সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

দ্যা প্রফেট (সপ্তম অনুচ্ছেদ) : কাহলীল জীবরান 


প্রকাশিত:
৬ জানুয়ারী ২০২১ ২০:২৫

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৫৯

ছবিঃ কাহলীল জীবরান এবং অনুবাদক রোজীনা পারভীন বনানী 

 

মূল: কাহলীল জীবরান 
অনুবাদ: রোজীনা পারভীন বনানী 

 

ত্রয়োদশ 

 

একজন বাগ্মী বললেন, আমাদের স্বাধীনতা সম্বন্ধে বলুন।

তিনি উত্তর দিলেন:

আমি দেখেছি নগরতোরণ থেকে বাসগৃহ পর্যন্ত তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে অসহায় করে তোলো এবং নিজেদের স্বাধীনতাকে পূজা কর, যেমনভাবে ক্রীতদাসরা অত্যাচারী শাসকের সামনে নিজেদেরকে বিনয়ী করে তোলে এবং তার প্রশংসা করে যদিও সেই তাদের দাসত্বের জন্য দায়ী।

হ্যাঁ, মন্দিরের ভিতরের কুন্জ্ঞবনে এবং দূর্গের ছায়ায় আমি দেখেছি চরমতম স্বাধীনতাকে যা তোমরা পরিধান করেছ জোয়াল এবং হাতকড়ার মত এবং আমার হৃদয়ের ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়; একমাত্র তখনই তুমি মুক্তি পাবে শেষপর্যন্ত, যখন তোমর স্বাধীনতা খোঁজার আকুল আকাঙ্খা তোমার কাছে শৃংখল হয়ে দেখা দেবে এবং যখন একটা পরিপূর্ণতা ও লক্ষ্য হিসেবে স্বাধীনতার কথা বলা থেকে তুমি বিরত হবে।

 

তুমি কার্যতভাবে তখনই স্বাধীন হবে যখন তোমার দিন কাটবে উৎকন্ঠার সঙ্গে অথবা তোমার রাত কাটবে কোন একটা অভাব এবং মনস্তাপের সঙ্গে, কিন্তু তদসত্তেও এই সমস্ত জিনিষ যখন তোমার জীবনকে বেষ্টন করবে এবং তথাপি তুমি নগ্ন এবং বন্ধনহীন ভাবে এসব কিছুর উপরে উঠবে।

 

তুমি কিভাবে তোমার দিন এবং রাত্রির উর্ধ্বে উঠবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি সেই শৃঙ্খল ভাঙতে পারছ যা দিয়ে তুমি তোমার বোঝাপড়ার দুপুরবেলাকে আবেষ্টন করেছ ভোরবেলা?

এটাই সত্য যে যাকে তুমি স্বাধীনতা বল তা এই শৃংখলের ভিতর সবচেয়ে শক্তিশালী, যদিও এর জোড়া প্রখর সূর্যালোকে জ্বলজ্বল করে তোমার চোখ ধাঁধিয়ে দেবে এবং এটা কি তোমার নিজেরই একটা খন্ড নয় যা ফেলে দিয়ে তুমি মুক্ত হতে পার?

 

যদি এটা কোন অন্যায় আইন হয় যা তুমি বিলুপ্ত করতে চাও, সেই আইন তুমি তোমার নিজের হাতে তোমার ললাটে লিখেছ। তুমি তোমার আইনের বই পুড়িয়ে ফেলে একে মুছে ফেলতে পারবেনা অথবা তোমার বিচারের ললাটকে ধুয়ে ফেলে, যদিও তুমি সাগরের সমস্ত পানিকে এর উপর ঢালতে পার।

 

যদি এটা কোন স্বৈরাচারী শাসক হয় যাকে তুমি সিংহাসন চ্যুত করতে চাও, প্রথমে দেখ যে তোমার ভিতরে তার ঋজু সিংহাসন ধ্বংস হয়েছে কিনা। কিভাবে একটা অত্যাচারী শাসক মুক্ত এবং গর্বিত লোকদের শাসন করতে পারে, বরং তাদের নিজেদের স্বাধীনতার স্বেচ্ছাচারিতার জন্য এবং গর্বের লজ্জার জন্য তারা এরকম শাসিত হয়ে থাকে।

