সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

কৃষচূড়ার রঙ হলুদ : কাজী জাকির হাসান


প্রকাশিত:
২২ অক্টোবর ২০২০ ২১:৪০

আপডেট:
৩ আগস্ট ২০২১ ১৭:১৯

ছবিঃ কাজী জাকির হাসান

 

(কাজী জাকির হাসান ১৯৫৪ সালের ২ মার্চ কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহন করেন। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই ফুলবাড়িয়ার মোগলহাটের গোরপমন্ডল গ্রামে তাঁর নেতৃত্বে একটি বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়। কাজী জাকির হাসান এবং সহযোদ্ধাদের বীরত্বে এ যুদ্ধে দশজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হলে তাঁকে কোচবিহারের জি এন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অপারেশন করে তাঁর ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দেশের সাংস্কৃতিক পুর্ণগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। জনাব হাসান ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রে নাটক বিভাগে যোগদান করে আমৃত্যু সেখানে চিফ স্ক্রিপ্ট রাইটার পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি একজন সফল নাট্যকার। বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, অন্যান্য মৌলিক নাটক ও রূপান্তর নাটকের সংখ্যা তিনশতাধিক। ‘মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’, ‘যুদ্ধের গল্প’, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তাঁর পরের গল্প’ ইত্যাদি তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কাজী জাকিরের প্রযোজিত নাটকের সংখ্যা প্রায় চারশতাধিক। এছাড়া তাঁর লেখা বেশ কিছু গবেষণাগ্রন্থ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগে রেফারেন্স বই হিসাবে পঠিত হয়।  এই অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও গুণী নাট্যকার ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারী পরলোকগমন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য মরহুম কাজী জাকির হাসানকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক ২০১৮ (মরণোত্তর)  এ ভুষিত করা হয়।)

 

কৃষচূড়ার রঙ হলুদ

এক.

-এমন কিছু যে একটা ঘটবে সে আমি আগেই অনুমান করেছিলাম।
-অনুমান করেছিলে তো বলোনি কেন?
-ভাই-বোনের ব্যাপার-স্যাপারে নাক গলাবো আমি? তবেই হয়েছে।

ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে চাপা গর্জন করতে করতে কার্পেটের উপর বেতের মোড়া টেনে বসে পড়লেন রাহেলা বেগম। বাইরে যদিও এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে তবুও এ বাড়ির গুম ভাবটা কাটে নি এখনো। সামনে চেয়ারে বসা হাসিব আহমেদ ঘন ঘন সিগারেট টেনে বাঁ হাতে ধরা এস্ট্রেতে ছাই ফেলছেন। রাতে ঘুম হয় নি কারো, এক রকম কলহ করেই কেটে গেছে সারারাত। ডাইনিং টেবিলে সাজানো গত রাতের খাবার তেমনই ঢাকা রয়েছে, একটু ছুয়েঁও দেখে নি কেউ। দু দুবার থালাবাসন সরাতে এসে অযথা ধমক খেয়ে কাজের ছেলেটা সেই যে সার্ভেন্ট কোয়ার্টার গিয়ে ঢুকেছে আর একটিবারও আসে নি এদিকে। অনাহার আর অনিদ্রায় এক রকম বেপরোয়া ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন দুজনে। কেউ কারো কাছে হার মানতে রাজি নন। বিশেষ করে রাহেলা বেগমের আপসহীন ভঙ্গি দেখে তাই মনে হয়। কলহের সূচনা হয়, গত সন্ধ্যারাতে রংপুর থেকে হাসিব আহমেদ এর ছোট বোন শিল্পী রহমানের টেলিফোন পাবার পর থেকে।

কথা ছিল, প্রবাসী উচ্চশিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বড় ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে টুম্পার বিয়ে দেবেন শিল্পী রহমান। সেইমতে ছেলেকে শীঘ্র দেশে ফিরতে বলে, পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র টুম্পাকে তিনি রংপুরে নিয়ে গেছেন নিজের কাছে। টুম্পা এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলসফিতে এম. এ. দিয়েছে। ভেবেছিল পরীক্ষা শেষে কয়েকটা দিন বাবা মা’কে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। কিন্তু তা হয়ে ওঠে নি ফুফু আম্মার জেদাজেদীতে। দশ-বারোদিন হয় টুম্পা রংপুর গেছে ফুফু আম্মার বাড়িতে।

ঘটনা এ পর্যন্ত ঠিক ঠিকই ছিল। কিন্তু গোল বাঁধলো একটি টেলিফোন। গতকাল সকালে শিল্পী রহমানের প্রবাসী ছেলে টেলিফোনে জানিয়েছে দেশে ফিরতে তার দেরি হবে।

কারণ?

ডাক্তার বলেছেন এ সময় যে কোন ধরনের জার্নি এলিজার জন্য বিপজ্জনক।

এলিজা?

শিল্পী রহমানের প্রবাসী ছেলের মেমবউ।

-এখন কি করবে? জিজ্ঞেস করলেন রাহেলা বেগম।

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে শুকনো মুখে হাসিব আহমেদ বললেন।

-ভাবছি।
-ভাবছি মানে!
-আপাতত রংপুর থেকে তো ঢাকায় নিয়ে আসি টুম্পাকে, তারপর যা হোক একটা কিছু করা যাবে ভেবেচিন্তে।
-রংপুর কি তুমি নিজেই যাচ্ছো?
-তা কি করে সম্ভব।

-তাহলে?
-দেখি হৃদয়কে বলে।

এই হৃদয় লোকটি সম্পর্কে দুএকটা কথা বলা প্রয়োজন। লম্বায় সাড়ে পাচ ফুট, ঘন কালো কোঁকড়ানো মাথার চুল, জোড়া ভ্রূ, চোখ মারবেলের মতো, চ্যাপ্টা নাক, মনে হয় ছোট বেলায় ভারি কিছু নাকের উপর পড়ে থাকবে। চওড়া কপাল, চেহারা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই করছে। বাবার নাম কি? কবে কোথা থেকে এসেছে এখানে তা কেউ জানে না কিংবা জানার প্রয়োজনও কেউ কখনো অনুভব করেছে বলে মনে হয় না। হাসি-খুশিতে ভরপুর, অত্যন্ত বিশ্বাসী হৃদয়ের কাজই হলো মানুষের বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। সেখানে জাত বেজাত, উঁচুনীচুর ধার ধারে না সে। বোধকরি সে কারণেই সব পরিবারে চলাফেরায় তার অবাধগতি।

বিকেল চারটায় রংপুর রেল স্টেশনে নেমে রিক্সা যোগে হুমানতলায় শিল্পী রহমানের বাড়ি পৌছতে বিকেল সাড়ে চারটা বেজে যায় হৃদয়ের। টুম্পা বাড়িতে ছিলো না তখন। তাজহাট মহারাজার বাড়ি এবং উত্তরবঙ্গের তাজমহল বলে খ্যাত রংপুর কারমাইকেল কলেজ দেখতে গিয়েছিলো ফুফাতো ছোট ভাই লাটুকে সঙ্গে নিয়ে। সন্ধ্যায় যখন সে বাড়ি ফিরে আসে হৃদয় তখন বাইরে ঘুরতে গেছে। যাবার আগে ফুফু আম্মাকে বলে গেছে, আগামীকাল বিকেল সাড়ে তিনটায় ট্রেন, রিজার্ভেশন কনফার্ম।

মনে মনে রাগ হয় টুম্পা। তাকে না জানিয়ে হুট করে রিজার্ভেশন করা ঠিক হয় নি হৃদয়ের। এত অল্প সময়ে সব কিছু গুছিয়ে ওঠা সম্ভব কি করে। তাছাড়া, আরো দুএকজন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়ানো বাকি ছিলো তার। আবার কবে রংপুর আসা হবে কে জানে। ফের ভাবে কাজের মানুষ হৃদয়, কি জানি বাবাই হয়তো বলে দিয়েছেন তাড়াতাড়ি ফিরতে।

প্রচণ্ড ভিড় স্টেশনে। ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে এই অস্থাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি। কি যে হয়েছে দেশে আজ কাল, কথায় কথায় স্ট্রাইক। তুচ্ছ কারণে খুন-খারাপি, মুড়ি-মুড়কীর মতো বোমাবাজি তো লেগেই আছে হর হামেশা। ভাগ্যিস, বুদ্ধি করে হৃদয় রিজার্ভেশনটা কনফার্ম করেছিল, নইলে স্টেশন থেকেই হয়তো ফিরে যেতে হতো তাদের।

-কই তাড়াতাড়ি করুন।

সচকিত হয়ে ওঠে টুম্পা। ভারি দুটো সুটকেস হাতে সামনে ভিড় ঠেলে পথ করে এগিয়ে যায় হৃদয়, পেছনে পেছনে টুম্পা।

দুসিটের বার্থ রিজার্ভেশন করা হয়েছে। বেশ সুন্দর। এই বার্থে কোন জিনিসেরই অভাব চোখে পড়ে না। রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা থেকে শুরু করে খাবার সব কিছুই পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে। সন্দেহ নেই এতক্ষণ হৃদয়ই এ কাজ করেছে।

-হাত পা ছড়িয়ে যুত করে বসুন। আমি এক ফ্লাক্স পানি নিয়ে আসি।

ট্রেন থেকে নেমে দ্রুত ভিড়ে মিশে যায় হৃদয়। সঙ্গে সঙ্গে তীর হুইসেল দিয়ে চলতে থাকে ট্রেন। মুখ শুকিয়ে যায় টুম্পার। অস্থিরভাবে জানালা দিয়ে মাথা বার করে তাকিয়ে থাকে বাইরে। একটু দুরে ভিড়ের মধ্যে হাত দেখা যায় হৃদয়ের। টুম্পার দিকে ইশারা করে চিৎকার করে বলে ওঠে।

-দরোজাটা বন্ধ করে দিন ভাল করে।

আর শোনা যায় না কিছু। ধুলো উড়িয়ে দ্রুত বেগে ছুটে চলে ট্রেন সামনের দিকে।

কাউনিয়া জংশন স্টেশন। বোনারপাড়া লাইনে যেতে হলে ইঞ্জিন ঘুরাতে হয় এখানে। তা ছাড়া এই স্টেশনেই উঠতে হয় ঢাকাগামী কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট যাত্রীদের। ভিড়ের প্রচন্ডতা এখানেও কম নয়। কার ঘাড়ে পা দিয়ে কে আগে উঠবে সেই প্রতিযোগিতাই চলছে প্রাণপণ। স্টেশনের সাইড লাইনে চার নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঢাকা মেইল। এক নম্বরে পার্বতীপুর, দুই নম্বরে শান্তাহার মেইল। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ। এর মধ্যেই টুম্পা হাপুস নয়নে খুজে ফিরছে হদয়কে। বেচারা হদয়।

-‘হারিয়ে গেছি ভাবছেন তো?’

দাঁত বার করে হাসতে থাকে হৃদয়। রাগে রি রি করে ওঠে টুম্পার শরীর। এই রকম একটা কান্ডজ্ঞানহীন লোককে কিনা বাবা পাঠিয়েছেন তাকে নিয়ে যেতে। বাবার ওপর ভীষণ রাগ হয় টুম্পার। কিন্তু করার নেই কিছু ঢাকা না পৌছান পর্যন্ত।

-ফ্লাক্সটা রেখে দিন। ইঞ্জিন লেগে গেছে, ট্রেন ছেড়ে দেবে এক্ষুনি।
-আপনি উঠবেন না?

-আমি থার্ড ক্লাসে উঠেছি।
-মানে!

চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় টুম্পা। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে যন্ত্রণায়। ধপ্‌ করে বসে পড়ে সিটে। চেষ্টা করে রাগটা আয়ত্তে আনার।

-বাবা কি আপনাকে থার্ড ক্লাসের ভাড়া দিয়েছেন?

দাঁতে দাঁত ঘষে জিজ্ঞেস করে টুম্পা।

-তা দেন নি। তবে মিছিমিছি –

-মিছিমিছি বলছেন কেন? মহত্ব ফলাবার আর জায়গা পেলেন না, না?
-না মানে আমার তো কোন কষ্ট হচ্ছে না।
-আমার হচ্ছে। উঠে আসুন।

বয়সের তুলনায় টুম্পার মানসিক গড়ন অত্যন্ত দৃঢ়। অযথা সৌজন্য কিংবা অতি বিনয় কোনটাই তার পছন্দ নয়। মেনিমুখো ছেলেদের সে সব সময় এড়িয়ে চলে। ঘৃণা করে মনে মনে। তার কেবলই মনে হয়, আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা ছাড়া সমাজের কোন কাজেই এদের যোগ্যতা নেই। হৃদয়ের এই মুহূর্তের আচরণে তার তাই মনে হয়েছে।

মাথা নিচু করে কামরায় উঠে আসে হৃদয়।

ট্রেন ছেড়ে দেয়।

-ধুলো উড়ছে, গ্লাসটা নামিয়ে দেবো? জিজ্ঞেস করে হৃদয়।
-না, থাক।
-তাহলে চোখে বরং সানগ্লাসটা পরে নিন।
-আমার চোখের জন্য ভাবনাটা আপনার বেশি মনে হচ্ছে?

-ভাবনা না হোক – ভারটা তো নিয়েছি।

মৃদু হেসে পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করে হৃদয়।

-থার্ড ক্লাসে টিকেট কাটবার আগে ভারের কথাটা কি একবারও মনে হয়েছিল আপনার?
-চা খাবেন এক কাপ?

প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে হৃদয়। কিন্তু লাভ হয় না। রাগটা আরো বেড়ে যায় তাতে। চামড়ার স্যুটকেসের সাইড পকেট থেকে একটা রিডার্স ডাইজেস্ট বার করে চোখ বুলাতে থাকে পাশ ফিরে। এইভাবে পার হয়ে যায় কত স্টেশন। পার হয় গাইবান্ধা, বোনারপাড়া জংশন। এর মধ্যে অনেক বার ডেকেও টুম্পার কোন সাড়া পায় নি হৃদয়। এই সাড়া না দেয়ার কারণ ইচ্ছে করে, নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে আসলে, বিষয়টা যাচাই করে দেখতে পারেনি হৃদয় বই দিয়ে টুম্পার মুখটা ঢাকা ছিলো বলে। ব্যাপারটা যাই হোক তবুও খারাপ লাগে হৃদয়ের। এ রকম একটা পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না সে। তার ধারণা ছিলো এ ধরনের ব্যবস্থায় টুম্পা বরং খুশিই হবে, কিন্তু বাস্তবে ফল হলো গিয়ে তার উল্টো।

একটু নড়েচড়ে বসে হদয়। দূরের জার্নিতে এভাবে চুপচাপ বসে যাওয়া খুবই কষ্টকর। বিশেষ করে কথা বলা লোকদের জন্য এ রকম অবস্থা সত্যিই পীড়াদায়ক। উঠে দাঁড়ায় হৃদয়। আপার সিটে পড়ে থাকা পুরনো একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ। ভাল্লাগে না জানলা দিয়ে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিযে মুখ বার করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। অযথা গুণতে থাকে দ্রুত পার হয়ে যাওয়া টেলিগ্রাফের থাম্বাগুলো। কিন্তু তাই-বা গোনা যায় কতক্ষণ, মাথা ধরে বসে পড়ে সিটে। চোখ বুজে পেছনে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে জোর করে। আচমকা ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা ছুটে যায় হৃদয়ের। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে রাত পৌনে ন’টা বাজে। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে ফুলছড়ি ঘাটে।

স্টীমার ঘাট।

ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে যেতে হবে বাহাদুরাবাদ ঘাটে। ছড়োহুড়ি করে নেমে যাত্রীরা ছুটতে থাকে স্টীমারের দিকে।

-শুনছেন ঘাট এসে গেছে।

হৃদয়ের ডাকে মুখে হাই তুলে উঠে বসে টুম্পা। দু হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করে নেমে আসে ট্রেন থেকে।

মানুষের ভিড় ঠেলে ক্লান্ত টুম্পা স্টীমারের কেবিনে বসে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে একটা। হাটার তাগিদে এতক্ষণ যা বুঝতে পারে নি, বিশ্রাম নিতে গিয়ে টুম্পা অনুভব করে তার ডান পা’টা ব্যথা করছে একটু একটু। মাথা ঝুকেঁ ব্যথার জায়গায় হাত দিয়ে দেখে কড়ে আঙ্গুলে বড় বড় দুটো ফোস্কা পড়ে গেছে। ব্যাপারটা টুম্পা বুঝতে দেয় না হৃদয়কে। স্বাভাবিকভাবে ন্যাংটা পায়ে বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে বসে পড়ে সিটে।

-কিছু খেয়ে নিন, রাত হয়েছে।
-খিদে নেই।
-বাইরে বাতাসে দাঁড়াবেন একটু?
-ইচ্ছে করছে না।
-ঠিক আছে রেস্ট নিন তাহলে।

কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় হৃদয়। টুম্পার হঠাৎ মনে পড়ে, কাজটা ভাল হলো না। একবার অন্তত খাবার কথা হৃদয়কে বলা উচিত ছিলো তার। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে বলেই খাবার প্রসঙ্গটা টেনে এনেছেন। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার। ফুফু আম্মা সাজিয়ে দিয়েছেন, যাতে পথে কোন অসুবিধা না হয়।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কেবিনের বাইরে এসে রেলিং-এ হাত দিয়ে দাড়ায় টুম্পা। তাকিয়ে দেখে সামনে স্টীমারে সার্চ লাইটের আলোতে চিক্চিক্‌ করছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। শির শির করে বয়ে যাওয়া বাতাসে মুহূর্তেই যেন সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বিচিত্র ধরনের একটা সুখানুভূতি নিয়ে টুম্পা দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে।

-চাদরটা গা'য়ে জড়িয়ে এলে ভাল করতেন। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা।

হৃদয়ের কথাতে কেমন যেন একটা মায়া জন্মে যায় টুম্পার। এত আন্তরিকভাবে এই প্রথম কেউ যেন তাকে শাসনের ভঙ্গিতে কথা বললো। মাথা তুলে ভাল করে তাকায় টুম্পা হৃদয়ের মুখের দিকে। বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে কপালে। মুখটা শুকনো। গায়ে ফিনফিনে একটা হাফ সার্ট। কষ্ট হয় টুম্পার। লজ্জা পায় নিজের ব্যবহারে।

-আপনার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? টুম্পা জিজ্ঞেস করে।
-কি যে বলেন। লজ্জা পায় হৃদয়।
-যাই বলুন আপনার মুখ দেখে কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।
-খিদে পেয়েছে মুখ দেখে বুঝতে পারেন। আর কিছু বুঝতে পারেন না মুখ দেখে?
-কি রকম! সচকিত হয়ে ওঠে টুম্পা।
-কথাটা আপনাকেই জিজ্ঞেস করেছি জানতে।
-কি জানতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
-বুঝতে পেরেছেন ঠিকই, বলতে চাইছেন না।
-হেঁয়ালি করে কথা বললে আমি খুব কষ্ট পাই।
-আমিও কি কম কষ্ট পেয়েছি।
-কি বলছেন!

একটা অজানা আশংকায় কেপে ওঠে বুকের ভেতরটা। বুঝতে পারে না টুম্পা কি বলতে চাইছে হৃদয়। 

-আপনার পায় ফোস্কা পড়েছে, কষ্ট পাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে। এ কথাটা আমার কাছে লুকোবার কি খুবই প্রয়োজন ছিলো?

চুপ করে যায় টুম্পা। অতি সন্তর্পণে সে যা লুকোতে চেয়েছিল, তা ধরা পড়ে গেছে হৃদয়ের সুক্ষ দৃষ্টিতে। বিব্রত বোধ করে। লজ্জায় তাকাতে পারে না টুম্পা মাথা উঁচু করে। হৃদয়ও খেই হারিয়ে ফেলে, কোন কথা খুঁজে পায় না আর। স্টীমারের মুখটা ধীরে ধীরে ঘুরে যায় উত্তর দিকে। সার্চ লাইটের আলোটাও পড়ে সেদিকে। ত্রমশ অন্ধকারে ঢেকে যায় পশ্চিম দিক। পানিতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে একটা হৃদয় মুচড়ানো গুমগুম শব্দ ভেসে আসতে থাকে কেবলই।

বাহাদুরাবাদ ঘাট পৌছতে রাত এগারোটা বেজে যায়।

তাড়াতাড়ি করে ট্রেনে উঠে বিছানাপত্র ঠিক করে ফেলে টুম্পা। হৃদয় কুলির মাথা থেকে অন্যান্য মালামাল গুনে গুনে নামিয়ে সাজিয়ে রাখে সিটের আশেপাশে। গোছগাছ শেষ হয়ে যায় অল্প সময়ে।

-এখন এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না।' ঘুম ঘুম চোখে মৃদু হেসে বলে টুম্পা।
-আমার মনে হয় চায়ের চেয়ে ঘুমটাই আপনার দরকার বেশি।
-তা ঠিক। কিন্ত একা একা বসে আপনি কি করবেন?
-বসে থাকবো কেন। উপরের সিটে বিছানা তো পাতাই রয়েছে আমার। আপনি শুয়ে পড়লেই আমি উঠবো।
-সেকি! উঠে পড়ুন আপনি। আমার জন্য ভাবতে হবে না।
-ভাবছি না কিছু, ট্রেন ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করছি।

রাত পৌনে বারোটায় হুইসেল বেজে ওঠে তীব্রস্বরে। মানুষের কোলাহল থেমে যায় ধীরে ধীরে। সরে যায় বৈদ্যুতিক আলোর খুঁটি গুলো দূর থেকে দূরে। নিকষ অন্ধকারের বুক চিরে গন্তব্য পথে হুশ হুশ শব্দে ছুটে চলে ট্রেন।

 

দুই.

বছর দুয়েক পরের ঘটনা।

দেশের রাজনীতি-সমাজনীতি প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক। চীনে রেস্তোরা আর ভিডিও ক্লাবে ভরে গেছে ঢাকা শহর। নিয়নবাতির জায়গায় জ্বলছে সোডিয়াম বাতি। রাস্তা ঘাটের উন্নতি হয়েছে প্রভূত। সুউচ্চ ভবনের পাশাপাশি বস্তিবাসীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রচুর।

পরিবর্তন হয়ে গেছে টুম্পাদের পরিবারেও। রাহেলা বেগম ইন্তেকাল করেছেন মাস ছয়েক হলো। হাসিব আহমেদ রিটায়ার করেছেন তারও দুমাস আগে। টুম্পা এম. এস. করেছে, পাশাপাশি বাবার সংসার দেখাশুনা করছে মনোযোগ দিয়ে। এর মধ্যে দু একটা ভাল বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো, কিনতু রাজ হয়নি টুম্পা। তার এক কথা এত তাড়াহুড়োর কি আছে। মেয়ের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারেন নি হাসিব সাহেব, মেনে নিয়েছেন সব মুখ বুজে। আষাঢ়ের শেষ।

সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। হাসিব সাহেব টঙ্গি গেছেন তাঁর এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখনো ফিরে আসেন নি তিনি। কডকড় শব্দে মেঘের গর্জন ভেসে আসছে মাঝে মাকে। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাফেরা এক রকম নেই বললেই চলে। যদিও কখনো কখনো দু-একটা রিক্সা চোখে পড়ছে, কিনতু যাত্রী নেই তাতে।

মহানগরীর নিচু এলাকা পানিতে ডুবে থৈ থৈ করছে। দুর পাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আটকে পড়া কিছু যাত্রী গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছে যাত্রী ছাউনি গুলোতে। মাঘের শীতের মতই তারা ঠকঠক করে কাঁপছে ঠান্ডায়।

এমনি এক সন্ধ্যায় লেক সার্কাসের একটি দ্বিতল বাড়ির রিডিং রুমে বসে হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলছে টুম্পা। হৃদয় – হ্যাঁ হৃদয় আগের মতই আছে। পরিবর্তনের মধ্যে আসা যাওয়াটা একটু বেড়ে গেছে টুম্পাদের বাড়িতে। সেও টুম্পার অনুরোধেই। মা’র মৃত্যুর পর একাকিত্বের মুহুর্তগুলোতে ভাল লাগে তার হৃদয়ের সাথে কথা বলতে। এর মধ্যেই চাল ভাজা দিয়ে দু বার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আরেক বার খেতে মন চাইলেও বুয়াকে ডাকতে ইচ্ছে করে না টুম্পার। রাত বাড়ছে, রাতের খাবার তৈরি করতে নিশ্চয়ই সে এতক্ষণে রান্নাঘরে ঢুকেছে। মুহূর্তের ভাবনা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় টুম্পা হৃদয়ের দিকে। দেখে নিবিষ্ট চিত্তে দুটা বইয়ের র‌্যাকের মাঝামঝি দেয়ালে সেগুন কাঠের ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো একটি ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছে হদয়।

-কি দেখছেন অমন করে? জিজ্ঞেস করে টুম্পা।
-ছবি। এমন সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না।
-নাইখ্যংছড়ির ছবি। গত বছর ওখানে বেড়াতে গেলে আমার এক চাকমা শিল্পী বন্ধু প্রেজেন্ট করে।
-এতদিন আসা-যাওয়া করছি আপনাদের এখানে, অথচ এমন একটা সুন্দর জিনিস চোখে পড়ে নি একবারও।
-পড়বে কি করে? আজই তো প্রথম এলেন আমার রিডিং রুমে।

মৃদু হেসে উত্তর দেয় টুম্পা।

-সে আমার সৌভাগ্য।
-আরো আছে দেখবেন?

আগ্রহ প্রকাশ করে টুম্পা।

-মাফ করবেন। বিদ্যেটা এ পর্যন্তই। বুঝবার শক্তি নেই।

একটু সরে গিয়ে টুম্পার দিকে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে জানালার একটি পাল্লা খুলে ডান হাতের পুরোটাই প্রায় বার করে বৃষ্টির পানিতে মেলে ধরে হৃদয়।

বাইরের আলোক রশ্মি জানালার গ্লাসে এসে পড়ায় বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি ইলিশ মাছের আঁশের মতো চক্চক্‌ করে উঠে হৃদয়ের হাতে।

সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হৃদয় হেসে উঠে আপন মনে।

-কি হলো হাসছেন যে?
-এমনিই।
-এমনি আবার কেউ হাসে নাকি?
-হাসে কখনো কখনো।
-আসলে বলবেন না তাই।

কেমন যেন একটা অভিমানের সুর ফুটে ওঠে টুম্পার কণ্ঠে। মায়া লাগে।

ভালোও লাগে।

জানালা বন্ধ করে পেছনে হাত দুটো মুঠি করে টুম্পার দিকে ফিরে তাকায় হৃদয়।

-অর্থ জেনে তা প্রকাশ না করার মধ্যে কিছুটা বাহাদুরী থাকলেও হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু একেবারে না জেনে কিছু বলতে যাওয়াটা নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
-আসল ব্যাপারটা কি জানেন, নিজের প্রশংসা আমরা পরের মুখ থেকেই শুনতে ভালোবাসি। কিন্তু নিজের কথাটি পরকে বলতে চাই না। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে এই যে ঠকিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি - একটা কিছু বাহাদুরী নিশ্চয়ই এর পেছনে আছে।
-একটা সমস্যা আছে। আর সে সমস্যা হলো, সহজ কথা আমরা সহজ করে বলতে পারি না কখনো।
-বিশেষ করে সমাগত যৌবনে।

হেসে উঠে টুম্পা।

হতচকিত হৃদয় সামলে নেয় নিজেকে।

-জীবনের আসল উৎসই তো প্রেম। তাকে বাদ দিয়ে অন্য কিছু ভাবার অর্থই জোচ্চেরের মতো পালিয়ে বেড়ানো। জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যকে অস্বীকার করা।

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে হৃদয় টুম্পার মুখের দিকে। বিশ্বাস করতে পারে না সে নিজের কানকে।

এতদিনের পরিচিত টুম্পার মুখে আজ সম্পূর্ণ নতুন কথা শুনছে সে।

বাইরে বিদুৎ চমকানোর মতো ঘরে টুম্পার উচ্ছল মোহময় হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠছে বারবার।

বুকের মধ্যে শেল হানে হৃদয়ের।

মনের অর্গল খুলে সম্মুখে বসে থাকা টুম্পাকে সে চিনতে চেষ্টা করে ভাল করে।

সাহস করে এগিয়ে যায় সামনে।

মুখোমুখি বসে চেয়ারটাতে।

রক্ত প্রবাহে জোয়ার ভাটা সৃষ্টি হয়।

ঘামতে থাকে ভেতরে ভেতরে।

চুপচাপ বসে কি যেন ভাবে কিছুক্ষণ।

একসময় দরোজার চৌকাঠে হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়া আহত মানুষের মতো উচ্চ কণ্ঠে বলে ওঠে, - ‘প্রেমকে অস্বীকার করছে কে? আমরা তো মনে মনে প্রেমকেই আহবান করে চলেছি সারাক্ষণ’।

-তা হলে জীবনের সেই সত্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে পথ চলতে দোষ কোথায়?
-দোষ নেই কিছু। তবে তার আগে প্রয়োজন পথের সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় করা। নইলে হয়তো মাঝপথেই একদিন জীবন থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
-সে উদ্যোগ নিজেকেই নিতে হয়। অন্যের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে ঠকতে হয় বারবার।
-কিন্তু সমস্যা হলো সে অর্গলটা খুলবে কে?
-আমাদের বিপর্যয়টা তো এখানেই। প্রগতি প্রগতি বলে যতই চিৎকার চেঁচামেচি করি না কেন এই একটি জায়গায় এসে আমরা সব মহিলা-পুরুষ রক্ষণশীল হয়ে পড়ি।

কি ভেবে হঠাৎ থেমে যায় টুম্পা।

-থামলেন কেন বলুন?

উৎসাহিত করার চেষ্টা করে হৃদয়। 

-আর নয়। প্রেম চর্চা নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। লোকে শুনলে পাগল ভাববে।

বিষয়টাকে হালকা করার জন্য টুম্পা হাসতে থাকে।

-তাই বলে মাঝপথে থামিয়ে দেবেন?

উসখুস করে ওঠে হদয়।

-থামিয়ে দিই নি। কথা সব শেষ হয়ে গেছে। এখন কিছু বলা মানেই বাড়াবাড়ি।
-একে বাড়াবাড়ি বলছেন কেন?
-প্রকৃত কারণের সমাধান যেখানে নেই, সেখানে অবান্তর টেনে লাভ কি।
-আমি কিন্তু এটাকে অবান্তর ভাবছি নে।
-আপনি কি ভাবছেন সেটা আমার ভাবনার বিষয় নয়।
-সত্যকে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করলে জীবন একদিন শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাবে।
-আপনার জীবনে যা সত্য বলে মনে হয়েছে আরেকজনের জীবনেও যে তা সত্য বলে মেনে নিতে হবে এমনটা ভাবা বোধকরি ঠিক নয়।
-এখন ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাবার অর্থই স্ববিরোধী ভূমিকাকেই সমর্থন করা।
-আপনার ব্যাপার আপনিই ভাল বুঝেন। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই।
-অভিন্ন মতাদর্শই মানুষকে কাছে টানে।
-মতাদর্শ এবং স্বপ্ন এক জিনিস নয়।
-স্বপ্ন বলছেন কেন? এমন কি হতে পারে না, আপনি আমি অন্তরের বাঁধনে বাঁধা পড়ে ঘর বেঁধে ফেললাম।

দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে টুম্পা।

সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে থরথর করে।

বক্রদৃষ্টিতে তাকায় হৃদয়ের দিকে।

-বাচালতা করারও একটা সীমা থাকে। আপনার দেখছি সে জ্ঞানও নেই।

কড়কড় শব্দে বাইরে কোথাও বজ্রপাত পড়ার শব্দ হয়। এক ঝলক আলো হঠাৎ ঝলসে উঠে মিলিয়ে যায়।

সেই আলোতে পোড়া কাঠের মতো দেখায় হৃদয়ের মুখাবয়ব। যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠে সে।

কষ্ট হয় নিঃশ্বাস নিতে। 

বজ্রপাতটা মাথার ওপর পড়লেও বোধকরি এতটা আশ্চর্য হতো না হৃদয় যতটা হয়েছে টুম্পার কথা শুনে।     

-আপনার আপত্তি আছে, সে কথাটা অবিশ্যি একবারও ভাবি নি। মাফ করবেন।

মন্থর গতিতে উঠে দাঁড়ায় হৃদয়।

সে প্রত্যাখ্যাত।

অপমানিত।

মাতালের মতো উলতে টলতে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। বাইরে বৃষ্টির প্রচন্ডতা বেড়েছে।

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন।

গুড়গুড় শব্দে ডাকছে মেঘ।

এরই মধ্যে আর্তচিৎকার করে একটি কাক ডানা ঝাপটে ঝুলে পড়লো লাইট পোস্টের তারে।

শঙ্কিত টুম্পা উঠে দাড়ায় ক্ষিপ্র গতিতে।

-হৃদয় শুনুন –

এক হাঁটু পানি ভেঙে গলির মোড়টার বাঁক ঘুরতেই চিৎকার করে ডাক দেয় টুম্পা। ডাক শুনে হৃদয় আবার ফিরে আসবে এমন একটা বিশ্বাস নিয়ে চেয়ে থাকে সে। কিন্তু ফিরে আসে না হৃদয়।

টুম্পা অপেক্ষা করতে থাকে।

একদিন –

দুদিন –

তিনদিন –

হৃদয় আসবেই।

আসতেই হবে তাকে।

কিন্তু না।

হৃদয় ফিরে আসে নি।

অনেক খুঁজেও এ শহরে আর কোনদিন পাওয়া যায় নি তাকে।

সমাপ্ত

 

কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিকনাট্য ব্যক্তিত্বমুক্তিযোদ্ধাজাতীয়  স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top