সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

একটি শব্দ, একটি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম  : সিরাজুল ইসলাম জীবন


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০২০ ২১:০৩

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৪৬

ছবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম

 

আলোচ্য সঙ্গীতটি বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত। এই গানটি আমি অজস্রবার শুনেছি। গানটির শিল্পগুণ এতটা উঁচুমানের যে, এর প্রশংসা করার কোনো পরিভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এই সঙ্গীতের একটি শব্দ টোটাল গানটিকে অসাধারণ সৌন্দর্য দান করেছে। এখন এই বিখ্যাত সঙ্গীতের কথাগুলো দেখে নিই,

মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম
ছিলাম নদীর চরে
যুগল রূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে।।
তমালতরু-চাঁপালতার মতো
জড়িয়ে কত জনম হলো গত
সেই বাঁধনের চিহ্ন আজো জাগে
জাগে হিয়ার থরে থরে।।
বাহুর ডোরে বেঁধে আজো ঘুমের ঘোরে যেন, 
ঝড়ের বনলতার মতো লুটিয়ে কাঁদো কেন? 
বনের কপোত-কপোতাক্ষীর তীরে
পাখায় পাখায় বাঁধা ছিলাম নীড়ে,
চিরতরে হলো ছাড়াছাড়ি নিঠুর ব্যাধের শরে।। 

উল্লিখিত গানটির প্রথম চরণের একটি শব্দ হলো 'হংসমিথুন'। এই একটি শব্দই পুরো গানটির নিওক্লিয়াস। এই শব্দটি সম্ভবত সঙ্গীতে নজরুলই প্রথম ব্যবহার করেন। এটি একটি সমাসবদ্ধ শব্দ। গানে নজরুল অজস্র সমাসবদ্ধ শব্দের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু এই শব্দটি তাঁর একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। এটি শুধু একটি শব্দই নয়; একটি উপমা, একটি প্রতীক, একটি রূপক, একটি চিত্রকল্প হিসেবে উপস্থাপিত। এই শব্দের ব্যঞ্জনা অনেক গভীরে প্রোথিত। 

প্রেম-প্রণয়, বিরহ-মিলন মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অবিচ্ছেদ্য অংশের অসাধারণ ও নান্দনিক প্রকাশ চিহ্নিত করতে কবি হংসমিথুন চিত্রকল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। সম্ভবত এরচেয়ে উপযুক্ত শব্দ আর বাংলা শব্দভাণ্ডারে নেই। পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে আনন্দঘন ও রোমান্টিক সময় বা ক্ষণ চিরকালই ক্ষণিকের। মহাকালের তুলনায় এর অস্তিত্ব নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। কবি অসাধারণ শিল্পকুশলতায় সেই অতি বিশেষ ক্ষণের বিমুগ্ধ চিত্ররূপ খুঁজে পেয়েছেন হংসমিথুন রূপক ব্যঞ্জনায়। কবি জীবনানন্দ দাশের 'আমি যদি হতাম' কবিতার সঙ্গে এই রূপকের কিছুটা সাদৃশ্য লক্ষণীয়। সেখানে কবি বনহংস-বনহংসীর অবতারণা করেছেন। কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও ভাব-ভাষায় বিস্তর পার্থক্য আছে। হংস-বনহংসের এই মিল একদম কাকতালীয়।  কবিতায় জীবনানন্দ সম্ভাবনার চিত্র অংকন করেছেন আর নজরুল উল্লিখিত গানে অতীত এবং বর্তমানের রূপ চিত্রিত করেছেন। তাই একটার সঙ্গে আরেকটা তুলনীয় নয়।  

গানটির প্রথম দুচরণ হলো, মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম/ ছিলাম নদীর চরে। প্রথমেই কবি মোরা শব্দ ব্যবহার করে যুগল কল্পনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বর্তমানের পৃথিবীতে আসার আগেই তারা আরেক পৃথিবীর বা অন্য জনমের বাসিন্দা ছিলেন। এবং সেখানে তারা যুগল রূপে তো ছিলেনই, ছিলেন হংসমিথুন রূপে। ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে এরচেয়ে উৎকৃষ্ট  উপমা আর হতেই পারে না। হংসের আবাস স্থল হিসেবে নদীর তীর বা চর খুবই নির্জন স্থান। তাই তারা আর জনমে হংসমিথুন রূপে নদীর চরে ছিলেন। তৃতীয় চরণ হলো, যুগল রূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে। অর্থাৎ এই জনমে  তারা আবার এসেছেন, নদীর চরে নয় মাটির ঘরে, মানে মাটির পৃথিবীতে। সুদূর অতীত থেকে কবি চলে এলেন বর্তমানে। নিখুঁত ভালোবাসার অসাধারণ ট্র্যাজি-কমেডি অংকন করে চলেছেন কবি।

গানের দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম দুচরণ হলো, তমালতরু-চাঁপা লতার মতো/জড়িয়ে কত জনম হলো গত। এখানে আবার কবি অসাধারণ উপমা তুলে এনেছেন। আবার অতীতচারী হয়েছেন। এনেছেন পূর্ব বঙ্গের একটি বিশেষ গাছ---তমাল। তমাল কৃষ্ণ বর্ণের গাছ। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিরূপ ভাবা হয়। মধ্য যুগের বাংলা গীতিকবিতায় এর এমন পরিচয় বিধৃত। সেই তামাল গাছকে সাপের মতো প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে চাঁপালতা। এবং এভাবে কত জনম গেছে তার হিসেব নেই। প্রেমের গভীরতা বুঝাতে কবি এই উপমাটি তুলে ধরেছেন। এখানে তমাল এবং চাঁপালতা হংসমিথুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। এরপরের দুচরণ হলো, সেই বাঁধনের চিহ্ন আজো জাগে/জাগে হিয়ার থরে থরে। অর্থাৎ তমালকে চাঁপালতার জড়িয়ে থাকা যে কত কালের ছিল, তার কোনো হিসেব নাই, তবে সেই বাঁধনের চিহ্ন এখনো জেগে আছে হিয়ার থরে থরে, মানে হৃদয়-কন্দরে সব সাজিয়ে রাখা আছে। অতীতকাল থেকে কবি বর্তমান কালেও সেই প্রেমের স্মৃতি চিহ্ন বহন করে চলেছেন। যার তুলনা একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের প্রেম পিপাসার সঙ্গেই হতে পারে।

গানটির শেষ স্তবকের প্রথম দুচরণ হলো, বাহুর ডোরে বেঁধে আজো ঘুমের ঘোরে যেন/ঝড়ের বনলতার মতো লুটিয়ে কাঁদো কেন? প্রথম চরণে যেন শব্দ ব্যবহার করে কবি সংশয় সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু পরের চরণে মতো শব্দ ব্যবহার করে যে উপমা ও চিত্রকল্পের অবতারণা করেছেন তাতে এক অন্তহীন যন্ত্রণা বা করুণ বেদনাঘন চিৎকার শোনা যায়। বাহুর ডোর কিন্তু ঘুমের ঘোর, আবার ঝড়ের বনলতা, যে বৃন্তচ্যুত হয়ে প্রচণ্ড ঝড়ের কুণ্ডলীর ভেতর পাক খেতে খেতে বারাবার লুটিয়ে পড়ছে, ঠিক এমন অসহায়ত্বের সঙ্গে কবি তার প্রিয়তমার অসহায়ত্বের মিল খুঁজে পেয়েছেন। বনলতার মতো লুটিয়ে কাঁদার কথা বলছেন। বিরহের করুণ রাগিণী কী মধুর স্বরে-সুরে সৃজন করলেন কবি, যা আমাদের পক্ষে আঁচ করাও ভীষণ কঠিন।পরের দুচরণে বলছেন, বনের কপোত-কপোতাক্ষীর তীরে/পাখায় পাখায় বাঁধা ছিলাম নীড়ে। এই গানের সবচেয়ে জটিল জায়গা হলো-- কপোত-কপোতাক্ষীর তীর। এর ব্যাখ্যা আমার কাছে খুবই দূরহ। অবশ্যই কবি এখানে রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। কপোত হলো পায়রা আর কপোতাক্ষী হলো পায়রার চোখ, কিন্তু কবি এরপর যখন তীরে শব্দ ব্যবহার করলেন তখন মনে হচ্ছে এই কপোতাক্ষী বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা ধারণ করে আছে। একদিকে যেমন হতে পারে চোখের তীর আবার হতে পারে কবির কল্পিত ভালোবাসার নদীর তীর। অর্থাৎ এই উভয় তীরই বিবেচ্য। যেই তীরে বা বনের পাশের নির্জন নদীতীরে যুগল পায়রা হয়ে পাখায় পাখায় বন্ধিত হয়ে নীড়ের ভেতর স্বপনঘোরের বাসিন্দা তারা। তবে এটা ছিল অনেক অতীত। সেই স্বপনঘোরে কত কাল কেটেছে তার হিসেব নেই। অন্তহীন প্রেম, অন্তহীন সময়। কিন্তু এরপরই ঘটলো বিনামেঘে বজ্রপাত। উন্মোচিত হলো বেদনার ক্লাইমেক্স-সমুদ্র। 

গানের শেষ চরণ করুণ রসের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। চরণটি হলো, চিরতরে হলো ছাড়াছাড়ি নিঠুর ব্যাধের শরে। এই একটি লাইন হংসমিথুন শব্দের দ্যোতনা লক্ষগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কবি অসাধারণ দক্ষতায় এই চরণে পুরাণ-মিথ ব্যবহার করেছেন।

গানের শেষ চরণ করুণ রসের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। চরণটি হলো, চিরতরে হলো ছাড়াছাড়ি নিঠুর ব্যাধের শরে। এই একটি লাইন হংসমিথুন শব্দের দ্যোতনা লক্ষগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কবি অসাধারণ দক্ষতায় এই চরণে পুরাণ-মিথ ব্যবহার করেছেন। আর জনমের প্রিয়তমা বর্তমানের পৃথিবীতে কীভাবে বিচ্ছিন্ন হলো তারই প্রতিভাস শেষ চরণটি। মিথলোজির অসাধারণ ব্যবহার গানটির আবেদন চিরকালের করে দিয়েছে। পৃথিবীর আদি কবি ছিলেন বাল্মীকি। তিনি তমসা নদীর তীরে আপন মনে ছিলেন । নদীতীরে ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চী প্রেমিক যুগল ছিলেন তখন মিথুনরত। এ অবস্থায় এক শিকারী বা ব্যাধ আচমকা ক্রৌঞ্চ অর্থাৎ প্রেমিক পাখিটিকে হত্যা করতে শর নিক্ষেপ করে। ততক্ষণাৎ পাখিটি রক্তাক্ত হয়ে ছটপট করতে থাকে। তখন স্ত্রী পাখিটি অর্থাৎ ক্রৌঞ্চী বেদনায় ক্রৌঞ্চর চারপাশে ঘুরতে থাকে। এই বেদনাঘন নির্মম দৃশ্য দেখে বাল্মীকি হয়ে গেলেন মহাকবি। কিন্তু চির বিচ্ছেদ হয়ে গেল ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর। গানের শেষ লাইনটিতেও কবির মানস প্রিয়ার সঙ্গে কবির চির বিচ্ছেদ হয়ে গেছে নিঠুর ব্যাধের শরে। কখনো তারা ছিলেন নদীর চরে, কখনো ছিলেন তমালতরু-চাঁপালতা হয়ে, আবার কখনো ছিলেন কপোতাক্ষীর তীরে। কিন্তু এই মাটির পৃথিবীতে তাদের চির বিচ্ছেদই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে পূর্বজনমের স্মৃতি। গানের ইতিহাসে এই গানটির আবেদন ও কাব্যকলা চরম সার্থকতায় পর্যবসিত।  সুরের ঐন্দ্রজালিক মোহে মোহাবিষ্ট থাকতে পারেন কিছুক্ষণ।

 

সিরাজুল ইসলাম জীবন
প্রভাষক (বাংলা), নজরুল গবেষক, কবি, গল্পকার



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top