মন চল নিজ নিকেতনে : শান্তনু কুমার


প্রকাশিত:
৭ জানুয়ারী ২০২১ ২১:০৯

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ০১:৫১

 

এটর্নি বিশ্বনাথ দত্তদের  তিন নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রীটের বাড়িটির ইতিমধ্যে হাতবদল হয়েছে। যে চুয়ান্ন ঘর এখানে সংসার পেতেছিল, ঠিকানা বদলে যারা এখন অন্য গৃহে-- তাদের কেউ যে এটর্নিদের সপ্ত কুলের এক কুল তাও সম্ভবপর নয় কারণ ইতিহাস বলে বিশ্বনাথের জীবিত পুত্রদের কেউই দারপরিগ্রহ করেননি। শোনা যায় আত্মঘাতী দুহিতা যোগীন্দ্রবালার কন্যাবংশসূত্রে কয়েক ঘর বাসিন্দার হয়ত ঠাঁই ছিল এখানে। বহুকাল যাবৎ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অসীম প্রচেষ্টায়, শত শত নিযুত দেশীবিদেশী মুদ্রার  উদার  বিনিয়োগ-দাক্ষিণ্যে, দক্ষ মজুর-মিস্ত্রিদের অমানুষিক শ্রম ও উন্নত প্রযুক্তিবলে সন্ন্যাসীর সেই প্রাচীন জরাজীর্ণ পৈতৃক বাড়িটির আদল বজায় রেখে সমাঙ্গ ভোলবদল সম্ভব হয়েছে। অনুপম স্থাপত্য মাধুর্যে  আর শ্বেত রক্তিম প্রসাধনী প্রলেপের উৎকর্ষে গৃহ, অলিন্দ, আসবাব আর তার নিত্য নিখুঁত পারিপাট্য যখন দৃষ্টির একটি নয়ন বিমোহিত করে তখন অপর নয়ন খুঁজে ফেরে সেই বিশ্বভ্রাম্যমাণ ক্লান্ত কল্যাণসাধককে---- সন্ন্যাসী হয়েও যে তাঁর জীবনটাকেই বাজি রেখেছিল এই দুর্ভাগা দেশবাসীর দুঃখ নিবারণে  আর পরম মমতাময়ী মাতা ভুবনেশ্বরী দাসীর দুর্দশা মোচনে।

 

 অসময়ে অন্তিমে বিশ্বনাথ---আর তার আগে থেকেই  তিন নম্বর বাড়িটির মালিকানা দখলের শরিকি মামলা শুরু। দত্তজায়া অপরূপা গুণবতী ভুবনেশ্বরী দাসী--, যিনি একের পর এক দশ পুত্র-কন্যার অধিকাংশকে অকালে হারিয়ে, শোক-মায়ার পরিভাষা ভুলে--পুত্র নরেন্দ্র, মহেন্দ্র আর ভূপেন্দ্রকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্নের তরী সাজাচ্ছেন---অকস্মাৎ জীবনসাথী-নিপাতে, প্রবল অর্থাভাবে এবং মামলা মোকদ্দমায় দিকহারা হয়ে তিনি অকূল দরিয়ায় এসে পড়লেন। ষষ্ঠসন্তান  এবং জীবিত জ্যেষ্ঠ পুত্র একুশ বর্ষীয় নরেন সেই তখন থেকেই আমৃত্যু তাঁর মাতৃকষ্ট নিরসনে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরই অনুরোধে খেতড়ির(রাজস্থান) রাজা, বিবেকানন্দের পরম বন্ধু, দাতা অজিত সিং দরাজ হস্তে ভুবনেশ্বরীর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত  সাহায্য করেছিলেন। আর ক্ষুধা-অবসন্ন, ক্লান্ত, অভাবী নরেন্দ্র মামলা নিষ্পত্তির নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন---- মঠ থেকে ঋণ নিয়ে বিবাদী খুড়ীমাকে সম্পত্তির ভাগ মিটিয়েও প্রবঞ্চিত হয়েছেন।

 

সন্ন্যাসী হয়েও তাঁর বিবেক দংশন কম ছিল না----'আমি এক অযোগ্য সন্তান, কোথায় যে মায়েদের ভাসিয়ে দিয়ে এলাম'-- তাই মায়ের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে বিবেকানন্দ  মাতৃঋণ শোধ করতে বদ্ধপরিকর  ছিলেন। মারা যাবার সাতদিন পূর্বে আইনি সাহায্যে লিখিত বোঝাপড়ার  মাধ্যমে এবং পুনরায় অর্থ প্রদানে শরিকি বিবাদ নিরসনে অসুস্থ বিবেকানন্দ সক্ষম হন। মারা যাবার পরেও মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য তিনি সন্ন্যাসীভ্রাতাদের কাছে বিনীত অনুরোধ রাখেন। ভুবনেশ্বরীর আমৃত্যু  দায়িত্ব তাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ সানন্দে পালন করেছিলেন।              

 

অরণ্য-গুহাবাসী সাধুসন্তদের এ ভূমি, একদা তাই প্রশ্ন এসেছিল ----এ কেমন সন্ন্যাসী তুমি গৃহমুখী হে, যে পরদুঃখে কাতর হও, নিকটজনের মৃত্যুতে ক্রন্দন কর?  সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ বলেন, আমার হৃদয় কি নিরেট, প্রস্তরনির্মিত ? আমিও তো মানুষ, আমারও তো ভাবাবেগ আছে !

 

গৃহী আর সন্ন্যাসীর দোলাচলতায় না থেকে জোড়াসাঁকোর আর এক মহামানবের পথ স্পষ্ট ছিল-- 'বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।' সংসারে মন কাড়লেও রবিঠাকুর যে মুক্তির গীত গেয়েছেন আজীবন--'নাথ হে, প্রেমপথে সব বাধা, ভাঙিয়া দাও--মাঝে কিছু রেখো না....নির্জনে সজনে অন্তরে বাহিরে----নিত্য তোমারে হেরিব'। অন্যদিকে, সন্ন্যাসী হয়েও বিবেকানন্দ গৃহী-যোগীর প্রশ্নের সমাধানও করেছেন অনায়াসে : যদি কোন গৃহী তার দেশ অথবা ধর্মের জন্য যুদ্ধ করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করে তাহলে যোগী ধ্যান ও সাধনার দ্বারা যে লক্ষ্যে পৌঁছায়, সেই গৃহীও সেই একই লক্ষ্যে পৌঁছায়। ঈশ্বর আরাধনার জন্য যে গৃহ ত্যাগ করে সে যেন এটা না ভাবে যে, যারা সংসারে আছে, সংসারের মঙ্গলের জন্য কাজ করছে, তারা ঈশ্বরের আরাধনা করছে না। আবার যারা স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য সংসারে জীবন যাপন করছে, তারাও যেন মনে না ভাবে যে, যারা সংসার ত্যাগ করেছে, তারা নিম্নস্তরের ভবঘুরে। আপন আপন ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই মহান। তাঁর এই সুচিন্তিত মন্তব্যের পক্ষে তিনি একটি কাহিনী শোনান :

 

কোনো এক রাজা রাজ্যে আগত সন্ন্যাসীদের জিজ্ঞেস করলেন, সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী আর সংসারবাসী গৃহীর মধ্যে কে বড়? উত্তর দিতে জ্ঞানীগণ দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ বলেন সন্ন্যাসীই বড়। রাজা প্রমাণ চাইলেন। তাঁরা পারলেন না। রাজা তাঁদের বিবাহ করে গৃহী হতে বললেন। আবার অন্যদল বলে গৃহীই বড়। রাজার আদেশমত এঁনারাও প্রমাণ করতে পারলেন না।  রাজা এঁদের সংসারে বাস করতে বাধ্য করলেন। এরপর এক যুবক সন্ন্যাসীর প্রবেশ। সে বলে, প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে বড়। রাজা বললেন প্রমাণ দাও। যুবক বললেন কয়েকদিন আমার মত জীবন যাপন করে আমার সঙ্গে চলুন। রাজা রাজি হলেন।  তাঁরা একটি বড় রাজ্যের রাজধানীতে উপস্থিত হলেন। সেখানকার জনগণ সেজেগুজে রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে। কি ব্যাপার ? না, ওই রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রাজকুমারীর এক স্বয়ংবরা উৎসব চলছিল। এটি ভারতের এক প্রাচীন প্রথা। রাজকন্যার ইচ্ছে সবচেয়ে সুপুরুষকে সে স্বামীরূপে গ্রহণ করবে। পিতার মৃত্যুর পর সেই হবে ওই রাজ্যের রাজা। রাজকন্যা  সিংহাসনে চেপে, বাহকেরা তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিল। উপস্থিত পুরুষদের দেখে রাজকন্যার মন ওঠে না। এমন সময় এক সুশ্রী যুবক সন্ন্যাসী সেখানে হাজির। রাজকন্যা তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গলায় মালা পরিয়ে দিল। যুবক বলল, আমি একজন সন্ন্যাসী, আমার আবার বিয়ে কি? সে দেশের রাজা বললেন, আমার কন্যাকে বিয়ে করলে এখনি অর্ধেক রাজত্ব, আর আমার মৃত্যুর পর তুমিই এ দেশের রাজা হবে। যুবকটি রাজি না হয়ে মালা ছুঁড়ে ফেলে প্রস্থান করল।

 

এদিকে রাজকন্যা সেই  সুশ্রী যুবকটিকে এরই মধ্যে ভালোবেসে ফেলেছিল এতটাই যে তাকে বিনা সে জীবনই রাখবে না।  রাজকন্যা যুবকটির পিছু পিছু চলল। পূর্বে কথিত আমাদের যে সন্ন্যাসী প্রমাণের জন্য রাজাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন সেও রাজাকে নিয়ে ওদের অনুসরণ করতে লাগলেন। যুবকটি বনের গহন পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।  রাজকন্যা তাকে খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে লাগল। তখন আমাদের রাজা ও সন্ন্যাসী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি কেঁদোনা, এখন অন্ধকার হয়ে গেছে, আলো ফুটলে তোমাকে আমরা পথ দেখাতে পারব। এস, এখন এই বড় গাছটার নিচে আমরা বিশ্রাম করি।

 এদিকে ওই গাছের উপরে একটা পাখি, তার স্ত্রী আর তিনটে ছানা বাস করত। পাখিটা নিচে অবস্থানরত তিনজনকে দেখে স্ত্রীকে বলল, দেখেছ আমাদের তিনজন অতিথি এসেছেন, শীতকাল, এখন একটা কিছু তো করতে হবে। সে তখন জ্বলন্ত একটা কাঠের টুকরো মুখে করে নিয়ে এসে নিচে ফেলে দিল। অতিথিরা সেই আগুনে শুকনো ডালপালা দিয়ে আরও বড় আগুন করে নিজেদের উষ্ণ করল।  পাখির মন খুশি নয়।  সে আবার বলল, ওরা অভুক্ত, ওদের কিছু খেতে দেওয়া গৃহীর কর্তব্য। এই বলে সে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে দেহ দান করল। অতিথিরা তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেও পারলনা। স্ত্রী-পাখিটি ভাবল তিনজন মানুষ ক্ষুধার্ত আর তাদের জন্য মাত্র একটা পাখি! যথেষ্ট নয় মোটেই। স্বামীর চেষ্টা বিফলে যাতে না যায় সেজন্য সেও ওই আগুনে ঝাঁপ দিল। বাচ্চা পাখি তিনটি এতক্ষণ ঘটনাগুলি দেখছিল। তারা ভাবল, তিনজনের পেট ভরার পক্ষে এ খাবারও যথেষ্ট নয়, সুতরাং তারাও পিতামাতার আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করতে সেই আগুনে পুড়ে মরল।

সেই তিনজন লোক বিস্ময়ে হতবাক। তাঁরা অবশ্য ওদের মাংস খেলেন না। সে রাত্রি সকলে অভুক্ত থেকে সকালে রাজকন্যাকে পথ দেখিয়ে তার পিতার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। 

 

এবার সন্ন্যাসী রাজাকে বললেন, আপনি নিজের চোখে দেখলেন প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে বড়। যদি সংসারে থাকতে চান, গৃহী হতে চান  তাহলে যে কোনো মুহূর্তে পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থেকে পাখিদের মত বাস করুন।  আর যদি সংসার ত্যাগ করতে চান, ত্যাগী হতে চান, তবে ওই যুবক সন্ন্যাসীর মত হোন যার কাছে সুন্দরী বা রাজ্য, রূপ বা অর্থ  কিছুই নয়। প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে মহান কিন্তু একজনের যা কর্তব্য অন্যজনের তা কর্তব্য নয়।

 

সংসার বা সন্ন্যাস---কর্তব্যের এক  নতুন সংজ্ঞায় জীবসেবার মধ্য দিয়েই মুক্তির দিশা দেখিয়েছিলেন গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ-দর্শনে দীক্ষিত স্বামী বিবেকানন্দ।

                  

  

তথ্য ও গ্রন্থঋণ :
বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র ১ম ও ২য় খন্ড : কামিনী প্রকাশালয়
অচেনা অজানা বিবেকানন্দ : শংকর
THE LIFE OF VIVEKANANDA : ROMAN ROLLAND
সংগীত সাধনায় বিবেকানন্দ ও সংগীত কল্পতরু : দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায়
PROFILE OF SOME EDUCATORS,SWAMI VIVEKANANDA : SWAMI PRABHANANDA
মহারাজ সাক্ষাৎকার : স্বামী বিবেকানন্দর পৈতৃক বাড়ি, রা.কৃ.মি.

 

শান্তনু কুমার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top