বিসর্জন : ডা: মালিহা পারভীন


প্রকাশিত:
৫ আগস্ট ২০২০ ২১:২৪

আপডেট:
৬ আগস্ট ২০২০ ০৬:১৪

ছবিঃ ডা: মালিহা পারভীন

 

দুপুর নাগাদ ফরহাদ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মফস্বল শহর। আগামিকাল কুরবানি ঈদ। করোনা মহামারির কারনে এবার মানুষের মধ্যে ঈদ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তবে এই ভাটি অঞ্চলে বন্যার প্রভাব পড়েছে স্পস্ট। আশ্রয়হীন মানুষ, পশু শহরের পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

‘স্যার, দুইডা ট্যাহা দেইন --' দুজন ভিখিরি দুদিক থেকে এগিয়ে আসে। ফরহাদ ১০ টাকার নোট বের করে দিয়ে খালি রিক্সার একটিতে ওঠে বসে। রিক্সাওয়ালাকে তারাকান্দি বাজারে যেতে বলে হুড তুলে দেয়। ভাপসা একটা গরম পরেছে আজ।

ফরহাদের দলের লোকজন অপেক্ষা করছে নদীর ঘাটে। সরকারি ত্রান বিতরনে আজ ওরা যাচ্ছে দুরের একটা চরে। ওরা প্রায় ৫ সদস্যের দল। ত্রানের প্যাকেট নিয়ে একটা বড় নৌকায় উঠে পরে।

'এই সবুইজ্যা ব্যানার কই’ --? ফরহাদের গলার স্বর শুনে লিকলিকে একটা ছেলে ব্যানার হাতে নৌকার অন্য প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসে। নৌকার পালের সাথে ব্যানারটা টানিয়ে দেয়। কমলা রঙ পালের সাথে পাল্লা দিয়ে পতপত করে উড়তে থাকে সবুজ কাপড়ে লাল রংগে লিখা 'বন্যার্তদের সাহায্যার্থে ত্রান বিতরন কার্যক্রম' ব্যানার। ফরহাদ মোবাইলটা একজনকে ধরিয়ে দেয়। ব্যানার ও ত্রান সামগ্রিসহ ছবি তোলা শেষ হলে মাঝিকে নৌকা ছাড়তে বলে।

রোদ চকচকে নীল আকাশ। সাদা রঙ পেঁজা তুলা মেঘ মনে করিয়ে দেয় শ্রাবন শেষ হয়ে ভাদ্র এসে গেছে প্রায়। ইঞ্জিনের নৌকা দ্রুতবেগে এগোচ্ছে। চারিদিকে থই থই পানি। পানির মধ্যে মাঝে মাঝেই মাথা উঁচু করে গাছ পালা, ঘর বাড়ি তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এবারের বন্যা যেন একটু বেশি বাড়াবাড়ি রকমের। কি সুন্দর চারিধার ! ঈদের পরদিন বউ বাচ্চা নিয়ে ফরহাদ নৌ ভ্রমনের প্ল্যান ক'রে ফেলে।

'এইতো আইয়া পরছি। এমুন উঁছা গেরাম। সব্বনাশী রাক্ষসি বান তাও খাইলো --' মাঝির গলা শুনে ফরহাদ সাফারীর পকেট থেকে বান ভাসা পরিবারের তালিকার কাগজটি বের করে।

শহর থেকে ত্রান এসেছে। খবরটা চাউর হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বানভাসি মানুষগুলি কেউ সাঁতরে, কেউ ভেলায় চড়ে, হাঁটু পানি ভেঙে নৌকার কাছে আসাছে। পথ, সাঁকো সব পানির নীচে। বাড়ির উঠানে কোমর পানি। ফরহাদ নৌকা নিয়ে লিস্ট অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি নৌকা ভিড়াতে চেস্টা করে।
তাজুল ব্যাপারি, ছমির মিয়া, জব্বার ফকির, মিয়া বাড়ি - মাঝির সহযোগিতায় খুঁজে বের করে।

সরকারি হিসেবে ত্রানের বস্তায় প্রতিটিতে দশ কেজি চাল সহ আটা, ডাল, তেল, আলু আছে। ঈদ উপলক্ষে আছে সেমাই, চিনি। অল্প কিছু শাড়ি, লুংগিও আছে। আসল মাপে ২ কেজি চাল কম আছে প্রতি বস্তায়। সবাই এটা জানে। তবুও এলাকার লোক ফরহাদকে ভরসা করে। প্রতি বছর বন্যায় ত্রানের তালিকায় গ্রামের কোনো ঘর বাদ যায় না ফরহাদের কারনেই।

'এইড্যা মকবুল মৃধার বাড়ি --' মাঝি নৌকা থামায়। টিনের একটা ছোট চালা ঘর। তার চাল বরাবর ছুঁইছুঁই পানি। মধ্যবয়স্ক মকবুল মৃধা পরিবার সহ এখানে আশ্রয় নিয়েছে। মাটির চুলা, শুকনা ডাল পালা, প্লাস্টিকের বালতি, পাতিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘর ঘেঁষে কলা গাছের ভেলায় বছর সাতেকের খালি গা, হলুদ প্যন্ট পরা বাচ্চা ছেলে একটা ছাগলকে জড়িয়ে বসে আছে।

ফরহাদ শীর্ন ক্লিষ্ট মকবুল মিয়ার হাতে ত্রানের একটি প্যাকেট তুলে দেয় - 'তুমি মকবুল মৃধা ? এই নাও। বস্তায় নতুন লুঙিও আছে। পইরা ঈদের নামাজ পইরো। '
মকবুল হাঁটুর উপর কাছা দিয়ে রাখা ভিজা লুংগি নামাতে নামাতে হাত বাড়িয়ে ত্রানের বস্তাটা নেয়।

-- এই যে শহরের ব্যাডা হুনুইন - মকবুলের পাশে বসা ওর বউ আফরোজা বানু ঝাঁঝিয়ে উঠে। সবাই তাকায় ওর দিকে।
- আন্নে আমরার লগে মশকরা করুইন? কপাল ঠেহানোর মাডি নাই সারা গেরামে। আর নয়া লুঙি পইরা পোলার বাপ নাইচতে নাইচতে নামাজ পরবার যাইব?

ফরহাদ পরন্ত বিকেলের হলুদ রোদে ভাল করে দেখে আফরোজা বানুকে। ২৫-২৭ বছরের ভরা শরীর। গায়ের শাড়িটি একটু ভিজা। মাথায় ঘোমটা টানতে যেয়ে আফরোজার পিঠ, কোমর কিছুটা অনাবৃত হয়ে পরে। ফরহাদের চোখ আটকে যায় ওই খোলা মসৃন তামাটে মেদহীন কোমরের ভাঁজে। জলের মধ্যে আগুন লাগে!

ফুল ফুল একটা ছাপা শাড়ি আফরোজার হাতে তুলে দেয় ফরহাদ।
: তোমরা শহরের আশ্রয় কেন্দ্রে চইলা আস। তুমাদের জন্য ইস্পেশাল থাকার ব্যবস্থা কইরা দিমুনি আমি। '

ভেলায় বসা আফরোজার ছেলে মাসুম বলে ওঠে : আমার জামা কই ? মা আমি নতুন জামা পরমু। 'একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ত্রান সামগ্রীর তালিকায় বাচ্চাদের কাপড় নাই।

ফরহাদের ফোন বাজে। ওর ছেলে ফারদিন। ভিডিও কল করেছে। ছেলেকে সে বন্যার বিস্তৃত প্লাবিত এলাকার ছবি দেখায়, আকাশে সন্ধ্যার সুর্য দেখায়। ঘরের চালে মানুষ বসে আছে এ দৃশ্য দেখে ফারদিন খুব মজা পায়। ভেলায় বসা আফরোজার ছেলে মাসুম আর জড়িয়ে ধরা ওই ছাগলটাকেও দেখায়।

ফারদিন মাসুমের সাদাকালো ছাগলটি দেখে তো মহা খুশি। এটা তার চাইই। কুরবানির জন্য এই সাইজের ছাগল ফরহাদ খুঁজছিল। এটাকে নিয়ে গেলে ভালই হবে। ছেলের খুশি খুশি মুখটা মনে পরলো। ফরহাদ মকবুল মৃধারা হাতে পাঁচ হাজার টাকায় দফারফা করে ফেললো।

মাসুম ছোট্র দুই হাতে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে ছাগলটির গলা জড়িয়ে ছিল। কিন্তু তবুও সে তার ছাগল ' টাইগারকে' ধরে রাখতে পারে নি। খুব বেশি জোর লাগেনি ছাগলটাকে নৌকায় তুলতে। নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। ইঞ্জিনের বিকট শব্দ আর ছাগলের ভ্যা ভ্যা চিৎকার ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যায়।

'বাজান আমার টাইগার, বাজান আমার ছাগল --'। মাসুমের চিৎকার রাতের নির্জনতায় বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আকাশে শ্রাবনের পুর্নিমা চাঁদ। বন্যার পানিতে চাঁদের ছায়া তখন বাতাসে তিরতির কাঁপছে।

রাত বাড়ে। পৃথিবীর তিন ভাগ জলের মধ্যে একভাগ মাটি তখন ভিজে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে মাসুম আর আফরোজা বানুর চোখের জলে।
------



ডা: মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক

সেগুনবাগিচা, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top