের কম্পার্টমেন্টে মানবঢাল হিসেবে তুলে নেয় বাঙালি যাত্রিদের। এই উভয় সংকটে সিদ্ধান্ত হয় রতœাই রেল ও রোড ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে যোযাযোগ বিচ্ছিন্ন করার। কাজটা ক্যাম্পে বসে সহজ মনে হলেও বাস্তব অবস্থা তা না। পাশাপাশি দু'টো ব্রীজ উড়াতে হবে এক সঙ্গে। রেকি করার পর বুঝা গেছে চলাচলকারী আপ-ডাউন এক একটি ট্রেনের সময় ব্যবধান মাত্র তিন ঘণ্টা করে। এর মধ্যে দু দু'টো ব্রীজ এক্সপ্লোসিবের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া অবস্থানটাও আমাদের বর্ডার থেকে বেশ ভিতরে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ শেষ করতে না পারলে সমূহ বিপদ। যা হোক স্পটে এসে পারিপার্শ্বিক অবস্থা যাচাই করে মেকু ভাই, আকরাম, সিরাজুল, কিবরিয়া এবং আমি একমত হলাম ব্রীজ অপারেশনের। সেই মোতাবেক শামসুল, কিবরিয়ার নেতৃত্বে এক এল.এম.জি.সহ ছয় রাইফেল পাঠানো হলো ব্রীজের লালমনিরহাট দিকে। মর্টারসহ চার রাইফেল নিয়ে পজিশন নিলাম আমি মোগলহাটের দিকে। আকরাম এবং সিরাজুলের নেতৃত্বে দু'টো দল গেল এক্সপ্লোসিবের কাজে রেল ও রোড ব্রীজে। সমন¦য়কারী মেকু ভাই। কঠোর সাবধানতা। যেন এতটুক শব্দ না হয় পানিতে। প্রতি মুহ‚র্তের শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস এসে লাগছে কানে। অশরিরীর মত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি যে যার মত। আবহাওয়াও অনুক‚লে নয়। থেমে থেমে বয়ে যাচ্ছে কন কনে ঠাণ্ডা বাতাস। খালি গায়ে মশাও পেয়ে বসেছে মওকা। রাইফেলের গুলিও বুঝি উত্তম এর চেয়ে। বয়ে যাচ্ছে সময় দ্রুত। ধুকধুক করে কাঁপছে বুক।

কানের কাছে চাপা আওয়াজ হলো একটা। শামসুল কিবরিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বললাম চাপা কণ্ঠে, ‘কতদূর?'

: রোড ব্রীজের কাজ এগুচ্ছে, রেল ব্রীজের কাজ এগুয়নি তেমনটা।

কথা শুনে কিবরিয়ার ভয় পেয়ে গেলাম রীতিমত। বললাম, উপায় তা হলে?

: চল তাড়াতাড়ি, গিয়ে আমরাও হাত লাগাই।

সহকারী মোসলেমের কাছে মর্টারের দায়িত্ব দিয়ে ছুটে গেলাম দু'জন রেল ব্রীজের দিকে।

রাত তিনটা বাজে তখন। শেষ করতে হবে কাজ চারটার মধ্যে। ঠাণ্ডা মাথায় লেগে গেলাম বারুদ লাগাতে। পৌণে চারটা রাত। বারুদ লাগানোর কাজ শেষ হলো দুই ব্রীজের। লালমনিরহাটের দিকে কভারিং-এ নিয়োজিত যোদ্ধাদের সরিয়ে আনা হলো ব্রীজের এপাড়ে মোগলহাটের দিকে। সতর্ক করে দেয়া হলো সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে। দুই ব্রীজের মধ্যস্থানে এসে দাঁড়ালো সিরাজুল কমান্ড দিতে। সেফটি ম্যাচ নিয়ে প্রস্তুত দু'জন দুই ব্রীজের তারে আগুন লাগাতে। ঠিক এমন সময় একটি আলোক রশ্মি দেখা গেলো দূরে। কেঁপে উঠলো রেলব্রীজ গমগম শব্দে। ট্রেন আসছে লালমনিরহাট থেকে। পিস্তল ছুড়ে আওয়াজ না করে উত্তেজিত সিরাজুল চিৎকার করে উঠলো, ‘ফায়ার.... সেফটি ম্যাচের আগুন রোড ব্রীজের তারে লেগে ছুটে চললো তরতর বেগে। রেল ব্রীজের আগুন নিভে গেল মাঝ পথে এসে। বিপদ এগিয়ে আসছে সামনে। তীব্র আলো পড়ছে ট্রেনের হেড লাইট থেকে। ঘটে যাবে এক্ষুণি বিপর্যয় একটা। পারবো না জীবন নিয়ে কেউ ফিরে যেতে। কোথায় থেকে শক্তি এলো জানি না আকবর আলীর হাত থেকে সেফটি ম্যাচটি কেড়ে নিয়ে ধরিয়ে দিলাম আগুন রেল ব্রীজের তারে। শুয়ে পড়লাম দ্রুত সবাই নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে। মিনিট দু'য়েকের ব্যবধানে প্রচণ্ড শব্দ করে পর পর উড়ে গেল রোড ও রেল ব্রীজ খড় কুটোর মত। বিস্ফোরণের আগুনে ভেসে গেল গোটা এলাকা দিনের আলোয়। ঐ আলোতে ছুটে গেলাম ঝোঁপের আড়ালে, মর্টার নিয়ে পজিশন নিয়েছিলাম যে জায়গায়। গিয়ে দেখি রক্তাক্ত আব্দুল বারেক পড়ে আছে বিচ্ছিন্ন দেহে। এটা হয়েছে উড়ে আসা ব্রীজের লোহার টুকরোর আঘাতে। থেতলানো মাথায় চোখ দু'টো তাকিয়ে আছে তখনও। পড়ে আছে রাইফেলটা খণ্ডিত দেহের পাশে। সময় পায়নি হয়ত সরে যেতে। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ব্রীজের ওপারে ব্রেক কষে থেমে গেল ট্রেন। শুরু করে দিলো গোলাগুলি পাকিস্তান বাহিনী। রাতও ভোর হয়ে আসছে। রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে ফেলে রেখে বারেকের লাশ ছুটতে লাগলাম প্রাণপনে সীমান্তের দিকে। দৌড়াচ্ছি আর ধিক্কার দিচ্ছি নিজেকে। কত কঠিন হৃদয়ের হয়ে গেছি যুদ্ধ করতে এসে। তাকিয়ে রয়েছে বারেক ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে। ভাবছে হয়ত নিয়ে যাব তাকেও সঙ্গে করে।

 

গেরপমন্ডল অপারেশন

তারিখটা জুনের পঁচিশ কি ছাব্বিশ মনে নেই এখন। রাত্রে বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। তারই ঠাণ্ডা আমেজ বইছে বাতাসে এখনও। সকালের নাস্তার পর বন্ধুরা মিলে চা পান করছিলাম রেল লাইনের ওপর বসে। আলাপ করছিলাম সামনের ছড়াতে এক্সপ্লেসিব বাস্ট করে মাছ ধরার। বার কয়েক এভাবে মাছ মেরেছি আমরা ক্যাপ্টেন উইলিয়ামের সঙ্গে গিয়ে। এই আলাপ চারিতার মধ্যে আচমকা কোত্থেকে এসে একজন বৃদ্ধ আছরে পড়লো আমাদের সামনে। আলুথালু বেশ। জীর্ণ শরীর। অনেক পথ হেঁটে এসেছে বুঝা গেল। ফোলা দুই চোখে কান্নার দাগ লেগে রয়েছে তখনও। আর্তনাদ এত বেড়ে গেছে গোরপমণ্ডলে যে, গরু-ছাগল, হাঁস মুরগী থেকে শুরু করে ডিম-ডাল পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যাচ্ছে লোকজনদের মারপিট করে। শেষ এখানেই নয় অত্যাচারের, গত সন্ধ্যা রাত্রে একদল সশস্ত্র লোক এসে ধরে নিয়ে গেছে বৃদ্ধের নাতনিসহ বেশ ক'জন মহিলাকে। ঘর-বাড়ি ফেলে আশ্রয় নিয়েছে তারা দড়িবাসে এসে।

