সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

অভয়ারণ্য : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:১৫

আপডেট:
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:০০

 

এক

দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বাস স্টপ থেকে, ফ্যাক্টরির দেয়াল ঘেঁষে যে রাস্তাটি মলরোড অভিমুখে গেছে, সেই রাস্তা বরাবর সোজা এগিয়ে গেলে মলরোড ত্রিকোণ পার্ক। পার্ক বলতে রেলিং দিয়ে ঘেরা এক চিলতে তিন কোণা জমিতে একটি বট গাছ। এই পার্কটিতে ধাক্কা খেয়ে রাস্তাটি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে, ডানদিকের রাস্তাটি চলে গেছে মলরোড বাজারের দিকে, আর বাঁদিকের রাস্তাটি আয়ুধ ফ্যাক্টরির পাঁচিলকে বাঁহাতে রেখে সেই পাঁচিল বরাবর এগিয়ে গেছে। রাস্তার ডান হাতে প্রথমে রত্নাগড় গার্লস হাই স্কুলের মাঠ এবং রত্নাগড় গার্লস স্কুল, তারপর ‘আনন্দলোক’ নামক একটি শান্ত জনবসতি পেরিয়ে আয়ুধ ফ্যাক্টরির কর্মী আবাসন, ‘আঠেরো নম্বর মলরোড এস্টেট’ এর গেট অবধি। যদিও এই রাস্তা আগ বাড়িয়ে গিয়ে মিশেছে কৈখালি ভিআইপি রোড মোড়ে, সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর, কারণ রঞ্জনা থাকে আঠেরো নম্বর মোল রোড এস্টেটের কর্মী আবাসনে। আর ত্রিকোণ পার্কে দ্বিখন্ডিত রাস্তার কেন্দ্রস্থলে রাস্তা পেরলে একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসের ডান দিকে অবস্থিত মলরোডের বিখ্যাত তিন চা বিক্রেতা ভাই অধর, মন্টু, অবন্তীর তিনটি চায়ের দোকান। যারা জনশ্রুতিতে অমর, আকবর, অ্যান্টনি নামেই পরিচিত। সেই তিন চায়ের দোকানের কোনও একটিতে কোনও এক বসন্তের ভোরবেলা আঠেরো নম্বরের গেটের দিকে মুখ করে বসে আছে ধ্রুবজ্যোতি। সময়টা গত শতাব্দীর আশির দশকের মধ্য ভাগ।বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ, দলের রক্ত পতাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আকাশে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জনা একসময় কর্মী আবাসনের গেট দিয়ে সেই অবিনশ্বর মায়াবী ভোরে লাল পাড় সাদা শাড়িতে রত্নাগড় গার্লস স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরোবে, মিনিট দুয়েকের রাস্তা পেরিয়ে সে রত্নাগড় মাঠে গিয়ে পড়বে, ধ্রুব চায়ের দোকান থেকে উঠে এসে কৃষ্ণচূড়ার গা ঘেঁসে দাঁড়াবে, আরও মিনিট খানেক দৃশ্যপটে রঞ্জনা ভেসে থাকবে, কারণ রঞ্জনারা কখনও হাঁটে না, তারা ভেসে বেড়ায়। এই চিত্রকল্প নিয়ে ধ্রুব ত্রিকোণ পার্কের কাছে মলরোড বাজারের রাস্তায় তার বাড়ি ফিরে যাবে, অসহ্য ঘন্টা পাঁচেক কাটিয়ে আবার এসে বসবে ত্রয়ী চায়ের দোকানের একটিতে, রঞ্জনার স্কুল ছুটি হবে এবং ধ্রুবর দৃষ্টিপথে মিনিট দুয়েকের পালকের মতো ভেসে থেকে সে অদৃশ্য হবে সেদিনের মতো। বস্তুত গত এক বছর শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা স্কুল ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে এভাবেই বসে থাকে ধ্রুব। আজও আছে তাই, কিন্তু আজ রঞ্জনা রত্নাগড় মাঠে না নেমে এগিয়ে এল অধরের চায়ের দোকানের দিকে, যেখানে বসে আছে ধ্রুব। ধ্রুবর মনে হল ওর বুকের মধ্যে কে হাতুড়ি পিটছে, রঞ্জনা যত কাছে এগিয়ে আসতে লাগল, হাতুড়ির আওয়াজ তত বাড়তে লাগল। দোকানের সামনে এসে রঞ্জনা কেকের বয়ামের দিকে দেখিয়ে অধরকে বললো, “একটা কেক দিন তো।” ধ্রুব দেখলো ওটা বাপুজী কেক, যেটা রঞ্জনা কোনওদিন খেতে পারে বলে ওর মনে হল না, এটা শ্রমিকশ্রেণী আর ওর মতো বেকারদের খাদ্য, যার পকেটে দুটাকা দামের প্লাস্টিকের চিরুনী আর মানিব্যাগে খুচরো পয়সা সম্বল। হঠাৎ ধ্রুবর মনে হল এক বছরের কঠোর তপস্যায় ফল হয়েছে, দেবি প্রসন্ন হয়েছেন এবং বরদান আসন্ন, নয়তো এ মেয়ে অধরের চায়ের দোকানে এসে বাপুজী কেক কেনে না। সেঁধিয়ে যাওয়া হাত পা পেটের মধ্যে থেকে বার করে ও বলে বসল, “অধরদা টাকা নিও না দামটা আমি দেব।”

 

দুই

রঞ্জনা কেকটা নিল, হালকা একটা হাসি উপহার দিল কি? ধ্রুব ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারল না, তবুও মনে হল হবে, তার মোক্ষ লাভ হবে। আয়ুধ ফ্যাক্টরির কর্মী আবাসনের ছেলে রাজীব ধ্রবজ্যোতির স্কুল জীবনের বন্ধু। সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া ধ্রুবর সঙ্গে এখনও যথেষ্ট সখ্যতা আছে। ধ্রুব বুঝল রাজীবই হচ্ছে ওর তুরুপের তাস, এতদিন সে আঠেরো নম্বরের কর্মী আবাসনের ভেতর খুব একটা যেত না, ভয় ছিল রঞ্জনা যদি ওকে দেখে বিরক্ত হয়ে ওর পাড়ার ছেলেদের কিছু বলে, তো অভ্যর্থনা কপালে খুব একটা ভালো জোটার কথা নয়। আজ মনে হচ্ছে সবুজ সিগন্যাল পাওয়া গেছে, রাজীবের সঙ্গে ঘন ঘন আড্ডা মারতে ওদের পাড়ায় যাওয়াই যায়। যা ভাবা তাই কাজে পরিণত করতে ধ্রুব সময় নিল না, আর আবিষ্কার করল বিকেলের দিকে কোয়ার্টারের প্রশস্ত রাস্তায় দু একজন বান্ধবীর সঙ্গে ঘুরতে বেরোয় রঞ্জনা। রঞ্জনা কিছু লজ্জাবতী লতা নয়, ধ্রুবর সঙ্গে ওর দু একটা কথাও হতে লাগল। আগে ধ্রুবর খালি সকালে ডিউটি ছিল, এখন সেটা দুবেলা হয়েছে। ইতিমধ্যে রঞ্জনা মাধ্যমিক পাশ করে মতিঝিল গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছে, ধ্রুব মাঝে মাঝে রঞ্জনার সঙ্গে বাসে করে কলেজ অবধি চলে যায়, দু-একদিন কলেজ কেটে ভিক্টোরিয়া থেকেও ঘুরে এল। এই পর্যন্ত বেশ ভালোই চলছিল, রঞ্জনা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ডিগ্রী কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর, একদিন ভিক্টোরিয়ায় বসে ধ্রুবকে জিজ্ঞাসা করলো এই সম্পর্কের পরিণতি কী? তুমি চাকরি বাকরির চেষ্টা করছ? একটা দুটো টিউশনি দিয়ে কী হবে? ধ্রুব চেষ্টা করছিল কিন্তু পাসকোর্সের গ্র্যাজুয়েটের জন্য কোথাও চাকরি নেই। ইঁট বালি সাপ্লাই এর ব্যবসায় বন্ধুরা কেউ কেউ দু’পয়সা করছে, ভাবছে নেমে পড়বে।

 

তিন

সেই সুযোগ ধ্রুব পেল না। একদিন বিকেলে দেখল রঞ্জনা নেই, ওর বন্ধু দোয়েল একাই কোয়ার্টারের রাস্তায় ঘুরছে। ধ্রুবর সঙ্গে ভালোই আলাপ হয়ে গেছে দোয়েলের, ওকে দেখে বলল হাওয়া ভালো নয়, রঞ্জনার কিন্তু বিয়ের কথা অনেকটাই এগিয়ে গেছে, পাত্র ওর বাবার সহকর্মীর ছেলে, রেলে অফিসার। সেই ছেলে আজ এসেছে রঞ্জনাদের কোয়ার্টারে, তাই ও বেরোয়নি। পরের দিন রবিবার থাকায় ধ্রুব সকালে রঞ্জনার নাগাল পেল না, দেখা হল বিকেলে। ধ্রুব কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই রঞ্জনা ওর বিয়ের কথা বার্তা চলার কথা বলল, ধ্রুব বলল, “আর আমি? তুমি যে গাছের নিচু ডাল ছেড়ে মগডালে বাসা বাঁধতে চাইছ, ভেবে দেখেছ যে উঁচু ডাল অনেক সময়ই হতে পারে ভঙ্গুর এবং বাসা বাঁধার জন্য দুর্বল, মূল থেকে যতই ওপরে ওঠে শাখা প্রশাখা, তার দূরত্ব মটির থেকে বেড়ে যেতে থাকে আর হাওয়া দিলে সবার আগে আন্দোলিত হতে থাকে মগডাল সংলগ্ন এলাকা।” রঞ্জনা বলল, “দেখো ধ্রুব, বাবা মা যদি আমার বিয়ের ঠিক করেন তো আমার কিছুই করার নেই, তুমি কিছুই করো না, আর আমার পক্ষে নভেল, সিনেমার মতো কিছু করে তোমাকে বিপদে ফেলা সম্ভব নয়, সেটা ভালোবাসা নয়। তুমি বরং থেকে যাবে আমার সেই দ্বীপভূমি যার সবুজ ঘাসে মাঝে মাঝে জিরিয়ে নেওয়া যায়, যে দ্বীপের গাছের ডালে বসে পাখির মতো গান গাওয়া যায়, যে ডাল মাটির কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও থেকে যায় শিকারি বিড়ালের আয়ত্তের বাইরে, সেই দ্বীপ আমার অভয়ারণ্য।” ধ্রুব কথা খুঁজে পায় না, একটা ভীষণ কষ্ট গলার মধ্যে দলা পাকাতে থাকে।

অঞ্জন দত্তের ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ গানটি তখনও কালের গর্ভে, তাই সব জেনে বুঝেও ধ্রুব বিকেলে রঞ্জনার পাড়ায় আসতেই লাগল। সকালে রঞ্জনা প্রায়ই কলেজ যায় না, কিন্তু বিকেলে মাঝে মাঝে তার দর্শন পাওয়া যায়। রঞ্জনা ধ্রুবকে বলেছিল তার অভয়ারণ্য দ্বীপভূমি হতে কিন্তু কে না জানে যেকোনো মোহনার বদ্বীপগুলির একদিক যেমন ভাঙ্গতে থাকে, তেমন অপর দিকে গড়ে ওঠে নতুন বন্দরের সম্ভাবনা, যেখানে থাকলেও থাকতে পারে কোনও নতুন নোঙরের গল্প। এখানেও তেমনটা ঘটল, রঞ্জনার বন্ধু দোয়েলের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা হতই ধ্রুবর, এখন বেশিরভাগ দিন রঞ্জনার অনুপস্থিতিতে কথাবার্তার পরিমাণ বাড়ল, হঠাৎ ধ্রুব একদিন অনুভব করল দোয়েল প্রতিদিন বিকেলে তারই প্রতীক্ষায় থাকে এবং এটা ঠিক দেখা হলে সৌজন্য বিনিময়ের থেকে অনেক বেশি কিছু। আর একজনও সেটা লক্ষ্য করল, সে রঞ্জনা। ওর কোয়ার্টারের জানলা দিয়ে লক্ষ্য করল, বারান্দা থেকে লক্ষ্য করল, কখনও দোয়েলের সঙ্গে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতেই ওর ছটফটানি টের পেল।

রঞ্জনা বাবা মাকে সাফ জানিয়ে ছিল ওদের ঠিক করা পাত্রকেই বিয়ে করবে তবে গ্র্যাজুয়েশনের পর, সেই অবধি অপেক্ষা করতেই হবে। ওর বাবা মাও এই নিয়ে বেশি আপত্তি করেননি, পাত্র শুভ্রনীল চেয়েছিল রঞ্জনা বিয়ের পর পরীক্ষাটা দিক। রঞ্জনা রাজি হয়নি তবে আজকাল ভাবছে রাজি হয়ে যাবে।

 

চার

ধ্রুব আজকাল সকাল বেলায় খুব ব্যস্ত থাকে, ও এখন পুরোপুরি ইঁট, বালি, পাথর সাপ্লাই এর ব্যবসায় নেমে গেছে। এখনও সকালে এসে চায়ের দোকানে বসে, তবে রঞ্জনার সঙ্গে সঙ্গে বালির গাড়ির প্রতীক্ষাও থাকে। রঞ্জনাকে মাঝে মাঝে দেখে কলেজে যেতে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাজে লেগে পড়ে। এক একদিন সামনা সামনি পড়লে একটু হাসি বিনিময়, কেমন আছো গোছের কথা হয় মাত্র।

সেদিন সকালে এসে ধ্রুব অধরের দোকানে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসল। মনটা খচখচ করছিল, গতকাল সন্ধ্যায় দোয়েলের জন্মদিনে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ধ্রুবকেও ডেকেছিল দোয়েল। রঞ্জনাও ছিল, দোয়েল যখন কেক কেটে সবার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে তখন ধ্রুবর কাছে এসে একটু বেশিই সময় নিল, ধ্রুবর কেন জানি মনে হল এক জোড়া চোখ তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করছে।

চায়ের কাপটা নামিয়ে সিগারেট ধরাতে গিয়ে ধ্রুব দেখল সে আঠেরো নম্বরের গেটের দিকে মুখ করেই বসে আছে, আর অবিনশ্বর মায়াবী ভোরের আলো মেখে গেটের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে রঞ্জনা। পরনে সেই লাল পাড় সাদা শাড়ি, হাতে ব্যাগ; কৃষ্ণচূড়া গাছটাও আজ অকৃপণ হস্তে আকাশ যেন রাঙিয়ে দিয়ে রঞ্জনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, এসো। ধ্রুবর সিগারেট ধরান হয় না, তার হাত কাঁপতে থাকে, খসে পড়ে সিগারেট। রঞ্জনা দোকানের সামনে এসে অধরকে বলে, একটা কেক দিনতো, ধ্রুব জানে রঞ্জনা কেকটা খাবে না, সে অধরকে পয়সা দিয়ে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ায়। রঞ্জনা হাতের ব্যাগটা ধ্রুবর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি, কেননা ভেবে দেখলাম আমার অভয়ারণ্যের গাছের ডালে আমি কোনও দোয়েল, শালিখ, চড়াইকেই বসতে দিতে পারি না, এ একান্তই আমার নির্জন দ্বীপভূমি। হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না,” বলে, রঞ্জনা ধ্রুবর হাত ধরে, সাক্ষী থাকেন অমর, আকবর, অ্যান্টনি এবং কৃষ্ণচূড়া। আমাদের আশা ওরা এই শহরের বুকে ওদের অভয়ারণ্য খুঁজে পাবে।

 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top