লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট) : কাজী মাহমুদুর রহমান
প্রকাশিত:
৬ মার্চ ২০২১ ২১:৪৮
আপডেট:
৬ মার্চ ২০২১ ২২:৩৭

আমি হেসে আমার মাথায় আঙুল ছোঁয়ালাম। অর্থাৎ আমার মস্তিষ্ক প্রসূত।
মা মাথা নেড়ে বললেন, উহু। আরো কিছু আছে!
এবার আমি আমার আঙুল আমার বুকে ছোঁয়ালাম। অর্থাৎ আমার হৃদয় জানে।
মা’র এবার ভীষণ বিরক্ত কণ্ঠস্বর, তিমু দুষ্টুমি না করে বল, মেয়েটা কে?
আমি বললাম, মেয়েটা কে তা জানে ওমর আলী।
মা’র অবাক প্রশ্ন ওমর আলী! সে কে?
আমি বললাম সে একজন কবি যার বিখ্যাত কবিতা;
‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল হাসিমাখা
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।’
মা আমার আবৃত্তি শুনে মৃদু হাসলেন। বললেন, বুঝেছি তুই আমার চোখে ধুলো দিচ্ছিস। ঠিক আছে, যদি কখনো ঐ কবিতার মতো একটি মেয়ে খুঁজে পাই আমি সেই মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে আনব।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। সত্যি বলছ মা?
হ্যাঁ সত্যি। ছোটন, নাজু তোদের বলে রাখছি ঐ ছবির মতো মিষ্টি মেয়েটিকে কখনো কোথাও দেখতে পাস তাহলে-
মার কথা শেষ না হতেই ছোটন ফোড়ন কাটল, অবশ্যই তাকে কিডন্যাপ করে আনব।
আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিপুল আনন্দের স্রোত বয়ে গেল আমাদের বাড়িতে।
আমি মনে মনে বললাম, ভালো থেকো হে শ্যামশ্রী, রাজকন্যের মতো সাত মহলায় লুকিয়ে থেকো। আমার মতো রিকশা পেইন্টারের সঙ্গে তোমার যেন আর কখনো দেখা না হয়।
শ্যামশ্রীর ছবিটা যেদিন এঁকেছিলাম, যে ছবি দেখে জয়ী মা মুগ্ধ চোখে বলেছিলেন, যদি কখনো ঐ কবিতার মতো একটি মেয়ে খুঁজে পাই আমি সেই মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে আনব।
আর আমি মনে মনে বলেছিলাম, ভালো থেকো হে মেয়ে রূপকথার অধরা রাজকন্যার মতো কোনো অচেনা কোনো সাতমহলায় লুকিয়ে থেকো। আমার মতো সাধারণ একটা রিকশা পেইন্টারের সঙ্গে তোমার যেন আর কখনো দেখা না হয়।
তবু দেখা হয়ে গেল এক অভাবিত ঘটনায়।
ছোটনের শরীরের ক্রমাবনতি ঘটছে। জ্বরে ও কাহিল হয়ে পড়ছে। ইনজেকশন, ওষুধপত্র চলছে। কিন্তু তেমন একটা উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ছোটনের মানসিক শক্তি প্রবল। ও কাউকে ওর কষ্টের কথা বলে না। আমরা ওর চিকিৎসার ত্রুটি করছি না। আমাদের সমস্ত আয়-উপার্জন সাধ্যমতো ওর জন্যে ব্যয় করছি। শুভার্থীরা যখন যে যা বলছেন, সেই মতো অ্যালোপথির সঙ্গে হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, টোটকা, দোয়া-তাবিজ সবই করা হচ্ছে।
একদিন বাবা অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বললেন, লালবাগে তারাপ্রসন্ন বাবু নামে এক নামকরা বৈদ্য নাকি আছেন। লোকে বলে তিনি নাকি ধ্বন্নন্তরী কবিরাজ। ঐ বৈদ্যবাড়ির নাম আরোগ্য নিকেতন। তুই কি কাল সকালে ছোটনকে নিয়ে ওখানে যেতে পারবি? যদিও ধ্বন্নন্তরী কথাটায় আমার বিশ্বাস নেই। তবুও ছোটনের জন্যে শেষ চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।
লালবাগে তারাপ্রসন্ন বাবুর আরোগ্য নিকেতন কবিরাজ বাড়িএই কথাটা শুনেই আমার বুকের ভেতর ঘুমন্ত ঘোড়াটা হঠাৎ যেন চিঁ হিঁ শব্দে লাফিয়ে উঠল। হায় আল্লাহ গত সাত আটমাস ধরে যে নাম, যে কথা আমি ভুলতে চেষ্টা করেছি, ঐ লালবাগ এলাকায় কখনোই আমি যাইনিসেখানেই আমাকে যেতে হবে! ওখানে গেলে যদি শ্যামশ্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়?
হাজার হাজার মানুষ, হাজার রিকশার ভিড়ে দেখা না হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি তো কবিরাজ বাড়িতে যাব। ছোটনকে দেখিয়ে তার নিদান নিয়ে চলে আসব। কেইবা আমাদের দেখবে বা চিনবে?
সকালে ছোটন আর নাজুকে নিয়ে আমি আমার রিকশায় রওনা দিলাম। আমি চালক, ছোটন আর নাজু আরোহী। লালবাগের আমলিগোলার অনেক ভিড়-ভাট্টার মধ্যে পুষ্পরাজ সাহা রোডে সেই আরোগ্য নিকেতনকবিরাজ তারাপ্রসন্ন বৈদ্যের বাড়ি খুঁজে পেতে তেমন একটা কষ্ট হল না। একতলা পুরাতন বাড়ি, সামনে টিনের চালের বারান্দা। বাড়ির সম্মুখভাগে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে নানা রকম ঔষধী-গাছ গাছড়া ও ফুলের বাগান। টিনের বারান্দাটিতে বেশ কয়েকটা বেঞ্চ যেখানে রোগীরা অপেক্ষা করে। বাইরের একটা বড় ঘরে কবিরাজ মহাশয়ের চেম্বার।
তারাপ্রসন্ন বাবু বয়োবৃদ্ধ মানুষ। কবিরাজ হিসাবে তার নাম ডাক আছে। চেম্বারে দেয়ালের তাকে তাকে লেবেল মারা কবিরাজি ওষুধের বোতল সাজানো।
কবিরাজকে আমি ছোটনের সম্পর্কে সবকথাই খুলে বললাম। কবিরাজ চোখ বন্ধ করে ছোটনের হাতের নাড়ি স্পন্দন গুনে দেখলেন, চোখ, জিহ্বা সবকিছু দেখলেন। তারপর কেমন যেন একটা সম্মোহন করার ভঙ্গিতে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছোটনের দিকে। তারপর নিজেই চোখ বন্ধ করে কী একটা ভাবনায় ডুবে গেলেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে।
কবিরাজের সেই তাকিয়ে থাকা আর চিন্তামগ্ন ভাবে চক্ষু মুদে থাকা দেখে ছোটনেরও যেন একটা অস্বস্তি। হঠাৎ সে বলে উঠল, আমি তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের একটা বই পড়েছিলাম। বইটার নাম ছিল আরোগ্য নিকেতন। সেই আরোগ্য নিকেতনের যে কবিরাজ তিনি নাকি রোগীর হাতের নাড়ির স্পন্দন গুনেই বলে দিতে পারতেন রোগী বাঁচার কিংবা কবে তার মৃত্যুর সময়। দাদাবাবু, আপনি কি সেই কবিরাজ মহাশয়ের মতো বলে দিতে পারবেন আমি আর ক’দিন বেঁচে আছি?
কবিরাজ তার চোখ খুললেন। মৃদু হেসে বললেন, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় ছিলেন উপন্যাস লেখার মানুষ, কল্প-গল্প লেখার মানুষ। আর আমি তারাপ্রসন্ন বৈদ্য একজন সামান্য কবিরাজ। যদিও আমার বাড়ির নাম আরোগ্য নিকেতন তবুও আমি তারাশংকর বাবুর উপন্যাসের সেই ধ্বন্নন্তরী কবিরাজ না। মানুষের জন্ম-মৃত্যু সব ভগবানের ইচ্ছা। তবুও আমি সেই ভগবানের দেওয়া নানা গাছ-গাছড়া, শেকড়-বাকড় দিয়ে শাস্ত্রের বিধান মতো ওষুধ বানাই, চেষ্টা করি রোগীদের সুস্থ করে তুলতে। বাপু, আমি তোমার জন্যেও চেষ্টা করব তোমাকে সুস্থ করতে। তবে ভগবান যদি সহায় হন।
কথাগুলো বলে কবিরাজ মহাশয় ছোটনের হাতটা আবার টেনে নিলেন নিজের হাতের মুঠোয়। বললেন, বড় বেশি বিলম্বে তার কাছে আনা হয়েছে। প্রথমাবস্থাতেই তার কাছে আনা হলে অসুখের এতটা বাড়াবাড়ি হত না। কেমোটা দেওয়া আদৌ উচিত হয়নি। ওটা ভয়ংকর বিষ।
আমি বললাম, কিন্তু এই রোগে দুনিয়া জুড়ে তো এই কেমো থেরাপিই চলছে।
কবিরাজ বললেন, এটাই হল অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার আর তাদের গবেষণার চরম ব্যর্থতা। ওরা মনে করেন বিষে বিষক্ষয়। কিন্তু সব বিষে বিষ ক্ষয় হয় না। ঐ কেমো জীবনের মেয়াদ হয়তো ছ’মাস, এক বছর বাড়াতে পারে। কিন্তু যতদিন মেয়াদ বাড়ায় তার চাইতে বেশি বাড়ায় দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণা। দাদা ভাইরে, তোমরা কি শুনেছো অমুক ক্যানসার রোগীকে শুধু কেমো দিয়েই সারা জীবনের জন্যে ক্যানসার মুক্ত করা হয়েছে? পাবে না, একজনও খুঁজে পাবে না। হয়তো প্রথম পর্যায়ে দু’একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকে চার পাঁচ বছর। তারপর যা তা-ই। বিধির সেই বিধান, সেই নিয়তি।
কবিরাজ বাবুর কথা শুনে আমি হতাশ। ছোটনের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। নাজুর চোখ দুটো ছলছল।
কবিরাজ অভয়দানের ভঙ্গিতে বললেন, মানুষের যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। আমি তো কবিরাজ, রোগীকে হতাশার কথা বলি না। রোগীকে আশার কথা, বাঁচার কথা বলি। তাই আমার নিদান অনুযায়ী আর কেমো নয়। ছোটন বাবুর দেহ কেমোর বিষমুক্ত করতে হবে। তবে অ্যালোপ্যাথি অনুযায়ী শুধু রক্ত পরিশোধন চলতে পারে। অন্যকিছু নয়। আজ আমি কিছু ওষুধ দেব। ওটা নিয়ম করে খেতে হবে। আর সাতদিন পর ওকে আমি বিশেষ কিছু ওষুধ দেব ওটা আমাকে বিশেষ ব্যবস্থায় বানাতে হবে। সাতদিন পর ওকে সঙ্গে নিয়ে এসো। আমি ওর শারীরিক অবস্থা দেখে ঐ ওষুধটা দেব। তবে বিধিবিধান মেনে ওষুধ নিয়ম করে খেতে হবে। কোনো ভিড়ের মধ্যে, হাটে বাজারে, কোনো লোক সমাগমে যাওয়া চলবে না। এই ঢাকা শহরের বায়ূ দূষিত। মানুষের ভিড়ের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আরো দূষিত। তাই নিজের সাবধান নিজের কাছে। তবে ঘরবন্দি হয়েও থাকতে বলব না। সকাল-বিকেল খোলা মাঠে, পার্কে বেড়াতে যেতে পারো। ভগবান যদি দয়া করেন আমার আশা তুমি ছ’মাসের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করবে।
সাতদিন পর আসার নির্দেশসহ কবিরাজ কিছু জড়িবুটি আর বোতলের ওষুধ দিলেন। ফি নিলেন না। শুধু ওষুধের দাম রাখলেন পাঁচশো টাকা।
তারাপ্রসন্ন কবিরাজের আরোগ্য নিকেতন থেকে বের হতেই দেখি বাড়ির সামনে রাস্তার প্রান্তে রাখা আমার রিকশা ঘিরে কিছু কৌতূহলী মানুষ আর ছেলেদের ভিড়। তারা রিকশার পেছনের ছবিটা দেখছে। ছোটন আর নাজুসহ আমি রিকশার কাছে আসতেই মানুষের ভিড় থেকে কেউ একজন বলে উঠল, এই ছবিটাতো আমাগো শামু দি’র! এইটা কেমনে আঁকা হইল? কেউ বলল, দারুণ একখান ছবি হইছে। আর্ট করছে কেডায়? সিড়িঙ্গে মার্কা চেহারার ট্যারা চোখ একটা লোক রিকশার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে প্রশ্ন করল, এই রিকশা আপনার?
- হ্যাঁ। আমার উত্তর।
লোকটা বলল, ঐ যে পাশের লাল দোতলা বাড়িটা দেখছেন ওটা উকিল সোমনাথ বাবুর। উনি আপনাদের ডাকছেন।
- কেন?
- কারণ, উনি ডাকছেন।
- কিন্তু আমরা তো কোনো উকিলের কাছে আসিনি। এসেছি এই আরোগ্য নিকেতনে কবিরাজ মহাশয়ের কাছে। উকিলের কাছে যাবার আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।
লোকটি দাঁত বের করে হাসল। বলল, কিন্তু উনার প্রয়োজন আছে।
- প্রয়োজনটা কী?
- প্রয়োজন মানে, আপনার এই রিকশার পেছনে যে মেয়ের ছবি আঁকা হয়েছে সেই মেয়েটি সোমনাথ বাবুর মেয়ে। কেন তার মেয়ের ছবি বিনা অনুমতিতে একটা থার্ডকক্লাস প্রাইভেট রিকশার পেছনে আঁকা হল সে বিষয়ে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান।
আমার বেশ রাগ হল লোকটার কথায়। বললাম, আমার মন থেকে যদি কোনো মেয়ের ছবি আঁকি সেই ছবির মুখ যদি কারো মুখের সঙ্গে মিলে যায় সেটা কি অপরাধ?
লোকটি এবারও দাঁত বের করে হাসল। বলল, অপরাধ না নিরাপরাধ তা কোর্ট বিবেচনা করবে।
- তা আপনি কোর্টের কে?
- আজ্ঞে আমি সোমনাথ বাবুর ল’ অ্যাসিসটেন্ট অবিনাশ সাহা।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আপনার পরিচয় শুনে খুশি হলাম। কিন্তু আমার ছোট ভাই গুরুতর অসুস্থ। ওকে নিয়ে এক্ষুণি বাসায় ফিরতে হবে। সোমনাথ বাবুকে বলবেন, কোর্টেই তাঁর সাথে দেখা হবে।
অবিনাশ আমার রিকশার হ্যান্ডেল সজোরে চেপে গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়ের লোকজনের উদ্দেশ্যে বলল, দাদাসকল শুনুন, সোমনাথ বাবু এই মহল্লার একজন নামী দামি মানুষ। এই রিকশাওয়ালা তার রিকশার পেছনে একজন নামী মানুষের মেয়ের ছবি বিনা অনুমতিতে এঁকে তাদের মান-ইজ্জত নষ্ট করেছে। এটা মারাত্মক অপরাধ। সোমনাথ বাবু এ জন্যে এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করবেন। ধনে প্রাণে মারা পড়বার আগেই এই লোকটি যদি সোমনাথ বাবুর সঙ্গে দেখা না করেই পালাতে চায় তাহলে এই মহল্লাবাসীর আমরা কেউই এই রিকশার এক চাক্কাও আগাতে দেব না।
সবাই হৈ হৈ করে উঠল।
ছোটন বলল, বড়দা এখানে এই অবস্থায় ঝামেলা করে লাভ নেই। চল সোমনাথ বাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি। শুনি কী বলতে চান উনি।
আমি ছোটন আর নাজু ঐ সিড়িঙ্গে অবিনাশের পিছু পিছু পার্শ্ববর্তী দোতলা বাড়িটার সোমনাথ বাবুর চেম্বারে প্রবেশ করলাম। চেম্বারে দু’জন মক্কেল বসে। সোমনাথ বাবু তাদেরকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। সোমনাথ বাবু তার ভদ্রতাবশেও আমাদের বসতে বললেন না। রাগী রাগী চেহারায় আমাদের দিকে তাকালেন। হুংকার দিয়ে প্রশ্ন, কী করা হয়?
- জি, রিকশা চালাই।
- নিজের রিকশা না অন্যের রিকশা?
- নিজের রিকশা।
- ছবিটা কে এঁকেছে?
- আমি।
- তুমি! রিকশাওয়ালারা তাহলে ছবিও আঁকে?
- আঁকে। যাদের আঁকার মতো শিল্পী মন আছে।
সোমনাথ বাবুর ব্যঙ্গস্বর, বাহ্ বাহ্, বেশ বেশ। তা শিল্পী মহাশয়, আমার মেয়ের ঐ যে ছবিটা রিকশার পেছনে এঁকেছ তা কি তার অনুমতি নিয়ে এঁকেছ? সে কি জানে?
- না।
সোমনাথ বাবুর আবারও হুংকার, তাহলে কোন সাহসে তার অনুমতি ছাড়া এইসব ফালতু ছবি আঁকলে?
- আমার মনে যা আসে, আমার কল্পনায় যার চেহারা দেখা যায় তাকেই আঁকি। এটা শিল্পীর স্বাধীনতা।
সোমনাথ বাবু ব্যঙ্গস্বরে বললেন, স্বাধীনতা! যখন জেল হাজতে যাবে তখন স্বাধীনতা কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
আমারও এখন প্রচ- বিরক্তি এইসব ফালতু হুমকি ধমকিতে। আমারও ক্ষেপে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আমার দু’হাতে ছোটন আর নাজুর চাপ সংকেতআমি যেন ক্ষেপে না উঠি, শান্ত থাকি। তবুও আমি সোমনাথ বাবুর মতো গর্জন না করেই বললাম, হাড়ে হাড়ে টের পাবার আগেই জানতে চাই এটা কি থানা নাকি কোনো বটতলার উকিলের চেম্বার?
- হোয়াট? তু... তুমি আমাকে বটতলার উকিল বললে? তোমার এত বড় দুঃসাহস! অবিনাশ, এক্ষুণি লালবাগ থানায় যা। দারোগা বাবুকে আমার কথা বলবি। বলবি পুলিশ পাঠাতে, রিকশাসুদ্ধ এই বেয়াদব ছোকরাটাকে ধরে নিয়ে যেতে।
অবিনাশ মহা উৎসাহে তক্ষুণি আদেশ পালনে তৎপর। দ্রুত বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেও কী ভেবে যেন থমকে গেল। বলল, কাকা বাবু, শামুকে দিয়ে একটা এজাহারের খসড়া লিখতে হবে। যার ছবি মানে শামুকে দিয়েই মানহানির একটা জিডি করাতে হবে। তা না হলে...
সোমনাথ বাবু ধমকে উঠলেন, ডাক শামুকে।
অবিনাশ সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল অন্দর মহলে।
আমি তখন ছোটন আর নাজুর হাত ধরে। আমি বুঝতে পারছি ওরা এখন ভয় পেয়েছে। আমার হাতে ক্রমশ ওদের ভয়ের চাপ বাড়ছে। ওদের হাত ঘামছে আমার হাতের ভেতর।
একটু পরেই শ্যামশ্রী নামের সেই মেয়েটি প্রবেশ করল অবিনাশের সঙ্গে। আমাকে দেখেই ওর চোখ যেন কপালে। ছুটে এল আমার কাছে। কোনো সংকোচ ছাড়াই আমার হাত ধরে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠল,
- আরে আপনি! এতদিন পরে? বাবা, জানো ইনি আমার হঠাৎ একদিন পথের দেখা গান পাগলা, নাটুকে মানুষ। একটা রিকশাওয়ালার ভূমিকায় অভিনয় করে আমাকে কী বোকাটাই বানিয়েছিলেন। তারপর কত খুঁজেছি ওনাকে মনে মনে, পথে পথে। অথচ আজ এইখানে! বাবা, ওরা এখানে কেন? কী হয়েছে?
সোমনাথ বাবু গর্জন করে বললেন, ব্যাপার মানে মহাব্যাপার। তুই কি জানিস তাইমুর নামের এই রিকশাওয়ালাটা নিজেকে উত্তম কুমারের পোজে আর তোকে সুচিত্রার পোজে রিকশার পেছনে ছবি এঁকেছে। জানিস তুই?
শ্যামশ্রীর বিস্ময়! তাই নাকি? কই দেখিতো!
যা রিকশার পেছনে গিয়ে দ্যাখ। পাবলিক মাছির মতো ভিড় জমিয়েছে। আমার মান ইজ্জত যাবার আর বাকি নেই।
শ্যামশ্রী আর বাক্য ব্যয় না করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল রিকশার পেছনে ছবি দেখতে। অবিনাশও ছুটে গেল তার পিছু পিছু।
সোমনাথ বাবু চোখ সরু করে বললেন, ওহে ছোকরা, তুমি কি জানো আমার কন্যা এবং আমি যদি তোমাকে ক্রিমিনাল কেসে ফাঁসিয়ে দেই তাহলে বুঝতে পারবে এই বটতলার উকিল বটগাছের কত আগায় উঠতে পারে, তোমাকে কতদিন ধরে জেলের ঘানি টানাতে পারে। তোমাকে তো মিনিমাম তিন বছরের জেল, পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা...
আমি বাধা দিয়ে হেসে বললাম, আপনারা আইনের মানুষ। আপনারা কত কিছুই না পারেন। নির্দোষ নিরাপরাধ মানুষকে আইনের প্যাঁচ কষে ফাঁসি দিতে পারেন, আবার সন্ত্রাসীকে নিরাপরাধ প্রমাণ করে তাকে রমনা পার্কের ফুরফুরে হাওয়ায় হাওয়া খাওয়াতে পারেন। তবে গাছের বেশি আগায় উঠলে হাত ফসকে হুড়মুড় করে পড়েও যেতে পারেন।
সোমনাথ বাবু আরো ক্রুদ্ধ। গর্জে উঠে বললেন, ত্যাদোড় যুবক, তোমার ত্যাদড়ামি যদি আমি না ভাঙতে পারি আমার নাম সোমনাথ রায় নয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে চেম্বারে প্রবেশ করল শ্যামশ্রী। ও এখন ভীষণ উত্তেজনা আর আনন্দে মাতোয়ারা। বলল, বাবা আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না আমাকে না দেখেই আমার মতো একটা সাধারণ মেয়ের ছবি এতো সুন্দর করে কেউ আঁকতে পারে! কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত!
অবিনাশ মিনমিন করে বলল, কারো অনুমতি না নিয়ে এভাবে কারো ছবি আঁকা, ফটো তোলা ক্রিমিনাল অফেন্স। অ্যাকর্ডিং টু অ্যাক্ট ...
শ্যামশ্রী প্রচন্ড- ধমকে গর্জে উঠল,
- ইউ গো টু হেল উইথ ইয়োর অ্যাক্ট। ননসেন্স।যেমনি বটতলার উকিল তার তেমনি গাধা মুহুরি।
সোমনাথ বাবু হতভম্ব, মুখ ছাইবর্ণ। শেষে কিনা তার কন্যাও তাকে বটতলার উকিল বলল!
শ্যামশ্রী তার বাবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ না করেই সরোষে বলতেই থাকল,
- এই তাইমুর সাহেব কি বাবার ছবি এঁকেছেন যে তিনি মানহানির মামলা করবেন? তাইমুর কি তোমার মতো সিড়িঙ্গে শিংগি মাছের ছবি এঁকেছেন যে, তুমি মামলা করবে? মামলা করলে আমি করতে পারি। কিন্তু সে মামলা টিকবে না। করবও না। কারণ আ অ্যাম নট এ ডাফার লাইক ইউ। আই লাভ দিস পিকচার। যিনি আমার মতো একটা কালো মেয়ের ছবি এত সুন্দর করে এঁকে আমাকে গর্বিত করেছেন, আনন্দ দিয়েছেন তাকে আমার শত সহস্র প্রণাম।
বলে হাতজোড় করে আমাকে যেন প্রণামই করল, ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, বাবা আর এই সিড়িঙ্গেটার নির্বুদ্ধিতায় আপনাদের যে হয়রানি হল তার জন্যে আমি লজ্জিত, দুঃখিত।
টেবিলের ওপর থেকে কাগজ, কলম টেনে নিয়ে খসখস করে কি যেন লিখল। আমার হাতে দিয়ে বলল, উকিল, মুহুরি আর পাবলিককে বিশ্বাস করতে নেই। এই যে আমি লিখে দিলাম, রিকশার পেছনের এই যে ছবি তার সঙ্গে আমার চেহারার সাদৃশ্য থাকলেও তা প্রকৃত পক্ষে আমি নই। এই ছবিটি শিল্পীর কল্পনার, অসাধারণ সুন্দর। সুতরাং, এই ছবি নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি বা অপপ্রচারের সুযোগ নেই। শিল্পীর প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা। ইতি, শ্যামশ্রী রায়, পিতা, সোমনাথ রায়।
আমি কাগজটা পড়ে হাসলাম। ধন্যবাদ শ্যামশ্রী। এই সার্টিফিকেটের প্রয়োজন আমার নেই। আমি জানি সব প্রতিকূলতার মধ্যেও কীভাবে আমাদের লড়াই করে বাঁচতে হয়। যা হোক, এখন আমাদের যেতে দেবার অনুমতি দেওয়া হোক। আমার এই ছোট ভাই ছোটন খুবই অসুস্থ। কবিরাজ বাড়ি আরোগ্য নিকেতনে এসেছিলাম ওকে দেখাতে। তার পরে তো এই ঝামেলা। যাক চলি।
শ্যামশ্রী বাধা দিয়ে বলল, চলি বললেই যাওয়া হবে না। আমার ভাগ্য যে এই প্রথম আপনারা আমাদের বাসায় পা দিয়েছেন। চলুন পাশের ড্রইংরুমে একটুখানি বসবেন। আপনারা এই মুহূর্তে আমার অতিথি নারায়ণ।
ছোটনের ক্লান্ত মুখে এতক্ষণে একটু হাসি ফুটল। বলল, অতিথি নারায়ণ! আমরা তো মানে আমাদের বড়দা তো আসামী। তিন বছরের জেল, পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা ...
শ্যামশ্রী চোখে অগ্নিবর্ষণ করে বলল, কে বলেছে এই কথা? বাবা?
সোমনাথ বাবু চুপসে গেছেন তার মেয়ের কথাবার্তায়। আমতা আমতা করে বললেন, না। আমি মানে ... অবিনাশ এসে বলল বলে ...
শ্যামশ্রী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ঐ শিংগি মাছটা আজ আমাকে নিয়ে, এই শিল্পীকে নিয়ে পাড়াময় মহা কেলেঙ্কারি করেছে। বাবা আমি তোমাকে আবার বলছি, এই শিংগি মাছটাকে সময় থাকতে কলকাতায় চালান করে দাও। নইলে ওকে আমি বটিতে কুটে তোমাকে পথ্য হিসেবে খাওয়াব।
কথাগুলো বলে শ্যামশ্রী ছোটন আর নাজুর হাত ধরে চেম্বারের পার্শ্ববর্তী ড্রইংরুমে প্রায়ই টেনেই নিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হল ওদের পিছু পিছু।
চলবে
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
বিষয়: কাজী মাহমুদুর রহমান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: