সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

ব্যক্তিত্বের প্রাখর্যে বঙ্গবন্ধুঃ একটি ওকালতনামা : অশোক অধিকারী


প্রকাশিত:
১৪ জানুয়ারী ২০২১ ২১:২৪

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:২৬

 

যুক্তবাংলার আবেগ একটি সহজাত অনুপ্রাস। পরাধীন ভারতবর্ষের যে ক্রোধবহ্নি তা সর্বতোভাবে সত্য। তবু সেখানে জড়িয়ে থাকা ও শাখাপ্রশাখা সমন্বিত হয়ে শেকড়ের টান অনুভব করার মধ্যে একপ্রকার সুগন্ধি জন্মশোধের আতর ছিল। সাতচল্লিশ সেই শ্লাঘার অন্তর থেকে হৃদপিণ্ডের একটা দিক রক্তাক্ত হাতে ছিঁড়ে নিয়েছে।কিন্তু সে শিখিয়ে গেছে সংগ্রামের ভাষা। আর্থ সামাজিক পরিমণ্ডলে মানুষের যে চাওয়া পাওয়া,শিক্ষা স্বাস্থ্য সহ গণতান্ত্রিক বোধের উজ্জীবন, বেঁচে থাকার রসদ তার কথা বলার শোভন প্রজ্ঞা সর্বোপরি একটি মুক্ত মনের চাষ তার সবটাই তখনও ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। স্বাধীন বাংলাদেশ রচনার ভাব,নৈমিত্তিকতা, তার স্বাধীনতা নিয়ে লঙ্কা ভাগ অব্যাহত রইল স্বৈরাচারী শাসকের হাতে। সেখানে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বৃহত্তর প্রেক্ষিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সলতে পাকানো। এখানেও রক্ত ঘাম অশ্রুর বিসর্জন কোনো আপ্ত ইতিহাস নয়। মৃত্যুর গর্ব আর অহঙ্কারের জাত্যা ভিমান থেকে ইতিহাসের গর্ভে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন যিনি তিল তিল করে মানুষের অন্বিত মেধায় বপন করে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা সেই কিংবদন্তী পুরুষের জন্ম শতবর্ষ পেরিয়ে যাচ্ছি। সেদিক দিয়ে তাঁর কথা বলা এপার ওপার দুপারের মানুষের একটি দায়। যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে কেমন হতো বাংলাদেশ। কেমন থাকতো মানুষের বেঁচেবর্তে থাকা।এই যে এক অসহিষ্ণু সময়ের চাবুক খেতে খেতে দিনগুজরান আমাদের। মূল্যবোধের অবক্ষয়,যা দেশ কাল বিচার করে আসেনা। মানুষের বাঁচা-মরা যেখানে নির্ধারিত হয় বুলেটের এক ও অদ্বিতীয় একটি শর্টে।মৌলবাদ যখন মুক্তমনা মানুষের মগজ দখলে রক্ত মাখছে হাতে,  তখন শতবর্ষের নিকানো উঠোনে বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত কণ্ঠের আহ্বান 

“রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেবো

এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো....”

তখন শুধু আর একটি দেশের স্বাধীনতা পাগল মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সীমিত না থেকে বর্তমান সময়ের একটি স্লোগানে পরিণত হয়েছে, যার যথার্থতা প্রমাণের লড়াই লড়তে হচ্ছে বিশ্বের মানুষকে। বঙ্গবন্ধুর‘এ দেশ’ তখন বৃহত্তর মানচিত্রে অন্যমাত্রা পেয়েছে।তাহলে এমন একজন মানুষ যাঁর তেজদীপ্ত কথাসরিতে আগামীর মুক্ত পৃথিবীর পাঠচক্রের উপাদান সংযুক্ত থাকে তাঁর শতবর্ষ পালন স্বাভাবিক ভাবেই একটি চর্চার অভিমুখ নির্দিষ্ট করে, শুধু সেই গরিমায় যেখানে মানবতার অমোঘ সত্যের দিকে আমাদের হাওয়ামোরগ তাক করে থাকে।

কবি বেলাল চৌধুরীর ‘বত্রিশ নম্বর’ কবিতাটি মনে এল। যেখানে কবি লিখছেনঃ

“এ বাড়িটির প্রতিটি ইটে গাঁথা রয়েছে
বাঙালি জাতির গৌরব গাথা,শৌর্যের কথা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও অর্জনের কথা
বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দেশের
রক্তসিন্ধু অভ্যুদয়ের কথা”

সর্বজনীন অধিকার ফিরে পাওয়ার শপথ, তার অঙ্গীকারগাথা রচিত হয়েছিল যে মানুষটির বত্রিশ নম্বর বাড়িটিকে ঘিরে তার প্রতিটি ইট কাঠ পাথরের পলল স্তরে আগামীর স্বপ্ন বুনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তবু ইতিহাসের যে নির্মম অভিঘাতে, ফ্যাসিস্ত হানাদার দস্যুর খঞ্জর রক্ত রঞ্জিত হয়েছিল তাঁর কলজের রক্তে তা বৃথা যায় নি। একদিকে মুক্তির স্বপ্ন,অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে মুক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মক্ষণটি যেন লগ্ন ছিল তাঁর হত্যাদীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গে। তাই বেলাল তাঁর কবিতায় আরও লিখলেন, “একদিকে মানুষের ঢল অনর্গল/ তাদের চোখের টলমলে অশ্রুতে বিম্বিত/বত্রিশ নম্বরই স্বাধীনতার পবিত্র সনদ আর অঙ্গীকারনামা।” 

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশে লিখছেনঃ 

“একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।  একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালি- দের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালো- বাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।” দেশ ও জাতিসত্তার গভীরে যে মানুষটির সন্ধান পাওয়া যায় উক্ত কথনে তা অনুধাবন করার পর বাঙালি হিসেবে যে আত্মবিশ্বাস মনের মধ্যে লালিত হয় তা দিয়ে এক দূরদূরাশ্চয় আলোক রেখা  অভিসারী বীক্ষণে সযত্নে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে এই বলে যে, তুমি বঙ্গবন্ধু শুধু একটি প্রদেশের অভিমান নও। তুমি সর্বকালের, সর্বজন-মন ও মননের  আন্তর্জাতিক আলোকদিশা। একজন প্রাতিষ্ঠানিক বিপ্লবী পুরুষ।

বহুপঠিত ও বহুলালিত তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রচনার প্রেক্ষাপটটিও ভারী চিত্তাকর্ষক। তিনি লিখছেন,            “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল,‘বসেই তো আছ,লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।’ বললাম,লিখতে যে পারি না,আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জন - সাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে?কিছুই তো করতে পারলাম না।শুধু এইটুকু বলতে পারি,নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।” তাঁর স্ত্রী কয়েকটি খাতাও কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই হতষ্মান প্রেক্ষাপটে সেদিন কলম ধরার যে প্রেরণাটুকু রেণু(বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর ডাক নাম) বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে যান সেই সলতেয় অগ্নি সংযোগ করে তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্ম-জীবনী’ লিখে যান। অসমাপ্ত হয়েও ঐতিহাসিক দিক দিয়ে তার গুরুত্ব আশাতীত। ‘নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য(আসলে অসামান্য) একটু ত্যাগ স্বীকার’-র মধ্য দিয়েই যে দেশটির জন্ম হয়েছিল তার আত্মার করতলে প্রতীক্ষিত স্বদেশের ব্যঞ্জনা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল লক্ষ লক্ষ  মানুষের অধিকার বোধ। শাপে বর হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর চালানোর সময় ঘরের আলমারিতে রাখা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর চারটি খাতা, লেখা ডায়েরি,স্মৃতিকথা,ভ্রমণকাহিনী লেখা খাতার সবকটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে স্পর্শ করেনি।    

জীবনের অপ্রয়োজনীয় মুহূর্তকে কিভাবে মূর্ত করে তুলতে হয় তা তিনি তাঁর অসমাপ্ত জীবনকথায় স্পষ্ট করে গেছেন। পরাধীন ভারতবর্ষের যন্ত্রণা যাঁকে পীড়িত করে,তাঁর কাছে অসহিষ্ণু হওয়াটাই স্বাভাবিক। যিনি সুভাষ বোসের জীবনকে ধ্রুবতারা করে গড়ে নিতে চাইছেন তাঁর জীবনকে। রাজনৈতিক অধীনতা থেকে মুক্তি একটি পরাধীন জাতির যেমন প্রায়রিটি তেমনই স্বাধীন দেশে সম্মিলিত সম্পদের সুষম বন্টনও তার প্রায়োরিটির মধ্যে পড়ে।সেই অন্বীক্ষায় সুভাষচন্দ্র তাঁর জীবনের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। যে ধ্রুবতারার আলো তাঁর পথ ঠিক করে দিয়ছিলঃ “....এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো।”

নেলসন ম্যাণ্ডেলা বলতে ভালোবাসতেন,“ প্রকৃত নেতা তাঁরাই, যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন।"ম্যাণ্ডেলার কষ্টকল্পিত জীবনে বেশির- টাই কেটেছিল কারান্তরালে। অন্ধকার তাঁকে আরও নিবিড় করে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল তাঁর ফেলে আসা স্বদেশকে।বঙ্গবন্ধুর জীবনেও কারাগার তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছে অবরুদ্ধ বেদনের মাঝে মুক্ত হওয়ার ভাবনায় কিভাবে মোহিত থেকে জীবনকে উৎসর্গ করতে হয় মানব উজ্জীবনে। বেতার প্রকল্পক প্রনবেশ সেন কলকাতা বেতার কেন্দ্রের কালজয়ী সংবাদ পরিক্রমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়ে ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে....’ শিরোনামে সে সময়কে যেভাবে ধরেছেন তার একটি অংশ তুলে ধরা যায়ঃ“তখন তো এদেশে সকলের মনে শয়নে - স্বপনে - জাগরণে বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নিয়ে গল্প লেখা হচ্ছে,নাটক লেখা হচ্ছে,প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে,লেখা হচ্ছে কবিতা, লেখা হচ্ছে নতুন নতুন গান। বাংলাসাহিত্যের পশ্চিম খণ্ডে ততদিনে একটি নতুন উপ শাখা সংযোজিত হয়ে গেছে, যাকে বলা যেতে পারে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শাখা।একটা গানের কথা মনে পড়ছে।..লোকসংগীত শিল্পী দিনেন্দ্র চৌধুরী, অংশুমান রায়, গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের একটি চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসেছিল গৌরীপ্রসন্নর লেখা সেই গান....

 “শোন, একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি

আকাশে বাতাসে উঠে রণি

বাংলাদেশ- আমার বাংলাদেশ।”

যুক্ত বাংলার এই সম্পৃক্তি থেকেই একই রক্তের প্রবহ - মান ধারায় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের ধরতাই। একথা সত্য, বিদেশের অন্তর তখনও সেভাবে আলোড়িত হয়নি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় নিঙড়ানো যন্ত্রণার অভিব্যক্তিতে। কিন্তু হানাদার পাক বাহিনীর নৃশংসতার ঘৃণ্য নজির যখন গিয়ে পৌঁছচ্ছে সেদেশের সংবাদ মাধ্যমের কাছে তখন বিচলিত হয়েছে বিশ্ব হৃদয়। ভারতের উদ্বাস্তু শিবিরগুলি পরিদর্শন করে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের শিকার মানুষগুলোকে দেখে তাঁদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল It is a genocide. স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্রষ্টার উত্তরণ পর্বে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সার্বিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ কূটনৈতিক স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হয়েছিল। শ্রীমতি গান্ধীর কথায়ঃ “আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে,একই আদর্শ ও ত্যাগে অনুপ্রাণিত ভারত ও বাংলাদেশের সরকার এবং জনসাধারণ পারস্পরিক সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রসংহতি বজায় রাখা,অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা,সমান অধিকার এবং পারস্পরিক সুযোগ-সুবিধা- উপকারের ভিত্তিতে এক দৃঢ়মধুর সম্পর্ক গঠন করবে।” ঘোষনা পত্রের মধ্যে যে অমিতব্যয়ী পারম্পর্য দুটি দেশকে বিশ্বাস,আদর্শ ও ত্যাগের প্রাতিষ্ঠানিক ভূমির ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল তা আজও অমলিন।কলকাতায় আকাশবাণী কেন্দ্রের ১৯৭০-৭১-র সময় কার সংবাদ বিচিত্রার অনন্য উপাসক উপেন তরফদার তাঁর একটি লেখায় আবেগতাড়িত হয়ে উচ্চারণ করেছেন, “মুজিবের সেদিনের সেই তেজোদীপ্ত ঘোষনা আজও আমাকে উদ্দীপ্ত করেঃ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।” স্বাভাবিক বোধ ও প্রীতির স্বাক্ষরে আবেগ তাড়িত হয়েছিল যুক্তবাংলা।

১০ই জানুয়ারি ১৯৭২। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন।দীর্ঘ কারাবাসের পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছেন।ঐতিহ্য লালিত রমনা ময়দানে ভাষণ দেওয়ার পর নিজের বাড়িতে পা রাখবেন তিনি। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বাথরুমে আধাঘন্টা লুকিয়ে আছেন এপার বাংলার বিশিষ্ট চিত্র গ্রাহক তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু দেওয়ালে কান পেতে আছেন,কখন তিনি আসেন। হঠাই হট্টগোল। তিনি এলেন।তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিচারণ করে লেখেন         “ বুঝতে পারলাম, তিনি এসেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী কাণ্ডারী। একটি সদ্যস্বাধীন দেশ ও নতুন আত্মপরিচয় নিয়ে জেগে ওঠা একটা জাতির জনক। ...... একলাফে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ক্যামেরার ফ্ল্যাশগান সেট করে অন্ধের মতো ছবি তুলতে থাকলাম। কী সব মুহূর্ত! সকলের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন। ক্লিক। কন্যারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাঁর বুকে। ক্লিক।....... তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্ত্রীর মুখোমুখি হলেন বঙ্গবন্ধু। আলিঙ্গন করলেন স্ত্রী’কে। চারদিকে হইহই। বিপুল কলরব।  ক্লিক ক্লিক ক্লিক।” সবুজ ঘাসের ওপর নিজের মাথা রেখে ঘুমানোর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি। যাকে স্পর্শ করে এক অনাস্বাদিত মুক্তির স্বাদ পান বঙ্গবন্ধু। গোলাগুলির বীভৎসা যাঁকে কুয়াশার বর্ম ভেদ ক’রে  আলোক পানে চলার উন্মাদনায় দীক্ষিত করে। তাঁর সেই প্রিয় জন্মভূমি রক্তাক্ত হল তাঁর বুকের রক্তে। তিনি জানতেন তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামসিদ্ধ জীবনের অভিজ্ঞতায়, স্বৈরাচারী হায়নাদের নিঃশ্বাস তখনও প্রবহমান বাংলা দেশের প্রতি ইঁট কাঠ পাথরে। আর তাই এসেছে ’৭৫’র সেই কালোরাত্রি। অন্ধকারের জীবেরা তাঁর ও তাঁর আত্মজাদের কলজের রক্তে স্নান সেরে ফিরে গেছে। সকালের আলো ফোটার আগেই তড়িৎগতিতে সে সংবাদ ছড়িয়েছে। আপামর মানুষ বুকের গভীরে যে প্রিয় মানুষটির ছবি নিয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রাযাপন করত, রক্তিম সূর্যের দিকে মুখ করে দরবিগলিত ধারায় তারা চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছেঃ “হায় হায়, বঙ্গবন্ধুরে ওরা মাইরা ফালাইছে।” ইতিহাসের কী নির্মম পরিণতি! কী নির্লজ্জ অপসারন! কী ক্ষমাহীন বীভৎসা! আবার ইতিহাসের আশীর্বাদী ফুল,বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার ফলে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন। অনেক প্রতিকূলতা,মৌলবাদী চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশকে। তবু উচ্চারণ করতেই হয় রবীন্দ্রনাথের সেই আবিল লেখনীঃ“তুমি কি কেবলই ছবি,শুধু পটে লিখা/....কবির অন্তরে তুমি কবি/নও ছবি,নও ছবি,নও শুধু ছবি।”

 

“আজও তেমনি সব পথ বত্রিশ নম্বরের দিকে
উল্টোদিকে তখন দ্রুত ধাবমান রক্তধারা সিঁড়ি
করিডোর বেয়ে
সমগ্র দেশের দিকে
সমগ্র জাতির দিকে
সাগরের দিকে
বত্রিশ নম্বরই স্বাধীনতার পবিত্র সনদ আর অঙ্গীকারনামা।”            (বত্রিশ নম্বরঃবেলাল চৌধুরী)

 

অশোক অধিকারী
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top