সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শহীদের মা : ডঃ মীনা মুখার্জী


প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২০ ২৩:১৯

আপডেট:
২৪ জুন ২০২০ ২৩:২১

 

 —বলি বৌমা, ও বৌমা, তু কুলুক্ষুণী গেলি কুথায় লো ?
 —হমার ছুয়ার মাথাট খেঁয়েও কি তু লিচ্চিন্তেঘুমোইছিস ? ভাতার খাগী !
—ক্যানে মা বলোই না —তা হোল্য কি?

—বুলছিলাম তো—তা চুখ্যের জলট পুঁছ, ম্যাস্কিট ছেড়্যে একট কাপড় উরে ল্যে ন ৷
—ক্যানে কাপড় উরব্যো কুন দুঃখে ?
—আরে উয়ারা আসবেক ন৷
—কেটো আসবেক ?

—আ মরণ ! সিটো তুমি জানছস না কি ? খপরের কাগজ, টিভির নুক, পু ধান বাবু, মুখিয়া সুবাই আসবেক যে, কাইল ডাক হঁইছেঁ৷
     
 কিছুক্ষণ মূর্তির মত স্থবির থেকে মুঙ্গলি বলে উঠলো —
—তুমি তো মা বেটো, তুমি কল্যেই হবেক গো মা ৷ হামি মুখপুড়ি , হমার আর সং সাজ্যার দরকার নাই গো মা৷  আনখাই !
মুঙ্গলির দু'চোখে তপ্ত অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ে অঝোরে৷পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে পড়ছে বাঁকা চাহনি ৷
প্রবল শূণ্যতার হাহাকারে স্তব্ধ আকাশ, পাতাল ৷ শাল গাজুরির নামোটোলার বাসিন্দারাও শোকাতুর, তাদের এ টোলার সেনা ছিল অর্জুন ৷ পাক -সেনাদের হাতে জান যায় এই তরুণ বীর জওয়ানের৷
 —হামি??

বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে অর্জুনের দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ ! মনের ক্যানভাসে আঁকিবুকি কাটে সে হলদে রঙের পাঁংশুটে মুহূর্ত্তেরা ! রঙ্গোবতীর চোখে জল নেই, পরন্তু অট্টহাসির হুটোপুটি ওষ্ঠ-অধরে ৷ পাষাণী মা নাকি ? হাসতে হাসতেই বলে উঠল—         
—তু বীরের ইস্তিরী বেটিস, আর হামি সিনা মা, লতোন জমানায় গব্বো-ধারিণী মা এক পটি পরে লো ! জওয়ানের মাগ, ইস্তিরী তো তু একবারে বীরের মতন থাকবিস ৷ বুলবি ন ফটক বাবুকে—কি কইরে ঠাওরইতে হবেক, ভালতে হবেক বল কেনে বাবু ! ডরাবিনা লো ৷ উ তুখে ঠিক সমঝাঁই দিবেক ন, কুন্ ঠিনে চইখ রাখবি, কেমনি কইরে ভালবি —বেবাক সমঝাঁই দিবেক ন৷ বলবিস —
—হামার সোয়ামী মতলব হাইসব্যান জান দিল্য ব্ দ্যাশের ল্যেগে, তা হামি গব্বো করি, হামি গব্বিতা ! দ্যাশের ল্যেগে......
—না মা, ই হামি বুইলত্যে লারবো মা৷

—ভাতার খাগী!জানলি ন মুখপুড়ি, হতচ্ছাড়ী, গটা দ্যাশ শুইনব্যেক তুর কান্ন ! গটা দ্যাশ, দুনিয়া !
—প্যাটের ছুয়াটা লাফাঁই উইঠল্য মুঙ্গলির ডিঙ্গলে পারা প্যাটে ৷ আর আঁইরে লাগা কুলেরট মুঙ্গলির হাড়-লিকলিকে শরীরটাকে সজোরে জাপটে ধরল....বুঝিবা দুধের শিশুটিরও বুঝতে বা চিনতে বাকি রইলনা তার একমাত্র আশ্রয়কে!
 প্যাটে হাত বুলাঁই ছানাটর যন্তণ্ণা শুনে আরও রাগে কান্ন পওতি ছুঁড়ির !
 —না, না গো মা গড় করছি তুখে, ই কথা হমকে বুইলতে বলব্যেক নাই ৷ হামি মাফ চাইলম তুমার ঠিঁনে ৷ ইটো হামি পারবোক নাই ৷ হমার গলাট আঁটকাঁই যেছে  গো মা!হমার যন্তণ্ণা, হমার কান্ন !
 মুঙ্গলির দু'চোখের নোনা জল গড়িয়ে পড়ে চকচকে গালে ৷ কতই বা বয়স, টান -টান চেহারায়  ভরা যৌবনের ছাপ!
রঙ্গবতী কোরা ধুতির ট্যানার খুঁট দিয়ে চোখের কোণের জল মুছতে মুছতে, অর্ন্তদাহকে দমিত করে কান্না -ভেজা গলায় বলতে লাগল অনর্গল...
—হঁ লো,হামি পারছিস মা হঁয়্যেঁ, আর তু কিনা পারবিস নাস্ ? হমার সুনার পিদিম বুতে গেল, তবুও হামি মা হঁয়্যেঁ সঁয়্যেঁ লিছি, হামি দুখী মা হঁয়্যেঁ .......
পুত্রহারা রঙ্গবতী জননীর শোকাতুরা মুখটায় প্রবল উন্মাদনার উদ্ভাস ! তবুও ঢোক গিলতে গিলতে গলা চেপে থেমে থেমে বলে ওঠে ..
 —ভাল্ ভাল্, ভাল্ লো ভাতার খাগী ! হমার দিকে ভাল্ ...."শইদের মা " হামি ! খপরের কাগজ, ফটক বালারা টাকা দিবেক লো!লক্ষ্যো লক্ষ্যো টাকা ! 
রঙ্গবতী তেল না পাওয়া রুখু মাথায় উকুন তুলতে তুলতে হয়তো বা শোকের কথা ভুলতে চেষ্টা করছে ৷ পৌত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যের পানে দৃষ্টি আরোপ করে ক্ষতি পূরণের টাকার অঙ্ক প্রাপ্তির লোভে চক্ষু যেন ছানা বড়া!!
 টান টান নিকোনো উঠোনে টালির চালে ঝক্ ঝকে শরতের সোনা রোদ উঁকি মারছে, বীর জওয়ানের শবদেহকে স্বাগত জানাতে বুঝি বা !

 

ড. মীনা মুখার্জী
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top