আদবের সাথে বেয়াদবী : রহমান তৌহিদ
প্রকাশিত:
৬ মার্চ ২০২১ ২০:৩৪
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ২২:২২

বাল্যকাল থেকেই আদবের সাথে চলতে আর বেয়াদবী পরিহার করতে উপদেশ শুনে বড় হয়েছে মফিজ। তারপর ডেল কার্ণেগীর লেখা অনূদিত বই “প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ” পড়ে মফিজের মাঝে আদবের ভাব আরো বেড়ে গেল। লেখাপড়ায় বরাবরই ভাল থাকায় ভাল ছাত্রের মার্কা পড়ে গেল। বেয়াদবী আর করা হল না। কিন্তু, কর্মজীবনে এসে মফিজ দেখলো, ভদ্রলোক বা আদব পালনকারী ব্যক্তিরা বড়ই অবহেলার শিকার। এমনকি তার মফিজ নামটা নিয়েও তারা উপহাস করতে ছাড়ল না। তখন থেকে মফিজ বেয়াদবী শুরু করলো। তবে, দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে সেটা হয়ে গেল আদবের সাথে বেয়াদবী।
আদবের সাথে বেয়াদবী করতে তাকে উদ্বুদ্ধ বাল্যকালে শোনা গল্পটি।
ওস্তাদ ও সাকরেদ শীতের ভোরে গ্রামের পথ দিতে হাটছে। ঘাসের উপরে ভেজা শিশির। তা মাড়িয়ে যেতে হলে পরনের লুঙ্গির নিচের অংশ ভিজে যায়।
ওস্তাদ বলে, সাগরেদ সামনে হাটো।
সাগরেদ : বেয়াদবি হবে, ওস্তাদ। আপনি আগে যান।
এবার নারকেল গাছে উঠে ডাব পেড়ে আনতে হবে।
ওস্তাদ বলে, গাছে ওঠো।
সাগরেদ : বেয়াদবি হয়ে যাবে ওস্তাদ। আপনি নিচে থাকবেন, আর আমার পা আপনার উপরে থাকবে। এটা হয় না।
ওস্তাদ গাছে উঠে ডাব পেড়ে আনলো।
এবার দা দিতে ডাব কাটার পালা
ওস্তাদ বলে, ডাব কাটো।
সাগরেদ বলে, ওস্তাদের সামনে দা হাত দেওয়া বেয়াদবি হবে।
ওস্তাদ ডাব কেটে সাগরেদকে বলে, এবার খাও।
সাগরেদ বলে, বেয়াদবির হতে হতে কয়েকবার বেচে গেছে। আর ঝুকি নেয়া ঠিক হবে না ওস্তাদ। দেন ডাব দেন।
বস আসে বস যায়, মফিজ থেকে যায়। মফিজ হল সেই গোল আলু যা সব তরকারিতে লাগে।
নতুন বস এসে রুমের ফার্ণিচারগুলো প্রথমে এদিক সেদিক করালো। বুঝিয়ে দিলেন , তিনি আগের জনের মতো মাটির মানুষ নন। একটু আগুনের হল্কা তার মাঝে আছে।
বস বললেন, মফিজ সাহেব, আপনার আগের বস কেমন মানুষ ছিলেন?
মফিজ বললো, তিনি মাটির মানুষ ছিলেন। খুবই ভদ্র। বিনয়ী। তার বিদায়ে কর্মচারিরা কেঁদেছে।
আপনার কি মনে হয়, আমার বিদায়ে কর্মচারিরা হাসবে।
মফিজ একটু সময় নিল। তারপর দার্শনিতের মতো বলল:
হাসি-কান্না উভয়ই নিতান্ত প্রাকৃতিক বিষয়। হাসি-কান্না ভেতর থেকে আসে। আজকাল অবশ্য সেটা লোক দেখানোও হচ্ছে। আপনি যেটা চান স্যার, তার ব্যবস্থা করা যাবে।
আপনি তো মজার মানুুষ মফিজ সাহেব। হাসি-কান্নার ব্যবস্থাও করতে পারেন।
এটা কোন ব্যাপার হল স্যার। অনেকে বলে, মানুষ খারাপ হয়ে গেছে। আসলে মানুষ আগেও খারাপ ছিল, এখনও আছে। আবার ভাল মানুষ আগেও ছিল, এখনও আছে। কান্না কাটির গল্প একটা বলি স্যার।
স্বাধীনতার আগের গল্প স্যার। মায়ের কাছে শুনেছি। মায়ের গ্রাম সম্পর্কিত এক মামা শহরে বড় চাকরি করে। মাঝে মধ্যে গ্রামে আছে। যখন আসে তখন হুলুস্থুল কান্ড। গ্রামের পাশের ছোট নদী, যেখানে নৌকাই প্রধান বাহন, সেখানে ঢুকে পড়ে লঞ্চ। তিনি লঞ্চ ভাড়া করে গ্রামে আসে। লঞ্চের শব্দে গ্রামের মানুষ জড়ো হয় নদীর ঘাটে। যাহোক , সেই নানার মা মারা গেছে। মোবাইল ফোনের যুগ না। একজন দ্রæতগামী নৌকায় গিয়ে খবর দিয়েছে। মৃত্যুখবরদানকারী নানার পরিবারসহ লঞ্চে করে গ্রামে ফিরছে। সেই মৃত্যুখবরদানকারীর মুখে পরবর্তীতে গ্রামবাসী জানল ঘটনা।
ঘটনাটা হল:
মা মারা গেছে। শোকের একটা আবহ তৈরি করা প্রয়োজন। অথচ দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটি করার মতো মানুষের বড়ই অভাব। নানার স্ত্রী অর্থাৎ নানী খন্দকার বংশের মেয়ে। শাশুড়ি মারা গেছে, কিন্তু তারজন্য তো দীর্ঘ ক্রন্দন তার শোভা পায় না। তখন তারই পরামর্শে লঞ্চঘাট থেকে কয়েকজন দুঃস্থ নারীকে তুলে নেওয়া হল। সময়ের স্বল্পতায় দরদাম ঠিক করা হল না, শুধু জানানো হল, মৃত মায়ের জন্য কাঁদতে হবে। লঞ্চের মানুষদের বেশভূষা ও আচরণে তারা দরদাম করতে সাহস পেল না। ধরেই নিল, উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া যাবে।
লঞ্চ চলছে। দুঃস্থ নারীরা তাদের অদেখা স্বজন বুবুর নাম ধরে বিলাপ করছে:
ওরে, বু রে বু, আমারে কিছু না বলে চলে গেলে রে বু।
অচেনা বুবুর জন্য কাহাতক কান্না করা যায়? আর এতে আন্তরিকতার অভাব সহজেই বোঝা যায়।
এক পর্যায়ে এক নারী বিলাপ করে, ওরে বু রে বু, কত টাকা দিবেনে লে বু?
বেয়াদবি নেবেন না, স্যার। গল্পটা আমি সেই বাল্যকালে শুনেছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম কোনটা আসল কান্না আর কোনটা টাকা দিয়ে কেনা। আফসোস, যারা টাকা দিয়ে হাসি-কান্না কিনতে চায়, তারা তা বোঝে না।
আদবের সাথে মফিজের বেয়াদবি বস কিভাবে নিয়েছিলেন, সে আলোচনা আপাতত থাক।
আদব আর বেয়াদবীর মধ্যে সীমারেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোটাদাগে যারা আদবের মধ্যে জীবনযাপন করেন, তারা বুঝবেন না এসব। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বেয়াদবি হয়ে যায়। নিতান্ত গোবেচারা,সাত চড়েও রা করে না, সেও প্রতিবাদ করে। এখন সমস্যা হচ্ছে, এই সাত চড়ে রা না করা ছেলেটার প্রতিবাদেও ভাষা বড় কড়া হয়ে যায়। তখন তার বেয়াদবিটা সকলে বড় করে দেখে। কেউ খতিয়ে দেখে না, কেন সে বেয়াদবি করলো। তাই, ছোটখাট বেয়াদবি স্বাভাবিকতার লক্ষণ বলে অনেকে মনে করেন। মানুষ হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে, একটু আধটু বেয়াদবি করবে।
কিছু মানুষ আদবের সাথে বেয়াদবি করে পৃথিবীর চোহারাটা পাল্টে দিয়েছে।
একটু লক্ষ্য করে দেখবেন, সমাজে প্রচলিত ধ্যান ধারনার বাইরে কথা বললেই আপনি বেয়াদব বলে গণ্য হবেন। অথচ বেয়াদবি না করলে আপনি নতুন কিছু সৃষ্টি করতেই পারছেন না। সব বেয়াদবিকে মানুষ সমর্থন করে না। অবশ্য মানুষের সমর্থন করার আশায় কেউ বেয়াদবি করেও না। শেষ বিচারটা আবার সেই মানুষের হাতেই। আর তার চেয়ে বড় বিচারক হল, মহাকাল। কালের বিচারে উত্তীর্ণ হতে হয় সবাইকে।
কে আদব আর কে বেয়াদব - সেটা নির্ধারণ করে মহাকাল।
তাই, বেয়াদবি যদি করতেই হয়, সেটাও আদবের সাথে করেন।
বেয়াদবি থেকে যদি ভাল কিছু হয়, তো বেয়াদবিই ভাল।
শেষ করি, সেই বাচ্চা মেয়ের গল্প দিয়ে, যা পড়ার পর আপনি সিদ্ধান্ত নিন, মেয়ে বেয়াদব কি না?
দুই কলিগ পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন। উভয়ে ভদ্রমহিলা। একজনের ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। আর একজনের ছোট ছোট তিনটি বাচ্চা। তো যার ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে, তিনি আবার একটু মাস্টারনী টইপের। বাচ্চাদের পড়াতে ভালবাসেন। তাই, কলিগকে বললেন, তিন বাচ্চা পড়াতে তুমি তো হিমশিম খাচ্ছ, একটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি পড়াই।
কয়েকদিন পড়ানোর পর বাচ্চা আর আন্টির কাছে যায় না।
মা জিজ্ঞেম করে, আন্টির কাছে যাবে না কেন? আন্টি কি মারে?
মেয়ের উত্তর, না মারবে কেন? মারে না, তবে, অতিরিক্ত জ্ঞান দেয়। আমাকে বলে, মায়ের মতো হতে হবে, আন্টির মতো হতে হবে। আর শুধু পড়ায় আর পড়ায়।
মা বলে, সে তো ভাল কথা। আন্টি তো ভাল কথাই বলেছে।
এবার মেয়ে বলে, তা তো বলবেই। তোমরা তো বলেই খালাস। আমি বাপু, যেতে পারবো না। গতকাল আন্টিকে বলে এসেছি, এতই যখন পড়ানোর শখ, নিজে বাচ্চা বানিয়ে পড়াও। অন্যের বাচ্চা পড়ানোর এত শখ কেন, বাপু।
রহমান তৌহিদ
লেক সার্কাস , কলাবাগান ঢাকা
বিষয়: রহমান তৌহিদ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: