সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

প্রেমের অন্ধকার : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৩০ জুলাই ২০২০ ০২:২১

আপডেট:
৩০ জুলাই ২০২০ ০২:৩৯

 

করোনা ভাইরাসের দিনগুলোতে ঘরে থাকার নির্দেশ পেয়ে বিথিকা ভেবেছিল সময়টা বুঝি গৃহবন্ধীর জীবনযাপন হয়ে গেল। কিন্তু গত সাতদিন একটানা ঘরে থাকার পর নিজের ভেতরে নতুন অনুভব শুরু হয় বিথিকার। ও বিরূপ কোনো চিন্তা করতে পারে না। তবে, নিজেকে কোভিড মহামারী থেকে নিরাপদ রাখার এই প্রক্রিয়াকে তো মেনে নেয়া উচিত। না মেনে উপেক্ষা করলে যদি অসুস্থ হতে হয় তাহলে লাভ কি? বিথিকা নিজেকে সংযত করে। ভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এই সময়ের আগে পর্যন্ত অনেক ঘুরে বেড়িয়ে সময় কেটেছে। তারজন্য মনে দুঃখ থাকার সুযোগ নেই। বরং এই অন্যরকমের জীবন কাটানো মেনে নেয়া দরকার। বিথিকা ঘরের ভেতর সারাদিন ঘোরাফেরা করে ভাবে এই অন্যরকম জীবনযাপনও আনন্দের। এক অদৃশ্য ভাইরাস এই জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্ব জুড়ে মানুষ এই অদৃশ্য জীবানুর কাছে নতিস্বীকার করে ঘরবন্দি হয়েছে।

মৃদু হাসিতে বিথিকা নিজেকে স্বস্তির ঘোরে ডুবিয়ে রাখে। ভাবে, যা হচ্ছে হোক। অসুখ থেকে নিরাপদে রাখার একটি সাময়কি ব্যবস্থা। এই নতুন সময় দেখা নিজের জন্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ভবিষ্যতে বাচ্চাদের এই গল্প বলবে। নিজেদের সুরক্ষার জন্য ঘরে আটকে থাকতে হয়েছিল। এটা কোনোভাবেই বন্দীজীবন নয়। বন্দীজীবনকে কাজে লাগানোর নানা উপায় আছে। বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে দিয়ে পানি পড়ার শব্দের সঙ্গে খিলখিলিয়ে হাসে ও। যেন হাসির শব্দ কেউ শুনতে না পায়। বাড়িতে সবাইতো মনমরা হয়ে আছে। কারো মুখে হাসি নেই। বেশি মন খারাপ বাবার। বাইরে বেরুতে না পারার মধ্যে বন্দীজীবনের বাতাস আছে। সেই বাতাসে শ্বাস টানা যায় না। বাবা অনবরত সেই কথা বলে ঘড়ঘড় শব্দে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে। বাবা প্রায়ই বলে, সরকারের কি দায় পড়েছে যে মানুষকে ঘরে আটকে রেখে সুস্থ রাখতে হবে? যারা মরার তারা মরুক না? মানুষের মরণের দায় সরকার নেবে কেন?

- আব্বা আপনি এসব কি কথা বলেন? এটাতো মানুষের কথা না।

মেয়েকে ধম দেয় খয়রুদ্দিন।

- কেন মানুষের কথা না? তাহলে জানোয়ারের কথা?

- না, আব্বা এটা জানোয়ারের কথাও না। জানোয়ার তার চারপাশের জানোয়ার মরতে দেখলে এমন কথা বলবে না।

- খবরদার।

খয়রুদ্দিন রেগে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। বিথিকা দৌড় দিয়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। শুনতে পায় ওর বাবা দরজায় গায়ে ঠাসঠাস শব্দ করছে। চিৎকার করে ওকে বকাবকি করছে। বলছে, তোর এত সাহস! তুই আমাকে জানোয়ার বলিস!

বিথিকা ভয় পায় না। কথা বলেনা। মৃদু হাসি মুখে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুকান ভরে শোনে দরজা পেটানোর শব্দ। কোনোদিন বাবাকে এই চেহারায় দেখেনি। মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করলেও বাবা এভাবে ক্ষিপ্ত হয় না। ঘরে বন্দি থেকে এখন সে অন্য মানুষ। বিড়বিড় করে নিজেকে বলে, দুনিয়া জোড়া এই মহামারী কি সব মানুষকে এমন ক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে? ঘরকে ভালোবাসার জায়গা বলে মানতে পারনে না? মেয়েকে হাতের কাছে পেলে ধরে পেটাবে। একটু পর দরজায় পেটানোর শব্দ থেমে যায়। ও ভাবে, সারা দেশে যা হবার হোক। এই নতুন সময় দেখা আমার জন্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা। আমাদের নতুন যুদ্ধ। জীবনকে মহীয়ান করার যুদ্ধ। এই নতুন সময় দেখা আমার জন্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ভবিষ্যতে আমার বাচ্চাদের এই গল্প বলব। ওর মৃদু হাসিতে খিলখিল শব্দ হয়। ওর হাসি সামলে নিয়ে দরজা খুলে এক দৌড়ে বাবার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে বসে।

- আমাকে মাফ করে দেন আব্বা।

খয়রুদ্দিন ওর মাথায় ঠেলা দিয়ে বলে, যা, নিজের ঘরে যা।

বিথিকা উপুড় হয়ে বাবাকে সালাম করে। তারপর পায়ে চুমু দেয়। কয়েকবার চুমু দিয়ে উঠে চলে যায়। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গলির রাস্তাটা একদম জনশূণ্য। পয়ে হাঁটা মানুষ নেই। রিকশাও নেই। প্রকল শূণ্যতায় বুক হাহাকার করে। এ দেশ আমার নয়। এ দেশে জনেজনে মানুষ হাঁটে। ভীড়ে যানজট হয়। এটাই শহরের প্রকৃত চিত্র। বিথিকা দুহাতে চোখ মুছে রান্নাঘরে মায়ের কাছে যায়। মা আর ও একমাসে বাড়ির বাইরে যায়নি। বাবাকে যেতে হয় বাজার করার জন্য। তার অফিস বন্ধ। ছোট চাকরির মানুষ। বেতন কম। মনমেজাজ ভালো থাকেনা। বড় ভাই নিসার বিয়ে করার পর অন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে আলাদা থাকে।

বিথিকাকে আলাদা ডেকে বলেছে, আমার বউকে বাবার এই চেহারা দেখাতে চাইনা। রোজিনাকে দেখেছিসতো, ও খুব শান্ত মেয়ে।

- কিন্তু বাবা তোমার এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেনি। মন-মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে। সারাক্ষণই বলে, এক শহরে বাস করে ছেলে কেন আলাদা থাকবে?

বাড়ির কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেয়না। নিসারের পক্ষে কথা বলে সেটা উল্টো হবে। গালাগাল শুনতে হবে। মা বলে, ছেলে ছেলের মতো থাকুক। আমার কোনো দুঃখ নাই। ও খুশি থাকলে আমিও খুশি। মায়ের এমন কথা শুনলে বিথিকার মাথা ঝিমঝিম করে। ও নিজে কোনো মন্তব্য করে না। ও জানে, একদিন ও নিজেও এই বাড়ি ছাড়বে। সুমন্তর সঙ্গে বিয়ে হলে সুমন্ত কি এখানে এসে থাকবে? প্রশ্নই ওঠে না।

রান্নাঘরে ঢুকে মাকে বলে, আমার কিছু করতে হবে মা?

- এই পেঁয়াজগুলো কাট।

- বিথিকা বটি নিয়ে পেঁয়াজ কাটতে বসে। পেঁয়াজের ঝাঁজে চোখে পানি গড়ায়। সুমন্তর সঙ্গে দুদিন কথা হয়নি এই বোধও পানির বেগ বাড়ায়। মা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, কি রে তুই কারো কথা ভাবছিস?

ও চোখ বড় করে তাকায়। মাকে অন্যরকম মানুষ মনে হয়। মানুষের বোঝার বোধ এ তীক্ষ্ণ হয় কি করে? ও মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়না। মা মৃদু হেসে বলে, বুঝেছি। যা, তুই ঘরে যা।

- আর কাটতে হবে না?

- না, এখন আর লাগবেনা। এতেই হবে। এই পুডিংয়ের বাটিটা তোর বাবাকে দিস।

মা ও দিকে কাঁচের বাটিটটা ঠেলে দেয়।

বিথিকা ঝটপট রান্নাঘর থেকে বেরিয় আসে। ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

- বাবা পুডিং খাও।

- দে, পানি দিস এক গ্লাস। বুকটা কেমন জানি করছে।

- দেখি জ্বর আসেনি তো?

বিথিকা বাবার কপালে হাত দেয়।

- একদম ঠান্ডা। আমি তোমার জন্য একগ্লাস গরম পানি নিয়ে আসি। তুমি গরম পানি খাও।

- না, না গরম পানি লাগবে না। তুই আমাকে ঠান্ডা পানি দে।

বিথিকা বাবাকে পানি এসে দিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে। ঘরবন্দী থেকে বিথিকার দিনগুলো ভিন্নরকম হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ বন্ধ। সুমন্তের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। ফোনে কথা বলে মন ভরে না। সুমন্ত গতকাল ফোন করে বলেছিল, একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে বের হও, আমিও আসব।

- কোথায় যাবে?

- রমনা পার্কে।

- না, অত খোলামেলা জায়গায় যাব না।

- তোমার কি মনে হয় তুমি গৃহবন্দী?

- না, মোটেও না। মনে হয় প্রেমের ভিন্ন সময়ে আছি। এ এক দিকপাশহীন আয়োজন। অদৃশ্যের মাঝে দৃশ্যমান করে তোলা যায় প্রেমিকাকে।

সুমন্ত হা-হা করে হাসতে হাসতে বলে, দারুন বলেছ। ভাষা ব্যবহারে তোমার জুড়ি নেই দেখছি।

- তাই নাকি? কয়জনের প্রেমে পড়েছ যে জুড়ি খুঁজে পাচ্ছ না?

- বাজে কথা বলছ কেন? প্রশংসা করেছি ভালোলাগার মন থেকে। বুঝে গেছি যে আমি তোমার মন থেকে হারিয়ে যাইনি।

- এটা কোনো কথা হলো নাকি? আমি তোমার জীবন থেকে কখনোই হারিয়ে যাব না। মরে গেলে তখন হারাব। তার আগে না।

- মরার কথা বলো না। বিয়ের পরে আমরা একসঙ্গে মারা যাব। তুমি যদি আগে মারা যাও তাহলে আমি সুইসাইড করে তোমার সঙ্গে চলে যাব।

- ওহ, আমরা এসব কি কথা বলছি?

- আমরা প্রেমের কথা বলছি। মৃত্যুর সঙ্গে প্রেমের সূত্র কথা মৃত্যু আর প্রেম জীবনের কাছে শান্তির গোলাপ।

- জানো আমি অনেকদিন ভেবেছি তোমাকে একটি কথা বলব। কিন্তু বলা হয়নি।

- বলো, বলে ফেলো।

- আমি মারা গেলে আমাকে দাফন করার সময় আমার হাতে একটি লাল গোলাপ গুঁজে দেবে। আমি মনে করবো তোমার প্রেমের গোলাপ নিয়ে আমি কবরে যাচ্ছি।

- বাহ্, ভালোইতো। আমি মারা গেলে আমার হাতেও গোলাপ দিও।

- হ্যাঁ, দেব।

- আমরা এসব কি কথা বলছি?

- আমরা প্রেমের কথা বলছি। মৃত্যুর সঙ্গে প্রেমের সূত্রে এসব কথা।

- থাক, আর শুনব না। শুনতে ভয় করছে।

 ফোন রেধে দেয় বিথিকা। ঠিক সেই সময় মায়ের চিৎকার শুনতে পায় ও। ছুটে যায় মায়ের কাছে।

- কি হয়েছে মা?

- তোর বাবার জ্বর এসেছে। সঙ্গে গলা ব্যথা, কাশিও আছে।

বিথিকা আতঙ্কিত হয়ে কাঁদতে শুরু করে। মা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ডাক্তারকে ফোন কর। আগেই কাঁদতে শুরু করলে সে কান্না থামাতে পারে না বিথিকা। হাঁটতে হাঁটতে ঘরের বাইরে চলে আসে। বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ডাক্তারকে ফোন করে। ফোন যে ধরেছে সে বলে, আপনার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমরা পরীক্ষা করব।

মায়ের কাছে গিয়ে একথা বললে মা বলল, তুই গিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে আয় বিথী। আমরা তিনজনই যাব তোর বাবাকে নিয়ে।

- যাচ্ছি।

বিথিকা বাড়ির সামনে গলিতে এসে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে একটা সিএনজি পাওয়া যায়। পাশের বাড়ির আরিফুল জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে তোমরা?

- মা জানে, আমি মাকে জিজ্ঞেস করিনি।

- করোনার সময় বাইরে যাওয়া নিষেধ-

- আমরা তা জানি। তাহলে-

- আমাকে এত কথা জিজ্ঞেস করবেন না চাচা। আমি যাচ্ছি।

সিএনজি হাত ঈশারা করে ওর পেছনে আসতে বলে। নিজে হেঁটে সামনে চলে যায়। গেটের সামনে গিয়ে দেখে মা রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবাকে নিয়ে।

- মাগো আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।

- না, তোর যেতে হবে না। বাড়িতে থাক।

- বাবা, আমি যাব না?

- কালকে যাস। আজকে বাড়িতে থাক।

বিথিকা দুহাতে চোখের পানি মোছে। বাবা ওর মাথায় হাত রেখে বলে, মন খারাপ করিস না মা। আমরাতো ফিরে আসব। তুই অপেক্ষা কর।

বিথিকা মাথার ওপরে বাবার হাত চেয়ে রেখে অল্পক্ষণে ছেড়ে দেয়।

চলে যায় সিএনজি। ঘরঘর শব্দ ওর মাথার ভেতরে টুংটাং বাজে। ও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। গলি ছেড়ে সিএনজি চলে গেছে বড় রাস্তায়। ও গেট বন্ধ করে। ভাবে, সুমন্তকে আসবে বলবে। সুমন্ত কি আসতে পারবে? কয়দিন ধরে ওকে টেলিফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। আকস্মিকভাবে ওর মন খারাপ হয়ে যায়। ও ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে। যেদিকে তাকায় সেদিকাই মনে হয় শূণ্য। কোথাও কিছু নেই। পুরো বাড়ি প্রান্তরের মতো লাগছে। কেন এমন হচ্ছে ওর? ও আঁতকে উঠে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে প্রতিটি ঘরে ঘুরে বেড়ায়। একসময় বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে থাকে। ভাবে, পৃথিবী নিঃসাড় হয়ে গেছে ওর জীবনে। মাথায় এক অদ্ভুত শব্দ হয়। বুঝতে পারেনা শব্দটা কেমন নিঃসাড় পৃথিবীতে এই শব্দ কোথা থেকে আসছে। আকস্মিকভাবে ভয় করে ওর। ভয়ে কাঁপতে থাকে।

তখন টেবিলে রাখা মোবাইল বেজে ওঠে। ও ফোন ধরার জন্য আগ্রহ বোধ করে না। ফোন থেমে গিয়ে আবার বাজে। ও উঠে ফোন ধরে। সুমন্ত ফোন করেছে।

বিথিকা হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে সুমন্ত বলে, মনে কর আমি তোকে জড়িয়ে ধরে বলছি আমাদের ভালোবাসা মৃত্যু পর্যন্ত থাকবে।

- শুধু মৃত্যু? আরও বেশি সময় ধরে থাকবে।

- আজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মনে হচ্ছে আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি বিথিকা।

- তুই অনেকবার একথা বলেছিস। আমিও তোকে ভীষণ ভালোবাসি সুমন্ত। কিন্তু তুই হাসপাতালে কেন?

- মা করোনা আক্রান্ত হয়েছে। সঙ্গে আমিও।

- ওহ, আল্লাহ মাবুদ। ওদেরকে সুস্থ করে দাও।

বিথিকার কান্নার ধ্বনি সুমন্ত দুকান ভরে শোনে। একসময় কান্না থামিয়ে বলে, তুই কোন হাসপাতালে আছিস বল। আমি তোকে দেখতে আসব।

- না, তুই আসবি না।

- প্রেমে পড়ার শুরু থেকে আমরা পরস্পরকে যেভাবে দেখেছি সেই চেহারা তুই মনে রাখ। মৃত্যুর পরও আমরা পরস্পরের কাছে এমনই থাকব।

বিথিকা কিছু বলার আগেই সুমন্ত কেটে দেয় ফোন। বিথিকা নিজে ফোন করার চেষ্টা করলে দেখতে পায় সুমন্ত ফোন বন্ধ করে রেখেছে। বিথিকার সামনে অন্ধকার ঘণীভূত হয়ে ওঠে। মনে হয় চারদিকে কোথাও কোনো আলো নেই। ও গুটিগুটি পায়ে ঘরের চারপাশে ঘুরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

তখন ফোন আসে মায়ের কাছ থেকে।

- আমাকে হাসপাতালে থাকতে হবে বিথিকা। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছেন, তোর বাবার করোনা পজিটিভ।

ও চিৎকার করে বলে, মা-

সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দেয় মা। মাঝে মাঝে ফোন করে ওকে হাসপাতালে যেতে নিষেধ করে।

- তোমার জন্য খাবার নেব না?

- না, আমি এখান থেকে ব্যবস্থা করছি। একজন মহিলাকে টাকা দিয়েছি। সে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

কেটে যায় ফোন। কারো সঙ্গে কথা বলে মন ভরেনা বিথিকার। নিঃশব্দ সময়ের পীড়নে নিজেকেও করোনা আক্রান্ত মনে হয়। ওর বাবা, ওর প্রেমিক সুমন্ত, সুমন্তের মা তিনজন প্রিয় মানুষের অসুস্থতায় ও কাহিল হয়ে থাকে। মনে হয় হাঁটার শক্তি ফুরিয়ে গেছে।

দিন গড়ায়। শুধু মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। সুমন্ত নীরব হয়ে গেছে। একদিন খবর পায় বাবা মারা গেছে। একই দিন বিকেলে ফোন করে সুমন্তর বাবা। ওরা মা-ছেলে দুজনেই মারা গেছে। বিথিকা চিৎকার করে বলতে থাকে, করোনা ভাইরাস আমাকেও নিয়ে যাও। আমিও যেতে চাই।

চারদিকে কোথাও কোনো শব্দ নেই। দিনের আলোয় অন্ধকার ঘনিয়ে আছে ওর সামনে। বিড়বিড়িয়ে বলে, এ আমার প্রেমের অন্ধকার। জীবনে আর কখনো প্রেমের আলো ফুটবে না। সুমন্ত আমার কাছে প্রেমের অন্ধকার হয়ে থাকবে।

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top