সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

রাজার পোশাক-যুদ্ধ ও চৈত্য কথা : শান্তনু কুমার


প্রকাশিত:
২৬ আগস্ট ২০২০ ২০:৩৭

আপডেট:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৪০

 

গান্ধারের দাপুটে কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সেনা সামলাতে সব দেশের রাজারাই তখন কাহিল। ক্ষমতা বিস্তারে তিনি এদেশে (সেসময়ের ভারত) এসে জনৈক নাগরিকের কাছে দুটি চমৎকার বস্ত্র উপহার পান। রাজা একখানি নিজের জন্য রেখে আর একটি রাণীকে দিলে রাণী সেটি গায়ে দিয়ে রাজার সামনে হাজির হলেন। কিন্তু এ কি ! পোশাকে তামাটে রঙের হাতের ছাপ আর সেটি শোভা পাচ্ছে রাণীর ঠিক বুকের ওপর। সম্রাট তো এ দৃশ্য দেখে রেগে টং---- প্রিয়ে, এ কোন পোশাক তুমি পরেছ, আর এই হাত-ছাপের মতলবটাই বা কি ? রাণী বললেন, কেন, আপনি যা দিয়েছেন সেই একই পোশাক তো পড়েছি। ক্ষিপ্ত রাজা কোষাধ্যক্ষকে ডেকে এর ব্যাখ্যা চাইলেন। কোষাধ্যক্ষ বলল, কাপড়ের একটায় এরকম ছাপ তো আছেই। রাজা এবার সেই বস্ত্র ব্যবসায়ীকে তলব করলেন যে ওগুলি জনৈক ক্রেতা-নাগরিককে বিক্রি করেছিল। ব্যবসায়ী বলল, দক্ষিণ ভারতের রাজা সাতবাহন প্রতি বছর 'কর' হিসেবে পাওয়া এরকম হাজার হাজার সুন্দর পোশাক জড়ো করে তার ওপরে তামাটে রংয়ে হাত চুবিয়ে ছাপ দেন। সেই ছাপ পর পর সাজানো পোশাকগুলোর ওপর গিয়ে পড়ে। কোনো পুরুষমানুষ এটি যেভাবেই পরুক না কেন ছাপটি পড়বে পিঠের ওপর আর মহিলাদের ক্ষেত্রে তা পড়বে ঠিক বুকের ওপর।

 

রাজা তাঁর অনুচরবর্গকে ওই পোশাকগুলো পরার নির্দেশ দিলে দেখা গেল ব্যবসায়ী যা বলছে তা ঠিকই। ক্রোধে উন্মক্ত রাজা তরোয়াল ঠুকে চিৎকারে করে উঠলেন 'ওই সাতবাহন রাজার হাত আর পা-দুটো কেটে না ফেলা পর্যন্ত আমার দুচোখের পাতা এক করতে পারব না'--- এই বলে তিনি তাঁর আদেশ মান্য করতে একজন দূতকে দক্ষিণে পাঠালেন।

 

দূতের মুখোমুখি হয়ে সাতবাহন রাজা আর তাঁর মন্ত্রী মিথ্যে কথা সাজালেন--- 'আমাদের একজন ভালো রাজা আছেন সাতবাহন নামে, কিন্তু প্রকৃত রাজা তিনি নন, আমাদের মানে মন্ত্রীদের হাতেই রয়েছে কর্তৃত্ব আর সর্বময় ক্ষমতা।'

 

দূতের কাছে এ খবর শুনে, মারমুখী কণিষ্ক সাতবাহনকে ঘায়েল করতে তাঁর হস্তী ও অশ্বারোহী বাহিনীকে পাঠালেন। এদিকে প্রজারা রাজাকে একটি গুহায় লুকিয়ে রেখে কণিষ্কের সামনে সাতবাহন রাজার একটি স্বর্ণমূর্তি বানিয়ে পাঠাল। কিন্তু কণিষ্কর চোখে প্রজাদের এই চাতুরী ধরা পড়ে যাওয়াতে কণিষ্ক নিজের ক্ষমতা জাহির করেই ওই মূর্তিটির হাত ও পা দুটি ছেদ করে দিলেন। ঠিক সে মুহূর্তে গুহায় লুকোনো সাতবাহন রাজারও হাত ও পাগুলি  খসে পড়ল। 

 

৮৬০ খ্রিস্টাব্দে চীনা কবি Tuan Ch'eng-che রচিত এ কাহিনী তাঁর 'Yu yang tsa tsu' রচনার একাদশ অধ্যায়ে পাওয়া যায়। এর পূর্বে Wang  Hsiian-tzu's নামে আর এক চীনবাসী সপ্তম শতাব্দীতে বার কয়েক ভারতে এসেছিলেন। সম্ভবত তাঁর রচনা থেকেই তৈরী করা চীনা কবির উপরোক্ত কাহিনীটি। ১০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০৩০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাগুলি থেকে সংগৃহীত, পারস্য পণ্ডিত Al Biruni-র বর্ণনায় আরো একটি কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায় যেগুলি কানিক রাজা ও কনৌজের রাজার মধ্যে বস্ত্রসংক্রান্ত লড়াই বলে ভাবা হলেও আসলে তা ছিল কণিষ্ক ও সাতবাহন সম্পর্কিত উপরোক্ত কাহিনীটির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা প্রতিরূপ। কুষাণ সম্রাট প্রথম কণিষ্কের ওই পোশাক-যুদ্ধটি সাতবাহন বংশের গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর বা তাঁর পুত্র বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমভির রাজত্বকালের, সম্ভবত প্রথম শতাব্দীর শেষ ভাগের ঘটনা বলেই অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

 

রাজায় রাজায় যুদ্ধের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় সবিস্তারে আছে। থাক সেসব কথা। সাতবাহন কিন্তু প্রথম ঘাঁটিটি গেড়েছিল মহারাষ্ট্রে। দাক্ষিণাত্যের উত্তর পশ্চিমে এবং মহারাষ্ট্রে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে যে বৌদ্ধ ধর্মমন্দির বা চৈত্য গুহাগুলি গড়ে উঠেছিল সেগুলিই বিস্তার ও অর্থানুকূল্য লাভ করে সাতবাহন রাজত্বকালে। এগুলির মধ্যে পুণের কার্লে গুহাই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ । বোম্বাই ও পুণের মধ্যবর্তী লোনাভালায় অবস্থিত এই গুহাটি শুধু ভারতে নয় সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম। ধনী মহাজন ও বণিকরা এটিকে নির্মাণ করেছিলেন। এই পথ দিয়ে বণিকরা বাণিজ্য করতে যাবার সময় এখানে বিশ্রাম নিত। এর উপাসনা গৃহটি ১৪৮ ফুট লম্বা, ৪৫ ফুট চওড়া এবং উচ্চতাতেও প্রায় ৪৫ ফুট। ভিতরটা অনেকটা চার্চের ধাঁচে নির্মিত। দু-পাশে পনেরটি করে আটটি খাঁজবিশিষ্ট ত্রিশটি স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভে দুটি হাতি, উপবিষ্ট নারী পুরুষ কিংবা দুটি নারীর উন্নতমানের খোদাই মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।

 

সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র বা বাশিষ্ঠীপুত্র নামগুলি হয়তো মাতার নামের পরিচয় বহন করে। তা দেখে ধারণা হতে পারে সমাজে বা পরিবারে নারীদের ছিল উচ্চস্থান। যদিও বাস্তবে পরিবার ছিল পুরুষতান্ত্রিক এবং ব্রাহ্মণ্য প্রভাবযুক্ত। ধরে নেওয়া যায় ব্রাহ্মণ হওয়ার আগে সমাজজীবনে মায়ের পরিচয়েই ছেলের পরিচয় ছিল। অন্যদিকে, সাতবাহনের হাল নামে এক রাজার দ্বারা সংকলিত প্রাকৃত ভাষার 'গাথা সপ্তশতী' কাব্যের কিছু ছত্রে স্ত্রীদের স্বামীর প্রতি অভিমান-অনুরাগ-প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদের এরকমই কিছু কথা জানা যায়-

 

সে যুগে স্বামীরা যখন বর্ষার পরেই গৃহত্যাগ করত আর এক বর্ষা শুরুর পূর্বে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে---স্ত্রীদের দিন গোনা শুরু হত হাত পায়ের আঙ্গুল গুনে কিংবা দেওয়ালে দাগ কেটে। দিনের পর দিন অশ্রুপূর্ণ নেত্রে স্বামীর পথ চেয়ে থাকা--- এভাবেই দুশ্চিন্তায় শরীরের ক্ষয় হতে হতে হাতের গয়নাগুলোও একদিন গলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হত, গয়নাহীন বৌমার বিধবার বেশে ব্যথিত শ্বাশুড়ি (যদিও বৌমার দুর্দশায় তাঁর অন্তর কাঁদত না) ধরে নিত বিদেশে পুত্রের মৃত্যুর কথা। আবার কখনও পশ্চিমের একখানা মেঘ দেখে স্বামীর ঘরে ফেরার আশায় স্ত্রীর বসে থাকা--- মন তখন মরিয়া, প্রিয়কে কাছে পেতে---আবার বর্ষা যখন ঘন হয়ে মাটিতে পাকাপাকিভাবে নেমে আসে---- প্রিয়ার প্রত্যাশাটিও যেন সেই সলিলে সমাধিস্থ হয়ে যায়। কিংবা কখনও একাধিক স্ত্রীসঙ্গে আসক্ত স্বামীকে নিজের কাছে টেনে আনার জন্য শরীরের জ্বরকেও স্বাগত জানিয়ে আশীর্বাদ বলে মনে করে পরিত্যক্তা নারী, সে জ্বর যদি প্রাণঘাতী হয় তবুও ----

 

'By bringing that man

Who keeps his distance

To ask me how I'm feeling,

You have proved a blessing.

Now, fever, if you take my life,

I will not complain.'

 

পুণের কার্লে বৌদ্ধগুহা দর্শনের স্মৃতিরোমন্থনে আমার চোখের সামনে যেন উঠে আসে সে যুগের ইতিহাসের কয়েকটি পাতা আর অন্তর্লিখিত এক চলমান কাহিনী-----তা সে পুরুষকার রাজা রাজরাদের অসমসাহসিকতার বৃত্তান্ত হোক কিংবা অন্তঃপুরবাসিনীদের অশেষ বিচ্ছেদকাতরতার সজল গাথা হোক।

 

শান্তনু কুমার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top