সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

জননী জন্মভূমি : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:১৭

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২২

 

শীত আসছে। পপলার, বার্চ, ওক গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়ে গেছে । দূর পাহাড় থেকে বরফ ঠান্ডা হাওয়া এসে ঝরা পাতাগুলিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটার দিকে। সূর্য ডোবার সময় হল, গ্রামের লাল মাটির পথ ধরে জার্মান সৈন্যরা দিনের শেষ ড্রিল করতে করতে ব্যারাকে ফিরছে । নদীর পাশে যে বহু পুরোনো সাইবেরিয়ান পাইন গাছটা আছে, যার উঁচু ডালগুলো মাথা তুলে দেখতে হয়, সেই পাইন গাছের নিচে পাথরের একটা ঘর, বাইরে এক চিলতে বারান্দা । বিকেলের ড্রিল করে ফেরার পথে ফ্রেডরিক এক বৃদ্ধ মহিলাকে প্রতিদিন শেষ সূর্যের আলোতে পশমের টুপি বুনতে দেখে । বাড়িটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়  অন্যদের লুকিয়ে আড়চোখে বুড়ির দিকে তাকায়, আর বুড়ি মিষ্টি হেঁসে ঘাড় নাড়ে । বুড়ির  মুখের দিকে তাকালে বহু দূর দেশে পড়ে থাকা নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে । বাবা যুদ্ধে মারা গেছে তখন ফ্রেডের বয়স পাঁচ, তারপর বহু কষ্টে মা তাকে বড় করেছে । মায়ের চোখের জল ফ্রেডকে সেনাবাহিনীতে চাকরি নেওয়া থেকে বিরত করতে পারেনি । ছোটবেলা থেকেই মায়ের মুখে যুদ্ধক্ষেত্রে বাবার বীরত্বের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছে । বাবাই তার জীবনের আদর্শ । তাই পড়াশোনা করতে করতেই  সেনাবাহিনীতে পাওয়া সুযোগটা সে হাতছাড়া করেনি। আজ সেই সুদূর দেশে তার মা-ও এইভাবে একা একা তার প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছে । সেনাবাহিনীর দলটি ড্রিল করতে করতে এগিয়ে চললো সেন্ট সের্গিয়াস চার্চের দিকে । মূল রাস্তা থেকে ডানদিকে বেঁকে বৃদ্ধ পাইন গাছটার পাশ দিয়ে গিয়ে নদীর তীর বরাবর কিছুটা হেঁটে গেলেই চার্চের এলাকা। চার্চ ছাড়িয়ে কিছুটা চড়াইয়ে গিয়ে ঘন পাইন বনের ভিতর বেশ কয়েক একর জুড়ে বানানো হয়েছে জার্মান সৈন্যের ব্যারাকগুলো । আজ যাওয়ার সময় বুড়ির দাওয়ায় কাউকে বসে থাকতে না দেখে কুচকা আওয়াজের নিয়ম ভেঙে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো ফ্রেডরিক । পিছন থেকে সহকর্মীর খোঁচা খেয়ে সম্বিত ফিরে আবার দলের ছন্দে পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে গেলো । কিন্তু একটা অস্বস্তি ব্যারাকে ফিরেও রয়ে গেলো ।

কদিন ধরেই খবর আসছে যুদ্ধে জার্মানদের অবস্থা একদম ভালো নয়, মিত্রশক্তির সৈন্যরা আস্তে আস্তে জার্মান অধিকৃত জায়গাগুলো পুনরুদ্ধার করে নিচ্ছে। রাশিয়ার এই গ্রামে তারা এসেছে দিন পনেরো আগে, এখান থেকে মস্কো আর সেন্ট পিটার্সবার্গ কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। ওরা এই জায়গাটির দখল নিয়ে শক্তি বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে দুটোর মধ্যে কোনো একটা শহরে। এই অঞ্চলটি এমনিতে শান্ত, কিন্তু ধর্মভীরু মানুষগুলো চার্চের পাদ্রিকে ভগবানের মতো মানে, এই পনেরো দিনে সেনা আধিকারিকরা ফাদার গোমেজকে লাইনে আনতে পারছেনা। উপরন্তু খবর আছে আজ রাত্রে নাকি গোটা গ্রামকে ফাদার চার্চে দেখা করতে বলেছে। তাই আজ রাত্রে কয়েক ব্যাটালিয়ন সৈন্য চার্চ আক্রমন করবে। ফ্রেডরিকের নামও সেই তালিকায় আছে ।

রাত নটা, নদীর দিক থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা হাওয়া জ্যাকেট, টুপি ভেদ করে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে, জনা তিরিশেক সৈন্য পাইন জঙ্গল ভেদ করে পিছন দিক দিয়ে চার্চে পৌঁছতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্য আজকের জমায়েতের উদ্দেশ্য জানা, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা ৷  কাছাকাছি এসে দশজন সৈন্য ঢুকে পড়লো গির্জা চত্বরে, বাকিরা পাইন বনের ঘন অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে রইলো। ভিতরে ঢুকেই তারা কম্যান্ডার ফ্রিৎসের অঙ্গুলি নির্দেশে নিজের নিজের জায়গায় পজিশন নিয়ে নিলো। ফ্রেডরিক পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো প্রার্থনা কক্ষের পিছনের জানলার দিকে। বন্ধ জানলা প্রশিক্ষিত দক্ষতায় কোনো আওয়াজ না করে খুলে ফেললো। চোখ সওয়াতে একটু সময় গেল। যীশুর মূর্তির কাছে কেবলমাত্র একটি মোমবাতি জ্বলছে, বাকি গোটা ঘরে একটা দমবন্ধ করা অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। ফাদারের সাদা জোব্বার পিছনে মোমবাতির আলো তিরতির করে কাঁপছে। চোখ সয়ে আসতে ফ্রেড বুঝলো সামনের দলা বাঁধা অন্ধকারটা অনেক মানুষের সমষ্টি। ফাদারের গলা ভেসে আসছে, "আমার স্নেহের মা, ভাই ও বোন… আজ আমাদের সামনে মহা বিপদ ! এই গ্রামে আমার পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে , এত বড় বিপদের সামনে এই গ্রাম আগে কখনো পড়েনি। আজ কিছুদিন ধরে জার্মান সৈন্যরা আমাদের গ্রাম অধিকার করেছে, আমাদের লোকেদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে, আমরা যদি ভয় পেয়ে সব মুখ বুজে সহ্য করি তাহলে ওরা আমাদের হয় এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করবে, নচেৎ তাদের দাসে পরিণত করবে। প্রভু যীশু আমাদের সহায়, এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের যত শীঘ্র সম্ভব রুখে দাঁড়াতে হবে।" অন্ধকার পিন্ডটা নড়ে চড়ে উঠলো, নিজেদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হলো, তারপর গলার জোর বাড়তে বাড়তে সমগ্র জনতা উঠে দাঁড়িয়ে প্রভু যীশুর দিকে তাকিয়ে একযোগে চিৎকার করে উঠলো, "আমরা লড়বো !"

তারপর কি হলো ফ্রেড ঠিক বুঝে উঠতে পারলোনা, একটা বাঁশির আওয়াজ কানে এসেছিলো, কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক জানলার বাইরে তার পা মাটির সাথে যেন গেঁথে গিয়েছিল। চিৎকার, চেঁচামেচি, আর্তনাদ, কান্নার মধ্যে বুঝতে পারলো জার্মান সৈন্যরা চার্চের ভিতরে ঢুকে ছেলে-বুড়ো, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে পিটিয়ে চলেছে। হঠাৎ একটা গুলির আওয়াজে সম্বিত ফিরে যখন চার্চের সামনে এলো তখন দেখলো মানুষ প্রাণভয়ে আর্তনাদ করতে করতে গির্জা থেকে বেরিয়ে এসে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটে চলেছে। তার মধ্যে কয়েকজন সৈন্য পাদ্রিকে মারতে মারতে গির্জার বাইরে এনে সামনের ঘাস জমিতে ছুঁড়ে দিলো। বয়স্ক মানুষটা একটা কাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়লো, সাদা জোব্বাটি রক্তের লাল ছোপে ভরে গেছে। মাথা ফেটে রক্তের ধরা কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে এসে গলায় জমা হচ্ছে। চোখের চশমার কাঁচ ভেঙে ছিটকে দূরে পড়ে রয়েছে। এমন সময় সেই বৃদ্ধা ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে ফাদারের শরীরটা দুহাতে আড়াল করে চিৎকার করে বলে উঠলেন, " তোমরা বিদেশী, তোমরা আমাদের ঈশ্বরকে আঘাত করতে পারোনা !" কাছে দাঁড়ানো এক সৈনিকের রাইফেলের বাঁটের শক্ত আঘাত নেমে এলো বুড়ির মাথা লক্ষ্য করে। পাদ্রীর পাশের ঘাসের জমিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ফ্রেড বুড়ির চোখে আঘাতের কোনো কষ্ট দেখতে পেলোনা, একরাশ ঘৃণা আর ক্রোধ ভরা দৃষ্টি নিয়ে সোজা তাকালো ফ্রেডের মুখের দিকে। ফ্রেডের দুই হাঁটু কাঁপতে লাগলো, হাতের রাইফেলের ওজনটাও ভীষণ বেড়ে গেলো ।

রাত এখন একটা। পাইন বনের মধ্যে ঘন অন্ধকার জায়গায় জায়গায় যেন শিকারি চিতাবাঘের মতো অপেক্ষা করছে। ফ্রেড সেই অন্ধকারের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিয়ে আরো ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলেছে গ্রামের দিকে। সারা গায়ে- মাথায় জড়িয়ে নিয়েছে কালো মোটা তুষের চাদর। কয়েক মিনিটের মধ্যে চেনা পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেল বুড়িমার দরজায়। গোটা গ্রাম শব্দহীন, একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছেনা। নদীর হু হু বাতাস ঠান্ডার কামড় বাড়িয়ে চলেছে। দরজায় হালকা করে আওয়াজ করলো ফ্রেড, কোনো উত্তর নেই। এবার জোরে আঘাত করলো, এবারও নিরুত্তর। জোরে ধাক্কা দিতে পাল্লা দুটো খুলে গেল, ঘরের এক কোনে একটা মোমবাতি জ্বলছে, আরেক কোনে খাটের উপর অন্ধকারের একটা স্তুপ নিশ্চল পড়ে আছে। মোমবাতিটা নিয়ে ফ্রেড বিছানার কাছে পৌঁছলো। দু চোখ বোজা, চোখের কোনায় জলের পুরনো দাগ শুকিয়ে গেছে৷ কপালে আর দু ঠোঁটে রক্তের দাগ এখনো কাঁচা। পকেট থেকে তুলো আর ডেটল বের করে মাথার ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগলো। দুয়েকবার হাত ছোঁয়াতেই বুড়িমার দুচোখ খুলে গেল, ঘোলা চোখে ফ্রেডের অন্ধকার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। ঘর্ঘর শব্দে কি একটা বলতে চেষ্টা করছে, উঠে বসার চেষ্টা করতে ফ্রেড জোর করে শুইয়ে দিল। মাথায় হাত বোলাতে বুড়ি আবার দুচোখ বুঝলো। ফ্রেড পরম মমতায় মাথা, কপাল, ঠোঁট পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। এই সারাটা সময় বুড়ি হাত দিয়ে ফ্রেডের হাঁটু ছুঁয়ে থাকলো আর মাঝে মাঝেই ফ্রেডের দিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে কি একটা একটা শব্দ বারবার বলে যেতে লাগলো। ফ্রেড তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারলোনা। পরিচর্যা আর ওষুধের গুনে কিছুক্ষণ পর বুড়ি ঘুমিয়ে পড়লো। ফ্রেড ব্যারাক থেকে নিয়ে আসা একটা মোমবাতি ঘরের কোণে জ্বালিয়ে নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে ফিরে এলো ৷

পরের দিন ফ্রেডের যখন ঘুম ভাঙলো তখন সূর্যের জোরালো আলো ব্যারাক ভেদ করে চোখে এসে পৌঁছেছে। তড়িঘড়ি উঠে খেয়াল হলো আজ রবিবার, সকালের ড্রিলের ছুটি। ঘড়িতে আটটা বাজে, উঠে হাতমুখ ধুয়ে ক্যান্টিনে পৌঁছালো। চা, বাটার টোস্ট আর ওমলেট খেতে খেতে খবরটা কানে এলো, সকালেই কয়েক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য গেছে পুরো গ্রাম ইভ্যাকোয়েট করতে। ফ্রেড চমকে উঠলো। ফ্রেডের চোখের সামনে ভেসে উঠলো রক্তমাখা ফাদার আর বুড়ি মায়ের মুখ।  কাল রাত্রে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে গেছে, কিছু করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে বাইরে আসতেই মিলার খবর দিলো নটার সময় অ্যাডমিরাল ম্যাথেউসের অফিসে মিটিং আছে। অগত্যা ড্রেস চেঞ্জ করে দক্ষিণের শেষ বড় তাঁবুটার দিকে চললো। একে সবাই জমা হয়ে মিটিং শুরু হলো সাড়ে নটায়। ফ্রেড কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছেনা, একটা অস্বস্তি সুস্থিরভাবে বসে থাকতে দিচ্ছেনা। মিটিং চললো প্রায় বারোটা পর্যন্ত। ফ্রেড যেটুকু বুঝলো এখানকার তল্পিতল্পা গুছিয়ে তাদের আরোও দক্ষিণ-পশ্চিমে এগিয়ে যেতে হবে, অর্থাৎ এখন ওদের উদ্দেশ্য শহরের দিকে আরেকটু এগিয়ে যাওয়া। মিটিং শেষ হতে আর মুহূর্তকাল অপেক্ষা না করে ধরাচূড়া পরেই ফ্রেড বেরিয়ে গেলো।

তাড়াহুড়ো করে মূল রাস্তা ছেড়ে পাইনবনের পথ ধরলো, এপথে সুবিধা হলো সহকর্মী কারোর সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই রাস্তা ধরেই কাল রাতে তারা গির্জা আক্রমণ করতে গিয়েছিলো। পাইন বন ছেড়ে গির্জার পাশ দিয়ে সরু গলি পেরিয়ে গির্জার সামনে এলো ৷ কেউ কোথাও নেই , বিশাল দরজা তালাবন্ধ। তার মানে পাদ্রিকেও দেশছাড়া হতে হয়েছে। একটু এগিয়ে নদীর ধারের পথ ধরে জোর কদমে এগিয়ে চললো। এখান থেকে রাস্তাটা ডানদিকে ঘুরলেই সেই বৃদ্ধ পাইন গাছের তলায় বুড়িমায়ের কুটির। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই, আশপাশের বাড়ি গুলোতেও কেউ আছে বলে মনে হলোনা। তাড়াতাড়ি এগিয়ে বুড়ির দাওয়ার সামনে এসে বুঝলো, বুড়িও নেই। ভেঙে পড়া দরজা দুপাট খোলা, ভিতরে ঢুকে কাউকে দেখতে পেলোনা ফ্রেড। খাঁ খাঁ ঘরে এককোনায় ভাঙা কাঠের খাটটা ফ্রেডকে যেন গিলতে এলো। তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এলো। পুরো গ্রাম জনশূন্য, কাউকে জিজ্ঞাসা করবে এমন কেউ নেই। বুড়ির বারান্দায় হতাশ ফ্রেড বসে পড়লো। সেই কোন দূরে পড়ে থাকা বুড়িটার জন্যে খুব মনখারাপ করতে লাগলো, চোখের কোনদুটো জ্বালা জ্বালা করে উঠলো। সে জানেনা আর কোনোদিন মায়ের সাথে আর দেখা হবে কিনা! আর এখানে এসে যে বুড়িটার মধ্যে সে মাকে খুঁজে পেয়েছিলো, সে-ও হারিয়ে গেল। সূর্য এখন মাথার ওপর , হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, শীতের রোদের তেজেও হাত-পা জ্বালা জ্বালা করছে। ফ্রেড উঠে দাঁড়ালো, এবার ফিরতে হবে, সৈনিকের কঠোর- কঠিন বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রাস্তায় নামতে গিয়ে হঠাৎ করে মনে হলো কেউ একজন যেন চকিতে সামনের পপলার গাছটার মোটা গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়লো ৷ ফ্রেড দাঁড়িয়ে গেল, কোনো আওয়াজ করলোনা। বুঝতে পারছেনা, ঠিক দেখেছে কিনা ! কয়েক সেকেন্ড পর গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে একটা বাচ্ছার মুখ বেরিয়ে আবার চকিতে আড়ালে চলে গেল। এবার ফ্রেড আস্তে আস্তে এগোতে থাকল। ইচ্ছে করে একটু পিছন দিক দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে গাছটার ডানদিকে পৌঁছলো। এর মধ্যে বাচ্চাটা আর উঁকি দেয়নি। ফ্রেড যখন একদম গাছের কাছে পৌঁছলো, তখন বাচ্চাটা উঁকি দিতেই ফ্রেড একটু দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেললো। বাচ্চাটা আতঙ্কে কেঁদে ফেললো। খুব ভয় পেয়ে গেছে ; ফ্রেড তাকে আশ্বস্ত করতে থাকলো কিন্তু বাচ্চাটার কান্না থামলোনা। ফ্রেড কিছুটা সময় নিলো, কিছু পরে বাচ্চাটা একটু ধাতস্থ হতে ফ্রেড জিজ্ঞাসা করলো, " তুই কে, এখানে কি করছিস ? তোর বাবা-মা কোথায় ? তোরা গ্রাম ছেড়ে যাসনি ?" কিছু পরে কান্না ভেজা উত্তরে ফ্রেড যেটুকু বুঝলো, বাচ্ছাটার বাবা-মা দুজনেই তাদের ব্যারাকে কাজ করে, তাই তাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হয়নি ৷ ফ্রেড জিজ্ঞাসা করলো, " ওই বাড়িটায় যে বুড়িমা থাকতো, সে কোথায় গেছে জানিস?" উত্তরে বাচ্চাটা নদীর ধারে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটার দিকে আঙুল তুলে দেখালো। ফ্রেড আবার জিজ্ঞাসা করলো, " গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে ! সঙ্গে কেউ ছিল ?" বাচ্চাটা দুদিকে ঘাড় নাড়লো। ফ্রেড আর কোনো কথা না বলে বাচ্চাটাকে ছেড়ে নদীর ধারের পথ ধরে ছুটে চললো।

এই গ্রামটির নাম 'সেরগিয়েন পোসাড', গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লিস নদী। লিসের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে পাঁচ মাইল দূরের গ্রাম ভিয়াস্ক, যেখানে এই লিস ভোলগার সাথে মিশেছে। ফ্রেড এবার সত্যিই দৌড়োচ্ছে, তার সৈনিকের ট্রেনিং পাঁচমাইল পথ কয়েক মিনিটে পৌঁছে দিলো। ফ্রেডের মাথায় একদিকে অসহায় আহত বৃদ্ধার ক্রুদ্ধ আর ঘৃণার চাহনি আর অন্যদিকে কাল রাত্রের যন্ত্রণার কাতরানি কানে বাজছে। দূর থেকে ভোলগার আওয়াজ কানে আসছে, এবার ফ্রেড ছোটা বন্ধ করলো। একজন বৃদ্ধা- অসুস্থ মানুষ এই কয়েক ঘন্টায় কতদূর আসতে পারে ! বাচ্চাটার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এতক্ষন বৃদ্ধার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাওয়ার কথা। কাল রাতে ফ্রেড নিজের চোখে বৃদ্ধার মাথার আর মুখের চোট দেখেছে। সেই আঘাত নিয়ে বৃদ্ধা কতদূর যেতে পারে ! চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ফ্রেড ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। তাঁর তীক্ষ্ণ সন্ধানের ব্যাঘাত ঘটালো একটা কুকুরের চিৎকার।

ভিয়াস্ক গ্রামটিও জনহীন, ইতস্ততঃ ভাঙাচোরা বাড়িগুলো কোনো এক সময়কালের জীবন্ত ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটার আচরণটা ফ্রেডের স্বাভাবিক মনে হলোনা। একটা ভাঙা বাড়ির বারান্দা থেকে ফ্রেডের দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর ক্রোধে চিৎকার করছে আর পরক্ষণে দৌড়ে ঘরের দরজায় কাছে গিয়ে কি যেন দেখে আসছে। আর অদ্ভুত… তখন ওর গলার স্বরও বদলে যাচ্ছে, কিরকম করুন স্বরে কান্নার মতো লাগছে ! ফ্রেডের সন্দেহ হলো, আস্তে আস্তে ঘরটির দিকে এগিয়ে চললো। ফ্রেড এগোতেই কুকুরটি আরো তীব্রস্বরে ডাকতে লাগলো, ঠিক ডাক নয় যেন গর্জন করতে লাগলো। ফ্রেড তার সেনা ট্রেনিংয়ের কায়দায় কুকুরটাকে একটু শান্ত করতে পারলো। আস্তে আস্তে বারান্দায় উঠে এলো, কুকুরটার হাবভাব বুঝে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললো ভাঙা দরজার দিকে। দরজার সামনে থেকে ভিতরে উঁকি মারতেই দৃশ্যটা চোখে পড়লো।  দৃশ্যটি দেখে ফ্রেড চলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল৷ অনেক পর আস্তে আস্তে ধুলোমাটিতে শোওয়া বুড়িমার পাশে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো। কপালে কাল রাত্রের ব্যান্ডেজ থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে লাল হয়ে গেছে, সারা শরীর ধুলো মাখা। আর কি আশ্চর্য ! বুড়িমার সারা মুখ জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত এক হাঁসি ! হাত দুটো বুকে ভাঁজ করা, আর দুহাতের নিবিড় বাৎসল্যে আটকে আছে একটা ফটোগ্রাফ। ফ্রেড হাত বাড়িয়ে ফটোটা নিয়ে আধা অন্ধকার ঘরে চোখের সামনে নিয়ে এলো। সাদা-কালো একটা ছবি, সময়ের অভিশাপে অস্পষ্ট, তার বয়সী একটা ছেলের ছবি। তলায় কিছু একটা লেখা , ফ্রেড কষ্ট করে পড়তে পারলো- নিকোলাস ফ্রিওদস্কি- জন্ম: ১৮৯০ , মৃত্যু: ১৯১১.

এতক্ষণ ফ্রেডের বোধগম্য কাল রাতে বুড়ি তার হাত ধরে, 'নিকোলাস, নিকোলাস' বলে ডাকছিলো।

 

ডঃ গৌতম সরকার
অর্থনীতির অধ্যাপক
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top