সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বনবাংলোয় রহস্যময় রাত : মহীতোষ গায়েন


প্রকাশিত:
২০ আগস্ট ২০২০ ২২:৫৭

আপডেট:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৩৫

 

সকাল থেকেই রিমঝিম বৃষ্টি,কাজে মন নেই কারো। করোনা আবহে,স্কুল,কলেজ বন্ধ। আজ রান্নার মেয়েটিও আসেনি, দুপুর গড়িয়ে যায়,অনেক দিন থেকেই কিছুই ভালো লাগেনা রূপসার, কবিতা লিখতে বসে সে। ফোনে খাওয়ার অর্ডার দেয়, ফ্রাইডরায়েস আর তন্দুরী-চিকেন।অনলাইন ক্লাস শেষ করে রিয়াজ বলে, বেলা যে গড়িয়ে এলো আজ কি রেঁধেছো ? পেটে আজ তার হাঙরের খিদে, রিডিং রুম থেকে লিখতে লিখতে উঠে আসে রূপসা, বলে আজ বাইরে থেকে খাবার এসেছে। স্নান সেরে সটান ডাইনিং টেবিলে, আহার শেষ করতে না করতেই বাল‍্যবন্ধু অনিন্দ্যের টেলিফোন বেজে ওঠে...অনেক দিন থেকেই মালবিকা বলছে চলো না  কোথাও আউটিং-এ যাই, কোন নির্জন, নিরালায় প্রকৃতির কোলে দু' তিন রাত কাটিয়ে আসি। রিয়াজ বলে, ঝালং বনবাংলোয় গেলে কেমন হয় ? ওখানকার জলঢাকা নদী আর বিন্দু গ্রাম অপূর্ব।অনিন্দ্য রাজী হয়ে যায়। কথামত  সাররাত ধরে গোছানোর পালা শেষ।

 

পরদিন কাকভোরে কন্টেসা ভাড়া করে রওনা। অবশেষে পড়ন্ত বিকেলে বনবাংলোর কেয়ারটেকার সুধাময় নেমে আসে, বাবু, ভালো দেখে দক্ষিণমুখী দুটো ঘর বেছে নিন, আমি লাগেজপত্র পৌঁছে দিচ্ছি,ততক্ষণে

হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিন, আমি জলখাবার বানিয়ে আনছি।

সুধাময় আসে, বলে, এখন চিকেন পকোড়া আর গরম কফি খেয়ে নিন, রাতে ভালো খাবার বানিয়ে

দেবোখন। পরমতৃপ্তিতে খাওয়ার পর তারা চারপাশটা  ঘুরে দেখতে বেরোয়। কিছুদুর যাওয়ার পর আঁধার  ঘনিয়ে আসে, সবাই অর্কিড আর মাধবীলতা ফুলের গন্ধ পায়, রিয়াজের মাথাটা কেন জানি ঝিমঝিম করে ওঠে। অপূর্ব প্রকৃতির কোলে তারা যেন দেবশিশুর মতো ঘোরে। রাতে দেশী কাঁকড়ার ঝাল আর কচি পাঁঠার মাংস দিয়ে নৈশ আহার শেষে ঝুল বারান্দায় বসে গানের খেলায় মেতে ওঠে তারা, রিয়াজ ভালো তবলা বাজাতে জানে, টেবিলে তাল তোলে। রাত বাড়ে, যে যার ঘরে চলে যায়, প্রেমবিলাসে মেতে ওঠে, গভীর রাতে

চোখে নেমে আসে শান্তির ঘুম, হঠাৎ রিয়াজ শুনতে পায় ঘুঙুরের ত্রিতাল শব্দ, আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের নারী কণ্ঠের সুর, দু'চোখের পাতা এক হয়না তার।

 

পরদিন বৃহস্পতিবার, সকালে উঠে স্বস্তির নিশ্বাস। সুধাময়ের চা, জলখাবার রেডি, নানপুরী আর ছোলার ডালে ব্রেকফাস্ট সেরে জঙ্গলের অদূরে জলঢাকা নদীর ঝর্ণাধারা দেখতে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়।

সুধাময় বলে,জঙ্গলের মধ্যে বেশীদূর যাবেন না বাবু, আসার সময় বনদেবীর পুজো সেরে আসবেন, উনি বড় জাগ্রত, আবার রণচণ্ডী। অন্ধকার নামলেই বালোয় ফিরে আসবেন, আসলে এখানকার বিন্দু গ্রামের মানুষ এই বাংলোকে রহস্যবাংলো বলে। 

কেন? কেন? সবার প্রশ্নের উত্তরে সুধা বলে ১২বছর আগে এক পরিবার আসে, তাদের সাথে এক অল্পবয়সী দিদিমণি জঙ্গলে গিয়ে আর ফেরেনি।

অনিন্দ্যরা সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে বনদেবীর পুজো দিয়ে ফেরে,আসার সময় রিয়াজের রুমালটি দমকা হাওয়ায় হারিয়ে যায়, কি জানি এ কিসের ইঙ্গিত, রিয়াজ ভাবে, ভেবেই চলে। রাতে ফিরে এসে বনমোরগের ঝোল-ভাত খেয়ে অনাবিল জোৎস্নালোকে অর্কিড ফুলের মিষ্টিগন্ধ নিতে নিতে যে যার ঘরে চলে যায় তারা, সুধাময়

বলে বাবু দরজা ভালো করে বন্ধ করে রাখবেন, রাতে আমি ছাড়া কেউ ডাকলে দরজা খুলবেন না, আজ তো

পূর্ণিমা, বিন্দু গ্রামের লোক বলে এই বাংলোতে নাকি এক অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। শুনে হাড়হিম করা আতঙ্ক চেপে বসে তাদের মনে,রূপসা গায়ে মাখে না, বিছানায় রিয়াজের বুকে মাথা রেখে আদর খেতে শুরু করে, রাত বাড়ে, রূপসা ঘুমিয়ে পড়ে, পথকুকুরের করুণ ডাক শুনতে পায় রিয়াজ, ঠিক যেন আর্থার কোনান ডয়েলের রহস্য গল্পের কুকুরের ডাক, রাত্রি দুই প্রহর, আবার সেই ঘুঙুরের শব্দ আর পাগল করা গানের সুর ক্রমশ বাড়তে থাকে।

নিশিরাতের রহস‍্য-হাতছানিতে দরজা খুলে পা টিপে টিপে উপরে যায় রিয়াজ, মাদক সুর ভেসে আসা দরজায় কান পাতে, হঠাৎ প্রচণ্ড দমকা বাতাসে বন্ধ দরজা খুলে যায়,হাওয়ার প্রবল টানে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যায় সে, একি! সারা ঘরময় তার হারিয়ে যাওয়া মাধবীলতার গন্ধ কেন? সেই রহস্য-গন্ধ আর বিষাদ সুর-ঝংকারে সে অজ্ঞান হয়ে যায়, সারারাত রিয়াজ ওখানেই পড়ে থাকে।

 

ভোরের সূর্যের রক্তিম রশ্মি খোলা জানলা দিয়ে মুখে পড়ে রূপসার ঘুম ভাঙে, পাশে রিয়াজকে না দেখতে পেয়ে চিলচিৎকার জুড়ে দেয় সে, পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছে দাঁড়কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে। সুধাময়কে নিয়ে সবাই উপরে গিয়ে দেখে রিয়াজ পড়ে আছে, মুখে তার গোঙানির অস্ফুট আওয়াজ। ডাক্তার আসেন, ওষুধপত্র দেন। ১২বছর আগে সেই পরিবারের সাথে আসা মাধবী নামের মেয়েটির বিধর্মী ভালোবাসা জনিত পারিবারিক বিরোধ ও ছেলেটির ভীরু ভালোবাসার প্রবঞ্চনার করুণ পরিণতি- এই রকম এক পূর্ণিমা রাতে সঙ্গীতপটু মেয়েটির আত্মহত্যার কথা সব এখন খুলে বলে সুধাময়। রিয়াজ, আপলক চেয়ে থাকে সবার দিকে, মুখে কোন আওয়াজ নেই, কাউকেই সে চিনতে পারে না রূপসাকেও না। দুপুরবেলা আবার  ডাক্তারবাবু আসেন, অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলেন ও 'স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে, ওসব প্রেতাত্মা বলে কিছু হয়না, আসলে রিয়াজ বহু দিন ধরে হ‍্যালুসিনিয়েশনের মধ্যে আছে। কিছুদিন পরে স্বাভাবিক জীবনের  ছন্দ ফিরে পেলেও রূপসাকে সে আর কোনদিনই চিনতে পারবে না, যতদূর মনে হয় ঐ আত্মহত্যার সঙ্গে রিয়াজের অতীতের কোন কাহিনী নিশ্চিত জড়িয়ে আছে। রূপসার চোখে অন্ধকার নেমে আসে, বুক মোচড়ানো ব‍্যথা বেরিয়ে আসে। রিয়াজ তাকিয়ে থাকে রূপসার দিকে, কাউকেই চিনতে পারেনা সে, দু'চোখ বেয়ে ঝরে জলের ধারা, তার চারিদিকে এখন শুধু মাধবীলতার গন্ধ, তার প্রথম প্রেম, তার অপূর্ণ প্রথম ভালোবাসা।

 

ড. মহীতোষ গায়েন
অধ্যাপক, সিটি কলেজ, কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top