কথা শেষ করে ডুকরে কেঁদে উঠলো বৃদ্ধ।

সব গুনে ক্ষুব্ধ ক্যাপ্টেন হুকুম দিলেন গোরপমন্ডল আক্রমণের। সিরাজুল ও আকরামের নেতৃত্বে দু দু'বার আক্রমণ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর গোরপমন্ডল অপারেশনের দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। বড় ধরনের এই চ্যালেঞ্জের মুখে মেকু ভাই, মোসলেমকে সঙ্গে নিয়ে গোরপমন্ডল রেকি করতে গেলাম আমি নিজে। কৃষকের বেশ ধরে যখন পৌঁছলাম রোদ্দুরে কড়া তাপ চারদিকে ধুপ ছড়াচ্ছে তখন। জনমানুষ শূন্য গ্রামটা প্রেতপুরি মনে হলো। ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটাচলা করতে করতে একটা খড়ের ঘরের পাশে এসে বসলাম বিশ্রাম নেয়ার অছিলায়, উদ্দেশ্য জায়গাটা ভালভাবে পরখ করে দেখার। দৃষ্টি ফেরাতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো জারী ধরলার পাড়ে ঝাকড়া একটা বটগাছের তলে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে জনা দশেক পাক আর্মি। মুখোমুখি তাকিয়ে থাকলাম একে অন্যের দিকে। কি ভাবলো ওরা আমাদের দেখে বুঝতে পারলাম না। ওঠে গেল কিছুক্ষণ পর। আমরাও ওঠে চলে এলাম আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি নিয়মিত বাহিনীকে মোকাবেলা করে আসছি আমরা এই বিষয়টি মাথায় রেখে গত দু'টি আক্রমণ পরিকল্পনা ও আজকের বাস্তব প্রেক্ষিত আলোচনা করতে বসে গেলাম সিরাজুল, আকরাম, মেকু ভাই, ক্যাপ্টেন উইলিয়াম এবং আমি। পু´খানুপু´খ পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলাম আজ রাত্রেই গোরপমন্ডল আক্রমণ করবো। আমার বিশ্বাস, যদি বুঝে থাকে তারা (পাকিস্তান আর্মি) কৃষকের বেশে মুক্তিযোদ্ধাই ছিলাম আমরা তাহলে কালকেও আসবে তারা ঐ স্থানে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে আমাদের। সমর্থন করলো সবাই এই পরিকল্পনা আমার। 

এই অপারেশনে পুরনো সহযোদ্ধাদের মধ্যে আকরাম, আনসার, মোসলেম ও সহিদুরকে সঙ্গে রেখে সদ্য ক্যাম্পে যোগ দেয়া শেখ কামালের ব্যাচের পনেরজন মুক্তিযোদ্ধাকে অন্তর্ভুক্ত করলাম আমার গ্রুপে। এই প্রথম মেকু ভাইকে ছাড়াই (চোখ ওঠার কারণে) দড়িবাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম সন্ধ্যা সাতটার দিকে। জারী ধরলা পার হয়ে পৌঁছলাম গোরপমন্ডলে। ঝাঁকড়া সেই বটগাছটাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে পজিশন ঠিক করে নিলাম ত্রিভ‚জাকারে। অস্ত্রের মুখ সবার নদীর দিকে। কারণ গ্রামে ঢুকার একমাত্র পথ ঐ নদীর পাড় ধরে। গভীর নিশীথেরও একটা ভাষা থাকে। কিন্তু কোন শব্দই কানে এলোনা পাশের গভীর জঙ্গল থেকেও। থেমে আছে যেন সব কিছু। কর্তব্যে সজাগ অস্ত্রের ট্রিগারে হাত রেখে শুধু জেগে আছি আমরা যার যার পজিশনে।

ভোর হচ্ছে ১ জুলাইয়ের রাত। খসখস-পায়ের নিচে চাপা পড়লে যেমন শব্দ হয় পাতার। পজিশন নিয়ে আছে আমি যে জায়গায় সেখান থেকে ঠিক দশ বারো হাত দূরে। সতর্ক কান খাড়া করলাম। শব্দটা শুধু আমি নয় শুনেছে সবাই। মুহ‚র্তে দৃষ্টি বিনিময় হলো আকরাম ও মোসলেমের সঙ্গে। নড়ে চড়ে পজিশন ঠিক করে নিলাম। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো একে একে আটজন সেনা। নামলো নদীর পাড়ে। সোজা হাঁটতে লাগলো তারা গ্রামের দিকে। পাড় মাথা সমান। দেখা যাচ্ছে না কাউকে। গুলি ছুড়লে পড়বে গিয়ে নদীর পানিতে। বেকায়দা অবস্থা। ওদিকে আকরাম, মোসলেম ইশারা দিচ্ছে আমাকে কমান্ড দেয়ার জন্য। খেলছে না মাথায় কি করবো এ অবস্থায়। শরীর কাঁপছে উত্তেজনায় থর থর করে। কমান্ড দেয়ার পরিবর্তে গ্রেনেড ছুড়ে মারলাম পাকিস্তানী সেনাদের দিকে। এরপর মুহুর্মুহু গেনেড চার্জ শুরু হলো তিন দিক থেকে। নদীর ওপারে যারা দাঁড়িয়ে দেখছিলো এ দৃশ্য তারই প্রথম চিৎকার করে উঠলো উল্লাসে, ‘খতম হয়ে গেছে সব'। বন্ধ হলো গ্রেনেড চার্জ। ফিরে এলো চৈতন্য। গোবরের খালি গর্তে বসে ঠিক ঠাক করে নিচ্ছিলাম নিজেকে। হাসতে হাসতে আকরাম পা বাড়িয়েছে কেবল আমার দিকে। হঠাৎ থেমে গিয়ে কি যেন একটা জিনিস কুড়িয়ে তুলে নিলো হাতের তালুতে। উল্টে-পাল্টে দেখে বললো ওখান থেকেই, ‘জাকির মাইন....'।

মালকোচা লুঙ্গি লেংটির মত টাইট করে বেঁধে এলএমজি বাঁ হাতে ধরে লাফিয়ে উঠলাম চিৎকার করে, ‘কোথায় মাইন?' শব্দ হলো একটা। শূন্যের দিকে উঠে ছিটকে পড়ে গেলাম পাঁচ সাত হাত দূরে। উড়ে গেছে আমার ডান পা'র নিম্নাংশ মাইন বিস্ফোরণে। বারুদে লেপ্টে আছে সারা শরীর। উলঙ্গ সম্পূর্ণ, বাঁ পায়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছি খুঁড়ে কাঁটার ওপর। অসহায় চোখে তাকিয়ে চিৎকার করছি জবাই করা গরুর মত। ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে সহযোদ্ধারা কেউ কেউ। বাঁচার প্রবল তাগিদে উড়ে যাওয়া পা নিয়েই হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলাম সামনে... আর চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম সাথীদের, ‘বাঁচাও আমাকে। ফেলে যেওনা আমাকে এখানে'। দৌড়াচ্ছে যারা তারা ফিরে এলো না কেউ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনসার ডুকরে কেঁদে উঠলো আমাকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘তোকে আমি মরতে দেব না রে ভাই। আমি বাঁচিয়ে নিয়ে যাবো তোকে'। পাগড়ি বাধা মাথার গামছা খুলে কসে বাঁধলো আমার ডান পা রক্ত বন্ধ করার জন্য। পেছন থেকে ছুটে এলো আকরাম, মোসলেম, সহিদুর। কাঁধে তুলে চারজন পাড়ে নেমে এলো জারি ধরলার। ঘাটে ভিড়ানো ছিলো কলাগাছের ভেলা, রাইফেল বিছিয়ে তার ওপর শুয়ে দিলো আমাকে। ডুব সাঁতার দিয়ে ঠেলে ঠেলে ভেলা নিয়ে এলো দড়িবাসের ঘাটে।

যারা উল্লাস করছিলো এতক্ষণ আমাদের বিজয়ে-মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল তারা আহত আমাকে দেখে। ক্ষত-বিক্ষত দেহটা ধরে কাঁদতে লাগলো অনেকে। কে একজন দৌড়ে গিয়ে দু'খানা তক্তা নিয়ে এলো কাঠের। কাঁথা বিছিয়ে শোয়ানো হলো আমাকে।

শত মানুষের ভিড়ে কাঁদছিলো অনেকেই। এর মধ্যে হঠাৎ দেখতে পেলাম সেই বৃদ্ধকে। দু'হাতের তালুতে কপাল চেপে ধরে কাঁদছে অঝরে আলের ওপর বসে। যারা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে ফিরে এলো সে সব মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে। ঝটপট বাঁশ দড়ি দিয়ে ভাড় বানিয়ে নিয়ে চললো বন্ধুরা আমাকে ধরলার দিকে।

কথা নেই কারো মুখে। গভীর উৎকণ্ঠা সবার চোখে। অবিরাম রক্ত ঝরছে। লাল হয়ে যাচ্ছে নৌকার পানি। ভাটির দিকে তীব্র বেগে ছুটে চলা নৌকা ঝোঁপ-ঝাড় ঠেলে ক্যাম্পের দিকে মোড় ঘুরতেই গতিরোধ করে দাঁড়াল দু'টো নৌকা। একটিতে ক্যাপ্টেন উইলিয়ান, অন্যটি বিএসএফ জোয়ানে ভর্তি। মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরে আসা দেখে স্বভাব সুলভ কণ্ঠে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘মিশন সাকসেস তো?'

: ইয়েস স্যার।

মোসলেম বললো।

হঠাৎ দৃষ্টি পড়লো ক্যাপ্টেনের নৌকার পাটাতনের ওপর। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জাকির...

: আহত স্যার।

কান্নাভেজা কণ্ঠে উত্তর দিলো আকরাম। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো সবাই। ঝাঁপিয়ে পড়লো পানিতে বিএসএফ জোয়ান কয়েকজন। দ্রুত পাঁজা কোলা করে তুলে এনে শুয়ে দিলো আমাকে বিএসএফ ক্যাম্পের বারান্দায়। আমার আহত হওয়ার সংবাদটা ছড়িয়ে পড়লো মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। ওয়ারলেসে মেসেজ পাঠানো হলো বাগডোগরা আর্মি হেড কোয়ার্টারে। দ্রুত কোচবিহার হাসপাতালে শিফট করার নির্দেশ এলো ওয়ারলেসে। সহযোদ্ধা সবাই দাঁড়িয়ে আছে আমাকে ঘিরে। ঝরে পড়ছে পানি চোখ দিয়ে। একজন তো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল উড়ে যাওয়া আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে। ক্ষোভে চিৎকার করে উঠলো শামসুল কিবরিয়া, ‘আমি প্রতিশোধ নেব এর।

ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো বারান্দা ঘেঁষে। পেছনের সিটে শোয়ানো হলো আমাকে, আকবর আলীর কোলে মাথা, আকরামের কোলে পা রেখে। সামনের সিটে বসলেন বিএসএফ এর ক্যাপ্টেন একজন।

কোচবিহার জে, এন হাসপাতালের ভেতর ট্যাক্সি ঢুকতেই এষ্ট্রেচারে তোলা হলো আমাকে এবং দ্রুত নিয়ে নেয়া হলো ড্রেসিং রুমে। সেখানে এ্যান্টিসেফটিক তুলো দিয়ে ক্ষতস্থানগুলো ঢেকে ঢুকানো হলো অপারেশন থিয়েটারে।

অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবার মুহ‚র্তে দেখলাম দরোজার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন ভারতীয় লেঃ কর্ণেল। ডান হাতে আমার মাথার চুল নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘ভয় কি, আমরা তো আছি।'

জ্ঞান ফিরলো যখন বুঝলাম হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি আমি। আলো জ্বলছে ওয়ার্ডে জ্বলজ্বল করে। পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আকরাম তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। ভেতরটা শুকিয়ে গেছে তেষ্টায়। পানি খেতে চাইলাম। পানির বদলে সিস্টার তুলো দিয়ে ভিজিয়ে দিলো ঠোঁট দু'টো। যন্ত্রণা গোটা শরীরে। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে টের পেলাম হাত দু'টো বাঁধা বিছানার সঙ্গে ব্যান্ডেজ দিয়ে। মনে পড়লো অপারেশন থিয়েটারের ঘটনা। ইথার ক্লোরোফর্ম করার সময় দু'হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলাম মেঝেতে ডাঃ এন কে ঘোষকে। ঐ অবস্থাতে ভদ্রলোক কষে একটা থাপ্পড় মেরেছিলেন আমার গালে। এরপর আর কিছু মনে নেই।

হাতের বাঁধন খুলে দেয়ার পর টের পেলাম হাঁটুর নিচ থেকে ডানপা আমার অপারেশন করে বাদ দেয়া হয়েছে। তখন যে কি অনুভ‚তি আমার লিখে বুঝাতে পারবো না। তবে একটা কথা মনে আছে এখনও। সান্ত্বনা দিয়ে সিস্টার ভারতি দেবী বলেছিলেন, ‘মনে এত শক্তি যার, পারে সেইতো সব কিছু জয় করতে'।

ষোল শয্যার সার্জিক্যাল ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ। পা ফেলার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই মেঝেতে। নরক পরিবেশ। এর মধ্যেই প্রতিদিন ভিড় লেগে আছে মুক্তিযোদ্ধাকে দেখার জন্য। হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলিতে সে এক অভ‚তপূর্ণ পরিবেশ— যা কল্পনাই করা যায় না।

তিনদিন পরের ঘটনা।

পায়ের যন্ত্রণা আর দর্শনার্থীর ভিড়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। হঠাৎ ঘুমে ভেঙ্গে গেল চিৎকার-চেঁচামেচিতে। তাকিয়ে দেখি গোটা হাসপাতালেই গিজগিজ করছে মানুষে। অস্বাভাবিক ব্যস্ততায় ছুঁটোছুটি করছেন ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়রা। ঘর ঘর শব্দ এস্ট্রেচারের। কি হয়েছে আশে পাশে। আমার বিছানার পাশেও ভিড় মানুষ জনের। পেছন ফিরে আছে নার্স আমার দিকে অষুধের ট্রলি নিয়ে। এরই এক ফাঁক দিয়ে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। আমার পাশের বিছানায় শুয়ে আছে শামসুল কিবরিয়া। বা পা নেই পুরোটাই। কোমর অবধি ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা। শরীরের ক্ষত স্থানগুলো ভরিয়ে রাখা হয়েছে গজ দিয়ে। আহত স্থান থেকে বুক পর্যন্ত ঢাকা আলগা একটা লুঙ্গী দিয়ে।

আকরাম এলো। ওর বিষণœ চেহারা দেখে অস্থীর হয়ে উঠলাম, বললাম, ‘এসব কি?' আকরাম যা বললো তার সারমর্ম এই রকম...

আহত হয়ে আমি হাসপাতালে চলে আসার পরদিন জেদ ধরে কিবরিয়া গোরপমন্ডলে গিয়েছিল মাইন অপসারণের জন্য। ওর ধনুক পণ জেদে শেষ পর্যন্ত রাজী হন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম। মেকু ভাই ও সহিদুরকে সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দেন তিনি কিবরিয়াকে গোরপমন্ডলে।

বটগাছের তল থেকেই শুরু করে তারা মাইন তুলতে। ধীরে ধীরে এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে। এসে পৌঁছে সেই কুঁড়ে ঘরটার কাছে। অসংখ্য মাইনে বিছানো ঘরের চারদিক। বাঁধা দেন মেকু ভাই আর এগিয়ে না যেতে। কান দেয়না সে কথায় কিবরিয়া। লুঙ্গির কোচড় ভরতে থাকে মাইন তুলে তুলে। ঘটে যায় এর মধ্যেই বিস্ফোরণ মাইনের। বিচ্ছিন্ন বা পা কিবরিয়ার লাফাতে থাকে দূরে ছিঁটকে পড়ে। পেছনে থাকা আহত সহিদুর ঐ দৃশ্য দেখে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে। রক্তাক্ত মেকু ভাই আহত অবস্থায়ই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে দু'জনকে নিরাপদ স্থানে।

স্থান সঙ্কুলান না হওয়ার কারণে আহত মেকু ভাই আর সহিদুরের বিছানা পাতা হয়েছে হাসপাতালের সিঁড়ি বারান্দায়।

আকরাম এতক্ষণ ছিলো সেখানেই।

গভীর রাত্রে জ্ঞান ফিরে এলো কিবরিয়ার। চোখ মেলে ডান-বাঁ তাকাতেই দেখে ফেললো আমাকে। স্বাভাবিক ভাবে ঠোঁটে স্বভাব সুলভ হাসি টেনে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাল আছিস তো?'

ঝরঝরে কণ্ঠস্বর। ক্লান্তি কিংবা বেদনার ছাপ নেই চোখে-মুখে। এত ভাল লাগলো না আমার কাছে। কেঁপে উঠলো বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে। গড়িয়ে পড়া দু'চোখের পানি মুছতে গিয়ে কেঁদে ফেললাম শব্দ করে।

: কষ্ট হচ্ছে খুব না রে।

কিবরিয়া জিজ্ঞেস করলো আবার।

: বুঝতে পারছিনা কষ্টটা আমার কোথায়।

কথা শুনে মৃদু ঠোঁট নেড়ে হাসলো কিবরিয়া। এ হাসি এতটাই মুগ্ধ করলো আমাকে যে, চোখ ফেরাতে পারলাম না। কিবরিয়াও তাকিয়ে রইলে আমার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে। ব্যান্ডেজের জায়গাটা ভেসে উঠছে রক্তে। কোটরে ডুবে থাকা চোখ দু'টো বুঁজে আসছে ধীরে ধীরে। ক্লোরোফর্মের কার্যকারিতা তখনো ফুরিয়ে যায়নি একেবারে। বিরাম নেই তবুও কথা বলার। বলছে কিবরিয়া, ‘তোর কষ্ট দেখলে আমি বড় কষ্ট পাইরে। ডাকবো সিস্টারকে?'

‘না' বললাম মাথা নেড়ে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো কিবরিয়া, বললো, ‘আজকের রাতটা যেন কাটছেই না। তেষ্টা পেয়েছে খুব। কিন্তু খেতে পারি না। খেলেই বমি হয়'।

ডিউটিতে ভারতি সিস্টার। আমাদের কথাবার্তা শুনে এগিয়ে এলো কাছে। বললো কিবরিয়াকে, ‘এত কথা বলা ঠিক নয় আপনার জন্য, ঘুমোন।'

: আমিতো ঘুমোবই। কিন্তু ও যে ঘুমোতে পারছেনা সিস্টার।

: সে আমি দেখছি।

প্যাথেডিন ইনজেকশন পুশ করতেই নেমে এলো ঘুম আমার দু'চোখ জুড়ে।

ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে পরদিন সকাল আটটা। জেগে দেখি আমার আর কিবরিয়ার বিছানার মাঝখানে পার্টিশন সাদা কাপড়ের। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললে, ‘ঘুমিয়ে আছেন উনি'।

নাস্তা সেরে নিলাম মুখ কুলকুচি করে। ন'টা বেজে গেল। ঘুমিয়ে আছে এখনো কিবরিয়া। সিস্টারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এখন কেমন আছে কিবরিয়া?'

: ভাল।

নিরাসক্ত কণ্ঠ সিস্টারের।

: পার্টিশনটা সরাচ্ছেন না কেন?

: সুপারেনটেন্ড রাউন্ডে এলেই সরিয়ে দেয়া হবে।

: তার মানে?

উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

: আপনি অযথা রাগ করছেন আমার ওপর।

: কি হয়েছে?

জুতোর মচমচ শব্দ করে ওয়ার্ডে ঢুকলেন সুপারেনটেন্ড। পেছনে পেছনে ডাক্তার এবং আমার পরিচিত অনেকেই তাঁর সঙ্গে। সুপারেনটেন্ড সোজা এসে দাঁড়ালেন আমার বিছানার কাছে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার রাগ কি মানায়? কি হয়েছে? আমাকে বলো?

বললাম, ‘পার্টিশনটা সরিয়ে দিতে বলছিলাম।'

: এই কথা, বেশ তো আমি এক্ষুণিই সরিয়ে দিচ্ছি পার্টিশন। কিন্তু মনে রাখবে তুমি মুক্তিযোদ্ধা একজন।

সুপারেনটেন্ডের কথা শুনে মোচড় দিয়ে উঠলো বুকের ভেতর। দম বন্ধ হয়ে এলো লোকজনের ভিড় দেখে। সরিয়ে নেয়া হলো পার্টিশন। টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে কিবরিয়া। ঠোঁট দু'টো ফাঁক হয়ে আছে তখনও। কিন্তু হয়তো বলতে চেয়েছিলো সে। শুয়ে থেকে পাশেও বুঝতে পারিনি আমি। ভোর পাঁচটায় মারা গেছে কিবরিয়া।

গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলেন সুপারেনটেন্ড। লাশ তোলা হলো এষ্ট্রেচারে। ফুলে ফুলে ঢেকে গেল গোটা শরীর। দেখা যাচ্ছে শুধু মুখের অংশটুকু। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম, ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা আলম, আকরাম, সিরাজুলের সঙ্গে বেরিয়ে গেল কিবরিয়া। কবর হবে কোচবিচারে।

রয়েছি তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে। হাসপাতালের দরোজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো প্রত্যয় ভরা সেই ­স্নিগ্ধ হাসিটুকু যেন তখনও লেগে রয়েছে ওর ঠোঁট জুড়ে।

কিবরিয়ার মৃত্যু অন্যরকম এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো আমার মনে। আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম এই ভেবে, বুঝি ভাই-বোন, মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজনকে দেখতে পাবো না আর। একই পরিণতি হয়তো আমার জন্যও অপেক্ষা করে আছে। মনের যখন এই অবস্থা, হঠাৎ করে একদিন দেখা পেয়ে গেলাম আফতার আলী দাদার (আব্বার মামা)। বাঁশখালী থেকে ক্যাপ্টেন নওয়াজেস, ক্যাপ্টেন দেলোয়ার, অধ্যাপক হায়দার আলী ও আখতারুজ্জামান মন্ডলকে নিয়ে সাহেবগঞ্জ ফেরার পথে জীপ দুর্ঘটনায় আহত হন। ডান হাতের দু'টো আঙ্গুল ভেঙ্গে যায়। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসে জানতে পারেন আমার আহত হওয়ার সংবাদ। পাগল প্রায় দাদা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। আকুতি জানাতে থাকেন কর্তব্যরত ডাক্তার, সিষ্টারদেরকে হাসপাতালে থাকার জন্য।

হাসপাতালের আর. ও'এর বাড়ি ছিলো রংপুরে। আমার পরিচয় পাওয়ার পর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাঁর সঙ্গে। সকল বিষয়ে ওঁর সজাগ দৃষ্টি থাকতো আমার ওপরে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে তেমন ব্যবস্থা করতে না পারলেও আমার অনুরোধে একটা ইঙ্গিত দেন দাদাকে। সেইমত বিছানা পাতেন দাদা আমার বেডের তলে। জে. এন হাসতাতালে ছিলাম যে ক'দিন আমার দেখা শোনার যা কিছু দাদাই করেছেন সব। জানতে পারি বাড়ির খবরাখবর দাদার মুখ থেকেই। কিভাবে ছুটে বেরিয়েছেন আব্বা আমার খোঁজে। মঞ্জু মন্ডলের কাছ থেকে জানতে পারেন সব সাহেবগঞ্জ হেড কোয়ার্টারে এসে। গীতালদহে যাওয়া ঠিক হবে না বুঝিয়ে বলে আব্বাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। ফিরে যাওয়ার সময় অন্ততঃ শান্ত্বনা নিয়ে যান এইটুকু আমি বেঁচে আছি এখনো।

স্থানীয় রোগীর সংখ্যা বাড়তে সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছলো যে, সুষ্ঠু চিকিৎসার কোন পরিবেশেই থাকলো না আর। সিভিল হাসপাতলে চিকিৎসা চললেও সামরিক লোকজনের খবরদারী ছিলো প্রতিদিন। নিয়মের বাইরে কেবল আমার কারণেই সামরিক হাসপাতালে সরিয়ে নিতে পারছিলেন না তারা। ঠিক এই সময়ে একটা অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে গেল অর্থোপেডিক সার্জন ডাক্তার এন. কে ঘোষের সঙ্গে আমার। এই নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় গোটা হাসপাতালে।

 

(চলবে)


মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ১
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ২
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৩
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৪
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৫
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : শেষ পর্ব

 

কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top