সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বড় পরঙ : রাজন নন্দী


প্রকাশিত:
১৬ জুলাই ২০২০ ২৩:১৫

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:১৪

ছবিঃ লেখক রাজন নন্দী

 

বছরের এই সময়টা হিল চাদিগাঙের হিলিংয়ের সময়। 

আপাত দৃষ্টিতে মোটেলের গেষ্ট বলতে এই দু’জনই। টুরিষ্ট মৌসুম প্রায় শেষের দিকে। ভীরবাট্টা কমে আসছে। সামনের কয়েক সপ্তাহে হয়ত আরও কমবে। এরা কি সেজন্যই বেছে নিয়েছেন এই অসময়? 

রাঙ্গামাটি শহরটাকে প্রায় ঘিরে আছে কাপ্তাই লেকের নয়ণাভিরাম বিস্তার।তারই টানে সৌন্দর্যপিয়াসীরা এসে ভীর করেন এই শহরে। লেকের ধার ধরে গজিয়ে উঠেছে হোটেল, মোটেল। মৌসুম এলে সেসব ভরে যায় নানা রংয়ের, ভাষার মানুষে। মাছভাজার খিদেজাগাণীয়া গন্ধে মাত হয়ে থাকে রেস্তোরাগুলোও। 

মাছ এখানে সহজবধ্য। প্রকৃতিও। একটু চোখ মেলে চাইলেই দেখা যায়। অকালে চুলহারানো তরুণের মত বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আধন্যাড়া সব পাহাড়। বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় করাতের যান্ত্রিক উল্লাস। আর তাতে চাপা পড়ে থাকা শতবর্ষী গাছেদের মৃত্যুর বিলাপ। 

এসময় খানিকটা নিরিবিলি পাবেন ভেবেই হুট করে চলে আসা নিয়াজের। আর স্নেহকুমার? ওঁরও কি তাই? হয়ত! দুই ভিন্ন প্রজন্মের, একেবারেই ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দু’জন মানুষ। এদের ভ্রমণের উদ্দেশ্যও বোধ করি ভিন্নই। হোটেলের লবিতে প্রথম দেখায় তাদের কথাবার্তাও তাইভদ্রতাসূচক হাসি আর মাথা নাড়ানোতেই সীমাবদ্ধ রইল।

চেক ইন করে দোতালার রূমে গিয়েই প্রথমে হেডফোন খুলে রাখলেন নিয়াজ ইমতিয়াজ। তারপর কাপড়-জামা ছেড়ে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন শাওয়ারের নীচে। 

বিহার শেষে, সদ্যলব্ধ মুগ্ধতা ক্যামেরায় পুরে সৌন্দশিকারী মানুষ একদিন ফিরে যান। পেছনে পড়ে থাকে মৃত মাছের কংকাল, চিপসের প্যাকেট, আর তোবড়ানো বেভারেজের বোতল। আর মোটেলের ঘরগুলো? চাদর আর জানালার পর্দা পালটে নতুন অতিথিদের স্বাগত জানায় ঠিকই। কিন্তু ঘরগুলো থেকে শহুরে মানুষের ধাতব গন্ধ, ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কের এক আধটা টুকরো কিংবা নতুন কোন প্রেমের রোমাঞ্চ একেবারে তো আর মিলিয়ে যায় না। 

মোটেলের ঘরে ঢুকেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন স্নেহকুমার। যেন কান পেতে শুনতে চাইলেন সময়ের ফিসফাস। তারপর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। সেখান থেকে বাতাসে এলোমেলো উড়তে থাকা গোলাপী ফেসিয়াল ট্যিসুগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন স্নেহকুমার চাকমা। 

সকালের খাবারটা সাধারণত মোটেলেই খান নিয়াজ। এর আগের ক’বারও তাই করেছেন। এদের ইংলিশ ব্রেকফাস্টটা ভাল। কফিতেও দম আছে। নিয়াজ ভাবলেন, আজ একটু সময় নিয়ে নাস্তা করবেন। কফি খেতে খেতে পত্রিকার পাতা উল্টাবেন। তারপরে সঙ্গে আনা ফ্লাস্কে আরও গোটা তিন কাপ ব্ল্যাক কফি ভরে বেরিয়ে পরবেন। হেটে বাজারের দিকে যেতে পারেন। সেখান থেকে একটা স্কুটার নিয়ে বা হেটে কোন একটা গ্রামের দিকে যেতে পারেন। কিংবা চাইলে একটা নৌকায় চেপে লেকের নিরিবিলি কোন জায়গায় গিয়ে পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখবেন।

ভাবনার এই পর্যায়ে এসে নিয়াজ বিরক্ত বোধ করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না! ইদানীং এটা হচ্ছে। এই যে হুট করে কাওকে কিছু না জানিয়ে এখানে চলে এলেন; এটাও তার জন্য নতুন। তবে কি তিনি বাস্তবতা থেকে পালিয়ে থাকতে চাইছেন? তুলির কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে চাইছেন? এসব ভাবতে ভাবতেই নীচে নেমে এলেন নিয়াজ।

নীচে তখন একজন লোকই। মাথা নীচু করে বসে খাচ্ছেন। ‘একেই তো কালকে দেখেছিলাম চেক ইন করতে’, ভাবলেন নিয়াজ। গিয়ে বসলেন পাশের টবিলে। খাবারের অর্ডার দিতে দিতে বেয়ারাকে বললেন একটা পেপার দিয়ে যেতে। শুনে পাশের টেবিলের ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু মনে না করলে আপনি আমার কাগজটা নিতে পারেন। আমার পড়া হয়ে গেছে’। 

নিয়াজ তাকালেন ভদ্রলোকের দিকে। বয়স বোঝা যায় না। বেশ শক্ত শরীর। চেহারায় বেশ একটা আভিজাত্য আছে। স্থানীয় উপজাতীয়দের মতই দেখতে। তবে স্থানীয়দের বাংলায় সাধারণত যে টানটা থাকে সেটা এর উচ্চারণে অনুপস্থিত। কৌতুহলী হয়ে উঠলেন নিয়াজ। পেপারটা নিতে নিতে জানতে চাইলেন, ইজ ইট বিজনেস অর প্লেজার?

‘কোনটাই না’। মৃদু হেসে বললেন ভদ্রলোক। তারপর জানতে চাইলেন, ‘আপনার’?

‘প্লেজার, একদম নির্ভেজাল প্লেজার’, বলে হেসে উঠলেন নিয়াজ। তারপর বললেন, বাই দ্য ওয়ে, আমি নিয়াজ, ঢাকা থেকে। 

‘স্নেহকুমার, আমি একজন উদ্বাস্তু - আ ডেভলপমেন্ট রিফিউজি’।

স্নেহকুমারের এই কথায় নিয়াজ খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। কিছুক্ষন কিছুই বলতে পারল না। তারপর খুব ধীরে ধীরে বলল, আপনার আপত্তি না থাকলে, আমি কি আপনার টেবিলে এসে বসতে পারি?

‘অবশ্যই! দেশের সেরা ইংরেজি কাগজের সম্পাদকের সাথে টেবিল শেয়ার করব! সে তো ভাগ্যের ব্যাপার’। 

এবারে রীতিমত অবাক হলেন নিয়াজ। তাই বোকার মতই বলে বসলেন, ‘আপনি আমাকে চেনেন?’

‘নাহ্! তবে আপনার নাম জানতাম। আপনার লেখা পড়েছি; ছবিওদেখেছি। তাই চেক ইনের সময় দেখেই চিনে ফেললাম। অবশ্য এটাকে যদি চেনা বলেন ..’

স্নেহকুমারের কথা শেষ হবার আগেই নিয়াজের খাবার চলে এল। বেয়ারা খাবার রেখে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন দু’জনেই। 

তারপরে নিয়াজই শুরু করলেন, ‘আর দেখুন আমি কিন্তু আপনার সম্পর্কে এখনও কিছুই জানি না। বলছিলেন, আপনি একজন ডেভলপমেন্ট রিফউ..’

‘ওই যে দেখছেন’ নিয়াজ শেষ করার আগেই বলে উঠলেন স্নেহকুমার। একই সঙ্গে আঙ্গুল তুলে দেখালেন লেকের দিকটাতে। সেদিকে, বেশ দূরে, খানিকটা সবুজ ভেসে রয়েছে জলের উপরে। উড়ছে কিছু জলজ পাখী। 

‘ওটা একটা টিলা, ওর ঠিক ডানপাশে পানির তলে ডুবে আছে ‘ঝগড়াবিল আদাম’ - আমার গ্রাম। আজও চোখ বন্ধ করলেই, আমি ফিরে যেতে পারি আমার গ্রামে’। 

‘ঝগড়াবিল আদাম! বেশ মজার নাম তো?’

‘হ্যাঁ, নামের পেছনের গল্পটাও মজার। শুনবেন?

‘অবশ্যই’ বেশ আগ্রহ নিয়েই বললেন নিয়াজ।

‘একটা বেশ বড়সর বিল ছিল আমাদের আদামের পাশেই। বিল ভর্তি ছিল মাছে। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে লোকজন সব আসত মাছ ধরতে।সেই মাছ ধরা নিয়ে লেগে থাকত ঝগড়া। ধীরে ধীরে বিলের নামই হয়ে গেল ঝগড়াবিল। আর বিলকে ঘিরে গড়ে উঠা গ্রামটি হয়ে গেল ঝগড়াবিলআদাম’। বলে হেসে উঠলেন স্নেহকুমার।

হাসলেন নিয়াজও। ক্রমশ দু’জনের ভেতর এক অনুচ্চারিত সখ্য গড়ে উঠল। সত্যি বলতে কি স্নেহকুমারের ব্যাক্তিত্ব নিয়াজকে টানছিল। নিয়াজের নাস্তা শেষ হতেই তারা উঠে দাঁড়ালেন। হাটতে শুরু করলেন তবলছড়ি বাজারের দিকে। স্নেহকুমারের হাতে একটা বেশ বড়সর ব্যাগ।নিয়াজ একবার ভাবলেন, জিজ্ঞেষ করবেন যে এত বড় ব্যাগ নিয়ে কেন হাটতে বের হয়েছেন। তারপর কি ভেবে যেন চেপে গেলেন।

বাজারে পৌঁছে স্নেহকুমার বললেন, ‘জানেন, কাপ্তাই বাঁধের আগে এই বাজার আর আমাদের গ্রাম ছিল একই মৌজায়। যাবেন আমার গ্রামে?

‘মানে! আই মিন হাউ?’

‘নৌকায়’। বলেই, আবার সেই মৃদু হাসি খেলে গেল স্নেহকুমারের মুখে।

‘চলুন তবে, আমিও ভাবছিলাম একটা নৌকা নিয়ে লেকের কোথাও নিরিবিলিতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখব’। বলেই হো হো করে হেসে উঠল নিয়াজ।

‘কি আশ্চর্য’! বলতে বলতে হাসিতে যোগ দিলেন স্নেহকুমারও। তারপর বলে চললেন, ‘জানেন, আমিও ওখানে গিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা নৌকায় শুয়ে থাকি। বিশেষ করে রাতে। কপ্তাই আমার গ্রামের মাটি গিলে খেয়েছে ঠিকই। কিন্ত আকাশটাকে খেতে পারেনি। ওটা এখনও ঝগড়াবিলের আকাশ।’

স্নেহকুমারের কন্ঠে মিশে থাকা বিষাদ ছুয়ে গেল নিয়াজকেও। এই বিষাদ যে ওর পূর্ব পরিচিত! খুব পরিচিত। ওর বাবার কন্ঠেও এই একই বিষাদের বিলাপ শুনে বড় হয়েছে নিয়াজ। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ে নিজের শরীরটাকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এলেও অস্তিত্বকে যেন আসামেই ফেলে এসেছিলেন তিনি। ঝগড়াবিলের জন্য স্নেহকুমারের এই হাহাকার আর একজন এজাজ ইমতিয়াজের আমৃত্যু যন্ত্রনা মিলেমিশে এক হয়ে যায় নিয়াজের করোটিতে। সে ভাবে, পৃথিবীর সব উদ্বাস্তুর যন্ত্রনার ভাষাই কি তবে এক?

 

অফ সিজনের নৌকার ঘাট। তরপরেও নানা সাইজের গোটা বিশেক নৌকা সেখানে। সেখানে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হল নিয়াজের। প্রথমে সব স্বাভাবিকই ছিল। ওদের দেখেই হাকডাক শুরু হয়ে গেল। গুলিস্তানে বাসের হেল্পারদের যেমন ডাকতে শোনা যায়। নিয়াজ ভাবলেন সবাই হয়ত চাইছে যে ওরা তার নৌকাটাই নিক। কিন্ত অল্প সময়ের ভেতরই ওর ভুল ভাঙ্গল। হাকডাক আসলে ওর সহযাত্রীর উদ্দেশ্যে! একটু খেয়াল করেতই নিয়াজ বুঝলেন, নাহ্! ঠিক হাকডাক না। একধরনের সম্ভ্রম সেই ডাকে। তাদের চোখে মুখেও। যেন হঠাৎই রাজাকে কাছে পেয়ে তাকে ঘিরে স্তুতি করছে মুদ্ধ জনতা। নিয়াজের মনে পড়ল, একইরকমের সম্ভ্রম ছিল মোটেলের বেয়ারার চোখে; বাজারের পথে দেখা স্থানীয়দের চোখেও। কে এই স্নেহকুমার? 

ওদিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একেবারে খেয়াঘাটের কোনায় দাঁড়িয়েছেন স্নেহকুমার। তাকে ঘিরে এসে দাঁড়ালো নৌকার মাঝিরা। এমনকি ইজারাদারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল আরও কিছু  লোক। একজন মাঝি এক কিশোর ছেলেকে দেখিয়ে কি যেন বলল স্নেহকুমারকে। ছেলেটি সটাং শুয়ে পড়ে প্রণাম করল তাঁকে। তারপর উঠে দৌঁড়ে গিয়ে উঠল একটা নৌকায়। দক্ষহাতে সেটাকে এনে ভিড়ালো একদম স্নেহকুমারের পায়ের কাছে। পেছনে ফিরে নিয়াজকে নৌকায় বসার ইঙ্গিত করলেন স্নেহ। নিয়াজ বুঝলেন, এই কিশোরটিই মনোনীত হয়েছে ওদের অভিযানের জন্য। দু’জনেই নৌকায় উঠে বসলেন। জানা গেল মাঝিটির নাম কালিন্দী চাঙমা। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল রাঙ্গামাটি শহর। জলজ হাসের মত সহজাত দক্ষতায় নৌকাটি ভেসে চলল ইতিহাসের দিকে।

নৌকায় বসে স্নেহকুমার জানতে চাইলেন, তিনি যদি খানিকটা সময় ওপাড়ের গ্রামগুলোতে কাটান তবে নিয়াজের কোন আপত্তি আছে কিনা? নিয়াজ মাথা নেড়ে জানাল যে তার কোন আপত্তি নেই। নৌকা চলতে থাকল। আর কোন কথা হল না ওদের ভেতর। ওপাড়ে যে গ্রামটিতে গিয়ে ভিড়ল ওদের নৌকা সেটার নাম গর্বা।

হ্রদ সংলগ্ন অন্যান্য গ্রামের মতই গর্বায় ঢোকার মুখেই একটু বাজার মতন। পাশেই একটা বেশ গোছানো হোটেল কাম রেস্তোরা। সেটাকে পাশ কাটিয়ে ওদের তিনজনের দলটি হেটে চলল গ্রামের ভেতরের দিকে। স্থানীয়দেরকে নমস্কারের ভঙ্গিতে স্বাগত জানাতে দেখে এবার অর অবাক হল না নিয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখলেন অনেকেই তাদের অনুসরন করছে। সেটা দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলেন নিয়াজ। আচ্ছা, স্নেহকুমার কোন আদীবাসী গোপন সংগঠনের নেতা কি? হতেও তো পারে। এটা ভেবে একটু ঘাবড়েও গেলেন নিয়াজ। কিডন্যাপের ঘটনা ইদানীং কমে এলেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। কিন্তু এখন যে আর পেছনে ফেরার উপায় নেই! স্নেহকুমারের পেছন পেছন মিছিলটি এগিয়ে চলল গ্রামের ভেতরের দিকে। 

তারা গিয়ে থামলেন একটা বেশ বড় বাড়ির উঠোনে। এক নেতৃত্বস্থানীয় লোক এগিয়ে এসে স্বাগত জানাল তাদের। তারপর তাদের নিয়ে গিয়ে বসাল ইজরে (বাড়ির সামনে খোলা মাচাং)। সামনে তখন প্রায় গোটা গ্রাম। নিয়াজ বুঝলেন, এটি একটি পূর্ব নির্ধারিত সভা। তাকে এভাবে ছেলে ভোলানোর মত করে নিয়ে আসার জন্য নিয়াজের রাগ হইয়া উচিৎ। পাহাড়ী-বাঙ্গালীদের সাম্প্রতিক সময়ের সম্পর্ক মনে করে তার দুশ্চিন্তা হওয়া উচিৎ। কিন্ত এসবের কোনটাই হচ্ছে না নিয়াজের। নিজের অজান্তেই পর্যটকের ঢিলেঢালা ভাব ঝেড়ে ফেলে সাংবাদিক হয়ে উঠলেন নিয়াজ। তার অভিজ্ঞতা বলছে একটা কোন গল্প আছে স্নেহকুমারকে ঘিরে। আর সেটা তাকে জানতেই হবে।

 

স্নেহকুমার উঠে দাঁড়াতেই নিমিষে চুপ হয়ে গেল সামনের শ’খানেক মানুষ। গলা এটুও উঁচু না করে তিনি বললেন, ‘জু জু’। জনতাও সমস্বরে বলল ‘জু জু’। স্নেহকুমার চাকমা বলে চললেন, ‘ও আমার নিজের মানুষেরা, ও আমার হারিয়ে ফেলা মাটির উত্তরাধিকারগণ তোমাদের আমার প্রণাম। প্রতি বছরের মতই আমি ফিরে এসেছি। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বড় পরিঙীদের সন্দেশ নিয়ে ফিরে এসেছি। তোমাদের জন্য আজ আমি কেবল চিঠি আর সংবাদই নিয়ে আসিনি। একজন গরবাকেও (অতিথি) নিয়ে এসেছি। তিনি একটি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকের (বলে, আমার পত্রিকাটির নাম করলেন) কাবিদ্যাঙ্ (সম্পাদক)’। শুনে জনতা আবার বলে উঠল ‘নমষ্কার’। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে প্রতি উত্তর করলাম। 

স্নেহকুমার বলে চললেন, প্রতিবছরের মতই কাপ্তাইয়ের জলে তলিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর প্রতিনিধিরা এসে জড়ো হয়েছেন দেখে ভাল লাগছে। তোমাদের কাছে এলে আমি সেই তলিয়ে যাওয়া মাটির গন্ধ পাই। সেই গন্ধ আমি হৃদয়ে ভরে নিয়ে যাই বড় পরঙীদের জন্য। তোমরা সবাই ভাল আছোতো? এস দেখি তোমাদের জন্য কি কি আছে আমার ঝোলায়।’

এরপর স্নেহকুমার তার ব্যাগ থেকে একে একে বের করতে লাগলেন চিঠি, কাপড়ের পোটলা, ছোট বাক্স ইত্যাদি। একটি করে জিনিষ বের করে নাম ধরে ডাকেন, সেই নামের বা তার কোন প্রতিনিধি এগিয়ে এসে সেটা নিয়ে যান। অনেকের চোখেই জল। কেউ কেউ হাসছেন। কেউ কেউ চিঠি বা পোটলা হাতে নিয়ে জড়িয়ে ধরছেন। কেউবা বুক ভরে গন্ধ নিচ্ছেন সেগুলোর। যেন দূরে থাকা, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের গন্ধ যতটা পারা যায় টেনে নিচ্ছেন বুকের ভেতরে। এখান থেকে এই গন্ধ, স্বপ্ন, খবর এরা বয়ে নি যাবেন অরণ্যের আরও গহীনে। আরও অনেক পাহাড়ের ওপাড়ে যার যার গ্রামে।

চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এ দৃশ্যে হতভম্ব হয়ে গেলেন নিয়াজ। এ যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা এক সান্তাক্রজ। একটু আগেই স্নেহকুমারকে একজন গোপন সংগঠনের নেতা ভেবেছিল বলে, লজ্জিত বোধ করলেন নিয়াজ। তারপর সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে, এগিয়ে গিয়ে হাত লাগালেন স্নেহকুমারের চিঠি বাটার কাজে। নিয়াজ ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনেন একেকটা জিনিষ। স্নেহকুমার সেটাতে লেখা নাম ধরে ডেকে তুলে দিতে লাগলেন প্রাপকদের হাতে। ভেতরে ভেতরে ছেলেমানুষী আনন্দ হল নিয়াজের। এ আনন্দের তুলনা কেবল চলে ঈদে নতুন জামা আনন্দের সাথে। স্কুল থেকে ফিরে জড়িয়ে ধরার পরে মায়ের গায়ের গন্ধের সাথে।

নিয়াজ এরই মধ্যে জেনে গেছেন যে এটা এ গ্রামের হেডম্যানের বড়ি। দুপুরের খাবারের আয়োজনও এখানে। সাদা ভাতের সাথে পাজন (সবজি আর শুঁটকির পদ), হলা (মাছের পদ), হরু গোরাম (বাম্বু চিকেন), গুদেয়ি (ভর্তা) আর হরবু (সালাদ)। খাবার পরে সেখানেই কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন তারা। সেখানেই প্রথম বড় পরঙের কথা জানলেন নিয়াজ। এ যেন সাতচল্লিশের চাঙমা পরব। স্নেহকুমারকে তার মনে হতে লাগল আসামকে বুকে নিয়ে মরে যাওয়া এজাজ ইমতিয়াজ।

সেই পাকিস্তান আমলে, স্থানীয়দের মতামত বা তাদের যথাযথ পূণর্বাসনের কোন ব্যবস্থা না নিয়েই কর্ণফূলী নদীতে বাঁধ তৈরী শুরু করে সরকার। বাঁধ নির্মাণের কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু হয় গাছ কাটা। যাতে পানি আসার পর নৌকা চলতে কোন অসুবিধা না হয়। ১৯৬৩ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে পানি বাড়তে শুরু করে। তলিয়ে যায় চাষযোগ্য সব সমতল ভূমি। মানুষের ঘরবাড়ি, বৌদ্ধ মন্দির, এমনকি চাকমা রাজার বাড়িও তলিয়ে যায়। রক্ষা পায়নি প্রকৃতি আর পশুপাখিও। বাস্তচ্যূত হয়েছিল প্রায় একলক্ষ মানুষ। বাঁধ নির্মাণের আগে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার চাকমাদের প্রতিশ্রতি দিয়েছিল যে বাঁধের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে তা দিয়ে তাদের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই হয়নি। সেদিনের সেই সব হারানো মানুষদের একটা বড় অংশ মূলত বাধ্য হয়েছিল দেশান্তরীত হতে। প্রথমে ভারতের মিজোরামে, পরে হিমাচলের নেফায়। চাকমা ভাষায় এই দেশান্তরের নামই বড় পরঙ। নিয়াজ এসবের কিছুই প্রায় জানতেন না। মানবাধিকার নিয়ে গলা ফাটানো তার শহুরে অহম মাথা নোয়ালো হিমাচল থেকে আসা এক বড় পরঙীর কাছে।

বিকেল হতে না হতেই তারা বেরিয়ে পড়লেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। নৌকা তখন কর্ণফুলী থেকে বেরিয়ে কাপ্তাই হ্রদে পড়েছে। নিয়াজ হঠাৎ জানতে চাইল, ‘কিছু মনে করবেন না; মানে এই ২০১১ তে কেবল চিঠি দিতে নিশ্চয়ই আপনি আসেন না এতদূরে? এটাই কি আপনার আসার একমাত্র কারন?’

‘না’। এক কথায় জবাব দিলেন স্নেহকুমার। 

‘তাহলে’?

কিছুক্ষণ কোন কথা বললেন না স্নেহকুমার। তারপর যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে এমন গলায় বলে উঠলেন, ‘রাঙ্গাচুলির জন্য’।

‘রাঙ্গাচুলি’?

‘আমার বয়স তখন আঠার। রাঙ্গাচুলি সবে ষোল পেড়িয়েছে। আমাদের বিয়ের কথা সব ঠিক তখন। এরই ভেতর গ্রামে পানি চলে এল। গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। সেই অনুভূতি আসলে বলে বুঝানো যাবেনা। আর আপনার শুনতেও ভাল লাগবে না’।

‘না না আপনি বলুন। আমি শুনতে চাই’। প্রায় ছেলেমানুষি অগ্রহ ঝড়ে পড়ল নিয়াজের অনুরোধে।

একটু সময় নিলেন স্নেহকুমার। যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখছেন এমন ত্রস্ততায় বলে চললেন, ‘চারিদিকে তখন কেবল সব হারানোর হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস আর অবিশ্বাস। শুধু মানুষের কান্না না। পশু পাখির করুণ ডাকও মিশে গেল মানুষের কান্না আর হাহাকারের সাথে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল অমংগলের চিহ্ন। গভীর রাতে করুণ স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যেত ঘর হারানো পাখির ঝাঁক। আমরাও ভাসলাম একদিন। দল বেঁধে গিয়ে উঠলাম কাচালং ফরেষ্টে। ওটাই আমাদের নতুন আাদাম। বন কেটে নতুন গ্রাম তৈরীর কাজে মন দিলাম সবাই। কিন্তু এ কেমন আদাম? বন এত ঘন যে সূর্যের আলো ঢুকে না। কত মানুষ যে মরল। কেউ গেল বাঘের পেটে, কেউ বা সাপের কামরে।রোগে ভুগেও মরল অনেক। এরই ভেতর আমার আর রাঙ্গাচুলির বিয়ে হয়ে গেল’। 

‘তারপর!’

‘তারপর এল ৬৪’র সেই দাঙ্গা। হিল চাদিগাঙ্গের ইতিহাসে সেই প্রথম। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু জায়গা বিশেষ করে নতুন বসতি এলাকা মারিশ্যায় আদিবাসী পরিবারগুলো দাঙ্গার স্বীকার হল। মেয়েদের শ্লীলতাহানি হয়। এক দিকে উদ্বাস্তু হয়ে আমরা তখন দিশেহারা। পুনর্বাসন তো দূরের কথা জমিজমা এবং ঘরবাড়িরও ক্ষতিপূরণ পাইনি। তার উপর মেয়েদের উপর সেই জঘন্য অত্যাচার। প্রশাসনও একরকম মুখ ফিরিয়ে রইল। পাকিস্তানে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। হাজার হাজার চাঙমা ভারতে চলে যাওয়া শুরু করল। একদিন আমরাও যোগ দিলাম সেই বড় পরঙে। আর সেই অগ্যস্ত যাত্রার সময়ই আমি হারিয়ে ফেললাম আমার রাঙ্গাচুলিকে’।

‘হারিয়ে ফেললেন? মানে, কিভাবে?’

‘ভারতে যাবার পথে আমাদের উপর হামলা হয়। আমাদের গ্রামের আরও কয়েকজন মেয়ের সাথে রাঙ্গাচুলিকেও তুলে নিয়ে যায় হামলাকারীরা…

নিয়াজ আর কিছু শুনতে পায় না। সে রাঙ্গাচুলিকে দেখতে পায়। দেখতে পায় কারা যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। আর রাঙ্গাচুলিকে ক্রমাগত ডেকে চলেছে এজাজ! এজাজ! কিন্তু তা কি করে সম্ভব? রাঙ্গাচুলি কেন ওর বাবাকে ডাকবে? তবে কি সে আসলে দেখছে তার সেই অদেখা বড় ফুপি’কে? আসাম থেকে পূর্ববাংলায় পালিয়ে আসার সময় নিয়াজের বাবা যাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন চিরতরে। বড় হয়েও নিয়াজ তার বাবাকে দেখেছে ঘুম থেকে আপি আপি বলে চিৎকার করে জেগে উঠতে। সেই দমবন্ধ করা আতংকের উত্তরাধিকার কি তবে বর্তেছে নিয়াজের চেতনাতেও? তার মাথার ভেতরে সেই অদেখা ফুপি’কেই কি রাঙ্গাচুলি হয়ে উঠতে দেখছে আজ?  

ওদিকে স্নেহকুমার বলে চলেছেন, ‘সেদিন আমি আমার রাঙ্গাচুলিকে রক্ষা করতে পারিনি। আমি সহ অনেকেই আহত হয়েছিল। ভারতে পৌঁছানোর পরেই মারা গিয়েছেলন আমার বাবা। এরপর একসময় আমাদের হিমাচলে পাঠিয়ে দেয় ভারত সরকার। কিন্তু আমি একদিনের জন্যও ভুলতে পারিনি রাঙ্গাচুলিকে। প্রায় নয় বছর পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমি প্রথম বাংলাদেশে ফিরে আসি। আমার রাঙ্গাচুলির কোন হদিশ করতে পরিনি। কিন্ত খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক রাঙ্গাচুলিকে। 

স্নেহকুমারকে যেন কথায় পেয়েছে। চকিতে একবার চাইলেন নিয়াজের দিকে। তারপর আবার বলে চললেন, যারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাকে পেয়ে তারা তাদের আপনজনদের কথা জানতে চাইল। সবাইকে তো আর আমি চিনতাম না। যাদের চিনতাম তাদের কথা বললাম। আরও অনেকের কথা বয়ে নিয়ে গেলাম হিমাচলে। বছর দু’য়েক পরে হিমাচল থেকে তারাই আমাকে পাঠাল আবার। দেশে থেকে যাওয়া আত্মীয়দের সাথে ধীরে ধীরে যোগাযোগ তৈরী হল অনেকের। আর এই আসা যাওয়ায় আমি জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেলাম’। 

এ পর্যন্ত বলে একটু থামলেন স্নেহকুমার। যেন সামলে নিলেন নিজের আবেগ।

নোকা চলছে। দূরে রাঙ্গামাটি শহরের আলো। স্নেহকুমার হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘নৌকা থামাও কালিন্দী।’ তারপর তিনি শুয়ে পড়লেন নৌকার পাটাতনের উপর। তার দেখাদেখি নিয়াজও। ধীরে ধীরে নৌকা থামল। স্নেহকুমার কালিন্দীকে আরও খানিকটা ডানে সরিয়ে নিতে বললেন। যেন তারা দেখে জাহাজের দিক স্থির করছেন কোন প্রাচীন নাবিক। এক সময় নৌকাটা তার দেখানো জায়গায় এল। চারপাশে কেবল জলের সাথে জলের খেলার শব্দ। সেই শব্দের তালে তাদের নৌকাও মৃদু দুলতে থাকল।বেশ খানিকক্ষণ তারা কেউ কোন কথা বললেন না। নিয়াজ বুঝলেন। ওদের উপরের আকাশটা আসলে একটা জাদু আয়না। সেখানে বিম্বিত হচ্ছে ঝগড়াবিল নামের এক চাঙমা গ্রামের কোন এক সন্ধ্যা। কিংবা বিলের ধারে মাছ ধরতে আসা একদল চাঙমা গ্রামবাসীর ঝগড়ার দৃশ্য। 

নিরবতা ভাঙ্গলেন স্নেহকুমারই। ধীরে ধীরে বললেন, আপনার পত্রিকায় সেদিন ‘আপার্টহাইট নিয়ে লেখাটা পড়লাম। বর্ণবাদ নিয়ে এমন খোলামেলা লেখা তেমন একটা পড়িনি’। 

নিজের পত্রিকার প্রশংসায় খানিকটা খুশী হয়েই নিয়াজ বলল, ‘কালো মানুষদের অধিকার আদায়ের লড়াই তো আসলে শেষ হয়নি। দেখুন না আমেরিকাতে। প্রায় প্রতিদিনই বর্ণবাদের শীকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে আফ্রিকান-আমেরিকানরা, হিস্পানিকরা। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব’।

আকাশ থেকে চোখ না সরিয়েই, স্বভাবসুলভ মৃদুগলায় স্নেহকুমার বললেন, ‘নিয়াজ, ঠিক কতটা কালো হলে আপনারা চাকমাদের কথাও লিখবেন?



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top