সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

পিতৃপক্ষ : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১ অক্টোবর ২০২০ ২১:২৮

আপডেট:
১ অক্টোবর ২০২০ ২২:১৩

 

স্বর্গ আজ বেজায় সরগরম। সমস্ত লোক থেকে পিতৃপুরুষেরা এসে উপস্থিত হয়েছে বিশাল প্রান্তরে৷ আজ মহালয়া, মর্ত্যের মানুষেরা পিতৃপুরুষদের জলদান করবে৷ এক উচ্চ মঞ্চের ওপর বিশাল বিশাল এল. ই. ডি. টিভি শোভা পাচ্ছে। তার কয়েকটিতে মর্ত্য থেকে গঙ্গার ঘাটের ছবি ডাইরেক্ট টেলিকাস্ট হচ্ছে৷  যদিও এখন গঙ্গার ঘাট প্রায় জনশূন্য, কয়েকজন ব্রাহ্মণ জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে বসছে, রাত্রির অন্ধকার সারা গঙ্গাবক্ষ জুড়ে। আরো কয়েকটি টিভিতে স্বর্গের নিজস্ব চ্যানেল চলছে, এখানে যাদের উদ্দেশ্যে জলদান হয়ে যাবে তাদের নাম দেখাবে। এমন সিস্টেম করা আছে, যাদের নাম চ্যানেলে উঠবে সেই সব তৃপ্ত আত্মা সাঁ করে মুহুর্তকালের মধ্যে নিজ নিজ লোকে পৌঁছে যাবে। মঞ্চ ছাড়াও গোটা মাঠ জুড়ে কয়েকশো টিভি আর ডিসপ্লে বোর্ড ছড়িয়ে আছে। কেউ ইচ্ছে করলে তাঁর উদ্দেশ্যে সন্তানদের জলদান পর্ব টিভিতে এবং  নিজের নাম ডিসপ্লে বোর্ডে দেখতে পারবে৷ রাতের বেলাতেও এখানে একটা নির্মল নীলাভ আলো রয়ে যায়। পবিত্রবাবু টিভির দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ঘুমটা ভেঙে গেল সম্বৃতের৷ ডাইনিংয়ের টিউবলাইটের আলোটা সোজা চোখে এসে পড়েছে। চোখ চাইতে খুব কষ্ট হচ্ছে, একটু সময় লাগলো ধাতস্থ হতে। এমন সময় পাশের ঘর থেকে ভেসে এলো, "আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা.....'। সম্বৃতের মনে পড়লো -আজ মহালয়া। মহালয়া শেষ হলে বাবা গঙ্গার ঘাটে যাবে তর্পণ করতে। সম্বৃত নিজের মনেই হাসলো , বালিশটা জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরলো। কিছুক্ষণ পর শব্দটা অসহ্য লাগায় বালিশটা কানে চেপে ধরলো।

ছোটবেলায় মহালয়ার এই ভোরটির জন্য উদগ্রীব অপেক্ষা করতো। তখন মানে দাদু যতদিন বেঁচে ছিলো। জীবনের শেষ দুবছর দাদু বাড়িতেই তার পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ সেরেছে। তখন দাদু বিছানা থেকে প্রায় উঠতোইনা। সম্বৃতই হাতের কাছে সব জিনিস এগিয়ে দিতো। দাদু চলে যাবার পর এই প্রথম মহালয়া। কষ্ট হয় যখন মনে পড়ে , কি কষ্ট, অবজ্ঞা, অপমানের মধ্যে দিয়ে দাদুর শেষ জীবনটা কেটেছে।

হঠাৎ পবিত্রবাবুকে চমকে দিয়ে সমবেত ভিড়টা নড়ে চড়ে বসলো। টিভি চ্যানেলগুলো চলতে শুরু করেছে। মর্ত্যের টিভিতে অনেকগুলো গঙ্গার ঘাট পাশাপাশি, সানন্দ টিভি স্বর্গের কাছ থেকে বরাত পেয়েছে সরাসরি তাদের অনুষ্ঠান স্বর্গবাসীদের দেখানোর। প্রতিটি ঘাটে একটি দুটি করে লোক, অন্ধকার এখনো সম্পূর্ণ কাটেনি। তাদের তর্পণ ও জলদান পর্বের সাথে সাথে একটি দুটি করে নাম বোর্ডে ফুটে উঠছে , সেই সব স্বর্গবাসীর আত্মা পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ লোকে। তবে এত লক্ষ লক্ষ জনের মাঝে কোথা থেকে একজন- দুজন উবে যাচ্ছে বোঝার উপায় নেই। পবিত্রবাবু আর পাঁচজনের মতো একবুক টেনশন নিয়ে একবার টিভির দিকে আর একবার ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে তাকাতে লাগলেন।

সম্বৃতের জন্মের আগেই ঠাকুমা মারা যায়। দাদুর তখন অবসর নিতে কয়েকমাস বাকি। সম্বৃতের বাবা তখন সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে কলকাতায় একটা চাকরিতে ঢুকেছে। দাদু চোখে অন্ধকার দেখলেন। সংসার কি জিনিস কখনো তার জানার প্রয়োজন পড়েনি, চিরকাল নিভানলিনীই সামলেছে। এখন তাঁর চলে যাওয়ায় দুই অর্বাচীন পুরুষ সংসার নামক সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে লাগলো। তাদের নাকানি-চোবানি দেখে আত্মীয়-বন্ধুরা এগিয়ে এসে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধার্থের বিয়ে দিয়ে দিলো। বিয়ের পর প্রথম ছমাস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন পবিত্রবাবু। ওই ছমাসই তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হতে বাকি ছিলো। তারপর সম্পূর্ণ উল্টো গল্প, অবসরের পরই পবিত্রবাবু জীবনে প্রথম বুঝতে পারলেন -সংসার ধর্মের আসল অর্থ।

আস্তে আস্তে স্বর্গের আকাশে নীল স্বপ্ন রং কেটে উজ্জ্বল সাদা রং ছড়িয়ে পড়ছে। মর্ত্যে গঙ্গার ঘাটে ভিড় বাড়ছে। মাঝে মাঝে কোনো নির্দিষ্ট ঘাটকে গোটা পর্দা জুড়ে দেখাচ্ছে। তখন সব মানুষজনকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। যখনই এটা ঘটছে তখনই কাছে দূরে কোথাও একটা জিতে যাওয়ার উচ্ছাস শোনা যাচ্ছে। কখনো কখনো দুয়েকজনকে হাত উঁচু করে ভিড়ের মধ্যে 'ভিক্টরি ল্যাপ', দিতেও দেখা গেলো। চোখ দুটো যতটা সম্ভব প্রখর করেও টিভির বুকে কোনো চেনা মানুষের সন্ধান পেলেননা পবিত্রবাবু।

সম্বৃতের চোখটা একটু লেগে গিয়েছিলো, ওঘরে এখন মহালয়া শেষ হয়ে পুরোনো বাংলা গান শুরু হয়েছে। দরজা বন্ধের আওয়াজে বুঝলো বাবা গঙ্গাঘাটের দিকে রওয়ানা হলো। বাবা কাল সম্বৃতকে গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার জন্যে বলেছিলো। সে সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিয়েছে। বাবা আর ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটায়নি। সম্বৃত মনে মনে আওড়ায়...মুখ আছে নাকি কিছু বলার! জানে তো বেশি কিছু বললে সম্বৃতের দিক থেকে যেগুলো ধেয়ে আসবে সেগুলো শুনতে মোটেই ভালো লাগবেনা।

অন্ধকারের চাদরটা ছিঁড়ে আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে; দাদুর হাত ধরে ভোরের শিশির মাড়িয়ে হেঁটে চলেছে সম্বৃত। বাড়ি থেকে আধঘন্টার হাঁটাপথ। দাদু যেতে যেতে  ‘মহিষাসুর মর্দিনীর' গল্প বলতো। একটা সময় সমস্ত শিল্পীরা মিলে এই অনুষ্ঠানটি লাইভ করতেন। দাদুরা সেই সময় আকাশবাণীতে গিয়ে হাজির হতো। ভিতরে ঢোকা বারণ, তবে বাইরে মাইকের ব্যবস্থা ছিলো। দাদুরা বাইরে দাঁড়িয়ে সেই অনুষ্ঠান শুনত। সবচেয়ে উত্তেজনাকর ছিল, তাদের চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক শিল্পী গাড়ি থেকে নেমে আকাশবাণীতে ঢুকতেন। গঙ্গার ঘাট ভিড়ে ভিড়াক্কার। দাদু সম্বৃতকে ঘাটের একদম ওপরের পৈঠায় বসিয়ে জলে নামতেন। স্নান সেরে ঘটি করে জল এনে তার মাথায় ছিটোতেন....আর মন্দ্র স্বরে মন্ত্রপাঠ করতেন....। একটু বড় হয়ে এই গঙ্গার ঘাটেই দাদুকে জীবনে প্রথম কাঁদতে দেখেছিলো।

একজন সাধারণ কেরানী হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন পবিত্রবাবু। তাঁর অধ্যবসায়, সততা, পরিশ্রম করার মানসিকতা এবং সর্বোপরি কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ধাপে ধাপে প্রমোশন হতে হতে অ্যাসিস্টান্ট ডিরেক্টরের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। মাস গেলে মাইনের টাকাটা নিভানলিনীর হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। তাদের একটিই সন্তান, নিভানলিনী সংসার এবং সন্তান দক্ষ হাতে সামলে নিত , পবিত্রবাবুকে জড়াতেননা। পবিত্রবাবু নিজের চাকরি আর টুকটাক লেখালিখি নিয়ে থাকতেন। অবসরের পর ছেলের সাথে খিটিমিটি শুরু হলো। ছেলে আর বউয়ের দাবি ছিল , পবিত্রবাবু পেনশনের পুরো টাকাটা ওদের হাতে তুলে দিক। প্রথম প্রথম আপত্তি করলেও কয়েক বছর পর উনি ওদের কথা মেনে নিয়ে টাকাপয়সার দায় থেকে মুক্তি নিয়েছিলেন। সেবছর মহালয়া পড়েছিলো 2 রা অক্টোবর , পবিত্রবাবু পেনশন তুলতে যেতেন মাসের পয়লা তারিখে৷ টাকা তোলার কাজ অনেক আগেই হয়ে যেত, পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে গল্পগুজব করে সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি ফিরতেন৷ সিদ্ধার্থের অফিসে মাহিনা হতে সাত-আট তারিখ হয়ে যেত, তাই তারা স্বামী-স্ত্রী এই দিনটায় হাঁ করে বাবার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকতো। পবিত্রবাবু ফিরে স্নান সেরে ঘরের জামাকাপড় পরে চা-জলখাবার খেতেন। তারপর নিজের ঘরে ছেলেকে ডেকে পেনশনের পুরো টাকাটাই তুলে দিতেন। সেবার দাদু বাবাকে টাকা দেওয়ার পর কথাকাটাকাটি শুরু হলো, তারপর মা এসে যোগ দেওয়ায় বিষয়টি অচিরেই ঝগড়ায় পরিণত হলো। কথাবার্তায় সম্বৃত বুঝল, দাদু এমাসে পাঁচশো টাকা কম দিয়েছে৷  কিছুক্ষণ পর বাবা দাদুকে 'চোর,' বলে ভর্ৎসনা করতে শুরু করলো আর মাও তাতে সাথ দিলো। পরেরদিন মহালয়ার ভোরে সম্বৃত দেখেছিলো দাদুর চোখের লোনা জল গঙ্গার ঘোলা জলে ধুয়ে যাচ্ছে।

এখন প্রচন্ড গতিতে কাজ চলছে। মঞ্চের ওপর চিত্রগুপ্ত, বিচিত্রগুপ্ত এবং আরোও কয়েকশো কর্মীভাইয়েরা নিজ নিজ ল্যাপটপের কি বোর্ডে ঝড়ের গতিতে হাত চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিশাল মাঠের অর্ধেকের বেশি ফাঁকা। পবিত্রবাবুর লোক থেকে যারা এসেছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই আত্মা পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে গেছেন। আশপাশে চেনামুখ কমতে শুরু করেছে। এখন চারপাশে তারই মতো অনেকে উৎকণ্ঠা নিয়ে উদগ্রীব অপেক্ষায় আছে। তাঁদের মধ্যে যাদের নাম বোর্ডে আসছে বা সন্তানসন্ততিদের বড় টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে আনন্দে চিৎকার করে উঠছেন। এতক্ষণ ধরে ওই উজ্জ্বল পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পবিত্রবাবুর চোখে যন্ত্রনা শুরু হয়েছে। অন্যত্র দৃষ্টি সরাতে ঘোলাটে দুচোখে জলের ধারা নেমে এলো, জামার হাতলে চোখ মুছে আবার টিভির পর্দায় চোখ রাখলেন। এতক্ষন দেখতে দেখতে উনি কলকাতার উপকন্ঠে নিজেদের ঘাটটা চিনতে পেরেছেন। সবঘাটগুলিকে সবসময় দেখাচ্ছেনা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে। টিভির ছেলেটিকে দেখে তিনি নিজের ঘাট চিনে নিতে পারছেন। সকাল থেকে ভিড় বাড়তে বাড়তে গঙ্গার ঘাটে এখন তিলধারণের জায়গা নেই। বেশ কয়েকটা চেনা মুখের দেখা মিলেছে, কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিজের ছেলের দেখা পায়নি। তবে কি সিধু আসবেনা! জীবদ্দশায় যাই করুক , মৃত্যুর পর বাপের মুখে একফোঁটা জল দেবেনা?  অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, সিদ্ধার্থকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। কিছুক্ষণ আগে ভিড়ের মধ্যে সিদ্ধার্থের মতো কাউকে একবার দেখলেন কিন্তু মানুষের প্রবল হুল্লোড়ে কোথায় ছিটকে গেল আর দেখতে পেলেননা। এখন ঠিক দেখেছিলেন কিনা সেটা নিয়েও ধন্দ আছে। আর নিশ্চয়ই ওটা সিদ্ধার্থ ছিলোনা, তাহলে তো এতক্ষনে তাঁর মুক্তি পাওয়ার কথা। হঠাৎ একটা কথা ভেবে পবিত্রবাবু ভয়ে কেঁপে উঠলেন--ছেলেটার কিছু হলোনা তো! অত ভিড়ের মধ্যে, ঠেলাঠেলি, মারামারি, পবিত্রবাবু ছেলের মঙ্গল কামনায় দুই হাত ওপরে তুলে ভগবান বিষ্ণুর নাম নিলেন।

মা বারংবার ডাকাডাকি করলেও বিছানা ছেড়ে উঠলোনা সম্বৃত। জানলা বন্ধ থাকায় ঘরে এখনো অন্ধকার থমকে আছে, চোখের কোনায় আর বালিশে জলের দাগ। দাদুর কথা ভাবলে আঠারো বছরের সম্বৃতের পৃথিবীটা কেমন ফিকে মনে হয়৷ বুঝতে পারে পড়াশোনায় যথেষ্ট মন দেওয়া হচ্ছেনা, দাদু থাকলে খুব বকাবকি করতো। কিন্তু যখনই দাদুর কথা মনে হয় , তখন কি এক অন্ধ আক্রোশে তার চোখ মুখ কঠিন হয়ে যায়। দিন দিন সে কিরকম চুপ মেরে যাচ্ছে। বাড়িতে নিদেনপক্ষে কথা বলেনা, বন্ধুবান্ধবদের সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে।

মা এসে জানালা গুলো খুলে দিয়েছে। মফস্বল শহরের এখনো সবাইয়ের বাড়ির চারপাশে অনেক গাছপালা। ঠাকুমা যখন বেঁচেছিলো তখন মালি দিয়ে অনেক গাছ বসিয়েছিলো। দাদু কখনো বাগানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। এসব দাদুর কাছ থেকে শোনা। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন বাগানটা জঞ্জাল হয়ে পড়েছিল। তারপর গত কয়েকবছর একজন মালি মাসে একবার করে এসে বাগানের শ্রী কিছু ফিরিয়েছে। সম্বৃত লক্ষ করেছে দাদু একটা গাছের ব্যাপারে প্রচন্ড যত্নবান ছিলো। মালি রাখার আগেও ওই জঙ্গলাকীর্ণ বাগানের শিউলি গাছটার নিত্য পরিচর্যা করতো। সম্বৃত একটু অবাক হতো, দুয়েকবার জিজ্ঞাসা করে কোনো উত্তর পায়নি। জীবনের শেষ দুবছর এই মহালয়ার ভোরে দাদু স্নান সেরে এই গাছটার গোড়ায় জল দিয়ে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করতো। সেই সময় দাদু একদম শয্যাশায়ী, বাইরে বেরোতইনা , সম্বৃতের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলো। বাগানের মধ্যে একমাত্র এই গাছটাই ঠাকুমার নিজের হাতে লাগানো।

ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, সেই মাঝরাত থেকে এই উন্মুক্ত মাঠে বসে আছেন। স্বর্গে বছরের সব সময়ই একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলে। বেঁচে থাকাকালীন পবিত্রবাবু চিরকাল সর্দি-কাশিতে ভুগতেন। এখানে পৃথিবীর মতো অসুখগুলো না থাকলেও একটু ঠান্ডা আবহাওয়াতে তিনি এখনো কাতর হয়ে ওঠেন। এখন তিনি চুপচাপ মুখ নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। তাঁর সব আগ্রহ - উদ্দীপনা নিভে গেছে; এই বিশাল মাঠ প্রায় জনশূন্য। স্বর্গের টিভিতে দেখা যাচ্ছে কয়েকঘন্টা ঘাড় গুঁজে একনাগাড়ে কাজ করে চিত্রগুপ্ত, বিচিত্রগুপ্ত, মঞ্চের আরো অনেকে মিলে চা খাওয়ার অবকাশ পেয়েছে। সারা মাঠে খুব বিক্ষিপ্ত ভাবে পবিত্রবাবুর মতো কয়েকজন দুর্ভাগা বসে আছেন। সবারই মনের অবস্থা একইরকম। গঙ্গার ঘাট প্রায় জনশূন্য হতে চলেছে, পিতৃপক্ষের অবসানের আর বেশি দেরি নেই। যাদের মুক্তি হবেনা, রয়ে যাবে -চিত্রগুপ্তের খাতায় তাদের নাম নথিভুক্ত হবে, তারপর অন্য লোকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে । সেই লোক সম্বন্ধে পবিত্রবাবুর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। উনি বাস্তব ভুলে বোধবুদ্ধিহীন একটি জড়স্তুপের মতো বসে রইলেন।

জানালা দিয়ে সকালের প্রথম রোদ ঘরে ঢুকেছে, এখন সেটা লম্বা হতে হতে মশারীর চাল ছুঁয়ে ফেলেছে। সম্বিত আস্তে আস্তে উঠে বসে। এবারে শিউলি গাছটায় ঝেঁপে ফুল এসেছে। সকালবেলা গাছের নিচটা সাদা ফুলে ভরে থাকে। কখনো কখনো এক-আধটা ফুল টুপ করে জানালা গলে ঘরের মেঝে এসে পড়ে। একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়ায়। এইরকম এক শারদ দিনেই বাবা দাদুর গায়ে হাত তুলেছিল।

সারা মাঠ শূন্য, আশপাশে কেউ নেই। শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর মাথা নিচু করে বসে আসেন পবিত্রবাবু। দূরে মঞ্চ খোলার তদবির চলছে। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবী পক্ষ শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ। একটা গভীর কষ্ট গোটা বুক জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। মান-অভিমান, কষ্ট-যন্ত্রনাগুলো স্বর্গে এসেও পিছু ছাড়েনি। ছেলের ওপর অনেকদিন আগেই বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। ছেলের বউয়ের ওপর কোনো রাগ নেই-সে তো পরের বাড়ির মেয়ে। নিজের ছেলেই যদি অমানুষ হয়, পরের ঘরের মেয়ে এসে যেমন দেখবে, তেমনই নিজের আচরণ তৈরি করে নেবে। একমাত্র পার্থিব টানটা রয়ে গেছে নাতিটার জন্যে, বড্ড নেওটা ছিল। আর কি ভালোই না বাসতো তার দাদুকে। নাতির কথা মনে পড়লে বুকটা বড় টনটন করে। ওইটুকু ছেলে নিজের বাপ-মায়ের হাতে দাদুর অপমানটা অনুভব করতো। চোখের জল বাধা মানছেনা, শিশিরে ভেজা মাটি চোখের জলে আরো সিক্ত হয়ে উঠলো।

মহালয়ার পর থেকে যে কদিন স্কুল খোলা থাকে সম্বিতের স্কুলে পূজোর আমেজ চলে আসে। শিক্ষকরাও আর পড়ার জন্য তত চাপ দেননা, এরকম এক দিনে সম্বিতের তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে দেখে দাদু ভাত খাচ্ছে, আশপাশে কেউ নেই। সম্বিত স্কুলের কাপড়েই দাদুর পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। দাদু হাঁসি মুখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কারণ জিজ্ঞাসা করে আবার খাওয়ায় মন দেয়। সম্বিত খেয়াল করে দেখলো দাদু শুধু ডাল আর তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছে। ও জিজ্ঞাসা করে, " দাদু তুমি শুধু ডাল আর তরকারি দিয়ে খাচ্ছ কেন, আজ মাছ হয়নি?" বাড়িতে বৃহস্পতিবার ছাড়া রোজ মাছ হয়, আজ বৃহস্পতিবার নয়। দাদু প্রথমে কোনো উত্তর দিলোনা। জোর করতে দাদু উত্তর দিলো, “আজকাল মাছ খেতে ভালো লাগেনা৷” সম্বিত বিশ্বাস করলোনা। দাদুর চোখ-মুখ অন্য কথা বলছে। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দাদুকেই জিজ্ঞাসা করলো, "মা কোথায়?" যদিও জিজ্ঞাসার দরকার ছিলোনা; বাবা-মায়ের দরজা আলতো ভাবে ভেজানো, ভিতর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। তার মানে রোজ দাদুকে এভাবেই খেতে দেওয়া হয়, খাবার সময় পাশে দাঁড়িয়ে কেউ জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন বোধ করেনা করেনা মানুষটার আর কিছু লাগবে কিনা! সম্বিতের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেলো। উঠে বাবা-মার ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে মাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো, " দাদুকে মাছ দাওনি কেন?" অর্পিতাদেবী ছেলে ফিরে আসা টের পাননি, দরজা থেকে হুড়মুড় করে ছেলের ঢুকে আসা, ঐরকম ভাবে কৈফিয়ত চাওয়া -প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। কিছুটা সামলে নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, " কে বললো?"

সম্বিত মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, " আজ বাড়িতে মাছ হয়নি? দাদু শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছে, দাদুকে মাছ দাওনি?" ততক্ষণ পবিত্রবাবুও এঁটো হাতেই ঘরে ঢুকে এসেছেন। উদ্বেগের স্বরে বলে ওঠেন, " বাপান, কি হচ্ছে? আমি তো তোমায় বললাম আমার মাছ খেতে ভালো লাগেনা।" সম্বিত দাদুকে হাত তুলে চুপ করিয়ে দেয়। মায়ের দিকে ফিরে গলাটা আরেকটু তুলে জিজ্ঞাসা করে, " কি হলো উত্তর দিচ্ছনা কেন? দাদুকে মাছ দাওনি কেন?" অর্পিতাদেবী এবার নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়েছেন, শ্বশুর মশাইয়ের সামনে তার সাথে ছেলের এই ব্যবহারে আস্তে আস্তে তার মেজাজও গরম হয়ে উঠেছিল। ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমান উদ্ধত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, " তোকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে'"

সম্বিত বললো, “কৈফিয়ৎ নয়, আমি জানতে চাইছি উত্তর দাও৷”
“কেন দাদুর উত্তরে তুই সন্তুষ্ট না!”
সম্বিত উত্তর করে, “না!”

পবিত্রবাবু সম্বিতকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাবার জন্য হাত ধরে টানেন, সম্বিত ঝটকা মেরে দাদুর হাত সরিয়ে দেয়। মায়ের আরো কাছে এগিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, " তুমি ইচ্ছা করে দাদুকে মাছ দাওনি, তাই না!"

অর্পিতাদেবী কঠিন চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছেলের চোখ লাল হয়ে গেছে, গলা ভেঙে গেছে, ছেলের এই রূপ আগে কখনো দেখেননি। মনে মনে ভয় পেয়ে গেলেও চোখ মুখে প্রকাশ করলেননা। ছেলের গলায় এবার ঘৃণা ও ভর্ৎসনা মিশে গেল, চোখমুখ কুঁচকে বললো, " ছি ছি, তোমরা এত নীচ! এত নোংরা তোমাদের মনোবৃত্তি!" অর্পিতাদেবীর আর সহ্য হলোনা, ঠাস করে ছেলের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। অসহায় পবিত্রবাবু এবার নাতিকে জড়িয়ে ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আঠারোর যৌবনে দীপ্ত এক যুবার সাথে পঁয়ষট্টির প্রৌঢ়ের গায়ের জোরে পারার কথা নয়। তবুও তিনি দরজার কাছে নিয়ে যেতে পারলেন। দরজার কাছে এসে সম্বিত রাগ-অপমান-কষ্ট মিশ্রিত বিকৃত গলায় চিৎকার করে উঠলো," লজ্জা করেনা! যে লোকটার পেনশনের টাকার জন্য প্রতিমাসে হা-পিত্তেশ করে বসে থাকো, তার পয়সায় নিজেরা মাটন-কোর্মা খেয়ে বুড়ো লোকটাকে শাকপাতা দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছো! তোমাদের ছেলে হয়ে জন্মেছি ভেবে আমার লজ্জা -ঘেন্নায় সারা গা ঘিন ঘিন করছে!” এই বলে ঘরে একদলা থুতু ফেলে দাদুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।

পবিত্রবাবু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। সবকটা টিভি আর ডিসপ্লে বোর্ডে আর কোনো কিছু দেখাচ্ছে না। বিদ্যুৎ চলে গেলে টিভির পর্দা যেমন ঝির ঝির করে তেমন করছে; অর্থাৎ আজকের অনুষ্ঠান শেষ। সিধু তাহলে মরার আগের রাগ এখনো পুষে রেখেছে! মনের কোনায় জমিয়ে রাখা এত রাগ তিনি আগে কখনো টের পাননি, আর সঠিক কারণও কারণও কিছু খুঁজে পাচ্ছেননা । হ্যাঁ, আর পাঁচটা বাবার মতো যথেষ্ট সময় হয়তো ছেলেকে দিতে পারেননি, কিন্তু কখনো অবহেলাও করেননি। সাধ্যমত আবদার মিটিয়েছেন, পড়াশোনার ব্যাপারেও কোনো কিছু চাপিয়ে দেননি। তাহলে কেন এত রাগ তার বাবার ওপর!

সেই রাত্রের কথা ভাবলেও এখনো তিনি কেঁপে ওঠেন। কোন পাপে তাঁকে ছেলের হাতে এত হেনস্থা কোনো হয়! অফিস থেকে ফিরেই বউয়ের কাছে সব শুনে সোজা এঘরে হানা দেয় সিধু। এটাই দাদু-নাতির শোবার ঘর। পবিত্রবাবু চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন, বাপান টেবিলে বসে পড়াশোনা করছিল। সিধু ঘরে ঢুকেই পবিত্রবাবুর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, " ছি ছি বাবা! তোমার এত অধঃপতন! নাতিকে উস্কে ছেলের বউকে অপমান করতে পাঠালে!" পবিত্রবাবু বিছানায় উঠে বসার সময় পর্যন্ত পেলেননা, আবার ধেয়ে এলো বাক্যবান, " এই বয়সে তোমার যখন এত নোলা, প্রতিদিন সকালে কি কি তোমার গিলতে ইচ্ছে করবে তার একটা লিস্টি করে দিও। আমি আর তোমার বৌমা সারাদিন খিদমত খেটে তার যোগান দেবো।" পবিত্রবাবু এবার উঠে দাঁড়ালেন, তার কোন ভোঁ ভোঁ করছে, মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো, কোনরকমে বলতে পারলেন, " এটা তুই কি বলছিস! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?"

" আমার না, মাথা তোমার খারাপ হয়ে গেছে। আর মনটা কুচুটেপনায় ভরে গেছে.....এখন আমার ছেলেটাকেও নষ্ট করে আমাদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলছো।" পবিত্রবাবু একবার সম্বৃতের দিকে তাকিয়ে দেখেন, কঠিন চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

পবিত্রবাবু বলেন, " কোথা থেকে কি শুনে তুই বাপের কাছে কৈফিয়ত চাইছিস?"

“কোথা থেকে মানে? তোমার বৌমা বাইরের লোক?”

পবিত্রবাবুর মুখে একটা অবজ্ঞার হাঁসি খেলে গেলো। সেই হাঁসি সিদ্ধার্থের রাগ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো। বাবাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আরো কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, " তুমি সম্বৃতকে বলোনি যে অর্পিতা তোমায় মাছ দেয়নি?" পবিত্রবাবু চুপ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কিছুক্ষণ পর বলেন, " আমি পুরুষমানুষ, চিরকাল পুরুষমানুষের মতো আচরণ করেছি, সে আমার মায়ের আমলেই হোক বা তোমার মায়ের আমল বা তোমার বৌয়ের। সাংসারিক ব্যাপারটা আমি চিরকালই মহিলাদেরই ছেড়ে দিয়েছি। তুমি নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার কোরোনা। তোমার ছেলে এঘরেই আছে, তাকে নিজেই জিজ্ঞাসা করে নাও৷” কথা শেষ করে  ফিরে আবার খাটে বসলেন। এমন সময় পর্দা সরিয়ে অর্পিতাদেবী ঘরে ঢুকলেন, কুৎসিত ভঙ্গিতে খাটের কাছে গিয়ে আঙুল নেড়ে পবিত্রবাবুকে শাসাতে লাগলেন, " আপনি মিথ্যে কথা বলছেন! এত খেয়েও আপনার সাধ মেটেনা। এই বয়সেও একটুকরো মাছের জন্যে নোলা সকসক করে। লজ্জা হয়না আপনার। একপা তো ঘাটের দিকে বাড়িয়েই রেখেছেন! এখনো পর্যন্ত নোংরামি গেলোনা আপনার!" ওদিক থেকে সম্বিত চেঁচিয়ে উঠলো, " মা তুমি দাদুকে একদম ওসব কথা বলবেনা!" সে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে। অর্পিতাদেবী সিদ্ধার্থকে আরো উত্তেজিত করে বলে, " দেখো, নিজের চোখে দেখো কেমন ছেলে তৈরি হয়েছে! সব এই বুড়োটার কুশিক্ষার ফল।" পবিত্রবাবু আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেননা, ওনার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, " তোমার মত ছোট বাড়ির মেয়েদের শিক্ষা তোমাকে এর থেকে ভালো ভাষায় কথা বলতে শেখায়নি।" মায়ের প্রতি ছেলের চিৎকারে সিদ্ধার্থ ছেলের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে প্রচন্ড ধমক দিতে যাচ্ছিলো, এদিক থেকে বাবার কথা কানে আসতে মাথায় এতক্ষণকার ধিকি ধিকি আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। লাফিয়ে উঠে বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো , " কি বললে! আমার বউ ছোটলোক বাড়ির মেয়ে!" এই বলে ডান হাতটা দিয়ে একটা ঝাপটা মারলো যেটা পবিত্রবাবুর বাঁ কানমাথায় সপাটে গিয়ে পড়লো। আবার একবার হাত তুলতে যেতে সম্বিত দৌড়ে এসে বাবার হাতটা প্রবল আক্রোশে চেপে ধরলো। সিদ্ধার্থ হকচকিয়ে গেল, ছেলেটার হাতে এত জোর! আঠারো বছরের কব্জির জোরে বাহান্ন বছরের হাতটাকে যেন গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে চাইছে। আর এ চোখের দৃষ্টি তিনি কখনো দেখেননি! এ দৃষ্টি স্বাভাবিক মানুষের হতে পারেনা। মনে মনে ভয় পেয়ে গেলো সিদ্ধার্থ। সম্বিত কঠিন চোখে যেন ভস্ম করে দিতে চাইছে। অর্পিতাও ভয় পেয়ে গেছে, সেও সিদ্ধার্থকে আঁকড়ে ধরেছে, যেন ভয়ানক কোনো পরিণতির আশঙ্কায় স্বামীকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেতে চাইছে। ছেলেটা জোরে জোরে গরম নিশ্বাস ফেলছে, এবার মুখে বীভৎস এক মুখভঙ্গি করে দুজনকে একসাথে ঠেলতে ঠেলতে দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেল। পাগলের মতো অসংলগ্ন উচ্চারণে বারংবার বলতে লাগলো, " বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও তোমরা এ ঘর থেকে!" বাবা-মাকে জোর করে ঘর থেকে বের করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দাদুকে মাথা নিচু করে দ্বিতীয়বার কাঁদতে দেখলো।

পবিত্রবাবু মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন মঞ্চের দিকে। ওখানে বিচিত্রগুপ্ত খাতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। যেসব আত্মা জল পেলোনা তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক হবে। আশপাশে তার মতন দুর্ভাগা কাউকে দেখতে পাচ্ছেননা। কিছুটা হাঁটার পর হঠাৎ কিরকম একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেলেন। আশপাশে তাকিয়ে কিছু চোখে পড়লোনা। হঠাৎ করে ঘড়ঘড়ে আওয়াজটা বেড়ে গেলো, চোখ চলে গেল মাঠের চারপাশে টাঙানো ডিসপ্লে বোর্ডগুলোর দিকে। আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে। টিভিগুলো কিন্তু নীরব হয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে চোখটা রয়ে গেলো ডিসপ্লে বোর্ডের ওপর। স্ক্রিন গুলো খুব দপদপ করছে। আবছা ভাবে একটা ছবি ফুটে উঠছে। তিনি তখন মঞ্চের একেবারে সামনে পৌঁছে গেছেন। ডিসপ্লে বোর্ডের নাচানাচিতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছবি নয় ,মনে হল কতকগুলো অক্ষর পর্দা জুড়ে নাচানাচি করছে। এটা মঞ্চের ওপরে থাকা চিত্রগুপ্তের লোকজনেদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অক্ষরগুলো ভাসতে ভাসতে নাচতে নাচতে উঠে আসছে, আর কি আশ্চর্য অক্ষরগুলো স্পষ্ট হতে হতে পরস্পরের সাথে জোড়া লাগতে লাগতে চোখের সামনে ‘পবিত্র সেনগুপ্ত’ হয়ে গেলো। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, হঠাৎ নিজেকে খুব হালকা মনে হলো , এক অপার্থিব প্রতি অভিকর্ষ টানে যখন তিনি সেই জনশূন্য প্রান্তর থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছিলেন তখন দেখতে পেলেন মঞ্চে উপবিষ্ট চিত্রগুপ্তরা সমবেত করতালি দিয়ে তাঁর এই আকস্মিক সৌভাগ্যে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

অযুত-কোটি আলোকবর্ষ দূরে এক মফঃস্বল শহরে, সাধারণ এক পাড়ায়, ততোধিক সাধারণ এক  বিবর্ণ, শ্যাওলা ধরা  বসতবাড়ির বাইরে দেখা গেলো একটি কিশোর তামার ঘটিতে একটা গাছের গোড়ায় জল ঢালছে। গাছটা সাদা ছোট ছোট ফুলে ভরে উঠেছে। গাছটি জল পাচ্ছে, আর ঘটির জলের সাথে কিশোরটির চোখের নোনা জল মিশে যাচ্ছে।

 

ডঃ গৌতম সরকার
অর্থনীতির শিক্ষক, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top