কাজী নজরুল ইসলামের কুহেলিকা : সিরাজুল ইসলাম জীবন
প্রকাশিত:
৮ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৫৯
আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০৯
খুব বেশি উপন্যাস লেখার সময় পাননি কাজী নজরুল ইসলাম। মাত্র তিনটি উপন্যাস লিখেই জানিয়ে দিতে পেরেছেন, তাঁর উপন্যাস লেখার ক্ষমতা কোন পর্যায়ে ছিল। তিনটির একটি হলো 'কুহেলিকা '। কুহেলিকা পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি নজরুলের উপন্যাস নির্মাণের কৌশল প্রয়োগের মুন্সীয়ানায়। ধ্রুপদী মূর্চ্ছনায় এক অন্যলোকে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কুহেলিকা বুহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার অনন্য, অসাধারণ উপন্যাস।
নজরুলের কবিতা এবং সঙ্গীত নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। ঔপন্যাসিক নজরুল কত উচ্চাঙ্গের তা টের পেলাম কুহেলিকা পড়ে। একটুও বিরক্তি ধরেনি। উপন্যাসে এত নাটকীয়তা থাকতে পারে যা আমাকে বিস্মিত করেছে। হয়তো নজরুল বলেই সম্ভব।
একসঙ্গে অনেকগুলো বিষয় এ উপন্যাসে তুলে এনেছেন কবি। ভাষার অসাধারণ কারুকাজ তো আছেই। স্বদেশি আন্দোলনই মূল প্রেক্ষাপট। পাশাপাশি এসেছে গল্পের নায়ক জাহাঙ্গীর চরিত্রের দ্বান্দ্বিক মানস। নিজের জন্মপরিচয়ের সন্দেহ কীভাবে একজন টকবগে যুবককে আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত করে এবং ক্রমান্বয়ে বিপ্লবী করে তোলে তার নিখুঁত বিশ্লেষণ দেখলাম। এবং বিপ্লবীরা যে ফেরেশতা নয়, তারাও যে কাম-ক্রোধের উর্ধ্বে নয় তাও উপন্যাসে প্রমাণিত হয়। এসেছে প্রেম। জটিল প্রেম। তহমিনা চরিত্র ঘিরে। পুরুষ চরিত্রের বিশ্লেষণ যেমন করেছেন ঠিক তেমনি করেছেন কুমারী নারী চরিত্রের বিশ্লেষণ। তহমিনার পাশাপাশি ঘটনাচক্রে সমান্তরাল দাঁড়িয়ে যায় বিপ্লবী চম্পা । নারী বিদ্বেষী জাহাঙ্গীর তহমিনাকে বিয়ের দ্বারপ্রান্তে রেখে ঘটনাচক্রে চম্পার রূপগুণে বিমোহিত হয়। যদিও বিপ্লবীদের প্রেম-বিয়েতে অনাসক্তি থাকতে হয়। নিয়তির জটিল খেলার ক্রীড়নক যেন জাহাঙ্গীর।
এক অন্ধ পিতা, এক পাগলিনী মা, বিপ্লবী জমিদার পুত্র জাহাঙ্গীরের জন্মদায়িনী মাতা, অবিবাহিত তহমিনা ও বিপ্লবী চম্পার নিখুঁত চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। নারী চরিত্রের পাশাপাশি পুরুষ চরিত্রেরও যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন আমার বারবার রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। স্বাদেশিকতা, প্রেমাসক্তি, প্রকৃতিপ্রেম, মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ইত্যাদি একসঙ্গে কবি চমৎকার শিল্পকুশলতায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শেষ প্রান্তে করুণ রসের সৃষ্টি হয়। বিপ্লবী জাহাঙ্গীর ধরা পড়ে এবং বিচারে তার দ্বীপান্তর হয়। এদিকে বধূবেশী তহমিনার হৃদয়ের করুণ হাহাকার, অদ্ভুত সুন্দরী চম্পার অন্তরের রক্তক্ষরণ এবং মা ফিরদৌস বেগমের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা যে ট্র্যাজিক অবস্থার সৃষ্টি করে---তা এই উপন্যাসকে অনন্য উচ্চতা দিয়েছে। কিন্তু হাসিমুখে সব বরণ করলেন বিপ্লবী জাহাঙ্গীর। কেবল বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে এক মহাসত্য উচ্চারণ করে গেলেন----নারী কুহেলিকা।
সিরাজুল ইসলাম জীবন
প্রভাষক (বাংলা), নজরুল গবেষক, সাহিত্য সমালোচক, কবি
বিষয়: সিরাজুল ইসলাম জীবন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: