আমার আনন্দ নিবাস : শাহিদা ইসলাম
প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২০ ২১:১২
আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০৩
আমার বাবা ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, মানুষ উনাকে দেখলে দূর থেকে সালাম দিতেন সন্মান করতেন। আমাকে দেখে শুনেই চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে দিলেন। সচ্ছল পরিবার, সবাই এক সাথে মিলে মিশেই থাকেন। সুখের সংসার, কোল জুড়ে সোনার পুত্র কন্যার জন্ম হোল। সেই সুখ বেশী দিন কপালে স্থায়ী হলো না, চৌধুরী সাহেবের। কঠিন অসুখ ধরা পড়ল, জমি জমা বেঁচে চিকিৎসা করানো হলো।
ফজর নামাজ পড়তে উঠে আমাকে ডেকে বলল, আজ শরীরটা ভাল লাগে না, নামাজ পড়তে কষ্ট হচ্ছে, চেয়ার দাও, বসেই পড়ি, উনার অভ্যাস ছিল নামাজ পড়ে চা, মুড়ি খাওয়া, আমি চা বানিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি সোজা হয়ে বসে আছে, চোখের পলক পরছে না। হাতে মুড়ির বাটিটা দিতে চাইলাম, কিচ্ছু বলে না।
নামাজের সামনে যেতে চাইছিলাম না, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একই অবস্থান দেখতে পেলাম। আমি চা মুড়ি হাতে দিতেই উনি ঢলে পড়লেন ক্ষনিকের মধ্যে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল, আমার সোনালী আকাশ থেকে শান্তির কবুতর হারিয়ে গেল।নিস্তব্ধতা নেমে এলো জীবনে, শুরু হল জীবন যুদ্ধ, ছেলে মেয়ে মানুষ করা। নগদ অর্থ কিছু ছিল না, জমি জমা কিছু সম্পত্তি ছিল মাঠে। নিজের দেবর ভাসুর লুট পাট করে নিল।
মেয়ে বিয়ে দিলাম, এক ধনী পরিবারে, মেয়ে জব করে একটা প্রাইভেট ফার্মে, দুজনার সুখের সংসার।
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। আমার শরিরের রক্ত পানি করে ওদের বড় করেছি,নিজের সুখ আহ্লাদ বলতে কি বোঝায় জানি না। মানুষ বিপদে না পড়লে কষ্টের মর্ম বুঝবে না, ছেলে মাহিন বিয়ে করল তার ক্লাসমেট আইরিন কে। মেয়ে ময়না ছেলে মাহিন, আমার কলিজার টুকরা। তারা আমার কষ্ট দেখলে পাগল হয়ে যেত। আমি সুসন্তানের গর্বিত মা।
বাড়িতে একাই থাকি, উনার চলে যাবার পর একা হয়ে গেছি। শহর আমার ভাল লাগে না, যন্ত্র আর মানুষ গুলি যান্ত্রিক। গাড়ির হর্নের আওয়াজে ঘুম হারাম হয়ে যায়। গ্রামে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
বড় ভাসুর কৌশলে সমস্ত জমি ভিটা তার নামে লিখিয়ে নেয়। জমির কাগজ আমি কিচ্ছু বুঝি না। এক সন্ধ্যায় আমার ঘরে বসে মিষ্টি মিষ্টি কথ বলে আমার কাছে একখানা কাগজ মেলে ধরল,মেঝ বউ আমাদের ভাইদের অনেক জমিজমা বে দখলে চরে পরে আছে, চরের লোকেরা চাষাবাদ করে, আমরা দখলে নেবার চেষ্টায় আছি, তুমি এই কাগজ পড়ে সাইন দাও। সৎ বিশ্বাসে না পড়েই সাইন দিলাম, এখন আমি ভিটে ছাড়া, শহরে মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। নাতি নাত্নির সাথে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প থেকে রাজা রাণীর কাহিনী বলি।
একদিন ফিসফিস করে কথাগুলি বলছে জামাই,
শোন ময়না, আমাদের ছোট বাসা, আম্মার জন্য বাচ্চারা রুম শেয়ার করবে আর কত দিন?
মাহিন ভাইয়ের বাড়িতে উনি যাক, আমরা মাসে মাসে গিয়ে দেখে আসব, প্রয়োজনীয় কিছু কিনেও দেব। মেয়ে বলছে, আমি জব করি, আমার নিজের টাকায় মাকে খাওয়াই, এই ব্যপারে আমাকে প্রেসার ক্রিয়েট করবে না।
আমি যেন লজ্জায় মাটিতে নুইয়ে গেলাম,এত অপমান জামাই বাড়িতে এসে হলাম।
সকালে মাহিন কে ফোন করে বললাম, বাবা তোমাকে কতদিন দেখি না, বাচ্চাদের, বউমাকে দেখতে ইচ্ছা করে, মাহিল জানালো, মা রেডি থেকো, অফিস শেষে নিয়ে যাব।
ছেলের বাড়িতে ঢুকতেই লিখা দেখলাম, কুকুর থেকে সাবধান, গেট খুলে দিল দারোয়ান। ভেতরে ঢুকতেই বুল ডগ ছুটে এলো,ছেলে আদর করে দিয়ে বলল, এই যে দেখ আমার মা যখন তখন গায়ে উঠবা না, নামাজ পড়েন উনি, তুমি ছুয়ে দিলেই নাপাক। বউ বাচ্চা নাস্তা করছিল, মাহিন সবাইকে ডেকে সালাম করতে বলল।
থাক থাক সালাম লাগবে না, বলে বুকে টেনে নিলাম, দাদু দিদা আমার বুকে এসো।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বাংলা বলে কম। মায়ের সাথে আর বাবার সাথে ইংলিশ বলে, আমাকে মেপে নিয়েই বাংলা বলছে। আমি দুচার টা বলতে পারি, তবে ওদের ভাষা সব বুঝি। বউমা আদর যত্ন করছে।
বাবুর্চি কে বলে দিল,আম্মা যা খায় রান্না করে দিবেন। আম্মা তো খেতে আসে নাই। আমাদের দেখতে এসেছেন।
মাথা গোজার একটা ছাউনি চাই মনে মনে বললাম। একটা রুম গুছিয়ে দিয়েছে, দোতলার সর্ব বামে, আগে হয়ত কেউ থাকত এই রুমে, কেমন সিগারেট আর ধোঁয়ার গন্ধ।
রাতে ছেলেকে জানালাম, বউমা বলল, তাহলে উনি গেষ্ট রুমে থাকুক, কটা দিনের ব্যপারই তো। মাহিন রেগে উঠল, কি বলো তুমি? উনি আমার মা গেষ্ট নন। উনি এই বাড়িতেই থাকবেন।
জ্যাসি মানে বউমা এবার গলা নামিয়ে বলল, মা থাকবেন ভালো কথা, থাকবেই তো।
আমি ঘুমাতে গেলাম, গভীর রাতে মনে হচ্ছে চিৎকার, মানুষের কথার আওয়াজ।
দরজা খুলতে ভয় পাই, তবু জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে নজর গেল। বিশাল একটা সাপ, মানুষ মারার চেষ্টা করছে। এটা মাটিতে থাকে না পানিতে থাকে, লোকে বলে পাইন্না সাপ।
আমি এখানে নতুন, কে শোনে আমার নিষেধ। একবার বলতে চাইলাম নিরীহ প্রাণী মেরো না। নিজেকে সাপের সাথে তুলনা করলাম।
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুকের ভেতর মনের অজান্তেই। সকালে নাস্তার টেবিলে তাড়াহুড়ো লেগে যায়, বউ, বাচ্চা, ছেলে সবার টাইম সকাল আটটা, ওদের নাস্তা মানে কর্নফ্লেক্স, দুধ আর স্যান্ডউইচ। আমি খাই পরাটা চা আর ডিম, সবাই চলে গেলে শুন্য বাড়ি।
কাজের মানুষ হাফ ডজন। কাজ ভাগ করা, রাধুনি রান্না ছাড়া অন্য কাজে হাত দেবে না, আমি এক জনের কাছে পানি চাইলাম, বলে এটা আমার ডিপার্টমেন্ট না, মানে কি? বলে কিচেনের কাছে যান টেবিল যে সাজায় এটা তার কাজ, আমি লন্ড্রির লোক, অহ বাব্বা এত লোক কেন এই বাড়িতে, পরে অবশ্য জেনেছি বউমা বড় চাকরি করে তার দৌলতে এত নকর-চাকর।
সন্ধ্যায় বিয়াই বিয়ান এলো, আমাকে দেখেই বলল কবে এলেন? আছেন তো কয়দিন? আমার বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে তার পর যাবেন। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
আবার বুকের ভেতর ফাঁকা লাগল। কেউ কি আমার মনের কষ্ট বুঝতে পারছেন।
যাচ্ছে একে একে দিন পার হচ্ছে ছেলের বাচ্চার জন্মদিন, আমি সকালে উঠেই একটু পায়েস রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছি, বিকালে নাতি স্কুল থেকে ফিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ঘর সাজানোর জন্য, আমি তাকে ফ্রি পাচ্ছি না, বউমাকে বললাম, মা বাবন কে আমি একটু পায়েস খাওয়াব না, আচ্ছা ফ্রি হোক খাওয়াবেন।
সন্ধ্যায় একে একে গাড়িতে ভরে গেল বাড়ির সামনে পিছনে চারিধারে। আমি বাক্স থেকে একটা শাড়ি বের করে পরলাম। ডুপ্লেক্স বাড়ির নিচতলায় কেক কাটার আয়োজন। গেষ্ট সবাই নিচে লনে বসে গল্প করছে, সিড়ি দিয়ে সবে নামতে যাব এমন সময় বউমা বলল ,মা নিচে যাবেন না, আমার মা বাবা এসেছেন, আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছিল, আমি মিথ্যা বলেছি, আপনি চলে গেছেন। এখন আমি নিজেই অপরাধী হয়ে গেলাম।
উপরে উঠে নিজের রুমে এলাম, হায় আল্লাহ, আমি এ কোথায় এলাম? ছিলাম তপ্ত কড়াইয়ের মধ্যে, এসে পড়লাম জ্বলন্ত উনুনে।
আমার স্বামীর ভিটা ছিল আমার নিশ্চিন্ত ঠিকানা, তাই যখন থাকল না, এতো পরের মেয়ে।
ছেলেকে বললাম বাবারে এখানে তো অনেক থাকলাম এবার আমাকে ময়নার বাসায় দিয়ে আয়। ছেলে মায়ের কথার সুর বুঝতে পারল।
মাগো মা আমি বা এই বাড়ির কেউ তোমাকে কোন অপমান সূচক কিছু বলেছি।
নারে বাবা আমার মন ছুটেছে, আচ্ছা ময়নার সাথে আজ ফোনে কথা বলে নেই।
ময়নার সাথে ছেলের কি কথা হলো জানিনা, সকালে ময়না এলো, আমার গলা জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল। গালে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, মা আমরা তোমার জন্য নতুন একটা ঘর কিনেছি, সেখানে তোমার মত অনেক মায়েরা আছেন। আমি বুঝে উঠার আগেই সব ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামল ময়না, গাড়িতে স্টাট দিয়ে বার বার হর্ন দিচ্ছে ছেলে। বাড়ির কাউকে ঠিকঠাক বলে বিদায় নিতে পারলাম না, গাড়িতে উঠলাম, ময়না আমার কোলের কাছে বসে হাত নাড়াচাড়া করছিল। একটা বিশাল জায়গার উপরে। বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম।
আমার রুমে আরও তিনজন থাকে। আমার একটা বিছানা সেখানে বসলাম, ছেলে মেয়ে আমাকে বুঝিয়ে বলে চলে গেল, আবার আসার কথা বলে গেল। আমার পাশের বেডের মহিলা বলল, এই বৃদ্ধা নিবাসে
আসলেন?
দুচোখের পানি যেন আর ধরে রাখতে পারলাম না। এখানে খুব ভাল আছি, খাইদাই আর ঘুমাই।
কেউ বলে না কবে যাবেন? লুকিয়ে থাকতে হয় না। এই আনন্দ নিবাস যেন হয় আমার শেষ নিবাস।
বিষয়: শাহিদা ইসলাম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: