সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

সিমরান : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
৭ আগস্ট ২০২০ ০০:১৮

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১৮

ড. শাহনাজ পারভীন

 

সিমরান যখন রোজ এণ্ড রোজেজ পার্লারের ফাইনাল টাচ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তখন তার নিজের কাছেই নিজেকে বড় অচেনা লাগছিল। সে জানে, ‘মেয়েদের জন্য গন্ধহীন রং আর ছেলেদের রংহীন গন্ধ’। প্রাথমিক শিক্ষার সময়ে মক্তবের হুজুরের মুখে সে এইসব কথার সাথে সাথে আরো অনেক কিছুই শুনেছিল, শিখেছিল। ছোট বেলার শোনা কথা একেবারে পাথরের প্রলেপের মত স্থায়ী হয়ে আছে। সেগুলো সে প্রাণের সাথে গেঁথে নিয়ে জীবনের শুরুতে সে খুব প্রাণপণ মানতো সে সব। কিন্তু মধ্যবয়সের বাঁধ ভাঙা জোয়ারে অন্য সব নীতিকথার সাথে খড়কুটোর মতই ভাসিয়ে দিয়েছে সবকিছু। আজ পার্লারের পরিচিত মেয়েটা ওর নিজস্ব সেন্টের পরিবর্তে একটা সুন্দর ঝিমধরা সেন্ট ¯েপ্র করে দিয়েছে। ওর উৎস্যুক মুখে মেয়েটার ঠোঁটে খই ফোটে।
- আন্টি, স্যরি, ম্যাডাম এটা আমার ম্যাডাম আপনার জন্য এনেছে। ম্যাডাম ট্রেনিংয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। ওখান থেকে এনেছে। আপনি কী অর্ডার দিয়েছিলেন?
-হ্যা বলেছিলাম। এনেছে? কড়া হাসনু ফুলের ঝিম ধরা গন্ধ! আামার ডাক্তার আমাকে বলেছিল। ওর কোন পেশেন্ট নাকি ওর ঐ প্রিয় সেন্ট মাখে...
এইটুকু বলেই সিমরান সাবধান হয়ে যায়। ও একজন সামান্য বিউটিশিয়ান। ওর সাথে কেন ও এত কথা বলছে আজ?
ও আজ এমনিতেই খানিকটা আপসেট। অন্য রকম দিন এটা ওর জন্য। স্মৃতির ফেনা ওকে ছেঁকে ধরে চারপাশ থেকে। হঠাৎ ছুটে আসা বিরাট আজদাহা সাপের মত ঢেউয়ের সাথে লোনা পানির থই থই ফেনা হঠাৎ যেমন ঘিরে ফেলে আবার কিছুক্ষণ পর তা মিলিয়ে যায় স্বেচ্ছায়। আবার স্বচ্ছ শান্ত পানির রেখা হয়ে যেমন জীবনকে জড়িয়ে রাখে তেমনি সিমরান পার্লারে ঢুকলে ওকে এভাবে ঘিরে ধরে আর ফিরে যায়। পার্লারের সারাটা সময় আধো বাস্তব আর আধো স্বপ্নের ভেতর বুদ হয়ে ছিল পঞ্চাষোর্ধ সিমরান। তাই তো ও নিজেকে এতক্ষণ দেখতেই পায় নি। কিন্তু ফাইনাল পালিশ শেষে নিজেকে দেখে নিজেই ভুত দেখার মত চমকে উঠেছিল। কী আশ্চর্য! নিজেকেই নিজে চিনতে পারছে না? মুখে মুখে শুনেছে সিমরানের রূপের গল্প। কিন্তু এতটা! ও স্বপ্নেও ভাবে নি। ও কি করে পঞ্চাশ থেকে নেমে এসে পঁচিশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে? সামনের দু’পাশের ঝুলে থাকা হিট দেওয়া আঁকাবাঁকা সাপের মত চুলগুলো থেকে থেকেই যেন ছোবল বসাচ্ছে সিমরানের সৌন্দর্যে। খানিকটা বিহ্বল হয় যেন সে। পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় যেন। ডাক্তার বলেছিল এইসব...
ইদানীং ও সুক্ষè খেয়াল করছে ডাক্তারের আর আগের মত মন নেই ঘরে। আগের মত ও আর সিমরানের ঘরে ম্যাজিকের মত সময় পার করে না। এমনিতেও সে রাতে থাকে না কখনো। সেই দুপুরের লাঞ্চ শেষে এক টুকরো বিশ্রাম। এতেই সন্তষ্ট সে। রাতে তো তার ফ্যামিলীর কাছে যাবেই ঈদ, পার্বনেও। এ নিয়ে কোন কমপ্রোমাইজ নেই ইমতিয়াজের। ইদানীং সেখানেও ভাগ বসাচ্ছে কেউ... ভাবতে পারে না আর। সশব্দে নিজেকে গুছিয়ে নেয় ও...

আজ ওর বোনের আদরের মেয়ে রনির বিয়ে। সেখানে যাবার প্রোগ্রাম ওর। কথা ছিল ওর সাহেবের মত বড় ছেলে শাওনের সাথে রনিকে বিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে ও। কিন্তু সব কিছু কেমন ওলোট পালট হয় মুহূর্তেই। এজন্য সে নিজেকে দোষ দিতে ভুল করে না কখনো। কিন্তু আবার কখনো ভাবে সব দোষ কী তার একার? কী করে যে কী হয়ে গেল?

হঠাৎই ইমরান হাসতে হাসতে কী একটা কঠিন অসুখ বাঁধিয়ে ফেললো। কেন, ইমরান আজ কাল যখন কখন ওর স্মৃতির মধ্যে হামলা করে এতো, কেন আর স্মৃতিতে থাকে না সে। বাস্তব হয়ে ওঠে মুহূর্তে। সেদিন ওরা গিয়েছিল মানু ভাইয়ের পিকনিক স্পটে। ওর কাছের বন্ধুর মালিকাধীন স্পটটার ওদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল। বন্ধুরা সব সস্ত্রীক সেলিব্রেট করবার জন্য মিলিত হয়। আনন্দপ্রিয় ইমরানই প্রথম চল্লিশ ফুট উঁচু কৃত্রিম পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠে মূসা ইব্রাহীমের মত বিজয়ের হাসি হেসেছিল। স্বভাব সুলভ চঞ্চলতায় দ্রুত নামতে যেয়েই পা ফসকে বেশ খানিকটা গড়িয়ে পড়ে নিচে। সবার সহায়তায় যখন উঠে দাঁড়ালো তখনি একটু পা খোঁড়াচ্ছিল। কিন্তু কে জানে, তার আগেই ইমরানের প্রচণ্ড নার্ভের সমস্যা শুরু হয়েছিল। কোন কিছুতেই যখন ওর খুঁড়িয়ে চলা ছাড়ছিল না তখনি যায় ডাক্তার বোনজামাই ইমতিয়াজের কাছে। শুরু হয় চিকিৎসা। এদেশ বিদেশ। এক সময় ইমতিয়াজই ওর গৃহ ডাক্তার হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে যত না ইমরান গুরুত্ব পেত ইমতিয়াজের কাছে তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত সিমরান। ইমরানকে বিছানা থেকে ওঠাতে যেয়ে প্রথম যেদিন ইমতিয়াজের আঙুলে ওর টাচ লেগেছিল অমনি ও যেন হীম শীতল হয়ে যায়। কী শিহরণ লেগেছিল সিমরানের রক্তে! দীর্ঘ অভুক্তির শরীর ছিল ওর। ইমতিয়াজও কেমন তাড়া খাওয়া খরগোশের মত অবাক দেখেছিল। সে দেখায় কী খুঁজছিল সিমরান তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ওর কিছু করার ছিল না। ওকে তো আসতেই হতো দিনে তিনবার।

ওর পোষ্টিং এই শহরেই। ওর ওয়াইফ নাম করা গাইনোক্লোজিষ্ট। অন্য শহরে পসার তার। ইমতিয়াজ প্রতিদিন ভোরে চল্লিশ মাইল পথ পেরিয়ে আসে ড্রাইভ করে। ফিরে যায় গভীর রাতে। যতই রাত হোক না কেন, ও পাশ থেকে না ছিল কোন অনুযোগ না ছিল কোন অভিযোগ বা অপেক্ষা। বরং দেরি হলেই যেন নার্গিস খুশি। ভ্যানিটি ব্যাগের ওজন বাড়াতে পারে নিদ্ধির্ধায়।

সিমরান শত ব্যস্ততায় দরদ দিয়ে রান্না করে। টেবিল সাজায়। নির্ধারিত ক্যান্টিনে আস্তে আস্তে মিল কমতে থাকে ইমতিয়াজের। সিমরানের সাজানো টেবিলের লোভ কিংবা আহ্বান কোনটাই সামলাতে পারে না সে। দীর্ঘ ক্লান্তির পর পেট ভর্তি লাঞ্চ শেষে চোখ বুজে আসে তার।

খুব সন্তর্পনে পাশের রুমে গা এলিয়ে দেওয়া মাত্রই ওর চোখ জুড়ে ঘুম আসে। সিমরান খুব আসেÍ ওর ভেজানো দরজা ঠেলে দেখতে পায় জুতা মোজা পরা অবস্থায় গভীর ঘুমে নাক ডাকছে ব্যস্ত ডাক্তার। সিমরানের কোথায় যেন কষ্ট হয়। আহা! ইমরানের জন্য তার কী কষ্ট! কী দরদ! ঘড়ি ধরে ধরে ইমরানের জন্য সময় বের করা...। কত ব্যস্ত ইমতিয়াজ। আগের দিনের ইমরানের মত। আজ সে বিছানায়। ছোট হয়ে গেছে তার পৃথিবী। ছোট হয়ে গেছে তার জীবন। কোথায় যেন সিমরান পড়েছিল বয়স হলেই মানুষের জীবন ছোট হয়ে যায়, ঘন হয়ে যায় তার জীবন। কিন্তু ইমরান? তার তো বয়স হয় নি। তাহলে, কেন তার জীবন ছোট হয়ে গেল? সে তো টগবগে মধ্য যুবক। তাহলে এই অসময়ে কেন সে বিছানায়? বন্ধুদের মধ্যে মঞ্জুর একদিন ওদেরকে বলেছিল-
- তোমরাই হচ্ছো প্রকৃত সুখি। কারণ মানুষ যখন প্রকৃত সুখের সময় পার করে তখন সে বুঝতে পারে না যে সে সুখি। সুখ পেরিয়ে যখন সে অনন্ত দুখের সাগরে ভাসে তখন সে তার অতীতের সুখের সময়টাতে রোমন্থন করে পরম যত্নে। কিন্তু মানুষ যখন সত্যিকার সুখের সময় পার করে এবং যদি সে বুঝতে পারে যে সে সুখে আছে তাহলেই সে প্রকৃত সুখ উপভোগ করতে পারে। তোমরা হচ্ছো সেই সুখি কাপল যে কাপল সুখে আছে এবং সেটা তারা জানে এবং চিবিয়ে চিবিয়ে সুখকে চর্বন করে অনায়াস।
এই কথাটা শুনে ইমরান কেমন উল্লাসে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল মঞ্জুর। হা হা করে হেসেছিল। কান পাতলেই সিমরান সে হাসির গমক শুনতে পায়, স্পষ্ট দেখতে পায় ইমরানকে।
- হ্যারে, আজ থেকে আমরা সত্যি সত্যি সুখি হয়ে গেলাম। সাক্ষি তোরা ঠিক তো? তোদের আশিসে- তোদের ভালবাসায় আমরা দুজন সুখি হয়ে গেলাম।
অথচ সেই সুখি ইমরানের জীবন ছোট হয়ে গেছে নিমিষেই। ঘর আর বিছানা। বিছানা আর বিছানা। কোথায় সে ব্যস্ততা, কোথায় তার সে বন্ধু বান্ধব, কোথায় তার সম্মান প্রতিপত্তি, কোথায় তার সুখ? এ ঘরে আসে সিমরান। ইমরানও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আজ কী ঔষধ দিলো ইমতিয়াজ তাকে। ম্যাজিকের মত ঘুমাচ্ছে নিরিবিলি। আজ ও সারাবেলা ঘুমাতেই পারছিল না। কষ্ট পেয়েছে খুব ব্যথায়, যন্ত্রণায়। সাত-পাঁচ সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সিমরান ঢোকে ইমতিয়াজের ঘরে। সাবধানে জুতার ফিতা খোলে। পায়ের জুতা খুলতে না খুলতেই ঘুম ভেঙে যায় ইমতিয়াজের। এক লম্ফে সে উঠে বসে-
-কী হচ্ছে ভাবী? কী হলো এটা?
বলেই সিমরানের হাত ধরে টেনে পাশে বসায় ইমতিয়াজ।
-আপনি কেন আমার পায়ের কাছে? এখুনি বেরোতে হবে। জুতা মোজা খোলার সময় নেই।
-একটু রেষ্ট নেন। চা নাস্তা খেয়ে বের হবেন।
-যা খেয়েছি, তাতেই চোখ জুড়ে ঘুম আসছে। এখন আর কিছুই খাব না বলে সিমরানের নরম হাতটা ধরে কাছে টানে।
-কী করছেন? ইমরান ও ঘরে...
-অসুবিধা নেই। এখন ঘুমাবে সে। যে ওষুধ দিয়েছি ছয় ঘন্টা সে পাশ ফিরেও শোবে না। এক কাথেই ঘুমাবে সে। অতএব...
সেই থেকে শুরু সিমরানের নতুন জীবন। বুক থেকে যেন কষ্টের পাহাড় নেমে যায়। তেমনি প্রতিদিন নতুন করে জড়ো হয় ভারি বোঝার স্তুপ। কী এক মোহে সিমরানের ভেতরের সমস্ত বাঁধ ভেঙে যায়। প্রতিদিন নতুন করে ইমতিয়াজকে আবিষ্কার করে। নতুন নতুন গিফ্ট বক্স। নতুন নতুন ষ্টাইল...

ভেতরে ভেতরে শুরু হয় ইমরানের অপচিকিৎসা। অতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ ওর নার্ভ হজম করতে পারে না। এ বেলা জেগে ব্যথায় যন্ত্রণায় কাতরায়। ও বেলা অঘোরে ঘুমায়। ইমরানের নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থায় সিমরান শংকিত কিন্তু
অবোধ। বাঁধা কাজের মেয়েটাকে বিদায় করে দেয় সিমরান। নতুন কাজের ছেলে আসে। সেটাকেও বিদায় করে। ঠিকা বুয়া ঘন্টা মেপে কাজ করে। বাকীটা একাই সামলায় সিমরান। সুবিধা অসুবিধায় কেটে যায় দিনরাত। অসুবিধাই বেশি যেন। তারপরও থেমে থাকে না বাতাসের প্রবাহ। এক কান দুই কান এবং এক সময় টের পায় ইমরান সবকিছু। কিন্তু তার আর কিছুই করার থাকে না। এর মধ্যেই শাওনকে স্টুডেন্ট ভিসায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ছেলেটা হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন। শাওনের মুখটা খুব করে ভেসে ওঠে আজ ওর চোখের সামনে। ও খুব শক্ খেয়েছে রনির অন্যত্র বিয়ে হওয়াতে। অভিমানে সে তো ইদানিং ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজে তো আর ফোন করেও না আগের মত...। রনির বডি ল্যাংগুয়েজও মোটেই ভাল না। রনিও কী মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিল শাওনকে? সব দোষ যেন ওর একার? হঠাৎ ওর মাথাটা ঝিম ধরে আসে। ভাবতে পারে না কিছুই। নিচে গাড়ির হর্ণ বাজে অনবরত। পায়ে পায়ে সিমরান নিচে নামে। কল্পনার ঢেউয়ে ভেসে বাস্তবতায় পা রাখে।
হা করা গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভার ডাকে-
- আসেন ভাবী। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়ায় আছি।
- তোমার স্যার আসেনি?
-না ভাবী, ছার একটু কাজে আচে। আমারে আসতি কইলো।
সিমরান ঘন অতীত থেকে আর এক পা বাস্তবে ফেলে। এত সাজ গোজ এত কিছু তো ইমতিয়াজের জন্যই। ওরও তো এ বিয়েতে এটেন্ড করার কথা। এ রকমই কথা ছিল ওর সাথে। এত রাত পর্যন্ত তো ব্যস্ত থাকার কথা নয়। আজ অপারেশন অফ ডে। তাহলে? সিমরান প্রচণ্ড ঝাঁকি খায় যেন। পুরোনো ড্রাইভারের চোখ এড়ায় না সেসব।
-না ভাবী, ছার কইলো তোর ভাবীরে পারলারতে কমিনিটি সেন্টারে দিয়াই। আমি হাতের কাজ শেষ হলিই যাব। কোন রাগ করে না যেন।
-ঠিক আছে। চলো। তুমি যেয়েই তোমার স্যারকে পাঠিয়ে দেবে।
পুরোনো ড্রাইভার শুধু মুখে বলে
-ঠিক আছে ভাবী। আমি যেযেই ছাররে পাঠায়ে দিবানে।
কিন্তু রইস তো জানে, ছারের এত রাতে কিসির কাজ। সে কি তার দুই নম্বর ভাবীরে কবে সেসব। রইস তো নিজিই সব কিছুর সাক্ষি। সেই আমিই তো তিন বেলা আপনার বাড়িতিও আনা নেয়া করচি। বড় ভাবীও তো তখন টু শব্দটি পর্যন্ত জানতি পারিনি। এই জন্নিই তো ডাক্তার আমার বেতন বাড়াইচে দুইগুন।

সিমরান যখন বিয়ে বাড়িতে পৌঁছলো তার আগেই বর কনে এসে বসেছে স্টেজে। সবাই তাদেরকে উইশ করছে। ছবি তুলছে বর কনের সাথে। খাওয়া দাওয়াও প্রায় শেষের পথে। সিমরান যতই সৌরভ ছড়াতে ছড়াতে উঠুক না কেন হঠাৎই বিয়ে বাড়ির পরিবেশ পাল্টে যায় যেন। এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। রনির ফুপুরা তো স্পষ্ট অনেক বাজে কথাই বলেছে ওর খালাকে নিয়ে।
- ও মেয়ের সহজে বিয়ে হবে না। দেখে নিও। বুড়ো বয়সে খালার যে ভিমরতি ধরেছে। বরপক্ষ খোঁজ নিয়ে ঠিক পিছুবে। কিছুতেই এগুবো না ওরা। আরো কত কী?
- কেন মানুষ দ্বিতীয় বিয়ে করে না?
রনির মায়ের মুখের কথা মুখে থাকতেই কেড়ে নেয় বোল-
- সে সব আলাদা। স্বামী বেঁচে থাকতেই ফষ্টি নষ্টি করে... যতসব...
তারপরও বিয়েটা যখন ঠিক হলো তখনও ওরা দমে যায় নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা কানে গেছে সিমরানের।
কিন্তু হাজার হোক বড় খালা। বিয়েতে না থাকলেও ওতো হয় না। সব মিলিয়ে ওর...

দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ইমরান গত হলে নানা ঝক্কি ঝামেলা, বাদানুবাদ, পারিবারিক কলহ-চাপ সব ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত লুকিয়েই বিয়েটা করে ফেলে ওরা।
সিমরানও জানে ইমরানই ওর বাপের বাড়ির গার্ডিয়ান ছিল। বাবার ছোট চাকুরির সামান্য কটা পেনশনের টাকা দিয়ে শহরে জায়গা কিনে চার তলা ভিতের দুই ইউনিটের বাড়ি করতে যেয়ে ইমরান অনেক বড় অংকের টাকা শেয়ার করেছে। যেটা জামাই হিসেবে অনেকেই আশা করে না। ছোট তিনটে বোনের নিজের বোনের মত দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে দিয়েছে। তাদের যাবতীয় ঝামেলাসহ প্রসবকালীন সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে বাবার মত। নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দেবে বলে বলে এসেছে। ভাই দুটোর পড়াশুনাসহ চাকুরি, তাদের বিয়ে সংসার এক কথায় বলতে গেলে সিমরানের ছাব্বিশ বছরের বৈবাহিক জীবনের সমস্ত সময় ওর ফ্যামিলির সাথে বুক দিয়ে পিঠ দিয়ে সংসার সামলেছে। সেই ইমরানের সহসা এভাবে চলে যাওয়া তারই দুলাভাইয়ের সাথে এই রকম বল্গাহীন জীবন সবাই তো এক চোখে দেখে না। সেখানেও ডালপালা আত্বীয় স্বজন আছে অনেক।
কোন কিছুই তোয়াক্কা করে নি সিমরান। সে তার কাক শকুনের হা করা বিধবা জীবনও খুব কাছ থেকে দেখেছে। ইমরানের জীবিত কালে যাদের সাহস ছিল না সিমরানের দিকে তাকাবার তারাও সময় সুযোগ বুঝে বলে বসে--
-ভাবী, প্রয়োজন হলে ফোন দিয়েন। ইমরান নেই তো কী হয়েছে, আমরা তো আছিই...
সিমরান অবাক হয়েছে ইমতিয়াজ তো আঠার মত আছেই তার সাথে। এটা তো প্রকাশ্য গোপন। তারপরও এতটা সাহস তারা পায় কোথায়? আজ যদি সত্যি সত্যি ইমতিয়াজের মত কেউ ওর পাশে না থাকত তাহলে কী হতো তার? এই বয়সে কী হতো তার? সে তো পড়াশুনাও বেশি করে নি। কী করে চলত ওর জীবন? ও আর কিছু ভাবতে চায় না। ধীরে ধীরে উঠে যায় ভিড় থেকে। একপাশে চেয়ার টেনে বসে ও। ভিড় থেকে না উঠেও উপায় নেই কোন। কেউ তো তার দিকে এগিয়ে আসছে না, কিংবা তাকে দেখে কেউ তো দাঁতের ঝিলিক বের করছে না। ও জানে, এ সমাজ এ রকমই। সবলকে মেনে নিতে চায় না কেউ। অসহায়কে সবাই করুণা করতে ভালবাসে। কিন্তু বিজয়ীকে হিংসেই করে শুধু। ও তো বিজয়ী। ওকে সবাই হিংসা করবে করুক। ওর তাতে কিছুই যায় আসে না। বরং ওর ভালোই লাগে। ও গায়ে মাখে না সেসব। কিন্তু এখনো ইমতিয়াজ আসছে না কেন? সবাইকে দেখিয়ে দেবে সে মোটেই হেরে যায় নি। বরং সকলের থেকে জিতে আছে এখনও...কিন্তু এখনও ইমতিয়াজ আসছে না কেন?
পর মুহূর্তেই ওকে আবার বড় অসহায় মনে হয়। ইমতিয়াজ আসলেই ওরা রনিকে উইশ করেই চলে যাবে। এখানে অবশ্য আর কোন আনুষ্ঠানিকতাও নেই। বিয়ের কাজটা সকালে পারিবারিকভাবে করে ফেলেছে। এখন শুধু তাদের বিবাহোত্তর সম্বর্ধনার আয়োজন। বর কনেকে হাই বলে খাবার টেবিলে বাই বলছে সবাই। ওর আর এক মুহূত’ও ভাল লাগছে না এখানে।
ওর কী সাজ বেশি ভারি হয়েছে? শাড়িটা কী বেশি দামি পরে ফেলেছে? বিয়ে উপলক্ষে বাইশ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছে মনিপুরি পিঙ্ক কালারের কাতানটা। ঘাড় অবধি ঝুলে পড়া ...গার্নেটের দুলটা আসলেই বড় বেশি বড় হয়ে গেছে। বেমানান লাগছে ঠিক পঞ্চাষোর্ধ সিমরানকে। তাই হয়ত সবাই ওর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। কখন আসবে ইমতিয়াজ? রিস্ট ওয়াচের দিকে চোখ যায় ওর। অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয় না ওর। অথচ দু’পাশে ঝুলে থাকা আঁকা বাকা সাপদুটি ওকে ক্রমাগত দংশন করতে শুরু করেছে। দপ...দপ...দপ...হিস...হিস...হিসস্
কেন যে আজ বড় বশি মনে পড়ছে ইমরানকে। অজান্তেই চোখ ভিজে ওঠে সিমরানের। মনে পড়ে এর আগে ওর প্রতিটি ভাই বোনের বিয়েতে ইমরান কী বাঁধভাঙা খুশিতে মেতে উঠতো। যেন বা সিমরানেরই বিয়ে... ইমরানেরই বিয়ে...আর আজ ওদের সবচেয়ে আদরের মেয়ে রনির বিয়ে। সব কিছু অন্যরকমও হতে পারত...।

রাত বাড়তে থাকে ক্রমাগত। হল ফাঁকা হতে থাকে দ্রুত। বরকনেও উঠবার জন্য ব্যস্ত। গিফ্ট বক্সগুলো গাড়িতে উঠানো শুরু হয়েছে। জিনিসপত্রও যাচ্ছে কিছু কিছু। মুহূর্তেই সাঙ্গ হতে চলেছে সবকিছু। কিন্তু ইমতিয়াজের খবর নেই কোন। ভেতরে ভেতরে ছটফট করে সিমরান। মনের অজান্তেই চাপ পড়ে মোবাইলে
সুইস অফ॥ হোয়াট্ । নব টেপে অনবরত। সুইস অফ। ও তো অপারেশনের টেবিলে গেলেও ওর মোবাইল অফ করে না। ওর নার্সটা রিসিভ করে মোবাইল। দীর্ঘদিন তো ওর মোবাইল রাতদিন চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে। জনপ্রিয় খ্যাতিমান ডাক্তার বলে কথা? আগে সিমরানের ওখানে গেলে সবগুলো মোবাইলের সুইস অফ রাখতো ও। কিন্তু এর পর তো...
ও যা শুনেছে তাহলে কী তাই ঠিক?
মনের আগুনে পুড়তে থাকে ওর দামি শাড়ির আঁচল, ঝুলতে থাকা আঁকাবাকা সাপগুলো।

অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে কী এই জন্য ও অন্যশহরে পোষ্টিং নিয়েছে। ওকেও নিয়ে গেছে ওখানে। এখানকার পসার, সাপ্তাহিক রাত কাটানো, লাঞ্চ কোথায় হচ্ছে এসব? আবার ভাবে ওর ডাক্তার ওয়াইফ অসাধারণ সুন্দরী অমায়িক নার্গিসের কথা...। যে মনে করে যদি কেউ অন্য কিছ ুককরতেই চায় কতক্ষণ তাকে মানুষ চোখে চোখে রাখতে পারে। বরং যদি তার বিবেক থেকে সে ফিরে আসে তাহলে ঐ ফিরে আসার মধ্যেই থাকে কল্যাণ। কিন্তু সিমরান অত শিক্ষিত নয় আর তার এ ব্যাপারে কোর ছাড়ও নেই। মনের অজান্তেই আবার সিমরান ভাবে সর্বাংসহা নার্গিসকে রেখে ও যদি এভাবে সিমরানকে ... তাহলে সিমরানকে রেখেও তো...
বিয়ে বাড়িতে থেকেও ও বিয়ে বাড়িতে নেই। কোথায় হরিয়ে যায় মুহূর্তে এক দুই তিন, চার পাঁচ ছয়...এক দুই তিন

হল প্রায় ফাঁকা। বর কনের মঞ্চও ফাঁকা হয়েছে ও টের পায় নি। এরই মধ্যে হৃদয় কাঁপিয়ে নিচে বেজে ওঠে ইমতিয়াজের গাড়ির হর্ণ। ও ছুটতে ছুটতে কাউকে কিছু না বলেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে এক দুই তিন...।
ওর চোখ আবারও চড়ক গাছ। গাড়িতে ইমতিয়াজ নেই!

-কী ব্যাপার তোমার স্যার কই?
কণ্ঠে আগুন ছড়িয়ে ঝড় ওঠায় সিমরান।
-ছার তো দরকারী কাজে ব্যস্ত। কলাম না তহন।
-মাণে?
-মানে ছার আমারে কইল আপনারে বাসায় দিতি।
- ও আসবে না?
-না, আজ রাতি আসপি না।
-কী বলছো তুমি? তার মেবাইল বন্ধ কেন?
-মোবাইলি চাজ নাই।
-চল, স্যারের ওখানে
-ছার তো নাই
- কোথায় গেছে?
- জানিনা, আমারে কয়নি। ছারের জন্নি অন্য গাড়ি আসলি ছার তাতে উডে গেচে। যাওয়ার আগে আমারে কইলো...
সিমরান জানে আর কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। একটু আগের বিজয়ী হয়ে যাওয়া সিমরানকে হঠাৎই বড় পরাজিত মনে হয়। ও পরাজিত হয়েছে, জীবনের ফাঁকে পড়ে ও আজ সবচেয়ে বেশি হেরে গেছে। ও আর উপরে কাউকে কিছু বলতে যায় না। আস্তে করে গাড়ির দরজা খুলেই পেছনের সীটে বসে। গাড়ি চলতে থাকে অন্ধকারকে ভেদ করে সাঁ... সাঁ।
ওর নিজের গায়ের গন্ধটাকে বড় অসহ্য ঠেকে। অসহ্য গন্ধ ছাপিয়ে কখন যেন ইমরানের গায়ের অতি পরিচিত গন্ধে ও বিহ্বল হয়ে পড়ে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পায় না। অবশ হওয়া হাতে সে পাশের সীট হাতরায়।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।
সম্পাদক: দ্যোতনা, নান্দনিক ধারার সাহিত্য কাগজ, যশোর।
ছড়াঘর, ছড়া বিষয়ক সাহিত্যের কাগজ, যশোর।
সভাপতি, অগ্নিবীণা, কেন্দ্রীয় সংসদ, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top