‘মামব্লেকোর’ চলচ্চিত্র আন্দোলনঃ পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে চলচ্চিত্র নির্মান : রাম কৃষ্ণ সাহা
প্রকাশিত:
৫ আগস্ট ২০২০ ০৫:৫০
আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ২২:৫০

ষাটের দশকে হলিউড স্টুডিও সিস্টেমে ক্ষয় ধরে। যুক্তরাষ্ট্রে এইসময়ে বিদেশী ভাষার ছবি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ বা ফরাসি নবকল্লোল আন্দোলনের পুরোধা জাঁ-লুক গদার এবং ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো হলিউড সিনেমার পরিচিত গল্প বলার রীতিকে ভেঙে দেন ব্রেথলেস, ফোর হান্ড্রেড ব্লোস এবং জুল এ জিম ছবিতে। পশ্চিমী দর্শকেরা ইতালীয় পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনির নৈরাশ্যবাদ এবং সুইডেনের ইঙ্গমার বার্গম্যানের চমকপ্রদ স্বপ্নময়তার সাথেও পরিচিত হন। লাতিন আমেরিকার পরিচালকরাও হলিউডের দৌরাত্মকে রীতিমত চাপের মুখে ফেলেন। ফার্নান্দো সোলানাস এবং অক্টাভিও গেটিনো হলিউডের বৈপরীত্যে রাজনৈতিক থার্ড সিনেমা আন্দোলনের সূচনা করেন।
তবে সত্তর-এর দশকে নব্য হলিউড ঘরানা জোরদার হয়। এই দশকে নতুন যে পরিচালকরা উঠে এলেন তাদের মধ্যে ছিলেন মার্টিন স্কোরসেজি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলা, জর্জ লুকাস, উডি অ্যালেন, টেরেন্স মালিক আর রবার্ট অল্টম্যান। সেইসঙ্গে জনপ্রিয় হতে থাকে অতার মতবাদ, যেখানে পরিচালকই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার নিজস্ব সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। এই মতবাদের অনুসরণে পরিচালকরা ছবির ওপর আগের জমানার তুলনায় অনেক বেশি কতৃত্ত্ব পান। শুধু তাই নয়, ছবিগুলো দারুণ ব্যবসা সফল হয়, যেমন স্কোরসেজির ট্যাক্সি ড্রাইভার, কাপোলার দি গডফাদার সিরিজের ছবিগুলি, উইলিয়াম ফ্রেড্রিক এর দি এক্সরসিস্ট, অল্টম্যানের ন্যাশভিল, উডি অ্যালেনের অ্যানি হল আর ম্যানহাটন, মালিকের ব্যাডল্যান্ডস আর ডেজ অফ হেভেন, এবং পোলিশ অভিবাসী রোমান পোলানস্কির চায়নাটাউন। অবশ্য কিছুক্ষেত্রে ব্যর্থতার সম্মুখীন ও হতে হয় যেমন, পিটার বোগদানোভিচ এর অ্যাট লং লাস্ট লাভ আর মাইকেল সিমিনো র ব্যয়বহুল ওয়েস্টার্ন ছবি হেভেনস গেট, যার ফলে ইউনাইটেড আর্টিস্ট স্টুডিওর পতন ঘটে।
নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ইণ্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা নতুন রূপে ফিরে আসে, অভূতপূর্ব বাণিজ্যিক সাফল্যের সঙ্গে। স্টিভেন সোডারবার্গ এর সেক্স, লাইজ অ্যান্ড ভিডিওটেপ (১৯৮৯) আর কোয়েন্টিন টারান্টিনো র রিজারভয়ার ডগ্স (১৯৯২) প্রেক্ষাগৃহ এবং হোম ভিডিও, দুজায়গাতেই ভালো ব্যবসা করে। ইণ্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার এমন জনপ্রিয়তায় প্রভাবিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ স্টুডিওগুলো নিজস্ব ইনডিপেন্ডেন্ট প্রোডাকশন কোম্পানি তৈরী করেন। ১৯৯০ দশকের অন্যতম সফল কোম্পানি হল মিরাম্যাক্স ফিল্মস, যা প্রকৃত রূপে ছিল একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে চলচ্চিত্রেরও বিশ্বায়ন ঘটে, ইংরাজী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে বিদেশী ভাষার ছবিও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন (মান্দারিন), অ্যামেলি (ফরাসী), লগান (হিন্দি), স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (জাপানি), সিটি অফ গড (ব্রাজিলিয় পর্তুগিজ), দি প্যাশন অফ ক্রাইস্ট (আরামাইক), অ্যাপোক্যালিপ্টো (মায়া) আর ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস (একাধিক ইউরোপীয় ভাষা)। এই দশকে শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার ছবি বিভাগে অ্যাকাডেমি পুরস্কারের তালিকায় ইতালি সর্বোচ্চ স্থান পায় ১৪টি পুরস্কার, ৩টি বিশেষ পুরস্কার ও ৩১টি মনোনয়ন সহ।
এসময়ে প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় নতুন অভিব্যাক্তির। আমেরিকান ফিল্মস্কুল গুলো থেকে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা চালাচ্ছিল নতুন নতুন আঙ্গিকের সিনেমা নির্মান করতে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার নবজাগরণ শুরু হয় আগের যেকোন সময়ের চেয়ে প্রবল গতিতে। ফলশ্রুতিতে, একবিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে শুরু হয় ‘মামব্লেকোর’ চলচ্চিত্র আন্দোলন। ফরাসি নবকল্লোল ও ডগমি-৯৫ থেকে অনুপ্রাণিত ‘মামব্লেকোর’ আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম সফল চলচ্চিত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। ২০০২ সালে মুক্তি পায় প্রথম ‘মামব্লেকোর’ সিনেমা ‘ফানি হা হা’, পরিচালক আন্দ্রেই বুজালাস্কি। গ্রেতা গারউইং, লিন শেল্টন, ডুপ্লাস ভ্রাতাযুগল, জেফ বাওনে প্রমুখ উল্লেখ্যযোগ্য নির্মাতাদের শুরুটা হয়েছে ‘মামব্লেকোর’ সিনেমা থেকেই।
‘মামব্লেকোর’ সিনেমার উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য
১। স্বভাবজাত (Naturalistic) সংলাপ এবং অভিনয়
২। অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী
৩। তাৎক্ষণিক সংলাপ নির্মান (Improvisation) প্রাধান্য পায়
৪। অধিকমাত্রায় সংলাপ নির্ভর, প্লট গৌণ থাকে
৫। স্বল্প বাজেটে নির্মান করা হয়
৬। বাস্তবিক/প্রকৃত পরিবেশে (Real Location) চিত্রধারন করা হয়
৭। চিত্রধারনে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়
৮। অধিকাংশ সিনেমায় রোম্যান্টিক রিলেশনশিপের মধ্যে আবর্তিত আকাঙ্ক্ষা ও জটিলতাগুলোকে কেন্দ্র করে প্লট নির্মান করা হয়।
‘মামব্লেকোর’ সিনেমার ঐতিহাসিক প্রক্ষাপট
ষাটের দশকের ফরাসি নবকল্লোল-এর প্রভাব ‘মামব্লেকোর’ সিনেমায় স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়। তবে বিশেষ করে, অনুপ্রাণিত হয় এরিক রোমার এর চলচ্চিত্র থেকে। যেখানে চরিত্র সমূহকে দেখা যায় পরস্পরের সাথে অতি দীর্ঘ সময় যাবত সংলাপচারণ করতে এবং এখানে চরিত্রসমূহের 'Romantic Intrigues' অনুঘটকের ন্যায় ক্রীয়াশীল থাকে। ‘মামব্লেকোর’ সিনেমায় চরিত্রসমূহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চরিত্রগুলো অবিবাহিত, উদ্দেশ্যহীন ও ২০-৩০ বছর বয়সী তরুন-তরুনী। আন্দ্রেই বুজালাস্কি, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘মামব্লেকোর’ সিনেমার জন্মদাতা, তার ফানি হা হা (২০০২) সিনেমার সারমর্ম এরূপ, সদ্য গ্রাজুয়েট এক নারী একটা চাকরির জন্য দিশেহারা আর এরমাঝে সে এক বন্ধুর প্রেমে পরে। কিন্তু সমস্যা হলো তার বন্ধু অলরেডি একটা রিলেশনশিপে আছে। এখান থেকেই শুরু হয় 'Romantic Intrigues'। এমন সব প্লট-ই অধিকাংশ ‘মামব্লেকোর’ সিনেমার ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়ায় যেখানে চরিত্রগুলোর একমাত্র মোটিভেশন থাকে নিজেদের মধ্যে তাদের নিজ নিজ অনুভূতি আদান-প্রদান করা। ‘মামব্লেকোর’ সিনেমার এমন প্লট ও চরিত্র নির্মানে প্রভাব খাটিয়েছে যেসকল সিনেমা তার মধ্যে অন্যতম গার্লফ্রেন্ডস (১৯৭৮), ম্যানহাটন (১৯৭৯), স্ল্যাকার (১৯৯১), ক্ল্যার্কস (১৯৯৪), গো ফিস (১৯৯৪) এবং বিফোর সানসাইন (১৯৯৫)।
সাম্প্রতিক সময়ে মামব্লেকোর সিনেমা
আমেরিকায় জন্ম হলেও প্রায় সব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘মামব্লেকোর’ প্রভাব দেখা যায়। তবে সবগুলোকে খাঁটি ‘মামব্লেকোর’ বলা চলে না। বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান নির্মাতা ভ্রাতাযুগল জে ডুপ্লাস ও মার্ক ডুপ্লাসের শুরুটা হয় ‘মামব্লেকোর’ সিনেমা দিয়েই। ২০০৫ সালে তাদের ‘মামব্লেকোর’ সিনেমা ‘দ্য পাফি চেয়ার’ সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। এরপরে বেশ কিছু ‘মামব্লেকোর’ সিনেমা তারা নির্মান করেন। এক পর্যায়ে তারা পিওর ‘মামব্লেকোর’ থেকে সরে আসেন। সাম্প্রতিক সময়ে অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স, এইচবিও, ডিজনে ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়ে প্রচলিত ধারার অসংখ্য সিনেমা, সিরিজ, ডকুমেন্টারি নির্মান করেন এবং তা দর্শকপ্রিয় হয়। টিভি সিরিজ ট্রান্সপারেন্ট (২০১৪), মিনি ডকু সিরিজ ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড কান্ট্রি (২০১৮), ড্রট (২০২০) তাদের উল্লেখযোগ্য কাজ। এসকল কাজ খাঁটি ‘মামব্লেকোর’ সিনেমা না হলেও, বহুলাংশে প্রভাবিত।
অনেক গবেষকের মতে, ‘মামব্লেকোর’ সুপরিকল্পিত নয় বরং আকস্মিত। খোদ আন্দ্রেই বুজালাস্কি (২০০৯) বলেন, ‘WE didn't set out to start a film movement. It just happened’. পরবর্তী সময়ে অপরিকল্পিত আন্দোলনই ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট রূপ-রেখা পায় নির্মাতাদের তাগিদে ও পরিকল্পনায়। বর্তমানে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, ‘মামব্লেকোর’ সিনেমার কাঠামোবদ্ধ গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং নিজস্ব ঢং রয়েছে। নীতি নির্ধারনীর পালা ২০০৫ সালেই সম্পন্ন হয়েছিল যা অপরিবর্তনীয় রূপে এখনো টিকে আছে, থাকবে। ‘মামব্লেকোর’ অনুসারী লিন শেলটন (২০১৭) বলেন, ‘সময়ের সাথে সাথে মানুষের ধ্যান ধারায় পরিবর্তন আসবেই, নির্মাতারা ‘মামব্লেকোর’ ছেড়ে আরেক আন্দোলনে যুক্ত হবেন, যা স্বাভাবিক। নতুন চিন্তা আসে বলেই ভিন্ন ভিন্ন আন্দোলন জন্ম নেয়। তবে প্রত্যেক আন্দোলনই স্বতন্ত্র ও অপরিবর্তনীয়। ইতিহাস পরিবর্তন যোগ্য নয় কিন্তু সময়ের ভেলায় সিনেমার রূপ বদলাবে। আশার কথা হলো, ‘মামব্লেকোর’ কেবল ইতিহাস হয়ে নয় বরং এর বর্তমান বিচরন আরো বৃহৎ এবং ভবিষ্যৎ নির্মাতারাও এ ধারায় যুক্ত থাকবে ও সুফল পাবে’।
রাম কৃষ্ণ সাহা
চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়: রাম কৃষ্ণ সাহা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: