সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

মাথিন ট্র্যাজেডি: আমাদের বিস্মৃতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা (পর্ব এক) - সিরাজুল ইসলাম জীবন


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২১ ২২:৩২

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০০:৩৩

 

 

১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল আটলান্টিকের গহ্বরে টাইটানিক জাহাজ ডুবে যায়। মর্মান্তিক ঐ দুর্ঘটনায় দেড় হাজারের অধিক যাত্রীর করুণ মৃত্যু ঘটে। টাইটানিক জাহাজের সেই বিয়োগাত্মক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র 'টাইটানিক'। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সময়ের কথা বলছি। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা টাইটানিকের চেয়েও ট্র্যাজিক। অবশ্য এ ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজনের। ব্যাপারটা একটু হাস্যকরই মনে হচ্ছে! মনে হবারই কথা। আমরা (বাঙালি জাতি) অনেক বিষয়কে খুব গভীরে অনুসন্ধান করি না। অন্ধের মতো মাটির স্তূপ মনে করে অনেক  মণি-মুক্তাও পায়ে মাড়িয়ে চলি। 

পৃথিবীতে নর-নারীর প্রেম সম্পর্কিত অনেক কালজয়ী ঘটনার কথা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। প্রণয়-ঘটিত অনেক কালজয়ী নাটক-উপন্যাস-সিনেমা ইত্যাদির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে সর্বনাশা প্রেমের জন্য বড় বড় যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনাও। সম্রাট শা-জাহান প্রেমের কীর্তি স্বরূপ নির্মাণ করেছেন পৃথিবীর বড় আশ্চর্য ‘তাজমহল'। তাজমহলের কীর্তি-গাথা পৃথিবীর দেশে দেশে আলোচিত।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত ‘শা-জাহান' কবিতায় এমন অমর কীর্তির বিশ্লেষণ  করেছেন এভাবে---

 

“শুধু থাক্

একবিন্দু নয়নের জল

কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল

এ তাজমহল"

“তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে

চিরমৌনজাল দিয়ে বেঁধে দিলে কঠিন বন্ধনে। 

জ্যোৎস্নারাতে নিভৃত মন্দিরে 

প্রেয়সীরে

 যে নামে ডাকিতে ধীরে ধীরে

 সেই কানে-কানে ডাকা রেখে গেলে এইখানে

অনন্তের কানে।"

.........................................

.........................................

"তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি 

এড়াইয়া কালের প্রহরী 

চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া...

‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!"

 

প্রেমের গৌরব-গাথা স্মরণ করে আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে পর্যন্ত পালন করি। যদিও প্রেমের মহিমার চেয়ে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই এই দিবসের ক্ষেত্রে অধিক কার্যকরী। আমরা জানি রোমিও-জুলিয়েটের কথা, ওথেলো-ডেসডিমোনার প্রেম-পরিণতি, জানি এন্টনিও-ক্লিওপেট্রার কথা, আরও কত কী? আমরা প্রাচ্যের সুদূর ইতিহাস খুঁজে জানতে পারি কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত' কাব্যের কান্তা-যক্ষের বিরহ-গাথা। কিন্তু বড়ই আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে আমরা জানি না একজন মাথিনের কথা---প্রেমের জন্য এক কুমারী নারীর আত্মবিসর্জনের মর্মন্তুদ করুণ কাহিনি। প্রায় অজানা এই বিষাদাত্মক ঘটনা আমার মতো একজন অখ্যাত লেখকের হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপট বা পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে হতে পারতো কোনো মহাকাব্য, হতে পারতো বিশ্ববিখ্যাত নাটক কিংবা সিনেমা। কিন্তু হয়নি। এই দায় আমরা এড়াতে পারি না। এখন পর্যন্ত মাথিনকে কেন্দ্র করে একমাত্র মৌলিক বই ধীরাজ ভট্টাচার্যের “যখন পুলিশ ছিলাম" লেখকের আত্মজীবনী---যা কলকাতা থেকে প্রকাশিত। এ-ছাড়া দুএকটি কবিতা ও প্রবন্ধ ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সৃষ্টি আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। আর রচিত হলেও এগুলির বিস্তার হয়তো খুবই সীমিত পরিসরে। বড় কোনো সৃজনশীল ক্যানভাসে মাথিনের রূপায়ণ এখনো হয়নি বললেই চলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে এই মাথিন? কী তাঁর পরিচয়, প্রণয় এবং পরিণতি? এই প্রশ্নের জবাবই আমরা এখন খুঁজতে চেষ্টা করবো। 

