সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

দ্যা প্রফেট (চতুর্থ অনুচ্ছেদ) : কাহলীল জীবরান 


প্রকাশিত:
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৭

আপডেট:
৯ জানুয়ারী ২০২১ ২৩:১৫

ছবিঃ কাহলীল জীবরান এবং অনুবাদক রোজীনা পারভীন বনানী 

 

মূল: কাহলীল জীবরান 
অনুবাদ: রোজীনা পারভীন বনানী 

 

সাত
তারপর একজন মহিলা বললেন, আমাদের আনন্দ এবং দুঃখ সম্পর্কে বলুন।

 

তিনি উত্তর দিলেন:

তোমার মুখোশহীন দুঃখই তোমার আনন্দ। যে ঝর্ণা থেকে তোমার হাস্যধ্বনি উৎসারিত হয় মাঝে মাঝে তা চোখের জল দিয়ে পূর্ণ হয় এবং এ ছাড়া কি-ই বা হতে পারত? এই দুঃখ তোমার সত্তায় যত বেশী খুঁড়বে, তুমি তত বেশী আনন্দ ধারন করতে পারবে। যে পেয়ালা তোমার মদকে ধারন করে আছে, সেই কি প্রকৃত পেয়ালা নয় যা কুম্ভকারের চুলায় পোড়ানো হয়েছে?

এবং এই সেই বীণা নয় যা প্রকৃতই কাঠকে ছুরি দিয়ে গর্ত করে বানানো হয়েছে এবং যা তোমার আত্মাকে শান্ত করে? যখন তুমি আনন্দিত হবে, তোমার হৃদয়ের গভীরে তাকাও এবং দেখবে যা তোমাকে দুঃখ দিয়েছে শুধু তাই যা তোমাকে আনন্দিত করছে। যখন তুমি দুঃখিত হবে, পুনরায় তোমার হৃদয়ের গভীরে তাকাও, এবং দেখবে তুমি সত্যিকার ভাবে তার জন্যই কাঁদছ যা ছিল তোমার পরম আনন্দের।

তোমাদের মাঝে কেউ কেউ বলে, “বেদনার চেয়ে আনন্দ বড়,” এবং অন্যরা বলে, “না, বেদনায় বড়”।

 

কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলছি, আনন্দ এবং বেদনাকে আলাদা করা যায় না। তারা দুজন একসাথে আসে, এবং যখন একজন তোমার সাথে খাবার টেবিলে বসে থাকে, মনে রাখবে অন্যজন তখন তোমার শয্যায় ঘুমন্ত।

প্রকৃতপক্ষই তুমি তোমার আনন্দ এবং বেদনার মাঝখানে দাঁড়িপাল্লার মত ঝুলন্ত অবস্থায় আছো। শুধু ভারমুক্ত হলেই তুমি স্হির এবং সুষমভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। যখন সম্পদ রক্ষক তার স্বর্ণ এবং রৌপ্য মাপার জন্য তোমাকে তুলবে, তখন অবশ্যই প্রয়োজন হবে তোমার আনন্দ এবং বেদনার উঠা-নামার।

 

আট

তারপর একজন রাজমিস্ত্রী সন্মুখে আসলেন এবং বললেন, আমাদের বাসগৃহ সম্বন্ধে বলুন।

তিনি উত্তর দিলেন এবং বললেন:

প্রথমে তোমার কল্পনায় নির্জন প্রান্তরে একটা নিকুঞ্জ তৈরী কর, তারপর তুমি নগরপ্রাচীরের ভিতর গৃহ নির্মাণ কর। তোমার ভিতরে একজন যাযাবর বাস করে, যে চির-নিঃসঙ্গ এবং একাকী, ঠিক একই সময়ে তোমার ভিতর বাড়ী ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষাও আছে। তোমার গৃহ হচ্ছে তোমার বৃহত্তর দেহ। যা সূর্যোদয়ের সাথে জেগে ওঠে এবং রাত্রির নির্জনতায় ঘুমিয়ে থাকে; এবং যা স্বপ্নশূন্য নয়। তোমার গৃহ কি স্বপ্ন দেখে না? এবং স্বপ্ন দেখে শহর ত্যাগ করে কুঞ্জবন বা পাহাড়চূড়ার জন্য?

ভালো হতো যদি আমি তোমাদের সব গৃহ আমার হাতের উপর জড় করতে পারতাম এবং বপনকারীর মত সেগুলোকে বিশাল অরণ্যে এবং তৃণভূমির ভিতর ছড়িয়ে দিতে পারতাম। তাহলে উপত্যকাগুলো হতো তোমাদের রাস্তা, এবং তোমাদের পায়ে চলা পথ হতো সবুজ, যাতে তোমরা দ্রাক্ষাক্ষেতের ভিতর পরস্পরকে খুঁজে নিতে পারতে, এবং তোমাদের পরিচ্ছদে পৃথিবীর সৌরভ মেখে বের হয়ে আসতে পারতে। কিন্তু এ সমস্ত কিছুই শেষপর্যন্ত হবার নয়।

ভয়ে তোমার পূর্বপুরুষগণ তোমাদেরকে যতদূর সম্ভব নিজেদের কাছে জড়ো করেছেন। এই ভয়ের কিছু অংশ আরও কিছুকাল অবিচল থাকবে। যার ফলে আরও কিছুকাল নগরপ্রাচীর তোমাদের ক্ষেত থেকে তোমাদের বাসগৃহকে পৃথক করে রাখবে।

এবং অরফানেজবাসী, আমাকে বল, এই সমস্ত গৃহে তোমাদের কি আছে? এবং সুদৃঢ় দরজার দ্বারা তোমরা কি পাহারা দাও? যে প্রশান্ত জেদ তোমার শক্তিকে প্রকাশ করে, সেই শান্তি তোমার আছে? তোমার মনের সুউচ্চ চূড়ায় বিস্তৃত জ্বলজ্বলে যে তোরণ, সেই স্মৃতি তোমার আছে? তোমার হৃদয়কে কাঠ এবং পাথর দিয়ে তৈরী জিনিসের থেকে যা পবিত্র পর্বতের দিকে ধাবিত করে, সেই সৌন্দর্য কি তোমার আছে?

 

আমাকে বল, এ সমস্ত কিছু কি তোমাদের গৃহে আছে? অথবা শুধুমাত্র স্বাচ্ছন্দ্য কি তোমাদের আছে, এবং স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা, সেই গোপনীয় জিনিস যা গৃহে প্রবেশ করে অতিথির মত, এবং তারপর সেই অতিথি সেবকে পরিণত হয়, এবং তারপর একজন প্রভুতে?

 

হ্যাঁ, এবং এইভাবেই বশীভূত করবে এবং তীব্র যন্ত্রণায় এবং কষ্টে তোমার বৃহত্তর কামনাগুলোকে নাচের পুতুলে পরিণত কর। শুধুমাত্র তোমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তোমাকে ঘুম পাড়ানি গান শোনাবে এবং তোমার শারীরিয় মহত্ত্ব নিয়ে ব্যাঙ্গ করবে। সে তোমার গভীর জ্ঞানকে উপহাস করবে এবং তাদের বুনো কাঁটা গাছের ঝোপের ভিতর ভঙ্গুর পাত্রের মত শুইয়ে দেবে। প্রকৃতপক্ষেই স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা আত্মার আবেগকে হত্যা করে এবং তারপর তৃপ্তির সাথে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেয়। কিন্তু তোমরা মহাশূণ্যের সন্তানেরা, তোমরা বিশ্রামের ভিতরে বিশ্রামহীন, তোমরা বশীভূত এবং বন্দী হয়ো না। তোমাদের গৃহ কোন নোঙর হবে না বরং একটা মাস্তুল।

এটা কোন জ্বলজ্বলে ছবি নয় যা আঘাতকে ঢেকে রাখে, বরং একটা চোখের পাতা যা চোখকে পাহারা দেয়।

 

তুমি দরজা দিয়ে ঢোকার জন্য তোমার ডানাকে ভাঁজ করো না, অথবা ছাদের চূড়ায় ধাক্কা লাগার ভয়ে তোমার মাথাকে নুইও না, অথবা পাছে তোমার প্রাচীর ফেটে ভেঙ্গে পড়ে এই ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করো না। মৃতরা জীবিতদের জন্য যে সমাধি তৈরী করছে তোমরা তাতে বাস করো না।

 

এবং যদিও চমৎকার এবং জাঁকজমকপূর্ণ, তথাপি তোমাদের গৃহ না তোমাদের গোপনীয়তাকে ধরে রাখতে পারে, না তোমাদের আকাঙ্ক্ষাকে আশ্রয় দিতে পারে। সেই জন্য যা তোমাদের ভিতর সীমাহীন, তা আকাশের অট্টালিকায় বাস করে, ভোরের কুয়াশা যার দরজা, এবং রাত্রের নিঃস্তব্ধতার গান যার জানালা।

চলবে

 

রোজীনা পারভীন বনানী 
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top