সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

কর্মাটাঁড়ের সেই দিনগুলো : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
৭ নভেম্বর ২০২০ ২১:১৫

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২১

 

মানুষটি সারা জীবন অন্যের দুঃখ কষ্ট দূর করতে করতেই কাটিয়ে দিলেন, সমাজের পুতি-গন্ধময় দিকটা নিজের হাতে সাফ করতে করতে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছলেন, প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ে পুরুষ সিংহের বিক্রম দেখিয়ে বিশ্বের দরবারে বাঙালির জাত চেনালেন, নারী শিক্ষা এবং নারীকে যোগ্য সম্মান না দিলে একটা জাতি কখনোই উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারেনা - দেশের মানুষকে একথা বোঝাতে  সারাটা জীবন ব্যয় করে ফেললেন, সেই মানুষটিই প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে দেখলেন তাঁর আশপাশে কেউ নেই, তিনি একদম একা। সারাজীবন নিজের আদর্শের সাথে আপোস না করার দরুন কর্মক্ষেত্রে হিতাকাঙ্খীর তুলনায় শত্রু বা ঈর্ষাপরায়ণ সহকর্মীর সংখ্যাই বৃদ্ধি পেয়েছিল , বন্ধুর মুখোশ পরে যারা পাশে ছিলেন হয় তারা প্রয়োজন মেটানোর পর সরে গেছেন নতুবা অন্যায় দাবী মেটার সম্ভাবনা নেই দেখে সরে পড়েছিলেন, সর্বোপরি ইস্পাতসম লৌহকঠিন মানুষটাকে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছিল তাঁর একমাত্র ছেলে নারায়ণচন্দ্র। ছেলের বিভিন্ন কাজকর্মে অতিষ্ঠ বিদ্যাসাগর ১৮৩২ সালে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করে তার সাথে সমস্ত রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই স্ত্রী মারা যেতে মানুষটি ভীষণভাবে একা হয়ে পড়লেন। নাগরিক হিংসা, ঈর্ষাপরায়ণতা, লোভ, প্রতিশোধপরায়ণতা দেখতে দেখতে তখন তিনি ক্লান্ত। পাঁচ বছর বয়সে বাবার সাথে গ্রাম ছেড়ে কলকাতা শহরে আসার পর এই পরিনত বয়সে বিপ্রতিপে ফিরে চললেন কলকাতা থেকে নিজের ছোটবেলার গ্রাম, বীরসিংহে। কিন্তু বীরসিংহেও তখন নাগরিক ছোয়াঁ লেগেছে, বদলে গেছে চেনা মানুষজনের প্রকৃতি, চালচলন, কথাবার্তা, জীবনযাত্রা।এখানেও কাঙ্খিত শান্তি মিললোনা, তিনি এগিয়ে চললেন আরোও পশ্চিমে।

 

ছবিঃ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর

 

চলতে চলতে উনি পৌঁছে গেলেন বিহারের  সাঁওতাল পরগনার এক আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম 'কর্মাটাঁড়', প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা মাটিগন্ধ মাখা এক জনপদ। এখানকার মানুষগুলো অতি অল্পদিনের মধ্যেই তাঁকে আপন করে নিলো। মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা পেলেন। তিনি এখানে এক বিধবা ব্রিটিশ মহিলার কাছ থেকে সস্তায় একটি বাগানবাড়ি কিনলেন , নাম দিলেন নন্দনকানন। বাড়িটিতে অনেক গাছপালা, যদিও পরিচর্যার অভাব সর্বত্র বেশ প্রকট। বিদ্যাসাগর বাড়িটির প্রয়োজনীয় সংস্কার করলেন৷  তিনি নিজেও খুব গাছপালা ভালোবাসতেন। একজন পূর্ণ সময়ের মালি রেখে বাগান পরিচর্যা করতেন। তাঁর লেখাপড়ার কাজের জন্যও এই বাড়ি আর পরিবেশ অনুকূল ছিল। এখানে বসেই তিনি 'বর্ণপরিচয় তৃতীয়ভাগ' আর 'সীতার বনবাসের' প্রুফ দেখার কাজ করেছিলেন।

 

অতি অল্পদিনেই প্রমান হয়ে গেল, জীবনের অপরাহ্নে প্রকৃতির কোলে শুয়ে-বসে  কাটাতে তিনি এখানে আসেননি।  তাঁর চোখে পড়লো  এই সরল , সাদাসিধে সাঁওতাল মানুষগুলোর মূল সমস্যা হলো দুটি- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য।  সেসময়ে কাছেপিঠে  কোনো স্কুল ছিলোনা, মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কথা  আদিবাসী মানুষগুলো স্বপ্নেও ভাবতোনা ; শরীর খারাপ হলে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেতো, অনেকসময় সাধারণ অসুখেও সঠিক চিকিৎসা ও পথ্যের অভাবে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতো। বিদ্যাসাগরমশাই প্রথমেই তাঁর বাড়িতে একটি দাতব্য হোমিওপ্যাথি ক্লিনিক খুললেন। তারপর নিজের বাড়ির প্রশস্ত হলঘরে সাঁওতাল মেয়েদের জন্য দিনের বেলা এবং বয়স্ক পড়ুয়াদের জন্যে রাত্রে স্কুল চালু করলেন। এটিই সম্ভবত সমগ্র দেশে আদিবাসী মেয়েদের জন্য চালু হওয়া প্রথম স্কুল। দিনে দিনে এই মানুষগুলোর কাছে বিদ্যাসাগর ভগবান হয়ে উঠতে লাগলেন। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বিষাদে পাশে থাকতে থাকতে তিনি এদেরই একজন হয়ে উঠলেন। বিদ্যাসাগর এই সৎ,সত্যবাদী,সংযমী এবং সর্বোপরি ঋজু চরিত্রের মানুষগুলোর মধ্যে প্রকৃত মানুষ খুঁজে পেয়েছিলেন। তখন থেকেই মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে উনি লালন-পালন করতেন- জীবনের বাকি কটা দিন এই প্রকৃতির বুকে প্রকৃতির আদি সন্তানদের মধ্যেই কাটিয়ে দেবেন। যদিও ভাগ্য তাঁর  ইচ্ছাকে সাথ দেয়নি, অসুস্থতার কারণে ১৮৯০ সালে  কলকাতার বাদুড়বাগান স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরে আসতে হয়। কিছুদিন পর ১৮৯১ সালের ৩০শে জুলাই মধ্যরাত্রে এখানেই তাঁর মহাপ্রয়ান ঘটে।

জীবনের শেষ আঠারো বছর কর্মটাঁড়ে কাটিয়ে তিনি যেমন জীবনে বেঁচে থাকার নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন, তেমনি আদিবাসী  মানুষগুলো তাদের মধ্যে একজন অভিভাবক পেয়েছিলো যিনি কখনো শিক্ষক, কখনো ডাক্তার, কখনো উকিল আর কখনোবা অন্নদাতার ভূমিকায় আবির্ভুত হয়ে দীর্ঘসময় ধরে তাদের মাথার উপর ছাতা ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। কত স্মৃতি আছে ওনাকে নিয়ে ,কত গল্প বংশপরম্পরায় চলে আসছে। বিদ্যাসাগরমশাইয়ের ভাই শম্ভুচরণের স্মৃতিচারণে জানা যায়--বিদ্যাসাগর মশাই রোগীদের শুধু ওষুধই দিতেননা, তার সাথে পথ্য হিসাবে ফল,দুধ, সাবু, চিনি, বার্লি ইত্যাদিও বিলি করতেন। এই কর্মকান্ড চলতো ভোর থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত। তারপর  স্কুলের কাজ এবং লেখালিখির কাজ সেরে বিকেলবেলা বেরিয়ে প্রত্যেক রুগীর বাড়ি গিয়ে তাদের শরীরের খোঁজখবর করতেন। গ্রামের মানুষগুলো তাদের উঠোনে, দুয়ারে, ঘরে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পায়ের ধুলো পড়লে আনন্দে অধীর হয়ে উঠতো। তাঁদের ঠাকুরকে কোথায় বসতে দেবে, কি করে আদর যত্ন করবে এসব ভেবে কুলকিনারা করে উঠতে পারতোনা। বিদ্যাসাগর তাদের আশ্বস্ত করে  রুগীর বিছানার পাশে বসে শরীরের হালহকিকত জানতেন। আদিবাসী মানুষগুলো যত্ন করে যা খাবার খেতে দিতো উনি তৃপ্তি করে খেতেন। শম্ভুচরণের কথায় জানা যায়, বিদ্যাসাগর মশাই নিজেই স্বীকার করতেন -বড়লোক জমিদার বাড়ির  অভিজাত রাঁধুনির হাতে রান্নাকরা খাবারের চেয়ে এদের দেওয়া আটপৌরে খাবার তাঁর কাছে অমৃততুল্য ছিলো।

মানুষগুলোর সাথে সাথে কর্মাটাঁড়কেও উনি অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছিলেন। এখানকার রেলস্টেশনকে নিয়েই সেই বহুলপ্রচলিত গল্প আছে যেখানে বিদ্যাসাগরমশাই তথাকথিত এক বাবুর সাহায্যার্থে কুলির ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই নারায়ণচন্দ্র নন্দনকানন কলকাতার মল্লিকদের বিক্রি করে দেন। মল্লিকরা বাড়িটি সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা করলেননা৷সময়ের আঘাতে দিন দিন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সাধের নন্দনকানন ভেঙে পড়তে লাগলো। বেশ কয়েকবছর পর কয়েকজন প্রবাসী বাঙালি উদ্যোগ নিয়ে ১৯৩৮ সালে বেঙ্গল এসোসিয়েশন অফ বিহার ( বিহার বাঙালি সমিতি) নামক একটি সংস্থা তৈরি করেন এবং পরে ওই সংস্থাটি ২৪০০০ টাকা দিয়ে মল্লিকদের কাছ থেকে বাড়িটি পুনরায় কিনে নেয় এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার করে বাড়িটির হৃত সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনে।  বিদ্যাসাগর মশাইয়ের দেখিয়ে যাওয়া পথ অনুসরণ করে এই বাড়িতে তাঁর মা 'ভগবতী দেবীর' নামে বালিকা বিদ্যালয় চালু হয়। ২০০১ সালে যখন ঝাড়খন্ড বিহার থেকে আলাদা হয়ে গেল তখন এই সংস্থার নাম বদলে হয়, 'ঝাড়খন্ড বেঙ্গলি এসোসিয়েশন' এবং এগারোজন সদস্য মিলে গঠিত হলো  'ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মেমোরিয়াল কমিটি'। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সেই চিকিৎসালয়টি এখন আর নেই, তার জায়গায় শোভা পাচ্ছে আধুনিক সর্বসুবিধাযুক্ত 'বিদ্যাসাগর হোমিও চিকিৎসালয়'।

তাঁর মৃত্যুর বহুবছর পরও কর্মাটাঁড়ের মানুষেরা মানুষটাকে ভোলেনি। এখানকার একমাত্র রেলস্টেশনের নাম তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। সম্প্রতি রেল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে সমগ্র স্টেশনটি বিদ্যাসাগরের জীবনের বিভিন্ন গল্প ও ছবিতে সাজানো হয়েছে।

তাঁর দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে ঝাড়খণ্ড সরকার জামতাড়া জেলার অন্তর্গত কর্মাটাঁড় থানার নতুন নামকরণ করে 'ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর থানা।'

জীবনে অনেক কিছু পাবার ছিলো, তাই অপ্রাপ্তি আর কষ্ট নিয়ে মানুষটাকে চলে যেতে হয়েছিল। তবে জীবনের শেষ কটি বছর এই নিরক্ষর, সদাহাস্যময়, ধরিত্রীপুত্র- কন্যাদের কাছ থেকে যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েছিলেন  সেকথা ভেবে ওনার জন্যে জমে থাকা কষ্টের কিছুটা লাঘব হয়। আসলে তিনিওতো ছিলেন মাটির কাছাকাছি মানুষ; তাই তথাকথিত শহুরে , শিক্ষিত, আধুনিক মানুষদের তুলনায় এই গরীবগুর্বো মানুষগুলোর সাথে মিশে তাঁর আত্মার অনেক বেশি শুদ্ধিকরণ ঘটতো। যদিও এখানকার মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার ইচ্ছা তার পূর্ণ হয়নি। তাঁর নামে চলা মেমোরিয়াল কমিটি বছরে তিনটি দিনে তাদের ভগবানকে স্মরণ করে : ২৯শে মার্চ-গুরুদক্ষিণা দিবস,২৯শে জুলাই-মহাপ্রয়ান দিবস এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর-জন্মতিথি। সমস্ত স্মরণ অনুষ্ঠানগুলোই অনাড়ম্বরহীন  উদযাপিত হয়। প্রকৃতির কোলে, আদিবাসী মানুষগুলিকে নিয়ে, প্রচারের তীব্র আলোর আড়ালে , বন-প্রান্তর, পাহাড়-নদীকে সাক্ষী রেখে সবাই মিলে তাদের প্রিয় মানুষটিকে স্মরণ করে, ঠিক যেমন বিদ্যাসাগর মশাই চাইতেন৷

ছবি সংগ্রহে সহযোগিতা: সুপর্বা হোম রায়


ডঃ গৌতম সরকার
অর্থনীতির অধ্যাপক, যোগমায়া দেবী কলেজ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top