সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

খোলা চিঠি : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:০৭

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২৬

 

কি বলে তোমাকে সম্বোধন করি বলতো !  ‘পূজনীয়া মা', 'শ্রদ্ধেয়া মা', না 'প্রিয় মা'... দূর… সবগুলোই কেমন ক্লিশে লাগছে, তার চেয়ে শুরু করি,

আমার মা,

মা, তোমাকে কখনও চিঠি লেখা হয়ে ওঠেনি। আসলে তোমাকে যে চিঠি লিখতে হয় তাই কখনো অনুভব করিনি। চিঠিতো তাকেই লেখা হয় যে অনেক দূরে কুয়াশার ওপারে থাকে, আর তুমি তো সকালের রোদের মতো, তোমাকে পিঠে নিয়ে কত সকাল উঠোনে লাউমাচার পাশে বসে বারোর ঘরের নামতা মুখস্থ করেছি ; চিঠিতো তাকেই লিখতে হয় যাকে বিকেলের নদীর ঢেউয়ে, সন্ধ্যের দূর পাহাড়ের আলো জ্বলা জোনাকির ঝাঁকে আর মধ্যরাতের স্বপ্নভাঙা ঘুমঘোরে অনুভব করা যায় ; কিন্তু মা তুমি তো ধান শুকোতে দেওয়া উঠোনে, বাসন মাজা কলতলায়, হলুদ গন্ধমাখা রান্নাঘরে আর ধোঁয়াগন্ধ সন্ধ্যাবেলায় চোখে চোখেই থাকতে । তোমাকে চিঠি লেখার কখনো প্রয়োজনই হয়নি ৷

 

" আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি,

বাবাকে আপনি।

আমাদের মা গরীব প্রজার মত দাঁড়াতো

বাবার সামনে,

কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে

উঠতে পারতোনা।

আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে

মাকে আপনি বলার কথা আমাদের

কোনোদিন মনেই হয়নি” ৷

( আমাদের মা- হুমায়ুন আজাদ)

মা তুমি কেন এত সাদামাটা ছিলে গো ! তোমার একটু রঙিন হতে ইচ্ছে হতনা ! বিকেলের গা ধোয়া শেষ করে  আটপৌরে শাড়িটাকে একটু পরিপাটি পরে মাথায় বেলফুল গুঁজে কখনো বসতে ইচ্ছে হয়নি বাইরের ঘরের ভরা চৌকাঠে !

মা তুমি কখনো স্বপ্ন দেখতে ? প্রেম করতে  ? উঠোনের গাছগুলোকে যখন শেষ বিকেলে জল দিতে সেটাই কি ছিল তোমার নিবেদন ? বাবার গালাগালি শুনে সিঁড়ির ঘরে গিয়ে যখন কাঁদতে সেটাই কি তোমার প্রেম ? আর 'ছোটলোক ঘরের মেয়ে' বলে সারাজীবন গালিগালাজ করে যাওয়া ঠাকুমার যখন কলেরা হলো, নিঃশব্দে বুড়ির মলমূত্র নিজ হাতে পরিষ্কার করার নাম কি ছিল ভালোবাসা ! আচ্ছা মা, তুমি প্রেম আর অপমানের মধ্যে তফাৎ বুঝতে ? বুঝতে পারতে আমি তোমাকে গোঁয়ারের মত ভালোবাসি !  ছোটবেলায় তোমার ওপর সবসময় আমার ভীষণ রাগ হতো। রাগ হতো যখন সবাইকে খাইয়ে গড়ানো বেলায় তুমি খরখরে ভাত, ডাল আর এতটুকু তরকারি নিয়ে খেতে বসতে ; রাগ হতো যখন দেখতাম বাবা মাছের বিশাল মুড়ো আয়েশ করে খেয়ে তৃপ্তির উদ্গার তুলতো আর দিনের শেষে তোমার পাতে মাছের কাঁটাটাও থাকতোনা ; রাগ হতো যখন ভরা জৈষ্ঠ্যের খটখটে রোদ উপেক্ষা করে তোমাকেই যেতে হত ছাদে বিছানো ধান নেড়ে দিতে, কিংবা শুকোতে দেওয়া সবাইয়ের জামাকাপড় তুলে আনতে। আমি কিন্তু চাইতাম তোমার কষ্ট কমাতে , দুঃখ ঘোচাতে , কিন্তু আমি এতই ছোট ছিলাম তুমি আমার আর্তি বুঝতেই পারতেনা। তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম বড় হলেই তোমাকে ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে যাবো, কিন্তু তোমাকে চিঠি লেখার কথা কখনো মনে আসেনি ৷

 

" মা’র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল

ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,

যেন দুঃখগুলো সুগন্ধি পেতে পেতে

ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও…….

.................

দুঃখরা মা'কে ছেড়ে কলতলা অব্দি যায়নি কোনওদিন ৷

 (দুঃখবতী মা- তসলিমা নাসরিন)

 

মা তোমাকে কখনো গান গাইতে শুনিনি। বড় হয়ে যাবার পর নিজের জগৎ খুঁজতে যখন তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে এলাম তখন আমার আকাশে ছোট্ট হতে হতে তুমি একটা 'বিন্দু' হয়ে গেলে। আজ যখন কান্না পায়, আজ যখন তোমার বয়সে পৌঁছেছি, আজ যখন আমাদের সন্তানের আকাশে আমরা সিন্ধু থেকে বিন্দুতে পরিণত হয়েছি , তখন তোমার কথা বড় মনে পড়ে , তোমাকে খুব লিখতে ইচ্ছে হয় মা ৷

 

" আমি ভীষণ ভালোবাসতাম আমার মা-কে
--- কখনও মুখ ফুটে বলিনি ”৷
(জননী জন্মভূমি: সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

 

ডঃ গৌতম সরকার
লেখক, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top