সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

পেঁজা মেঘ : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:০৪

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২৩

 

আজ পঞ্চমী হয়ে ছুটি পড়বে। সমস্ত কলেজ চত্বর জুড়ে শিউলি-শরৎ আকাশে সাদা-নীল মেঘের ভেলা । আজ আর কেউ রেজিস্ট্রার নিয়ে ক্লাসের দিকে পা বাড়াচ্ছে না। অঘোষিত ছুটির খবর উড়ে বেড়াচ্ছে সারাক্যাম্পাস জুড়ে, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হাতে গোনা, যারা এসেছে নতুন পোশাকে সেজেগুজে পঞ্চমীর দুপুরটাকে অমল গন্ধে ভরিয়ে তুলেছে। আমার কাছে তো পূজোর সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলি হলো, চতুর্থী, পঞ্চমী আর ষষ্ঠী । এই দিনগুলোতে পূজো আর কদিন বাকি হিসেব করতে বসিনা, কিন্তু সপ্তমী থেকেই হিসেব শুরু হয়ে যায়। আজ একটু পরেই শ্রীধারার নেতৃত্বে প্রাক-শারদীয় অনুষ্ঠান শুরু হবে। এই অনুষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী সবাই অংশগ্রহন করে। তবে একদম ঘরোয়া অনুষ্ঠান, কলেজের অডিটোরিয়ামে নয়, স্টাফরুমেই আমরা এটা করি। ফোনটা এলো অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক পনেরো মিনিট আগে।

কলেজ থেকে বেরিয়ে বহু কষ্টে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম তখন বাবাকে আই.সি.ইউতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। গ্রামের বাড়ি থেকে অ্যাম্বুলেন্সে আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় লেগেছে। এখনতো বাবা-মাকে বাড়িতে একাই থাকতে হয়। সকালে অফিস যাওয়ার পথে আমার জামাইবাবু রোজকার মতো ঢুঁ মারতে গিয়ে দেখে এই অবস্থা। আমার এক দিদি একদম পাশের পাড়ায় থাকে। সেই ভরসায় আমরা শহরে নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে নিশ্চিন্তে আছি। আমার বাবা এমনিতে সুস্থ সবল, পঁচাত্তর বছর বয়সেও টানটান শরীর। একসময় কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে গোলকিপিং করেছে; তার সাথে ছিল ডিফেন্স সার্ভিস ট্রেনিং। আমার জামাইবাবু সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্হা নিয়ে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় এই নার্সিং হোমে এনে ভর্তি করেছে। সবকিছু ব্যবস্থা করে আমাকে ফোন করেছে ; নাহলে ব্যাপারটা ঘটেছে সকাল নটায় আর আমি ফোনটা পেলাম দুপুর বারোটায়। দিদি- জামাইবাবু ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলেছে, প্রাথমিক পরীক্ষায় বোঝা গেছে এটা হার্ট অ্যাটাক, মাইনর না মেজর এক্ষুনি বোঝা যাচ্ছেনা, তাই প্রয়োজনীয় টেস্টের রেসাল্ট না জেনে, ‘নো কমেন্টস’। দিদি-জামাইবাবুর সাথে টাকাপয়সা আর মেডিক্লেমের কাগজপত্রের ব্যাপারে কথা বলে বুঝলাম, এই মুহূর্তে আমার জন্যে কোনও কাজ পড়ে নেই। ইতিমধ্যে অনেকেই খবর পেয়ে চলে এসেছে। বৈশালীর স্কুল একটু দূরে, আসতে একটু সময় লাগবে। হঠাৎ নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হলো, কদিন রাতে ঠিক ঘুম হচ্ছেনা, মাথাটা কেমন টলটল করছে , লাউঞ্জে এসে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসলাম।

পঞ্চমীর সন্ধ্যার শারদীয় উৎসব হাসপাতালের সামনের রাস্তার আলোর ঝর্ণা আর অগণিত মানুষের আনন্দ-উল্লাসে পিছলে পিছলে যাচ্ছে। সেই সব আনন্দের নিরন্তর পথচলা হাসপাতালের দীর্ঘ পাঁচিলটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে কিন্তু হিমঠান্ডা ওয়ার্ডগুলোর মোটা দেওয়াল ভেদ করে রোগশয্যায় শায়িত মানুষগুলোর কাছে পৌঁছচ্ছে না। পাঁচিল থেকে একশো গজ দূরে পাঁচতলার ওপরে শব্দহীন ছোট্ট এক আলোর কুটিরে আমার বাবা মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে বাঁচার আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক আর পাঁচটা বাবা-ছেলের মতো নয়, বরঞ্চ আমার অন্য ভাইবোনদের সাথে বাবার সম্পর্কটা ছিল অনেক বেশি সহজ সরল। বড় হয়ে বুঝেছি আমাদের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কটা ছিল অনেকটা সমীহের ; আমরা পরস্পরকে কোনোদিন অস্বীকার করিনি আবার সেভাবে কাছেও টানিনি। অন্য ভাইবোনেরা যখন বাবার গা ঘেঁষে শুয়ে-বসে গল্প করেছে বা গল্প শুনেছে , আমি তখন পাশ দিয়ে উদাস মুখ করে হেঁটে গেছি। বুকটা হয়তো একটু চিনচিন করেছে, কিন্তু আমিও কখনও আগ বাড়িয়ে কাছে যাইনি, আবার বাবাও কখনও আমাকে সেভাবে কাছে ডেকে নেয়নি। সকালে যারা এসেছিল সবাই একে একে ফিরে গেছে , এখন অন্ধকারে আমি বসে আছি একা। আসলে কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, একা থাকতে ভালো লাগছে। সকাল থেকে ওষুধ, রক্ত, অক্সিজেনের গন্ধে মাথাটা ধরে গেছে, বাইরের ঠান্ডা হাওয়াটা বেশ ভালো লাগছে। বৈশালী গেছে ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলতে, একই কথা বারবার শুনতে আর ভালো লাগছেনা।

অনেক বছর পর এবছর পূজো একেবারে বৃষ্টিবিহীন কাটছে। আজ অষ্টমী, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মাইকে শুনছিলাম অষ্টমীর পূজো চলছে। এখন সন্ধিপূজো শুরু হয়েছে। হঠাৎ কানে এলো অ্যানাউন্সমেন্ট ডেস্ক থেকে বাবার নাম করে বাড়ির লোককে দেখা করতে বলছে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো, একা এসেছি! কিছুটা টলমল করতে করতে রিসেপশনে কাউন্টারে গিয়ে জানলাম ওয়ার্ডে যেতে হবে। আরও ভয় লাগলো, লিফটে করে যেতে যেতে মনে হলো বৈশালী সঙ্গে থাকলে ভালো হত। দরজা ঠেলে ঢুকে ডাক্তারবাবুর সাথে মুখোমুখি দেখা। একটা কাগজ ধরিয়ে বললেন, ‘একটা ইনজেকশন লাগবে। আমাদের ফার্মাসিতে আউট অফ স্টক। আপনি একটু বাইরে থেকে এনে দিন’। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘বাবা !’ উনি হালকা হেঁসে শুধু মাথাটা নাড়ালেন।

রাত্রে জোর করে বৈশালী আমাকে নিয়ে বেরলো। অষ্টমীর রাত্রে মানুষের স্রোত ভেসে চলেছে নগরপথ ধরে। রঙিন আলোর ধারাস্রোতে স্নান সেরে চলেছে কল্লোলিনী শহর। আমার চোখে আলোর ঝালরগুলো খুলে খুলে পড়ছে। ঝলমল আলোর বৃত্ত ছোট হতে হতে হালকা আলোর স্বপ্ন রং ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। সেই আবছা আলোয় প্রতিভাত হল ভাঙাচোরা একটা দূর্গাদালান। পেট্রোম্যাক্সের একটা হ্যাজাক ঝুলছে দালানের কাঠামো থেকে, আরেকটা জ্বলছে অনেক নিচের প্রশস্ত আঙিনায়। দুটো আলোই আলোর চেয়ে বেশি অন্ধকার ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের ছোটদের তাতে কিন্তু কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা। হারিকেন, লম্ফ, লণ্ঠনে অভ্যস্ত আমাদের জীবনে ওই আলোই লক্ষ-কোটি দীপশিখার সমান হয়ে আলোকিত করে তুলছে চতুর্দিক। ওই গোধূলি আলোয় লুকোচুরি, কবাডি, গোল্লাছুট, এমনকি ক্রিকেট খেলাও বাদ থাকতোনা। হঠাৎ করে চোখ চলে গেল সেই মেঘ-অন্ধকার ভেদ করে সাদা জামা- সাদা প্যান্টে সজ্জিত দীর্ঘকায় একটা মানুষ দুহাতে ঢাউস দুটো ব্যাগ নিয়ে হাঁসি হাঁসি মুখে এগিয়ে আসছে । মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের সাদা- কালো পৃথিবী রঙিন হয়ে যেত। আমার বোন দৌড়ে গিয়ে বাবাকে তার ছোট ছোট দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতো, আমি কেমন লজ্জা পেয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিতাম। বৈশালীর বকুনিতে চেতনায় ফিরলাম। সাময়িকভাবে বাস্তবের সাথে সংযোগ হারিয়ে সিগনাল খোলা অবস্থায় রাস্তা পেরোতে যাচ্ছিলাম, সময়মতো ও হাতটা টেনে ধরেছে।

কাল সারারাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হয়েছে। কিছু ভাঙাচোরা স্বপ্ন, তার ওপর রাত চারটে থেকেই মাইকে বেহালার অকাল মূর্ছনা, সবকিছু মিলে সকালে যখন চোখ মেলে আকাশ দেখলাম তখন আটটা বেজে গেছে। বিছানায় শুয়েশুয়েই ঘাড়টা হেলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, নীল জমির বুকে সাদা মেঘগুলো এক্সপ্রেস গতিতে দৌড়ে চলেছে। এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছে! ঠিক যেন নগর সভ্যতার দৈনন্দিন কাহিনী….শুধু দৌড় দৌড় আর দৌড়! লক্ষ্যহীন, দিশাহীন, মাত্রাহীন ছুটে চলা। কখনো সখনো এক-আধ টুকরো মেঘ হয়তো দলচ্যুত হয়ে এক ফোঁটা জল হয়ে ঝরে পড়বে, তাতে বাকিদের চলা কিন্তু থামবেনা। সময় কথা শোক করার! বাবার কথা মনে পড়লো, আজ নবমী। একদম ছোটবেলার একটা কথা বাড়ির সবাই বলাবলি করে, আমার কিন্তু কিছু মনে পড়েনা। তখন আমার বয়স চার কি পাঁচ। নবমীর সকাল। মণ্ডপের পূজো শেষ, আরতি বাকি। নিয়ম অনুযায়ী , নবমীর সকালে দূর্গাদালান থেকে অনতিদূরে আমাদের কালীমন্দিরে ছাগবলি হতো। আমি সকাল থেকে দালানে আর পাঁচটা বাচ্ছার সাথে হুল্লোড়ে মেতে উঠেছিলাম। কিন্তু যে মুহূর্তে ঠাকুরমশাই আর ঢাকি কালীমন্দিরে বলির পূজো দিতে গেল আমি তাদের সাথে যাইনি। কিছুক্ষন পর আমার খোঁজ পড়তে কেউ আমায় খুঁজে পায়না। আমাদের পুরোনো বাড়িতে অনেক ভাঙাচোরা ঘর আছে, এমনিতে কেউ যায়না; সাপ-খোপ, ভাম-বেড়ালের আস্তানা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাবা আমায় সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে বের করে আনে। কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছিলাম। অনেককষ্টে বাবা আমার লুকিয়ে পড়ার আর কান্নার কারণ উদ্ধার করতে পেরেছিলো। পরের বছর থেকে আমাদের বাড়ির পূজোয় নবমীতে ছাগবলি উঠে গেলো।

বৈশালী চাইলেও সকালে এক একাই হাসপাতালে গেলাম। পূজো বলে হাসপাতাল চত্বর জুড়ে একটু গা ছাড়া ভাব। অধিকাংশ আউটডোর কাউন্টার বন্ধ। আমি লিফটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ওপরে উঠে সুইংডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকেই আমার পৃথিবী থরথর করে কেঁপে উঠল। ঘরে ঢুকেই ডানদিকে দুটো বেড পরে বাবার বেড। দেখি বাবার বেড শূন্য, সাদা চাদরটা টানটান করে নিভাঁজ পাতা। মাথাটা ঘুরে গেল, হাতের কাছে কিছু নেই যে সেটা ধরে নিজেকে সামলাবো। ওই অবস্থাতেই কাকে কি জিজ্ঞাসা করবো ভেবে পিছন ফিরতেই কারোর সঙ্গে একটা জোর ধাক্কা লাগলো। যার সঙ্গে ধাক্কা লাগলো তার মুখ থেকে কয়েকটি বিরক্তিসূচক শব্দাংশ বেরিয়ে এলো। তাকিয়ে দেখি ক্যান্টিনের একটি ছেলে ট্রলি করে খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। ধাক্কাটা কোনরকমে সামলে নিয়েছে, খাবার নষ্ট হয়নি। রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে আমার মুখ দেখে থেমে গেল, আমারও মুখটা চেনা লাগলো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও আপনি ,একশো তিনের পার্টি তো ! ওনাকে সকালে জেনারেল বেডে দেওয়া হয়েছে, আপনি দিদিদের সাথে কথা বলুন”। বলে সিস্টার ডেস্কের দিকে ঈশারা করে নিজের কাজে চলে গেল। কিছুক্ষণ সময় লাগলো শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে। নির্দিষ্ট ফ্লোরে গিয়ে দেখি, বাবাকে বেডে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখটা অনেক প্রাণবন্ত লাগছে, কেউ যত্ন করে দাড়িটা কামিয়ে দিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি এতটা উন্নতি কল্পনাতীত। শুধু ওষুধের চ্যানেলটি ছাড়া বাকি সব খুলে দেওয়া হয়েছে। একজন নার্স বেডের পাশে বসে ফলের রস খাওয়াচ্ছিল। আমি যেতে উঠে দাঁড়ালো। আমি ওনার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বললাম, “আমি খাইয়ে দিচ্ছি”। বাবা হাসি মুখে তাকিয়ে, গভীর দুচোখে আমার আনন্দকে মেপে নিতে চাইছে। আমি আস্তে আস্তে পুরো রসটা খাইয়ে দিলাম। বললাম, “বাঃ তুমি তো অনেক সেরে গেছ বাবা! দেখো এইভাবে চললে তোমাকে দুয়েকদিনের মধ্যে ছেড়ে দেবে”৷ বাবা ম্লান হাঁসলো। কিছু পরে দরজার বাইরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “খোকন, আজ পূজোর কোন দিন রে?” আমি বললাম, তারপর একটু মজা করে বললাম, “কেন মন খারাপ লাগছে?” “আমার জন্যে নয়, তোদের জন্যে। একটা গোটা পূজো হাসপাতালে হাসপাতালে কাটিয়ে দিলি! বাড়ির পূজোয় যেতে পারলিনা”। আমি বললাম, “আরে ছাড়ো, তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠো, সামনের বছর আবার সবাই আমরা একসাথে পূজো দেখবো”৷ বাবা তার শীর্ন হাতটা দিয়ে আমার হাতটা আঁকড়ে ধরলো। ভিসিটিং আওয়ার শেষ হয়ে আসছে; ওঠার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, “সকালে ডাক্তারবাবু কি বললেন?” একটু লাজুক হেসে বললো, “ আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কবে ছুটি দেবেন, তা উনি মজা করে বললেন, আপনি যেদিন যেতে চাইবেন সেদিনই ছুটি দিয়ে দেবো”। আমি, ‘আসি, বিকেলে আসবো’ বলে উঠে পড়লাম। বাবা তার দুর্বল হাত নেড়ে কাছে ডাকলো। আমি কাছে গিয়ে কানটা মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। খুব কুন্ঠিত স্বরে বললেন, “বিকেলে আর আসিস না বাবা। বৌমাকে নিয়ে একটা দিন অন্তত ঠাকুর দেখতে বেরোস”।

“কিন্তু তুমি যে একা থাকবে বাবা!”

“তাতে কি! তুই আজ আর আসিসনা না।“

“ঠিক আছে, দেখি”। বিছানাটা টানটান করে, জামার বোতামগুলো আটকে, চাদরটাকে গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

নবমী নিশি পুরালো; মায়ের বিদায় নেবার সময় এগিয়ে আসছে। বাতাসে এক করুন মূর্ছনা যেন কেঁদে কেঁদে ভেসে বেড়াচ্ছে, “যেতে নাহি দিব”! “তবু যেতে দিতে হয় হায়”—আমাদের বাড়ির পুজোয় আমরা বলি ‘সুতো কাটা’ হয়ে যাওয়া মানে পূজো শেষ। সপ্তমীর সকালে সমস্ত দেবদেবীকে এক সুতোর বাঁধন দেওয়া হয়, আর দশমীর সকালে সেই বাঁধন ছিঁড়ে মায়ের যাত্রাপথকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। বাড়ির পূজোর দালানে এখন দধিকর্মা বিলি হচ্ছে। মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, ঢাক-ঢোল-কাঁসর- ঘন্টার নহবত শেষবারের জন্যে দুর্গামণ্ডপকে মাতিয়ে তুলছে। বাড়ির ছেলে- বউ- মেয়েরা চোখবুজে হাতজোড় করে মাকে আবার সামনের বছর আসার জন্য আকুল মিনতি জানাচ্ছে। আর আজই প্রথমবারের জন্যে কলকাতার আকাশ বৃষ্টি ধারাস্নানে মায়ের ঘরে ফেরার পথকে পিচ্ছিল করে তুললো। এবারে দশমী পড়েছে বৃহস্পতিবার। আজ ছোটখাটো প্রতিমাগুলিই শুধু বিসর্জনে যাবে। আমাদের বাড়ির ঠাকুরের বিসর্জন আগামী কাল হবে। খুব আনন্দ হচ্ছে, বাবাকে কাল সকালে ছেড়ে দেবে। বাবা অন্তত বাড়ির প্রতিমার মুখটা দেখতে পাবে। আজ জোর করে বৈশালীকে ওর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। বাবাকে যখন ছেড়েই দেবে তাহলে আর চিন্তার কি আছে! ও সাধারণত পুজোটা আমাদের সাথে আমার গ্রামের বাড়িতেই কাটায়। এবার তো আর হলনা, একটা দুটো দিন অন্তত বাবা-মার সাথে পূজো কাটাক। আর আমিও কাল সকালে বাবাকে বাড়ি নিয়ে যাবো। আজ সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালের পাওনাগন্ডা প্রায় চুকিয়ে ফেলেছি, সইসাবুদ করে পেপারের কাজও অনেক এগোনো আছে, কাল চেষ্টা করবো কত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে পারি। আজ অনেকক্ষন বাবার কাছে ছিলাম। দশমীর সন্ধ্যায় হাসপাতাল চত্বর প্রায় শুনশান। আমি ছাড়া আর দুয়েকজন ভিজিটরস ছিল; ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে তারাও চলে গেল। আমি বসে রইলাম, আজ আর ভিজিটিং আওয়ার্সের পর কেউ চলে যাবার তাড়া দিলোনা। সিস্টাররা জানে বাবাকে কাল ছেড়ে দেওয়া হবে, তাই আমাকে কিছু বললেন না। আমি কিছুটা পর রাস্তা থেকে মাইকের , ঢাকের আওয়াজ পেলাম। ওয়ার্ড সংলগ্ন ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে এলাম একটা-দুটো ঠাকুর ভাসানে চলেছে। কি মনে হল, চার্জে থাকা সিস্টারের অনুমতি নিয়ে বাবাকে ধরে ধরে বারান্দায় এনে একটা চেয়ারে বসালাম। বাবা প্রথমে কিছু বোঝেনি, অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়েছিলো। আমি আঙুল দিয়ে রাস্তার দিকে দেখালাম, ঠিক তখনি রাস্তা দিয়ে একটা একচালার প্রতিমা ভাসানে যাচ্ছিল, মায়ের চকচকে মুখ মাথা সিঁদুরে মাখামাখি। বাবার মুখে একটা শিশুর আনন্দ খেলে গেল, উঁচু হয়ে মূর্তি, বাজনা, মানুষজন সবাইকে দেখার পরিতৃপ্তি সারা চোখে-মুখে। আমার দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে আমার দুহাত ধরে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো কয়েকটা ঠাকুর দেখে বলল, “এবার আমাকে নিয়ে চল”। দুহাতে জড়িয়ে ধরে ফিরতে ফিরতে কানে কানে বললাম, “ কাল তোমাকে বাড়ির ঠাকুর দেখাবো।“ মুখজোড়া হাঁসির মধ্যে লক্ষ্য করলাম মুখের একটা রেখাতেও অসুস্থতার কোনো ঠিকানা লেখা নেই।

সব বিজয়াদশমী মানেই বিসর্জন নয়, কোনো কোনো দশমী আবাহনের বাজনা বাজিয়ে মনের অন্তরায় বোধনের মন্ত্রোচ্চারণও করতে থাকে। এবারের পূজো শুরু হয়েছিল বুকের বাঁদিকে এক তীব্র ব্যথার মধ্যে দিয়ে আর শেষ হতে চলেছে একরাশ ভালোলাগার নতুন দিনের স্বপ্ন মেখে। আমাদের গাড়ি বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে, চারিদিকে ঝকঝকে রোদ; আকাশ গাঢ় নীল, চারদিক দেখে মনে হচ্ছে আজ পূজো শুরু। বাবা বাচ্ছা ছেলের ছটপটানি নিয়ে জানলা দিয়ে একবার এদিক দেখছে একবার ওদিক। কোনো দিকের কোনো আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে রাজি নয়; মনে হচ্ছে পাঁচ দিন বদ্ধ একচিলতে ঘরে থাকার সব আক্ষেপ দুচোখের আয়নায় ভুলতে চাইছে। আমাকে গাড়িতে উঠেই বলেছে, “ খোকন, ফাঁকা কোনো জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াস”। আমি বুঝতে পারি, চা-খাওয়াটা বড় কথা নয়, বাবা স্বাভাবিক জীবনের গন্ধটা নিঃশ্বাস ভরে নিতে চাইছে। আর এখন সেই ছোটবেলার মতো আমাকে পাশে বসিয়ে একের পর এক জায়গা, রাস্তা চেনাতে চেনাতে নিয়ে চলেছে। আমি চুপচাপ বসে বাবার শরীরের উত্তাপ পাচ্ছি, বহুদিন পর বাবার গায়ের গন্ধে আমার দুচোখ বুজে আসছে। আমি সত্যিসত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষন ঘুমিয়েছিলাম জানিনা। গত চার পাঁচ রাত সত্যিই তো ভালোভাবে ঘুমোতে পারিনি। আতঙ্কে বারবার ঘুম ভেঙে যেত, ঘুম ভেঙে মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখতাম ফোনে কোনো মিসড কল ঢুকলো কিনা। অনেকদিন পর পরম নিশ্চিন্তে বাবার কাঁধে মাথা রেখে নিবিড় আশ্রয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে উঠে বসতে গেলাম। বাবা দীর্ঘ দুহাত দিয়ে নিবিড় ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “ আরেকটু ঘুমো খোকা, এ কদিন তো একদম ঘুম হয়নি, ঘুমো ঘুমো”। আমি চোখ বন্ধ করে বাবার শরীরে তলিয়ে যেতে যেতে অনুভব করলাম অনেকদিন পর আমি আর বাবা একসাথে নিজেদের বাড়িতে ফিরছি।

 

ডঃ গৌতম সরকার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top