সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ভবতোষবাবুর ভয় : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১০ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৬

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৯

 

এক

ভবতোষ সান্ন্যাল আজকে আবার রেগে গেলেন। তা রেগে যাবারই কথা, তার বাড়িটা উত্তর কলকাতার একটা কানা গলির মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে, কে বলবে এখান থেকে পাঁচশো মিটারের মধ্যে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে এখন লোকে লোকারণ্য, স্বয়ং নেতাজি রয়েছেন ঘোড়ার পিঠে বসে! পাঁচু দত্ত লেনে সন্ধ্যা সাতটাতেই সব শুনশান। আসলে নামেই লেন, ফটিক মিত্তির লেন থেকে দুটো বাড়ির মাঝখান থেকে এক চিলতে রাস্তা বেরিয়ে গিয়ে ভবতোষ বাবুর বাড়িতে হারিয়ে গেছে। ফটিক মিত্তির লেনের বাড়ির পেছন দিকগুলোই যা ভবতোষ বাবুর বাড়িটাকে সঙ্গ দিচ্ছে। বাড়িটার তা বয়সও হয়েছে বেশ, এ অঞ্চলের সব বাড়িই প্রাচীনের গন্ধ গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, ওভারব্রীজের ঝলসানি থেকে গা বাঁচিয়ে এ এক অন্য কলকাতা। একটা ছোট নিচু লোহার গেট পেরিয়ে এক চিলতে উঠোনের ধারে ভবতোষ সান্ন্যালের বাড়ি, এই ধরনের গেটও উত্তর কলকাতার গলিতে বেশ বিরল, হয়তো একলা দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই সান্ন্যাল বাড়ির এই আলাদা বৈশিষ্ট্য। গেট ঠেলে ঢুকতে ঢুকতেই ভবতোষ রেগে গেলেন, বিশু যথারীতি উঠোনে মিটমিটে হলদে বাল্বটা জ্বালিয়ে রেখেছে, আলোটার যেন গেট অবধি আসতে  কষ্ট হচ্ছে। ভবতোষ বাবুর আবার ভূতের ভয়, তিনি সেটা স্বীকার না করলে কী হয়, তিনি ভূত নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত, তাই বারান্দায় টিউব লাইটের ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু বিশু হারামজাদা তা জ্বাললে তো! ও ঠিক একটা ষাট পাওয়ারের হলদে বাল্ব জ্বেলে রাখবে, এই বাল্বগুলো যে এখনও কোথায় পাওয়া যায় তা বিশুই একমাত্র জানে। ওর নাকি চোখের সমস্যা, টিউবের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ভবতোষ বাবু হাঁক পাড়েন, “বলি, ও বিশু, বেঁচে আছিস না মরে গেছিস? একটু আলো টালো দেখাবি তো!” বিশু ভেতর থেকে সাড়া দেয়, “মরবার তো জো নেই, আর মরতে যদি পারতাম, তো তোমায় দেখতো কে? গিন্নী মা তোমাকে আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে স্বগ্গে গেলেন আর আমি দিনরাত তোমার ফাইফরমাশ খেটে মরছি, গালাগালিও খাচ্ছি। আলো তো জেইলে রেখেছি তোমারই জন্য, নয়তো আমার আঁধারেও বেশ কাজ চলে যায়।” ভবতোষ আরও রেগে উঠলেন, “সে তো তোর আঁধারে কাজ চলেই যাবে, বেটা একটা আস্ত ভূত। উফ! মা আমাকে কী ফাঁপরেই না ফেলে গেল, নয়তো একটা ভূত নিয়ে সংসার করতে হয়।” বিশু এবার হেসে ফেলে বলে, “থাক থাক, তোমার এত বয়স হল এখনও তেনাদের ভয় গেল না, আজকালকার বাচ্চারাও তেনাদের ভয় পায় না। এস হাত পা ধুয়ে নাও, আমি চা জলখাবারের ব্যবস্থা করি। আজ মুসুর ডাল বেটেছি, তুমি ঠাণ্ডা হয়ে বসতে বসতে গরম গরম ভেজে দেব। ডজন দুই সাবড়ে দিয়ে চা খাও। রাতে শুধু রুই মাছের ঝোল ভাত।” ডজন দুই নয় গোটা তিরিশেক ডালের বড়াই সাবড়ে দিলেন ভবতোষ, এসব হজম করা তার কাছে নস্যি। সান্ন্যালদের খাইয়ে হিসেবে সুনাম আছে। বড় কর্তা মানে ভবতোষ বাবুর দাদু মহীতোষ সান্ন্যাল একাই কিলো দুয়েক পাঁঠার মাংস খেয়ে তারপরে একশোটা রসগোল্লা খেতেন। তার ছেলে প্রাণতোষ সান্ন্যাল আবার রসগোল্লা পছন্দ করতেন না, তিনি খেতেন পান্তুয়া। ভবতোষের রসগোল্লা, পান্তুয়া কিছুতেই আপত্তি নেই, তবে উনি ষাটটার বেশি পারেন না। চায়ে চুমুক দিয়ে একটা পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভবতোষ বললেন, “হ্যাঁ, কী বলছিলি? এখনকার বাচ্চারাও তেনাদের ভয় পায় না। তা পাবে কোথা থেকে, ওরা সেসব দেখেছে কোথায়? আসলে ভয় নয় বুঝেছিস, এটা সম্মানের ব্যাপার। তেনাদের সম্মান না করলে তেনারা আসবেন কেন? কী দায় পড়েছে? এখনকার ছেলে ছোকরারা তেনাদের সামনে পড়লে তো চিনতেই পারবে না।”

বিশু বললো, “না চেনাই ভালো কি না, চিনতে চাইলেই গোলমাল বেঁধে যাবে। যা সব বিচ্ছু এক একজন। রাজেন মিত্তিরের নাতিটাকেই দেখো না, ওর জ্বালায় কাক পক্ষীর এ পাড়ায় আসার উপায় আছে! দেখলেই এয়ার গান ছুঁড়ছে, ভুলু কুকুর, মিনি বেড়াল সবাই ওর জ্বালায় অতিষ্ঠ।” ভবতোষ বললেন, “তা একটু ভয় টয় দেখাতে তো পারিস, অবলা জীবগুলো একটু স্বস্তি পেতো।” বিশু বললো, “সে চেষ্টা কি আর করিনি? একদিন সন্ধ্যাবেলায় দেখি আমাদের বাড়ির সামনে একটা বিড়াল বাচ্চাকে ঠ্যাং ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছে আর বাচ্চাটা পরিত্রাহি চীৎকার করছে, গেল মাথাটা গরম হয়ে, সব ভুলে ওর সামনে উদয় হয়ে বললাম বিড়াল বাচ্চাটাকে ছেড়ে দে। তা দিল বটে, কিন্তু বলে কিনা, এমন সং সেজেছ কেন? আমার কাছে কিন্তু পয়সাকড়ি কিছু নেই। বলে, হাঁটা লাগাল। ভাবো একবার, আমাকে সং ঠাউরেছে! কর্তামশায় বা বড়কর্তাকে যদি মুখের ওপর এমনতর বলে তো মান সম্মান থাকবে?” ভবতোষ বললেন, “হুঁ”, তা তোর কর্তামশায় আর বড় কর্তা এখন কী করছেন?” বিশু বলল, “বাপ ব্যাটা দুজনে টংএর ঘরে দাবা নিয়ে মেতেছেন। বলেছেন ভব এসে চা জলখাবার খেলে চারজনে তাস নিয়ে বসা যাবে।” ভবতোষ বললেন, “তুই তো হাত দেখে খেলবি।” বিশু বললো, “তুমি ভুল করছো, আমি তোমার হাত দেখি না, তাসগুলো চোখে পড়ে যায় আর কি। একসময় শিয়ালদহ শ্যামবাজার রুটে পকেটমারি করতুম তো, তা একদিন বড়কর্তা শিয়ালদহে তোমাদের দোকান থেকে বেরিয়ে বাসে উঠেছেন আর আমিও বয়স্ক লোক দেখে পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে উনি খপ করে হাতটা ধরে ফেলেছেন, তবে বাচ্চা ছেলে বলেই বোধহয় ওনার মায়া হল, চেঁচাননি। আমি ভেবেছিলাম একসময় হাত ছাড়িয়ে ঠিক পালাবো, কিন্তু কি বজ্র আঁটুনি। সোজা বাড়িতে নিয়ে এলেন, গিন্নী মার জিম্মায় আমাকে দিয়ে বললেন, বৌমা এ ব্যাটা আজ থেকে এখানেই থাকবে, তোমার হাতে হাতে কাজ কর্ম করবে। বড় কর্তা তো মন পড়তে পারেন, কীকরে যেন বুঝে ফেলেছিলেন আমার তিনকুলে কেউ নেই। গিন্নী মা যেন দুর্গা প্রতিমা, সেই যে মাথায় হাত রাখলেন আমিও তোমাদের কেনা হয়ে গেলাম। নাও চলো কর্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।”

 

দুই

প্রাণতোষ সান্ন্যাল বিড করলেন, “থ্রী ডায়মন্ডস।” মহীতোষ বললেন, “রাখ তোর থ্রী ডায়মন্ডস, বলে হাঁক পাড়লেন ফোর নো ট্রাম্পস।” তারপর ভবতোষের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাদাভাই হাত শো করো, দানটা আমরাই খেলছি, বিশুর মুখ দেখেই বুঝেছি ওর কিছু বিড করার নেই।” বিশু বললো, “আপনি অন্তর্যামী বড়কর্তা, সে আমি প্রথমদিন থেকেই টের পেয়েছিলাম।” বলে বড়কর্তা আর কর্তামশাই দুজনের পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, “আপনারাই আমার ভূত ভবিষ্যত।” যদিও কর্তাদের পায়ে ধুলো টুলো কিছু নেই, ধুলোর দিন তারা পেরিয়ে এসেছেন। মহীতোষ বললেন, “নে নে খুব ভক্তি হয়েছে, ব্যাটা ভূত তোর আবার ভবিষ্যত কী রে! তোর তো পুরোটাই ভূত মানে অতীত। যার ভবিষ্যত আছে তাকেই কাজের কথাটা বলি।” বলে স্প্রেডের টেক্কাটা চেলে, প্রাণতোষের দিকে চেয়ে সমর্থনের আশায় বললেন, “কী বলিস বড় খোকা ?” প্রাণতোষ বললেন, “ঠিকই বলেছো।” বিশুও মাথা নেড়ে সায় দেয়। ভবতোষ বললেন, “তোমাদের মতলবটা কী? তোমরা পাততাড়ি গোটানোর ধান্দায় আছ নাকি? বলি, ওটা হচ্ছে না, তোমরা জানো আমার ভারি ভূতের ভয়, একা আমি রাতে মোটে থাকতে পারি না।” মহীতোষ বললেন, “শোনো দাদাভাই, সেইজন্যই বলছি তোমাকে এবার একটা বিয়ে করতে হবে। বয়স তো প্রায় তিরিশ হল, আমরা তো বংশধরের মুখ দেখব, আর বৈঠকখানা রোডে অতবড় বই খাতার কারবারের তো একজন ওয়ারিশান দরকার। সেবার তোমার ছোটমামার বিয়েতে তুমি বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখবে বলে কিছুতেই গেলে না, বিশুও  তোমার সঙ্গে থেকে যেতে চাইল, কিন্তু তোমার প্রেস্টিজে লাগল, জোর করে বিশুকেও আমাদের সঙ্গে পাঠালে। আমরা ফার্স্ট ব্যাচে খেয়েই তাড়াতাড়ি ফিরছিলাম, অনেকটা পথ, বড়খোকা খালি বলছিল ভব আমার ভয় পাবে, রাত হলে একা বাড়িতে থাকতে পারে না, বাবার মন, খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল, একটা লরি কিছুতেই সাইড দিচ্ছিল না, অচেনা রাস্তায় ওভারটেক করতে গিয়ে গাড়িটা খালে পড়ে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল সলিল সমাধি আর বেরোতে পারব না, বিশু বললো বেরতেই হবে, দাদাবাবু নয়তো একা ভয় পাবে। তারপর বেরোলাম , গাড়ি পড়ে রইল, শরীরগুলোও, আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে এসে নিশ্চিন্ত হলাম। তোমাকে সবটা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল, তবে ভয় টয় যে পেয়ে যাওনি সেই ভাগ্যি।” দেখো দাদাভাই প্রাণতোষের বন্ধু হরিশের মেয়ে দেবযানীকে আমাদের খুব পছন্দ, আর তুমিও তাকে অপছন্দ করো না সে আমরা বেশ জানি, তোমাদের ছোটবেলা থেকে বহুবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। তোমার মামাদের খবর দাও, তারা এসে বিয়ের কথা বার্তা বলুক। আমি চিঠি লিখে দেব, বলবে এই তোমার দাদুর ইচ্ছে, তার ডাইরি থেকে জানতে পেরেছ। তোমার মামারা তাতে অমত করবেন না, তুমিও নিজে থেকে বলার লজ্জা থেকে অব্যাহতি পাবে। হরিশদের এ বিয়েতে মত আছে, দেবযানীর তো আছেই।” ভবতোষ বললেন, “ সব তো বুঝেছি, কিন্তু নতুন বউ এসে যদি তোমাদের দেখে ভয় পায়? আমি তো তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না।” প্রাণতোষ বললেন, “ বাপ দাদু কী চিরকাল কারো থাকে ? আর আমরা এখনই কোথাও যাচ্ছি না, আগে বংশধরের মুখ দেখি, তারপর ভাবা যাবে, তার আগে আমাদের মুক্তি নেই, মুক্তি চাইও না। নতুন বৌ যাতে ভয় না পায় তার ব্যবস্থা করা যাবে।বিশুর তো ঐসব বালাই নেই, ও বোধহয় থেকেই যাবে, ও ব্যাটা সব পারে, বৌমাকেও ম্যানেজ করে ফেলবে।”

 

তিন

ভবতোষ ভাবছিলেন কীকরে ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে টং এর ঘরে যাওয়া যায়। একটু আগে দেবযানী যমজ ছেলে মেয়েকে  নিয়ে নার্সিংহোম থেকে ফিরেছে। ভবতোষ ভাবছিলেন, দেবযানী ঘুমোলে রাতে একে একে দুজনকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আসবেন। দেবযানী বলল, “যা ভাবছ তা হবে না মশাই, কর্তারা কী খালি হাতে

বংশধরের মুখ দেখবেন? যাও আগে দুজোড়া সোনার বালা আর দুটো সোনার হার কিনে আনো, বিশুও তো মামা হয়েছে, ওর সাধ আহ্লাদও তো আছে।” ভবতোষ তাজ্জব হতে গিয়েও হলেন না, ভাবলেন, হুঁ ভুতুড়ে মামা। বিশু বেটা একটা আস্ত ভূত, দেবযানীকে শুধু প্রথম থেকে ম্যানেজই করেনি, কর্তাদের কথাও জানিয়ে রেখেছে। মুখ দিয়ে স্বগোক্তি বেরিয়ে এল, “বিশু বোধহয় ঠিকই বলেছিল, এখন তেনাদের কেউ ভয় টয় পায় না।” দেবযানী বললো, “হ্যাঁ, আপনজনদের কী কেউ ভয় করে? সম্মান করে, ভালোবাসে। নাও হাঁ করে বসে না থেকে স্যাকরার দোকান থেকে ঘুরে এসো, কর্তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন যে।” ভবতোষের প্রথমবারের মতো জীবনে ভয়টা কেটে যেতে থাকে, মনে হয় ফুটফুটে মুখ দুটো দেখে কর্তারা না থেকে গিয়ে পারবেন না। উঠোনে বেরিয়ে হাঁক দিয়ে ওঠেন, “ওরে ব্যাটা বিশু সন্ধ্যা হয়ে গেল, বলি আলোটা দেখাবি তো!”

 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top