 

যদি এটা কোন উৎকন্ঠা হয় যাকে তুমি ছুঁড়ে ফেলতে চাও, সেই উৎকন্ঠা তোমার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি বরং তুমি নিজেই তা পছন্দ করেছ এবং যদি এটা কোন ভয় হয় যা তুমি দ্রবীভূত করতে চাও, এই ভয়ের আসন তোমার হৃদয়ে, যাকে ভয় পাচ্ছ সেই ব্যক্তির হাতে নয়।

 

প্রকৃতপক্ষে তোমার সত্তার ভিতর সমস্ত জিনিস স্হিরভাবে অর্ধেক আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় প্রবাহিত হয়, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং ভয়, বিরক্তিকর এবং সস্নেহ ব্যবহার অনুসৃত জিনিস এবং যা থেকে তুমি পালাতে চাও। এই সমস্ত জিনিস তোমার ভিতর আলো এবং ছায়ার মত জোড়া বেঁধে দৃঢভাবে আবদ্ধ।

যখন ছায়া হালকা হয়ে যায় এবং একেবারেই থাকে না, যে আলো দীর্ঘকাল ধরে আছে ক্রমে অন্য আলোর কাছে ছায়ায় পরিণত হয়।

 

এবং এইভাবে তোমার স্বাধীনতা যখন তার শিকল ছিঁড়ে ফেলে তখন তারচেয়ে বড় স্বাধীনতার কাছে নিজেই শিকলে পরিণত হয়।

 

 

চতুর্দশ 

 

একজন ধর্মজাজিকা পুনরায় বললেন: আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি এবং গভীর ভাবাবেগ সম্বন্ধে বলুন ।

 

তিনি উত্তর দিলেন, বললেন:

 

তোমার মন মাঝে মাঝে একটা যুদ্ধক্ষেত্র, যার ভিতরে তোমার স্বাভাবিক বিচার এবং বুদ্ধি, তোমার ভাবাবেগ এবং শারীরিক আকাঙ্ক্ষার সংগে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যদি আমি তোমাদের আত্মার শান্তির-সংস্হাপক হতে পারতাম, তবে তোমাদের আত্মার বিভিন্ন অংশের মতভেদ এবং প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে আমি একত্ব ও ঐক্যতানে পরিণত করতাম।

 

কিন্তু কিভাবে আমি তা পারব, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা নিজেদেরকে একজন শান্তি-সংস্হাপক করে তুলবে, অথবা তোমাদের প্রত্যেকটি অংশকে ভালবাসবে?

তোমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি এবং ভাবাবেগ তোমাদের সমুদ্রচারী আত্মার হাল এবং পালের মত।

যদি তোমার হাল অথবা পাল ভেঙে যায়, তুমি হয়তো আন্দোলিত হবে এবং এলোমেলো ভাসতে থাকবে, অথবা মধ্য সমুদ্রে স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

 

স্বাভাবিক বুদ্ধি একাকী নিয়ন্তার ভূমিকায় একটা সীমাবদ্ধ শক্তি, এবং গভীর ভাবাবেগ, অসাবধানী একটা শিখা যা নিজের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতায় নিজেই জ্বলে যায়। সুতরাং তোমার আত্মা যেন তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধিকে চূড়ান্ত শিখায় উঠতে দেয়, যাতে এটা একটা সংগীতের মত বেজে ওঠে; এবং তোমার আত্মা ভাবাবেগকে তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধির সংগে সন্মুখে পরিচালিত করবে যাতে তোমার ভাবাবেগ স্বকীয় দৈনন্দিন পুনরুত্থানের ভিতর বেঁচে থাকতে পারে, এবং ফিনিক্স পাখির মতো নিজের ভস্ম থেকে পুনরুত্থান করতে পারে ।

 

আমি চাই তুমি তোমার বিচারবুদ্ধি এবং দৈহিকক্ষুধাকে এরকম বিবেচনা কর যেমন দুইজন প্রিয় অতিথিকে তোমার গৃহে আপ্যায়িত করবার সময় করে থাকো।

 

প্রকৃতপক্ষেই তুমি তোমার একজন অতিথিকে অন্যজনের চেয়ে বেশি সম্মান দেখাবে না; কারন যদি কেউ একজনের প্রতি বেশী মনোযোগী হয় তাহলে সে উভয়েরই বিশ্বাস এবং ভালবাসা হারাবে ।

 

পাহাড়ের ভিতর, যখন তুমি সাদা পপলার গাছের ঠান্ডা ছায়ায় বসে থাক, দূরের শান্ত ক্ষেত এবং তৃণভূমির শান্তিকে নেওয়ার সময় তোমার হৃদয়ের নৈঃশব্দের ভিতর বল, “ইশ্বর স্বাভাবিক বুদ্ধির ভিতর বিশ্রাম নেন”।

 

এবং যখন ঝড় আসে, এবং শক্তিশালী বাতাস বনকে নাড়া দেয়, এবং চমকিত বিদ্যুৎ ও বজ্রপাত আকাশের কর্তৃত্ব প্রকাশ  করে,---তখন সশব্দ বিস্ময়ে তোমার হৃদয়ের ভিতর বল, “ইশ্বর ভাবাবেগের দ্বারা তাড়িত হন”।

 

এবং যেহেতু তুমি ইশ্বরের গোলকের একটি নিঃশ্বাস এবং ইশ্বরের বাগানের একটি পাতা, তাই তোমারও উচিত স্বাভাবিক বুদ্ধির ভিতর বিশ্রাম নেওয়া এবং ভাবাবেগের দ্বারা তাড়িত হওয়া”।।

 

পঞ্চদশ 

 

একজন স্ত্রীলোক বললেন, আমাদের কষ্ট সম্বন্ধে বলুন। এবং তিনি বললেন:

 

তোমাদের কষ্ট খোলস ভাঙার মত যা তোমাদের বোধশক্তিকে আবৃত করে রেখেছে। ঠিক যেমনিভাবে ফলের আঁটি ভাঙতেই হয় যাতে এর হৃদয় সূর্যলোকে আসতে পারে, তেমনিভাবে তোমাদেরকে অবশ্যই কষ্ট পেতে হয়।

এবং যদি তুমি তোমার হৃদয়কে তোমার জীবনের দৈনন্দিন অলৌকিক ঘটনার ভিতর বিচরণ করতে দাও, তোমার কষ্টকে তোমার আনন্দের চেয়ে কম ভবঘুরে দেখাবে না; তুমি তোমার হৃদয়ের ঋতুকে গ্রহণ করবে, ঠিক যেমনিভাবে তোমার ফসলের মাঠের উপর দিয়ে যে ঋতু চলে গেছে তুমি তাকেও গ্রহণ করেছ।

 

এবং তুমি শান্তভাবে লক্ষ্য করবে তোমার দুঃখের শীতঋতুকে; তোমার অধিকাংশ কষ্টই তোমার নিজস্ব পছন্দের।

 

তোমাদের কষ্ট একটা তরল তিক্ত ঔষধ সেবনের মত যা দিয়ে অন্তরের চিকিৎসক তোমাদের রুগ্ন সত্তাকে আরোগ্য করেন। সুতরাং চিকিৎসকে আস্হা রাখ এবং তার প্রতিষেধক ধীর ও শান্তভাবে পান কর:

 

যদিও তার হাত খুব ভারী এবং শক্ত, কিন্তু তাকে পরিচালনা করছে অদৃশ্য কোমল হাত এবং যে পেয়ালা সে বহন করে এনেছে, যদিও তা তোমার ঠোঁটকে পুড়িয়ে দেয়, কিন্তু কুম্ভকার একে কাদা দিয়ে তৈরী করেছে এবং তাঁর পবিত্র চোখের জল দিয়ে  ভিজিয়ে নরম করে নিয়েছে।

 

চলবে

 

রোজীনা পারভীন বনানী 
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top