লৌকিকতা : সুতপা ধর চ্যাটার্জী
প্রকাশিত:
২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:০৮
আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:১৮
সাইকেলটা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে ঢুকতেই একটু ঘাবড়ে গেল চুমকি। মা এই অসময়ে মাথায় হাত দিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছে! কি ব্যাপার! বাবাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে চুমকি একটু অস্থির ভাবেই জিঙ্গেস করল- কি হয়েছে গো? বাবা কোথায়?
চন্দ্রাবতী ঘাড় ঘুড়িয়ে মেয়েকে দেখে। ঘেমে নেয়ে একসা। সপ্তাহের এই একটা দিন বুধবার গান শিখতে যায় প্রায় তিন কিলো মিটার সাইকেল চালিয়ে টাউন হলের পাশে। সেখান থেকে অতটা পথ সাইকেল চালিয়ে আসছে। আশ্বিনের রোদে ঝলসে আছে মুখটা। আশ্বিন মাস বলে রেহাই দেয় না দুপুর বারোটার সূর্য। সব শক্তি যেন বুক ফুলিয়ে দেখাতেই হবে ধরাধামকে। আজকাল তো আবার নগরায়নের রমরমা অত্যচারে গাছপালা সব রাস্তাঘাট থেকে উধাও। মাইলের পর মাইল হেঁটে যাও, গাছের ছায়াটি মিলবে না।
-পাখার হাওয়ায় একটু বোস, বলছি।
- বাবা কোথায়? চুমকি পাখার ঠিক তলাটায় দাঁড়িয়ে কামিজের গলার কাছটা ফাঁকা করে হাওয়া খায়।
-বড় কাকুর বাড়ি গেছে। চন্দ্রাবতী বিষণ্ণ স্বরে জবাব দেয়।
-এখন বড় কাকার বাড়ি? এই দুপুর রোদে? সকালেই তো কাকা এল! কি ব্যাপার?
-বলছি, একটু জিরো। সরবত খাবি?
-পাতি লেবু আছে? চুমকি বিছানায় বসে চুল গুলো গুছিয়ে হাত খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে জানতে চায়।
-না। নুন চিনি দিয়ে করে দিই?
-দাও। আর হেঁয়ালি না করে তাড়াতাড়ি বল কি ব্যাপার।
চন্দ্রাবতী রান্নাঘরে চামচ গ্লাসে টুংটাং আওয়াজ তুলে সরবত গোলে। চুমকি ফোন বার করে-মেসেজ লেখে বন্ধুকে।
চন্দ্রাবতী ঘরে এসে গ্লাসটা হাতে দেওয়া মাত্রই চুমকি চোঁচোঁ করে সরবতটুকু তৃষিত গলায় ঢেলে মুখ দিয়ে তৃপ্তি সূচক একটা শব্দ বের করে বলে- এবার বলো তো কি হয়েছে?
- তোর দিদিকে ফোন করেছিলাম।
- হ্যাঁ, তারপর?
- সে তো লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিল।
- মানে? পটলার জামার মাপ বলেনি?
- বলেছে। সেই সঙ্গে… চন্দ্রাবতী চুপ করে যায়।
অধৈর্য হয়ে চুমকি বলে- উফ! বলবে তো বাকিটা? আশ্চর্য! চিরকালের স্বভাব। অর্ধেক বলে থেমে যাবে।
-বলছি তো। এত অস্থির হোস কেন?
রুমকি বলল, ওর একটা জড়ির পাড় সাউথ সিল্ক শাড়ি চাই আর সৌগতর জন্য ভালো জামা প্যান্টের পিস।
চুমকি কথা হারিয়ে ফ্যালফেলিয়ে কয়েক মুহুর্ত চেয়ে থাকে মা-র দিকে। যেন অবিশ্বাস্য কিছু শুনেছে ওর কান। বিশ্বাস করার বা বোধগম্যের আগে তাই আর একবার যাচাই করে নেয় ঠিক শুনল কিনা -কি বললে? আবার বল?
-যা শুনেছিস তাই বললাম।
-দিদির কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা? গলা থেকে প্রশ্নটা তীক্ষ্ণ স্বরে বেরিয়ে আসে।
-ও জানে না আমাদের বাড়ির পরিস্থিতি? কোথেকে পাব আমরা? বাবার ওষুধ, তোমার ওষুধ, সংসার খরচ বোলপুরে আমার মেসের খরচ যোগাতে হিমসিম খাচ্ছি! দাদাটার তো ঐ ছিরি! এক দিলে পাঁচ নেয়। আজ চাকরি আছে তো কাল নেই। এই অবস্থায় ও এসব চাইল কি করে? ওর লজ্জা করল না? পাক্কা তিন লাখ খসেছে তোমাদের বড় মেয়ে পার করতে। তাতেও সাধ মেটেনি? অবশ্য ওরই বা দোষ কোথায়? শাশুড়ী আর বর ওঠাচ্ছে বসাচ্ছে আর ও-ও ওদের তালে বসছে উঠছে। উত্তেজিত হয়ে একটানা কথাগুলো বলে চুমকি সামান্য হাঁফায়।
চন্দ্রাবতী ছোট মেয়েকে সামলাতে চেষ্টা করে- আস্তে আস্তে। অতো চেঁচাস না। ওপরে বাড়িওয়ালারা শুনতে পাবে যে!
- শুনুক। কারোর কিছু জানতে বাকি নেই মা। বাবার এতবড় অসুখ গেল। একবারও দিদি বা সৌগতদা দেখতে এসেছে? একটা টাকা হাতে দিয়ে বলেছে-বাবাকে ওষুধটা বা ফলটা কিনে দিও? বলেছে? হ্যাঁ? কোনও বিবেক মানবিকতাবোধই নেই ওর। স্বার্থপর একটা! নিজেরটা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।
- তুই বড্ড ট্যারাবাঁকা কথা বলিস চুমকি। রুমকি এবাড়ির বড় মেয়ে। আবদার করে কিছু চাইতে পারে না ও?
- পারে, নিশ্চই-পারে। কিন্তু তার একটা পরিমিতিবোধ থাকা দরকার।আর তাছাড়া আমাদের এই সিচুয়েশানে অতো বড় পুজোর লিস্ট ধরিয়ে দেওয়াটা কোন যুক্তিতে মানব বলতে পারো? আমরা বাচ্চাটাকে দেব। সেটা আলাদা কথা। ও দু বছরের শিশু। তা বাবা কাকার কাছে কি করতে গেছে? টাকা চাইতে?
- টাকা চাইতে না, আলোচনা করতে।
-বলা যায়না। আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গেল…
- বড্ড চোপা তোর। থামিয়ে দিল চন্দ্রাবতী মেয়ের বাকি কথাটুকু।
- যা স্নান করতে যা। ভাত বাড়ব। আমার কপালটাই এমন। সারাজীবন শুধু দুশ্চিন্তা আর অভাব মেটাতেই সব শক্তি ক্ষয় করলাম।
চন্দ্রাবতীর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যার বিষণ্ণ ছায়ায় চুমকির মনটা ভার হয়ে গেল।খাট থেকে নেমে ধীর পায়ে মার কাছে এসে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল- ভেবো না। তোমার বড় মেয়ের শাড়ি হবে। দেখছি কি করা যায়।
চন্দ্রাবতী আশায় আলোয় চোখ ভরিয়ে ছোট মেয়েকে দেখল। সময়ে অসময়ে একটু আধটু মুখরা ঠিকই, তবে মনটায় বড় মায়া। সকলের জন্য ভাবে, করে। এটুকুই যেন চন্দ্রাবতীর দুপুর রোদে ছায়া পাওয়া।
দুইঃ
শরতের আকাশে পুজোর রঙ ঝরা দেখছে চুমকি ছাদের কোণায় কোণায় দাঁড়িয়ে। নীল আকাশের বুক ফুঁড়ে উঠে আসছে লালচে আভা। সকালে হঠাৎ না বলে কয়ে এক ঝাঁক বৃষ্টি এসে পড়েছিল। ছাদটা এখনো এই পরন্ত দুপুরে ভেজা ভেজা। এত সুন্দর আকাশ দেখছে চুমকি অথচ মনটায় একটা দুশ্চিন্তা ছায়ার মত লেপ্টে আছে সেই দুদিন ধরে।
দিদির শাড়ির টাকা, সৌগতদার জামাকাপড়ের টাকা কোত্থেকে জোগাড় হবে? চুমকি আজ কলেজে গিয়ে শুনে এসেছে ঐ শাড়ির দাম নাকি পনেরোশো থেকে শুরু। সবচেয়ে কমদামীটা কিনতে হলেও ওকে এই মুহুর্তে পনেরোশো টাকা হাতে আনতেই হবে। কাকাদের কাছ থেকে এই মুহুর্তে আর চাওয়া যায় না। ওর বিশ্বভারতীতে মিউজিক নিয়ে এম এ তে ভর্তি বাবদ অনেক টাকা কাকারা দিয়েছে। বাবার হাসপাতাল আর ওষুধের খরচও কাকাদের ঘাড়ে। এর পর আর কত? অভাব আর চাহিদার তাড়নায় চক্ষু লজ্জা বিবেক- এসব তো আর মেরে ফেলা যায়না?চুমকি ভেবে ভেবে কুল পাচ্ছে না টাকাটা আসবে কোত্থেকে।কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে আবার বাবা মায়ের সাথে একদফা বোঝাপড়া বচসা হয়ে গেছে। মা বাবা যে কেন মাঝে মাঝে এত অবুঝ হয়ে পড়ে চুমকি ভেবে পায়না। যাদের নেই তারা কেন এত লৌকিকতার ধার ধারবে? টাকা থাকলে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হয়, টাকা না থাকলে নিজের বাপের শ্রাদ্ধ করতে প্রাণান্ত হয়। মা বাবার ওই এক কথা-“দিদির শ্বশুরবাড়িতে কি ভাববে? পুজোর সময় বচ্ছরকার দিনে মেয়ে জামাইকে আশির্বাদ করব না এটা কেমন কথা? সামাজিকতা বলে তো কিছু আছে নাকি?” চুমকি বুঝিয়ে পারেনি- লোক লৌকিকতার চেয়েও বড় হোল আত্মসম্মান বোধ আর ওটাই জীবনে বেঁচে থাকার একটা গুরুত্বপূর্ণ রসদ। দিদির চাহিদা মেটাতে গেলে এখন মা বাবকে চেয়ে চিন্তে ধার করে টাকা জোগাড় করতে হবে আর সেটার মানে আত্ম সন্মান বোধে ঘা দেওয়া, তাও আবার এই তুচ্ছ কারণে। গত চার বছর তো দেওয়া হয়েছে। এবারের বাড়ির পরিস্থিতি আলাদা, বাবার কিডনির সমস্যা দেখা দেওয়ার পর থেকে তার চিকিৎসা করাতে ওরা প্রায় ফতুর। এই পরিস্থিতিতে সামাজিকতাটা না-ই বা করলাম আমরা? মা মানতে চায়নি। প্রথম দফায় তর্ক যুক্তি আর তারপর রাগ অভিমান করে বুঝিয়ে দিয়েছে মানা সম্ভব নয়।
ভাবতে ভাবতে বিকেল নামল রোজের মতো। চুমকির বড় প্রিয় সময় এই বিকেল বেলা। কতদিন বোলপুরে বা এখানে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখেছে চুমকি কেমন করে যাই যাই দুপুরের মরা আঁচে পিঠ সেঁকবে বলে ঝুপ করে বিকেল চলে আসে দুপুরের কাছাকাছি। সময়টা বড় মনোরম, বড় মায়াবী। ডানায় নরম আলো মেখে পাখিগুলো আকাশের এদিক ওদিক চষে বেড়ায় সেদিনের মতো আলোর কাছে নিজেদের ঠিকানা রাখবে বলে। কোন বাড়ির ছাদ থেকে শুকনো কাপড় তোলে কেউ, কেউ বা ছাদে পায়চারী করে আনমনে কিংবা মুঠো ফোন হাতে নিয়ে। এসবই খুব মন দিয়ে দেখে চুমকি। দেখতে ভালো লাগে ওর। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই বিকেলের আলোটাকে ঠিক উপভোগ করতে পারছে না। ছটফটে মন নিয়ে আকাশ দেখতে গিয়ে চলে আসছে জাগতিক সমস্যার বেপরোয়া ভাবনারা। কানের কাছ ঘেঁষে শিস দিতে দিতে উড়ে গেল এক ঝাঁক পাখি। আনমনে ওদের দিকে একবার তাকালো চুমকি।
হঠাৎ চোখে পড়ল ছাদের পাঁচিলে একটা বেশ বড় সড় বুলবুলি পাখি এসে বসে আপনমনে খুব তৎপরতায় নিজের শরীরের বিভিন্ন খাঁজে খাঁজে ঠোঁট ডুবিয়ে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। বিরাম নেই স্থিরতা নেই। চুমকি এক মনে পাখিটাকে দেখছিল। পাখিটা নিজের লেজের দিকে ঠোঁট ঢুকিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে একটা বড় পালক বের করে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর একটু এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যস্তবাগিশের মত উড়ে চলে গেল চোখের আড়ালে।
ভারী অদ্ভুত ঠেকল ঘটনাটা চুমকির কাছে। পাখিটা নিজের লেজের পালকটা অমন টেনে টেনে বের করে আনল কেন?সেটা কি নিজের অজান্তে নাকি শারীরিক প্রয়োজনে? ও কি ইচ্ছে করে করল নাকি সারা শরীর চুলকোতে গিয়ে ওটা আপনাআপনি বেরিয়ে এল? ও তো স্পষ্ট দেখল পাখিটা ঠোঁট দিয়ে পালকটাকে টানছিল? ওটা পড়ে যাবার পরই যেন পাখিটা নিশ্চিন্তে উড়ে গেল। চুমকি পালকটাকে হাতে তুলে নিল। কি সুন্দর মসৃণ চকচকে!যেন রঙ তুলি দিয়ে আঁকা। এটা পাখিটার সৌন্দর্যের প্রথম এবং প্রধাণ উপকরণ, পাখিটা কি সেটা জানে?
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল চুমকির। এমনটা আগে কখনো হয়নি। যেকোনো জিনিসের বা মুহূর্তের অস্তিত্ব কত স্বল্পস্থায়ী আমরা তা খেয়ালও করিনা। চারপাশে কত শত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বেনামী বা নামী ঘটনা ঘটে চলে। তাদের সময়সীমা সেকেন্ড থেকে মিনিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু কই এমন করে তো আগে কখনো চোখে পড়েনি যে এক সেকেন্ডে বা এক মিনিটে ভাঙা-গড়া, থাকা-না থাকার গূঢ় পরিণতিগুলো ঘটে যায় , ঘটে যেতে পারে!
চুমকির চোখে মুখে আলো ছায়া খেলে গেল। সারা ছাদে হেঁটে বেড়ানো সুন্দর বিকেলটাকে ছাদের কোণায় রেখে দিয়ে চুমকি নেমে গেল নীচে।
তিনঃ
-কি রে, এই বিকেলে তানপুরা নিয়ে বসলি? সন্ধে হলে তো রেওয়াজ করিস? আজ এতো তাড়াতাড়ি?
চন্দ্রাবতীর সামনে ঢাঁই করে রাখা শুকনো জামাকাপড়। রেডিওতে পুরনো দিনের গান বাজছে। জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করতে করতে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল চন্দ্রাবতী। চুমকি শব্দে উত্তর না দিয়ে হালকা হাসি ঠোঁটের কোণায় লাগিয়ে ইশারায় বোঝাল রেডিওটা বন্ধ করে দিতে। অনিচ্ছা স্বত্বেও উঠে গিয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিল চন্দ্রাবতী। চুমকি তানপুরার তারে হাত দিয়ে ঝংকার তুলতেই অনুভব করল ওর বুকের ভেতর হাহাকার আর কান্না শত সহস্র অগ্নি শিখার মত নেচে উঠল । গানের ভেতর ডুবতে ডুবতে সব কিছু ভুলতে চাইল চুমকি। সুরের মূর্ছনায় তানপুরায় চার তারের মেল বন্ধনের সাথে মিশতে মিশতে দ্রবীভূত হতে হতে চুমকি নিজেকে আবিষ্কার করল সম্পূর্ন অন্য ভাবে।আর্থিক অপারগতা আর দিদির শ্বশুরবাড়িতে মুখ রাখার অযৌক্তিক তাগিদের টানাপোড়েনে জর্জরিত মা বাবার মুখটা কেমন ম্যাজিকের মতো ধূসর ফ্যাকাসে থেকে ক্রমশ রঙিন উজ্জ্বল হয়ে গেল ওর কাল্পনিক চোখে। সমস্ত সংঘাত পেরিয়ে একরকম তৃপ্তির অমৃত স্বাদ হৃদয়ের গভীরতম স্থান থেকে মন্থন হতে হতে সমস্ত শরীর মনে যেন ছড়িয়ে পড়ল চুমকির। ওর মনে হল-এমন মুক্তি আর এমন আলোকময় উদ্ভাসিত জীবনের অমৃত স্বাদ এর আগে কখনো পায়নি।
সারা সন্ধ্যে গান ছেড়ে উঠতে পারল না চুমকি। টানা চার ঘণ্টা সঙ্গীতের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে অবশেষে গত দুদিনের প্রায় অতন্দ্র চোখের পাতা দুটো পরম শান্তিতে আশ্রয় নিল ঘুমের কোলে।
পরদিন সকালে কাউকে কিছু না বলে চুমকি ওর গানের ঘরটা খালি করে দিয়ে বেরিয়ে রিক্সায় সেকেন্ড হ্যান্ড তানপুরাটা রাখল যত্ন করে। গত তিন বছরের পরম বন্ধুর গায়ে হাত বোলাল মমতায় আর অহংকারে।
এ অহংকার যেন যে কোন কারোর বোধগম্যের বাইরের অনুভূতি। ছোঁবে না কেউ, দেখবে না কেউ, জানবে না কেউ।
‘জয় গুরু মিউজিক টিম্বার’ নামে বাদ্যযন্ত্রের দোকানটা সবে খুলেছে। মালিক শশাঙ্ক বণিক ধূপ জল দিচ্ছে লক্ষ্মী গণেশের পায়ে। চুমকিকে দেখে পুজো থামিয়ে বলল- আয়। একটু বোস ঐ চেয়ারটায়। পুজোটা সেরে নি।
শশাঙ্ক জ্যাঠার দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারটায় চুমকি তানপুরাটা কোলে নিয়ে বসল। কয়েক মুহুর্তের হাতের কাজ টুকু সেরে শশাঙ্ক চুমকির দিকে ফিরল-
কি রে? কি ব্যাপার? এটা সেই আমার কাছ থেকে কেনা তানপুরাটা না? সার্ভিস করাবি বুঝি? তা ঘাড়ে করে বয়ে আনতে গেলি কেন? আমাকে একটা খবর দিলেই তো হতো। আমি না হয় বাচ্চুটাকে পাঠিয়ে দিতুম।
না জ্যাঠা, সার্ভিসিং করাতে আসিনি। বলে কয়েক মুহূর্ত থামল। তারপর যাই যাই করেও রয়ে যাওয়া আবেগটুকু নিঃশব্দে গিলে নিয়ে বলল- বিক্রি করব তোমার কাছে।
কেন রে? আঁতকে উঠল শশাঙ্ক
- দিদির শ্বশুরবাড়িতে পুজোর জামাকাপড় পাঠাতে হবে। মায়ের হাত খালি । এদিকে না দিলেই নয়। অগত্যা…
শশাঙ্ক অসহায় গলায় বলল-
- সত্যিই বেচে দিবি? আর একটু ভাব।
- না শশাঙ্ক জ্যাঠা, ভেবে আর লাভ নেই। এই মুহুর্তে এটা ছাড়া গতি নেই গো।
শশাঙ্ক বণিক তার ষাটোর্ধ চোখের স্নেহ ভরা দৃষ্টি দিয়ে চুমকিকে দেখল। তারপর কাঠের বাক্স থেকে টাকা বের করতে করতে বলল- আমার দোকান থেকেই কিনেছিলি এটা, নরনারায়ণ পণ্ডিত বেচে দিয়েছিলেন আমার দোকানে। সেদিন তোর কত আনন্দ হয়েছিল, আমার আজও মনে আছে। আমি তোর কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়েছিলাম। দেখ কপালের ফের। এখন তুই এটা বেচে মাত্র আড়াই হাজার পাচ্ছিস। আমার যে উপায় নেই রে…। শশাঙ্ক বণিককে বিমর্ষ দেখাল। বর্ধমানে বাস স্ট্যান্ডের মুখেই বহু বছরের বাজনার যন্ত্রপাতি বিক্রির দোকান। বাবার মৃত্যুর পর পৈত্রিক দোকানের মালিকানায় আসার পর নয় নয় করে প্রায় বছর আঠাশ তিরিশ কাটিয়ে দিল। অভিজ্ঞতা কম হয়নি, সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি আর মূলধনকে নির্ভর করে আরও একবার বিচার করল চুমকির মতো মেয়ে পাওয়া মা বাবার ভাগ্যের ব্যাপার।
চুমকি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল- সব মনে আছে। নাও তো আর দেরী কোর না। এটা নিয়ে টাকাটা দাও।
-আবার হাতে কিছু জমলে আসিস মা। যত কমে পারি ভালো তানপুরা তোকে দেব।
-আসব শশাঙ্ক জ্যাঠা। আসতে আমাকে হবেই।
চুমকি টাকাটা পার্সে ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রওনা দিল ওদের দুটো ঘর আর এক চিলতে বারান্দা দিয়ে ঘেরা ভাড়া বাড়িটার দিকে।
রিক্সায় বসে চুমকি অনুভব করল একটা চাপা দুর্ভেদ্য উত্তেজনা। হাতটা খালি খালি লাগার কথা। কিন্তু কি, লাগছে না তো। হাত দুটো অপেক্ষায় আছে মা বাবার নিশ্চিন্ত শ্বাস আর হাসির ছোঁয়া পাবার আশায়। রাস্তায় সাইকেল রিক্সা গাড়ির হর্ণ ছাপিয়ে কানে বাজছে মাএর কথাটা- “না দিলে যে ওরা আমার মেয়েটাকে অপমান করবে”!!
সুতপা ধর চ্যাটার্জী
কোলকাতা, ভারত
বিষয়: সুতপা ধর চ্যাটার্জী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: