সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

নীল প্রহর : শরীফ উদ্দীন


প্রকাশিত:
২০ আগস্ট ২০২০ ২২:৩৫

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৫৭

 

এখানে যাদের আসতে হয় তাদের কাছে ভোরের সূর্যকিরণকেও বড্ড বিষণ্ণ মনে হয়। হতবিহব্বল মোতা একবার দাদার দিকে আরেকবার নার্স-টেবিলের দিকে তাকাতে লাগল।

মাঘ মাসের হাড়কাঁপানো শীত। উত্তরের হিমালয় থেকে নেমে আসছে হিম-বাতাস। রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে ওয়ার্ডগুলি শান্ত হয়ে গেছে। ডক্টরস কেবিনে ড. মমিনুল ইসলাম ও ড. শিরিনা বানু। দুবছর আগে ক্লাসমেট ছিল। শিরিনা বানুর ডিউটি অন্য ওয়ার্ডে। আপাতত কাজ শেষ করে কথা বলে সময় কাটাতে এসেছেন। শীত এড়াতে কেবিনের দরজা ভিজিয়ে রাখা। সন্দেহবাতিক সিনিয়র নার্স জমিলা আক্তার দুজন অবিবাহিত-অবিবাহিতার মধ্যরাতে এভাবে দরজা ভিজিয়ে কথা বলার মধ্যে আলাদা স্বাদের ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত পেলেন। জমিলা বেগমের রসালো চিন্তায় বাধা পড়ল।

 

উদ্বিগ্ন মোতা নার্স-টেবিলে এসে জমিলা আক্তারকে বলল, ‘নানার কাশির সাথে ছিটকে রক্ত বের হচ্ছে। বাড়িতে মাঝে মাঝে দু-এক ফোটা বের হতো কিন্তু আজ বেশি। আগে রতন ডাক্তার হোমিও ঔষধ দিত।’

জমিলা আক্তার বাঁকা চিন্তা বুকে পুষে ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে মোতাকে বললেন, ‘তুই গিয়ে স্যারের কেবিনে ঢুকে খবরটা দে। আমি তোর নানার কাছে যাচ্ছি।’

জমিলা আক্তারের কথা মতো মোতা দ্রুতপদে গিয়ে সজোরে দরজা খুলে ডক্টরস কেবিনে ঢুকল।

 

পরদিন জমিলা আক্তারের বিকেলের ডিউটি। বাসা থেকে এসে নিজের টেবিলে বসতেই মোতার চোখে চোখ পড়ামাত্র হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন। মোতা কাছে এলে সামনে থাকা টুলে বসতে বলে ব্যাগ থেকে চারটি আঙুর বের করে হাতে দিয়ে বললেন, ‘নে, এখানে বসে খেয়ে নে।’

 

এ দেশে আঙুর বড় লোকের ফল। গরীবরা খেলে একটিকেই অনেক্ষণ ধরে চিবিয়ে পুরো স্বাদ নিতে হয়। তা নাহলে দাম উসুল হয় না। মোতা উসুল পদ্ধতিতে খাওয়া শুরু করল। ধীরলয়ে খেতে দেখে বিরক্ত হয়ে মোতার মুখের দিকে তাকিয়ে জমিলা আক্তার আক্ষেপ করে মনে মনে বললেন, ‘আঙুর চিবানো যে একটা শিল্প তোকে আঙুর খেতে না দিলে তা জানতে পারতাম না, বাপ।’

 

ডানে-বামে দেখে নিয়ে মোতার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাল রাতে ডাক্তার স্যারের কেবিনে ঢুকে কিছু দেখতে পেয়েছিলি?’

 

মনে পড়তেই মোতা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা কাত করে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, দেখেছিলাম।’

 

অধুনালুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দা গিয়াসুদ্দীন। মৃত স্ত্রী ছিল কাকবন্ধ্যা। সংসারে শুধু দশ বছরের নাতি মোতাহার আলি। সংক্ষেপে সবাই মোতা ডাকে।

 

মেয়ে সুরাইয়া বেগম বিধবা হয়ে যখন ফিরে আসে তখন মোতার বয়স ছয় বছর। সুরাইয়া বেগম পুনরায় বিয়ে করতে রাজি ছিল না। গিয়াসুদ্দীনের মুখে রফিকের আশ্বাসের কথা শুনে সম্মতি দিল। বাচ্চা হওয়ার আগেই রফিকের আগের বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। রফিক কথা দিয়েছিল মোতাকে সন্তানের মতো করে মানুষ করবে।

 

শরীর বশ মানে, পেট মানে না। বাবার অভাবের সংসার। নিজের পেট আর সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় সুরাইয়া বেগমকে দেড় বছর আগে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হল।

বিয়ের দিন মোতার থাকার জন্য চালাঘর তুলবে বলে রফিক সুরাইয়া বেগমের কাছে দুসপ্তাহ সময় নিয়েছিল। মাস-বছর কেটে গেল। চালাঘর আর উঠল না, মোতারও রফিকের বাড়ি যাওয়া হল না।

 

উত্তরের হিমেল হাওয়া আর শৈত প্রবাহের প্রকোপে ছিটমহলের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ল। প্রচণ্ড শীতের ধাক্কায় হাপানির রুগী গিয়াসুদ্দীনের নিঃশ্বাসের কষ্ট চরম আকার ধারণ করল। সাথে লাগাতার কাশি। জেলা সদরের হাসপাতালে আসতে হলো।

 

প্রসবাসন্ন সুরাইয়া বেগমের পক্ষে বাবার সাথে হাসপাতালে আসা সম্ভব হয় নি। রফিক এসে ভর্তি করে গেছে। হাসপাতালে গিয়াসুদ্দীনের সাথী বলতে মোতা।

রস-বিবি জামিলা আক্তার বেশি রসের আশায় ব্যাগ হতে আরও তিনটি আঙুর মোতার হাতে দিয়ে বললেন, ‘কি দেখেছিলি বল?’

মোতা আঙুর চিবানো বন্ধ করে বলল, ‘ডাক্তার বাবুর মাথার পিছনের দেয়ালে দুটা তেলাপোকা দেখেছিলাম। অন্যদিন ভয় পাই। কাল পাই নি। আমি তেলাপোকা দেখে ভয় পাই মানুষকে এ কথা বলতে শরম লাগে।’

 

নার্স হাসনাহেনা ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে কখন পিছনের ফাইল কেবিনেটে এসে দাঁড়িয়েছেন জমিলা আক্তার খেয়াল করেন নি। মোতার কথা শেষ না হতেই কথা ধরলেন, ‘আপা, মানুষকে খামোখা সন্দেহ করা একটি অসুখ। আপনার এমন চিন্তা দেখে আমরা সবাই লজ্জা পাই। মানুষকে সন্দেহ করা বাদ দেন, আপা।’

 

জমিলা বেগম জানেন না, দশ বছর বয়সী চোখ নোংরা দেখে না। নার্স হাসনাহেনার কথা বলার সুযোগে মোতা উঠে এসে আবার গিয়াসুদ্দীনের পাশে বসল।

ডাক্তারেরা বুঝেছিলেন গিয়াসুদ্দীনের রোগ ভালো হবার নয়। চিকিৎসা নিতে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট আর রক্ত উঠার বিরতি পড়লে গিয়াসুদ্দীনকে ছুটি দিয়ে দিল।

হাসপাতাল থেকে রওনা দিয়ে যখন বাড়িতে এসে পৌঁছাল তখন দুপুর হয়ে গেছে। গিয়াসুদ্দীনকে বলে মোতা পাশের গ্রামে মাকে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার খবর দিতে গেল।

মোতার খিদে পেয়েছে। ভাতের খিদে। রাতে হাসপাতালের দেয়া দুদিনের বাসিরুটি চিমসে হয়ে যাওয়ায় খেতে পারে নি। খবর দেয়া উছিলামাত্র।

রফিক ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে ছিল। বাড়িতে ঢুকতে দেখে চৌকাঠ থেকে উঠে এসে মোতাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে এসেছিস? আমাকে খবর দিস নি কেন?

মোতা উত্তর দিল, ‘আজই এসেছি।’

রফিকের মা এগিয়ে এসে উঠোনের ওপাশের নিজের ঘরের দরজা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোর মাকে আঁতুর ঘরে নেয়া হয়েছে। আজ যা, কাল এসে নতুন বাবুর মুখ দেখে মিষ্টি খেয়ে যাস।’

ক্ষুধার্ত সন্তান উঠোনে দাঁড়িয়ে, মা জানতে পারল না। মোতা আঁতুর ঘরের বন্ধ দরজার দিকে মলিন মুখে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পিছনে ফিরে বাড়ির পথে পা বাড়াল।


কিছুদূর আসতেই মোতা স্কুল-বন্ধু সিদ্দিকের দেখা পেল। সোভানের বাড়ির সাথে লাগোয়া দোকানের বাঁশের মাঁচায় বসে সমবয়সী একজনের সাথে পাঞ্জা লড়ছে। গায়ের চাদর খুলে ভাঁজ করে তার উপর দুজনে কনুই রেখেছে। দুরন্ত মোতা কিছুক্ষণের জন্য খিদে ভুলে গেল। এগিয়ে গিয়ে সিদ্দিকের উদ্দেশে বলল, ‘আমার সাথে লড়বি?’ কত পারিস দেখা যাবে।’

মাঁচা ঘিরে ছোটো-বড় কয়েকজন খেলা দেখছিল। মোতার প্রস্তাবে পিছিয়ে যেতে সিদ্দিকের বাধল।

সিদ্দিক মোতার হাত কাত করে মাঁচার সাথে চেপে ধরতেই নিজের পাড়ার ছেলের জেতার আনন্দে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। সবার উদ্দেশে মোতা তার এই অনভিপ্রেত হেরে যাবার কারণ দেখাল, ’স্কুলে কোনো দিন আমার সাথে পেরেছে? কাল থেকে ভাত খাই নি তাই।’

 

মোতার দীর্ঘশ্বাস কারো কান থেকে বুকে পৌঁছাল না। হেরে যাবার অজুহাত ভেবে সবাই জোরে হেসে উঠল।

 

মোতা দাঁড়াল না। পিছন থেকে সিদ্দিক ডাক দিল। মোতা পিছনে মুখ ঘুরাতেই সিদ্দিক ভয় দেখাল, ‘স্কুলে গেলেই তোর ভাত খাওয়া ভাল করে মিটে যাবে। রূপমের আব্বা এসেছিলেন। তোকে পেলেই ধরবেন। স্যার-আপারা তোর খোঁজ করেন।’

রূপম মোতার সহপাঠী। বসার জায়গা নিয়ে হাতাহাতি। মোতা হাতের শক্তিতে না পেরে হঠাৎ জোরে মাথার গুতো দেয়। মোতার এমন আকস্মিক আক্রমণে টাল হারিয়ে পড়ে যাবার সময় বেঞ্চের কোণায় লেগে রূপমের কপাল কেটে যায়। রক্ত দেখে রূপম মোতাকে পুলিশ বাবার ভয় দেখায়। মোতা রূপমের আব্বাকে চিনে। টংবাজার ফাড়ির কনস্টেবল। কিছুক্ষণের মধ্যে মোতা ক্লাস থেকে নেই। বইপত্র রেখেই পালিয়েছে। মাস পার হতে চলল মোতা স্কুল মুখো হয় নি।


পায়ে হাটা পথ ছেড়ে যানচলাচলের রাস্তায় উঠতেই টংবাজারের গরু-হাট থেকে কয়েকজনকে গরু নিয়ে ফিরতে দেখল। মোতার মনে পড়ল, হাটবারে ব্যাপারীদের জন্য উপরে পলিথিন টাঙিয়ে ভাতের দোকান বসে। হাসপাতালে নানা খেতে টাকা দিত। পকেটে হাত দিয়ে বেঁচে যাওয়া টাকা গুনে বারো টাকা পেল। বাড়ির পথ না ধরে মোতা হাটের উদ্দেশে রওনা দিল।

বটতলার দোকানটি ছাড়া বাকী দোকানিরা দোকান গুটিয়ে নিচ্ছে। মোতা দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে সঙ্কোচের সাথে অনুচ্চস্বরে বলল, ‘বারো টাকায় ভাত দেয়া যাবে?’

 

দোকানি ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল, ‘বারো টাকায় কি আর ভাত খাওয়া হয়?’

মোতা অনুরোধের স্বরে বলল, ‘শুধু একটু ডাল দিলেই হবে। মরিচ ভেঙে খেয়ে নিব।’

মোতার উশকো-খুশকো চুল, শুষ্ক আর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে দোকানির মায়া হল।

আঙুল দিয়ে বসার জায়গা দেখিয়ে দিল। মোতা বারো টাকা দোকানির হাতে দিয়ে দেখিয়ে দেয়া স্থানে বসল।

দোকানি ডালের সাথে মাছের ছোটো একটা টুকরোও দিল। মোতা মাছের টুকরোটি পাতের একপাশে সরিয়ে রেখে খাওয়া শুরু করল। পরের দিকে মাছ দিয়ে খাবে।

অর্ধেকও খাওয়া হল না কিন্তু মোতার খিদে মিটল। সামনে তাকাতেই মোতার বুক ধক করে উঠল। রাস্তার ওপাশে তিনজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনের মধ্যে একজন রূপমের আব্বা। সিদ্দিকের কথাগুলি মোতার কানে বাজতে লাগল। মোতা বাস্তবিকই ভয় পেয়েছে। ভাবল, দেখতে পেলেই ওকে ধরে নিয়ে যাবে। মোতার বুক শুকিয়ে গেল। ঢকঢক করে পানি খেল। খাওয়া ছেড়ে কোনোরকমে হাতটা ধুয়ে বটগাছকে আড়াল করে দোকান থেকে বেরিয়ে রূপমের আব্বার চোখের নাগালের বাইরে চলে গেল।

 

সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। শীতের সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামে। কুয়াশায় রাস্তার পাশের সর্ষে ক্ষেতগুলি ঢেকে যাচ্ছে। গায়ে একটামাত্র গরম কাপড়। মোতার প্রচণ্ড শীত লাগতে শুরু করল।

মোতা তার সারাজীবনের দুর্ভাগ্যের জন্য মায়ের আবার বিয়ে করাকে মনে মনে দায়ী করল। মোতার বুকের ভিতরের অভিমান আরও জমাট বাধতে থাকল। বাড়ির আঙিনা থেকে মোতা গিয়াসুদ্দীনের ডাক শুনতে পেল, ‘মোতাহার এলি?’

সুস্থ কণ্ঠের ডাক। গিয়াসুদ্দীন অনেকদিন পর মোতার পুরো নাম ধরে ডাকছে। মোতা সব ভুলে দৌড়ে ঘরে ঢুকে আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘নানা, তুই ভালো হয়ে গেছিস?’

আদর কিংবা রাগ এই দুই সময়ে মোতা গিয়াসুদ্দীনকে তুই ডাকে। গিয়াসুদ্দীন উঠে বসা থেকে শুয়ে পড়তে পড়তে হাত ইশারা করে মোতাকে পাশে বসতে বলল।


দাসিয়ারছড়ার শেষ প্রান্তের এদিকে এখনও বিদ্যুৎ আসে নি। কয়দিন আগে সোলার প্যানেল বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। মোতা কুপিবাতি জ্বালিয়ে পাশে বসতেই গিয়াসুদ্দীন মোতার হাতটা টেনে নিয়ে বলল, ‘আমার কিছু হলে তুই মায়ের কাছে চলে যাস, মোতা।’

গিয়াসুদ্দীনের কথায় হ্যা-না কিছু না বলে মোতা ক্ষণিকের জন্য পিছনে ঘরের কোণায় জ্বলতে থাকা কুপিবাতির দিকে তাকিয়ে রইল। মোতা জানে, মায়ের কাছে জায়গা আছে কিন্তু মা যেখানে থাকে সেখানে তার জায়গা নেই।

 

গিয়াসুদ্দীন মোতার হাতে চাপ দিয়ে পুনরায় বলল, ‘আমি না থাকলে মায়ের কাছে যাবি তো?’

মোতাকে নানার প্রতি আদরে পেয়ে বসেছে। তুই ডাকা থামে না। কৃত্রিম ধমক দিয়ে গিয়াসুদ্দীনকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে বুকে মাথা রেখে মোতা বলে উঠল, ‘নানা, তুই থাম। তোর কিছু হবে না। তোকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।’

গিয়াসুদ্দীন তার শীর্ণ হাত দিয়ে মোতার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরল। মোতার কথা শুনে গিয়াসুদ্দীনের চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করল। নিজেকে সামলাতে মোতাকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘সন্ধ্যায় ফজর আলির মেয়ে এসে ভাত দিয়ে গেছে। বাক্সের উপর রাখা আছে। খেয়ে নে।’

মোতা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘আমি খেয়ে এসেছি। মায়ের কাছে গিয়েছিলাম। মাকে আঁতুর ঘরে নেয়া হয়েছে। তুই, আবার নানা হলে আমাকে আগের মতো ভালোবাসবি?’


গিয়াসুদ্দীন জোর দিয়ে বলে উঠল, ‘তুই-ই আমার সব।’


দুজনের কাপড়গুলি দড়িতে গুছিয়ে রেখে সন্ধ্যারাতেই মোতা গিয়াসুদ্দীনের পাশে এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। হাসপাতালের কয়েকদিন ভালো ঘুম হয় নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোতা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

নিভে যাবার আগে প্রদীপ যেমন জ্বলে উঠে গিয়াসুদ্দীন সন্ধ্যারাতে সেভাবে জেগে উঠেছিল। মাঝরাতে গিয়াসুদ্দীনের কাশি আর বুকের ঘড়ঘড় শব্দে মোতার ঘুম ভেঙে গেলে ধড়ফড় করে উঠে বসল।


গিয়াসুদ্দীনের কাশিতে কফের বদলে রক্ত বের হচ্ছে। নিশ্বাসের কষ্ট চোখে ফুটে উঠছে। গিয়াসুদ্দীনের বুকের ঘড়ঘড় শব্দ বিকট আকার ধারণ করল। মোতা ঝাকুনি দিয়ে অনবরত নানা-নানা করে ডেকে যাচ্ছে। গিয়াসুদ্দীন উত্তর দেবার অবস্থায় নেই। শক্ত করে মোতার হাটু খামছে ধরে আছে। গিয়াসুদ্দীনের নাক দিয়ে অনেক জোরে ঘোৎ করে একটি শব্দ বের হল। যমের সাথে টানাটানিতে হেরে গেল গিয়াসুদ্দীন। সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে গিয়াসুদ্দীনের দেহটা নিথর হয়ে পড়ল। নানা নেই এটা বুঝতে নাতির দেরি হল না।

 

জীবন ধরে মোতার বুকে জমতে থাকা অভিমানের পাথর ভয়কে জয় করল। মোতা চিৎকার করে কেঁদে উঠে প্রতিবেশিদের ডাকল না। পাথর-শান্ত মোতা উঠে দাঁড়াল। গিয়াসুদ্দীনের গায়ের উপর থেকে ছেড়া লেপটা সরিয়ে রেখে চাদর দিয়ে গিয়াসুদ্দীনের আপাদমস্তক ঢেকে দিল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের চাদরটা গায়ে দিয়ে খাবারের জায়গাতে ভাঁজ করে রাখা চটের বস্তাটা হাতে নিয়ে মোতা ঘরের দরজা খুলল।

 

রাতে উনুনের পাড়ে মোতার বশ-মানা কুকুর ফতু শুয়ে থাকে। ফতু নাম মোতার দেয়া। মোতা হাতের বস্তাটি বিছিয়ে দিয়ে চাদরে সারা শরীর মুড়িয়ে ফতুর গা-ঘেষে বসল। রান্নাঘরের চালার উপর আমড়া গাছের পাতায় জমে থাকা কুয়াশার টুপটাপ শব্দে ঝরে পড়া, দূরের ধঞ্চে ক্ষেত থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক, বাঁশঝাড়ের একটি বাঁশের উপর আরেকটি বাঁশের হেলে পড়ার কচকচ শব্দ, ছিটমহল ভাগের সময় ভারতে চলে যাওয়া প্রতিবেশি নরেন সরকারের শূন্য ভিটেতে কান্নার স্বরে কুকুরের আওয়াজ মধ্যরাতের হাহাকারকে বাড়িয়ে তুলল।


কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মোতা ফতুকে উদ্দেশ করে বলতে থাকল, ‘তোর যেমন কেউ নেই, আমারও তেমনি কেউ রইল না। আগের দিনগুলি কত সুন্দর ছিল! মা যেদিন আমাকে মারত নানা ছুটে এসে মায়ের সাথে রাগারাগি করত। মায়ের বকা খাওয়া দেখে আমি কাঁদতে কাঁদতে হেসে দিতাম। মায়ের হাতের ভাত শুধু নাপা শাক দিয়ে খেলেও মন ভরে যেত। সব এলোমেলো হয়ে গেল। মাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে। মা চলে যাবার পর থেকে মনে মনে খুব কষ্ট পাই কিন্তু কাউকে বুঝতে দিই না। এখন থেকে আমার অবস্থাও তোর মতো। তুই যেমন রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়াস তেমনি আমি সারাদিন টো-টো করে বেড়ালেও খোঁজ নেয়ার কেউ থাকল না। নানাকে ছাড়া আমি থাকব কি করে! নানা ছাড়া আমার যে কেউ…’

 

মোতা কথা শেষ করতে পারল না। বুকের সাথে চেপে ধরা দুই হাটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে দিয়ে হু-হু করে কাঁদতে কাঁদতে ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

সাত বছর অনেকটা সময়। বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশিদের মোতার কথা তেমন মনে পড়ে না। ভুলে গেছে। গিয়াসুদ্দীনের দাফনের পরদিন থেকে মোতাকে কেউ এলাকায় দেখে নি, সাথে ফতুকেও।


ভুলে নি শুধু একজন। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে নি। সন্তানের মুখের ডাক শুনবে বলে সারাদিন কান পেতে থাকে। ভরা পূর্ণিমায় সুরাইয়া বেগম মেয়ের পাশ থেকে উঠে এসে নিঃশব্দে দরজা খুলে উঠোনে নেমে উপরে তাকায়। সুরাইয়া বেগম চাঁদ দেখতে পায় না। দেখে, সাত বছর আগের চোখের পাতায় আটকে থাকা মোতার আলোয় ঝলমল করা মুখ। সুরাইয়া বেগমের মন বলে, একদিন না একদিন সব অভিমান ভুলে মোতা মায়ের কাছে ফিরে আসবে।



শরীফ উদ্দীন, সহকারি অধ্যাপক, অর্থনীতি, রুয়েট চত্বর, কাজলা, রাজশাহী
ছবি স্বত্ত্বঃ আনিসুল কবীর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top