 কলকাতার উঠতি যুবক ধীরাজ ভট্টাচার্য। বাবা ললিতবাবু ছিলেন ভবানীপুর মৈত্রী ইনস্টিটিউশনের বাংলা-সংস্কৃতের শিক্ষক। শিক্ষকপুত্র ধীরাজ খুবই সুদর্শন এবং অ্যাডভ্যাঞ্চারপ্রিয়। কলেজে পড়া অবস্থায় চলচ্চিত্রে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করার নেশা পেয়ে বসে। হঠাৎ সে সুযোগ চলেও আসে। ম্যাডন কোম্পানিতে পরিচালক জ্যাতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বাংলা ছবি ‘সতীলক্ষ্মী'তে অভিনয় করার প্রস্তাব পান। তবে নায়ক নয় ভিলেনের চরিত্রে। ঠিকই ঐ ছবির বদমাস চরিত্রে বিনোদের ভূমিকায় অভিনয় করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণপুত্রের এহেন কর্মযজ্ঞ পিতা-মাতার দৃষ্টিতে ভালো ঠেকেনি। বাবা-মার একান্ত অনুগত ধীরাজ শেষ পর্যন্ত ছবির জগৎ থেকে ফিরে আসেন। বাবা ললিতবাবুর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ধীরাজকে পুলিশের চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। বৃটিশ আমলে পুলিশে চাকরি করা খুব সহজ ছিল না। “যখন পুলিশ ছিলাম" গ্রন্থে ধীরাজ পুলিশ-জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, “এখন আমি পুরোপুরি পুলিশ, আই.বি-তে (এই ডিপার্টমেণ্টের প্রধান কাজ হল যারা স্বদেশী করে তাদের উপর কড়া নজর রাখা) রীতিমতো watcher বা ডিটেকটিভ। রোজ সাড়ে দশটায় একবার আফিসে যাই (১৩নং লর্ড সিংহ রোড)। সেখানে ডিউটি কী এবং কোথায় সব জেনে বেরিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে সিনেমা মনের মধ্যে উঁকি দিলে রবার্ট ব্লেক ও রিভলবার দেখে হতাশ হয়ে যেতাম। মনের মধ্যে বেশ খানিকটা গর্বও অনুভব করতাম। আগেই বলেছি, ডিটেকটিভ উপন্যাসের আমি ছিলাম পোকা। ছেলেবেলায় বই পড়ে সম্ভব-'অসম্ভব কত কল্পনাই যে করেছি। আজ হাতে হাতে তার পরীক্ষা দেবার সুযোগ পেয়ে আনন্দ ও গর্বে কেমন দিশেহারা হয়ে গেলাম। ভাবলাম বাংলাদেশেও যে রবার্ট ব্লেকের চেয়ে বড় ডিটেকটিভ হতে পারে, ভগবান বোধহয় আমাকে দিয়েই তা প্রমাণ করবেন।" 

পরবর্তীতে ধীরাজের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছে। ভগবান তাঁকে দিয়ে জীবন-নাট্যের এক অসাধারণ ক্ল্যাসিক্যাল ড্রামা করিয়ে ছেড়েছেন। পুলিশের এ.এস.আই হিসেবে সারদা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ধীরাজ ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হন। এরপর অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে তাঁকে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। যথারীতি তিনি চট্টগ্রামে চলে আসেন। এরপর থেকেই তাঁর দ্বিতীয় জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ধীরাজের ভাষায় তখনকার চট্টগ্রামের বর্ণনা এরকম, “চট্টগ্রাম, স্টেশনের কাছেই পুলিশ ক্লাব। সেখানেই আস্তানা নিলাম। রাস্তায় বেরুতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এতো ছোট্ট অথচ এতো সুন্দর শহর আর বাংলাদেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। থানায় যাবো, অচেনা পথ। পুলিশ ক্লাব থেকেই একজন সঙ্গী জুটিয়ে নিলাম। লাল সুরকির আঁকাবাঁকা পথ, অজগর সাপের মতো নিচু থেকে প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। সেখানেই থানা ও পুলিশ কোতোয়ালি। থানার পাশ দিয়ে লাল পথ নামতে শুরু করেছে ঘড়ির স্প্রিং-এর মতো ঘুরে ঘুরে। সমতলে নেমে সে-রাস্তা  আবার অন্যধার দিয়ে এঁকে-বেঁকে উপরে উঠেছে। সমস্ত শহরের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হল টাইগার হিল। শহরের উত্তরে পাহাড়তলীর পথ। সেখান থেকে Bay of Bengal দেখা যায়। পুলিশ কোর্ট ফেয়ারি হিলের ওপর। ওখান থেকে বাঁয়ে প্রশস্ত কর্ণফুলি ও ডাইনে প্রশস্ততর তার মোহনা দেখা যায়। কোর্ট-এর নিচে সদর ঘাট, ডবল মুরিংস জেটি, পরে মহেশখালি--- তারপর বে অব বেঙ্গল--- শহর থেকে অন্ততঃ ১৫/২০ মাইল দূরে।"

কিছুদিনের মধ্যেই চট্টগ্রামে ধীরাজ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ধীরাজের অভিনয় ও সঙ্গীত চর্চার কথা আর গোপন থাকলো না। বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার ডাক পড়া নিয়মে পরিণত হলো। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘কে বিদেশী, মন উদাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে।' তখন বারবার এই গানটিই ধীরাজ ভট্টাচার্য কণ্ঠে তুলতো। চট্টগ্রামে তাঁর দিনগুলো স্বপ্নের মতোই কেটে যাচ্ছিল। সে-কালের পুলিশ বিভাগের চালচিত্র অঙ্কনে পুলিশ-ধীরাজ কোনা কার্পণ্য করেননি। তিনি বলেছেন “ধরুন কোতোয়ালিতে বসে গল্প করছেন। সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছে। বলে দিন ক'প্যাকট কি সিগারেট দরকার, নিমেষে এসে যাবে। পয়সা দেবার কথা চিন্তাও করবেন না। কোথাও যাবেন ট্যাক্সি দরকার। কনস্টেবলকে শুধু বলে দিন, তারপর ট্যাক্সি এলে সারা শহর তাতে ঘুরে বেড়ান। ভাড়া? কি সর্বনাশ! ভাড়া অফার করে আপনি কি ট্যাক্সিওয়ালাকে অপমান করতে চান? সিনেমায় যাবেন? কোতোয়ালিতে বারো মাসের পাশ পড়ে আছে, শুধু গিয়ে সিনেমা হলের মালিককে ধন্য করে আসুন। এই রকম কত আর বলবো।"

চট্টগ্রামে ধীরাজের দিনগুলো ভালোই কেটে যাছিল। পুলিশ-ধীরাজের চেয়ে শিল্পী-ধীরাজের আকর্ষণই সবাইকে আকৃষ্ট করেছে বেশি। এমনিতেই তাঁর মনটা ছিল ভীষণ রোমান্টিক; কোতোয়ালি থানায় আগুন্তক এক নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় যেমন, “অপরূপ সুন্দরী মেয়ে, বড় টানাটানা চোখ, নাক-মুখ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ, অযত্নে  কিছু মলিন দেখালেও সে যে সুন্দরী বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না। বয়েস সতেরো-আঠারো। নিটোল সুন্দর দেহ। অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। চমক ভাঙলো হেমদার কথায়---কি হে, তোমার সিনেমার হিরোয়িন করে নেবে নাকি?"

এরপর লিখলেন, “কোতোয়ালি থেকে পুলিশ ক্লাবে ফিরে এলাম। সে রাত্রে অনেকক্ষণ অবধি ঘুমোতে পারলাম না। সুন্দরী ঐ কৃষক বধূটির জন্যেই কি? হবেও বা!"

 ধীরাজের এই সৌন্দর্যস্পৃহা ও সৌন্দর্যানুভূতিই তাঁর জীবনকে করেছে চরম নাটকীয়। ধীরাজ প্রকৃতিগতভাবেই সুন্দর এবং বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী। পুলিশের সামন্য একজন এ.এস.আই কী করে পুরো চট্টগ্রামকে মাত করলো সেটা অবশ্যই বিস্ময়কর। আরো অনেক বিস্ময়ই ধীরাজবাবু দেখিয়েছেন। এদিকে চট্টগ্রামের এস.পি মিঃ মরিস বদলি হয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় এসেছেন নতুন এস.পি মিঃ মুলান্ড। ইতঃমধ্যে মিঃ মুলান্ড ধীরাজের স্মার্টনেস টের পেয়ে গেছেন। আরো বেশি করে টের পেয়েছেন মিঃ মুলান্ডের অপরূপ সুন্দরী স্ত্রী নীল নয়না মিসেস মুলান্ডও। সত্যিই মিসেস মুলান্ডের সঙ্গে ধীরাজের প্রেম-প্রণয় চরমে ওঠলো। মিসেস মুলান্ড-ধীরাজের সম্পর্ক ধীরাজের বর্ণনাতেই বেরিয়ে এসেছে এভাবে, “মিসেস মুলাণ্ড অসামান্য সুন্দরী। বয়েস কুড়ি-বাইশ বলেই মনে হয়। কাছে যেতে হাত বাড়িয়ে আমার করমর্দন করলেন। তারপর হেসে বললেন---I never expected such a brilliant talent in the police force.

ধন্য হয়ে গেলাম। হেসে মেমসাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে দেখি হাঁড়িমুখো মুলাণ্ড কোঠরে ঢোকা নীল চোখ দুটো দিয়ে আমাকে যেন গিলতে চাইছে। 

দু'দিন পরের কথা। সিনেমা দেখে ফিরছি; পথে কোনো ট্যাক্সি পেলাম না। অগত্যা হেঁটেই কোতোয়ালিতে যাবো ঠিক করলাম। উঁচু-নিচু লাল সুরকির পথ, ঘুরে ঘুরে নামছি, বেশ লাগছিলো। হঠাৎ একবার পিছনে শুনলাম মোটর গাড়ির হর্ন। চমকে পাশে সরে গিয়েই দেখি স্টিয়ারিং-এ বসে আছেন মিসেস মুলাণ্ড।  সিগারেটটা ঠোঁটে মৃদুমধুর হেসে নিজেই দরজা খুলে দিয়ে বললেন---গট ইন। 

উঠে পাশে বসলাম। এবার আমার বিস্ময়কে চরমে পৌঁছে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন---কোথায় যাবেন? কোতোয়ালিতে? চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি, আমি ওদিক দিয়েই যাবো।

আমি নির্বাক। ভাবছি এখনো কি সিনেমা দেখছি, না সত্যিই সুন্দরী মিসেস মুলাণ্ডের পাশে বসে আছি। পথ অল্প, কোতোয়ালিতে পৌঁছে গেলাম। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে মিসেস মুলাণ্ড সিটের পাশ থেকে সিগারেটের কেসটা বার করে নিজে একটা ধরিয়ে কেসটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি তো অবাক। আমার হতভম্ব ভাব দেখে মিসেস মুলাণ্ড তো হেসেই খুন। তারপর বললেন---Don't you smoke? 

আর আপত্তি চলে না। কেসটা হাতে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম তারপর ভাবলাম---কি বলি, একটা কিছু বলা তো দরকার, একটু ইতঃস্তত করে বললাম---It's a nice case.

মেমসাহেব খিলখিল করে হেসে উঠলো, তারপর হাসতে হাসতে বললে---Keep it, every time you light a cigarette you will think of me. Yes? 

আবার সেই দুষ্টমিভরা হাসি। মনে মনে ভাবলাম, তোমায় আমি জীবনেও ভুলবো না মেমসাহেব। মুখে শুধু বললাম---Thanks. তারপর নিজেই দরজা খুলে নেমে পড়লাম। কোতোয়ালিতে ঢুকে দেখলাম বারান্দার থামের আশে-পাশে বিস্ফারিত চোখে হেমদা এবং আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ্য করছে। আমি যেন আজ উপকথার রাজপুত্রের মতো। হঠাৎ ঘুমন্ত রাজকন্যার রাজ্যে উপস্থিত হয়েছি। মনে মনে যে বেশ একটু গর্ব অনুভব করছিলাম, এটা অস্বীকার করতে পারবো না। 

একসঙ্গে অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে উঠলাম---কোথায় দেখা হল? কি বললে মেমসাহেব? এতোক্ষণ গাড়িতে বসে কি কথা হচ্ছিলো? ইত্যাদি, ইত্যাদি। যতো বলি সিনেমা থেকে ফেরবার পথে দেখা। মেমসাহেব দয়া করে আমাকে লিফট দিয়ে গেলেন। কেউ বিশ্বাস করে না, তবে একটা কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিলো যে, আমি অসাধারণ ভাগ্যবান এবং অতি শীঘ্রই প্রমোশন পাবো তাতে আর ভুল নাই। শুধু হেমদা সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমাকে একপাশে টেনে এনে বললেন---ব্যাপারটায় খুব উৎফুল্ল  হবার কিছু নেই। মুলাণ্ড সাহেব অত্যন্ত বদরাগী লোক, আর ঐ সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে অনেক রকম স্ক্যাণ্ডাল ও কানাঘুষো শোনা গিয়েছে।  কাজেই এখন থেকে একটু সাবধানে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।"

 আবেগের ধর্মই ভাসিয় নেয়া। সাবধান-বাণী কোনো কাজেই আসে না। বিদেশিনী মিসেস মুলান্ড অতি মাত্রায় ধীরাজের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে ওঠেন। আর পুরুষ-ধীরাজের পক্ষে কী করে সম্ভব বিদেশিনী নীল নয়নাকে উপেক্ষা করা? ধীরাজ ও মিসেস মুলান্ড ক্রমাগত এক স্বপ্নমোহনায় মোহাবিষ্ট। প্রেমের উল্টো পিঠেই থাকে ভয়-শঙ্কা। কখনো কখনো ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তাই-ই হলো। মিসেস মুলান্ডের সঙ্গে ধীরাজের কিছু রোমান্টিক কথোপকথন এবং অজানা আশঙ্কা ধীরাজের মুখেই শুনি, “দু'জনে পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে পড়লাম। দেখি, আমার হাতখানা তখনও মেমসাহেব ধরে আছে---ছাড়িয়ে নিতে সাহস হল না।

একটু চুপ করে থেকে দূর দৃষ্টি মেলে মেমসাহেব যেন নিজের মনেই বলে চললো---বরাবরই ‘জনি' হেড স্ট্রং ও জেলাস---ইদানিং আরো বেড়ে গিয়েছে। সুন্দর ও স্মার্ট কোনও ছেলের সঙ্গে আমায় কথা বলতে দেখলেই ও রাগে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বসে---তুমি জানো না ভটচায কি করে সব দিক মানিয়ে আমায় চলতে হয়! You can't imagine how unhappy.  কথার শেষে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়লো। 

অবাক হয়ে শুধু ভাবলাম---এ সব ঘরোয়া কথা মেমসাহেব আমাকে শোনাচ্ছে কেন? কি জবাব দেবো, চুপ করে বসে ঘামতে লাগলাম। 

একটু পরে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে মেমসাহেব বললে--- ভটচায, ডু ইউ বিলিভ ইন লাভ? ভালোবাসার অস্তিত্বে তোমার বিশ্বাস আছে? 

এ কী প্রশ্ন! ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেলাম। দেখি, উত্তরের আশায় মেমসাহেব মুখের দিকে চেয়ে আছে। কি বলি? আমতা আমতা করে বললাম---সিওর! 

হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়লো মেমসাহেব---যেন উন্মাদের হাসি---থামতেই চায় না। লজ্জায় লাল হয়ে ভাবলাম--- কী এমন হাসির কথা বলেছি! যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিলো তেমনি হঠাৎ থেমে গেল হাসি। গম্ভীর হয়ে মেমসাহেব বললে--- তুমি বিশ্বাস করতে পারো দু'বছর আগে ঐ মুলাণ্ডের জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, এক ঘণ্টা না দেখতে পেলে পৃথিবী অন্ধকার মনে হতো? ভাবতাম, এই হলো সত্যিকার লাভ। ভুল, ভুল, মস্ত ভুল। ভালোবাসা বলে কিছু নেই। মুলাণ্ডের আগে আরো চার জনের প্রেমে পড়েছিলাম--- প্রত্যেকবারই মনে হতো এই সত্যিই, এইটেই খাঁটি ভালোবাসা---! 

মেমসাহেবের হাতের মুঠোর ভেতর হাতখানা ঘেমে উঠেছে---নিরুপায়, চুপ করে বসে রইলাম। মেমসাহেব বলে চললো---আজ ওদের দেখলে হাসি পায়---একদিন ওদের জন্য পাগল হয়েছিলাম মনে হলে নিজের ওপর রাগ হয়। আর Johny! You don't know young man, How I hate him! How I hate him! 

মিসেস মুলাণ্ডের চরিত্রের ঐ দিকটা একেবারে অজানা ছিল---বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে চুপ করে রইলাম। 

একটু পরে হাসিমুখে আমার দিকে চেয়ে মেমসাহেব বললে---Do you know Bhattacharjee, I like you? তুমি টাউনে থাকলে আমি খুশিই হবো। But love! Oh never, never. ভালোবাসাটা মিথ্যে কথা---ভালোলাগাটাই সত্যি! হঠাৎ চেঁচিয়ে মেমসাহেব ডাকলো---গ্রেটা! 

স্বপ্ন ভেঙে গেল---দেখি, সন্ধ্যার অন্ধকারে মিশে গিয়ে কুকুরটা লাফিয়ে উঠেছে মেমসাহেবের কোলে---আদরে চুমুকে আচ্ছন্ন করে ছেড়ে দিতেই সে লাফিয়ে আমার কোলে এসে বসলো---তারপর আস্তে আস্তে আমার ডান পাশে সরে গিয়ে সামনের পা দুটো তুলে মুখটা আমার কোলে রেখে দিব্যি আরামে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে কুকুরটাকে আদর করতে শুরু করলো মেমসাহেব---ইউ নেটি গ্রেটা, হাউ ডু ইউ নো আই লাইক হিম? মুখে মদের গন্ধ পেলাম। মেমসাহেবের এত উছ্বাসের কারণ খানিকটা বুঝতে পারলাম। 

আদর আর শেষ হয় না। আমি যে রক্তমাংস দিয়ে গড়া একটা মানুষ---মনে হলো সে কথা একদম ভুলে গিয়েছে মেমসাহেব। আমি যেন জড়পিণ্ড, নয় তা ঐ লোহার বেঞ্চের একটা অংশ। কতোক্ষণ এইভাবে বসেছিলাম জ্ঞান নেই--- হঠাৎ দু'জনে চমকে উঠলাম--- দেখি একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুলাণ্ড। তাড়াতাড়ি কুকুরটাকে বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেমসাহেব। চাপা গম্ভীর গলায় মুলাণ্ড বললে--- It is past eight O'clock Milly! Everybody is waiting for you.

Oh, sorry dear, বলে কোনো দিকে না চেয়েই চলে গেল মেম সাহেব। শুধু মুলাণ্ড যাবার আগে একটা দৃষ্টি দিয়ে আমার আপাদমস্তক দেখে চলে গেল। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে কষ্ট হল না। 

এতো দুঃখেও হাসি পেলো আমার। ভাবলাম, ভাগ্য ছাড়া পথ নেই। বিধাতা অলক্ষ্যে দাবার ছকে যে ঘুঁটি সাজিয় রেখেছেন---তার বাইরে চাল দেবার সাধ্য কারও নেই।"

এরপর যা হবার তাই-ই হলো। মুলান্ড সাহেবের ক্রোধানল চরমে গিয়ে ঠেকল। ধীরাজকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় টেকনাফ থানায়। এ-সবই নিয়তির কারসাজি। তাই ধীরাজও সব মেনে নিয়ে টেকনাফের উদ্দেশে প্রস্তুতি নেন। রওয়ানা হবার পূর্বে ধীরাজ তাঁর বাবার নিকট একখানা পত্র লিখেন। সেই পত্রে সে-কালের টেকনাফ সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। ধীরাজের সে-পত্রের অংশ বিশেষ হলো,  “এখানকার লোকমুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে বুঝিলাম টেকনাফ অতি ভয়ঙ্কর জায়গা। এখান হইতে স্টীমার যাইতে আড়াই দিনের বেশি লাগে। বঙ্গোপসাগরের পারে ছোট্ট একটি দ্বীপ, তাহার বাসিন্দারা সব মগ, তাহাদের ভাষা বুঝা যায় না। কলিকাতা হইতে চিঠি যাইতে চৌদ্দ-পনের দিন লাগে। টেলিগ্রাম যায় সাত দিনে। বছরের সাত মাস এই দ্বীপটার সঙ্গে বাইরের জগতের কোনো সংশ্রব থাকে না। শুধু শীতকালে যখন সমুদ্র একটু শান্ত থাকে, তখন চট্টগ্রাম হইতে সপ্তাহে একদিন স্টীমার যায় ও আসে। ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের ঐ দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়। ওখান হইতে অধিকাংশই আর ফিরিয়া আসে না। এখানকার অনেকেই আমাকে নিষেধ করিতেছেন। প্রথমে ভাবিয়াছিলাম যাইব না, কিন্তু অনেক ভাবিয়া শেষ পর্যন্ত যাওয়াই স্থির করিলাম। চাকরিতে ইস্তফা দিয়া কলিকাতায় গেলে আপনারা ভাবিবেন, ফিল্ম-এ অভিনয় করিবার জন্য একটা মিথ্যা ছল করিয়া আমি চাকরি ছাড়িয়াছি। 

আশা করি এইবার আপনারা নিশ্চিন্ত ও আনন্দিত হইবেন, কারণ ওখান হইতে ফিরিবার সম্ভাবনা আমার খুব কম আর ইচ্ছাও নাই। জীবনে আমার বিতৃষ্ণা জন্মিয়াছে। আর অধিক লিখিয়া আপনাদের ধৈর্য নষ্ট করিব না। অজ্ঞাত শ্রীচরণে যদি কোনও অপরাধ করিয়া থাকি মার্জনা করিবেন।"

সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক জনপদ টেকনাফ। সিনেমার নায়ক হবার স্বপ্নে বিভোর কলকাতার উঠতি যুবক ধীরাজ ভট্টাচার্য স্বপ্নেও ভাবেনি এমন বিরূপ পরিবেশের বাসিন্দা হবে। ধীরাজ এখন টেকনাফ থানার এ.এস.আই। থানার অফিসার-ইন-চার্জ হচ্ছেন মহেন্দ্র বড়ুয়া। টেকনাফ থানার দুই কনস্টেবল হরকি বড়ুয়া এবং রমেশ দত্ত এর আগেই ধীরাজকে স্টীমার থেকে রিসিভ করে থানা পর্যন্ত নিয়ে আসেন। তাই ওদের দুজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় পর্বটা সবার আগেই হয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে সবার সাথেই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সমর্থ হন ব্রাহ্মণ ধীরাজ। টেকনাফে আসার পর থেকেই ধীরাজের তৃতীয় জীবন অর্থাৎ ক্লাইমেক্স-এর সূচনা হয়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি টেকনাফের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জীবনধারণ প্রণালী, প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন। ধীরাজ টেকনাফের সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে, “টেকনাফ অদ্ভুত দ্বীপ। লম্বা মাইল দেড়েকের বেশি হবে না, চওড়া প্রায় এক মাইল। নাফ নদীর পুব দিকে হল আকিয়াব,আর পশ্চিম দিকে টেকনাফ। একদিকে ঘিরে রয়েছে বঙ্গোপসাগর।"

ধীরাজের বর্ণনায় আরো বেরিয়ে এসেছে তখনকার টেকনাফের চমকপ্রদ তথ্য---“ঐ দ্বীপের বাসিন্দারা সবাই মগ, শুধু বাজারে কয়েকটি চট্টগ্রামের বাঙালী আছে, তারাও প্রায় মগ হয়ে উঠেছে। জিনিসপত্রের দাম এখানে অসম্ভব সস্তা। টাকায় আঠারোটা মুরগী, একটা পাঠার দাম দু'আনা। এক আনার মাছ কিনলে থানা সুদ্ধু ভরপেট খাইয়েও কিছু ফেলা যায়।"

দিন গড়াচ্ছে আর ধীরাজও মগজীবন ও পরিবেশের অভিজ্ঞতায় ক্রমাগত এক স্বপ্নের পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে ওঠেছে। যে জীবন কেউ কল্পনাও করতে পারে না অথচ সেই জীবনের প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশ এখন ধীরাজ। কলকাতা কিংবা চট্টগ্রাম এখন আর কিছুই তাঁর মনে নাই। শুধু চোখের পাতায় ভেসে ওঠছে জীবনের বহু বিচিত্র ও অজানা এক-একটা ক্যানভাস। ইতঃমধ্যে কনস্টেবল হরকি বড়ুয়ার সঙ্গে ধীরাজের সম্পর্ক খুবই ঘনীভূত হয়ে ওঠে। হরকি বাংলা এবং মগভাষা দুটোই সমান জানতো। ধীরাজ তাই হরকিকে সঙ্গে করেই ঘুরে বেড়াত।  দ্বীপের মগপল্লী ঘুরে দেখে অভিভূত ধীরাজ লিখেছেন, “হরকি বললে---এই ঘরটির নাম হল ক্যাংঘর,এটা সাধারণের সম্পত্তি। এ দ্বীপে মদ আর তাড়ি একরকম বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। পাকা কলা পঁচিয়ে এরা ঘরেই মদ তৈরি করে, আর তাড়ি পয়সায় দু'তিন ভাঁড় পাওয়া যায়। ঐ মগ ছেলেগুলো সকাল থেকে মদ আর তাড়ি খেয়ে এই ক্যাংঘরে এসে বিশ্রাম করে। এদের আলাচনার মূখ্য বিষয় হল পরনিন্দা আর স্ত্রীলোক ঘটিত ব্যাপার। মগদের মধ্যে ছেলেরা কোনো কাজই করে না, শুধু খেয়েদেয়ে, নেশা করে কাটিয়ে দেয়। যাবতীয় কাজ করতে হয় মেয়েদের। নদী থেকে মাছ ধরে সেই মাছ মাটিতে পুঁতে আর রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা, হাটে বাজারে কেনা-বেচা করা, রান্না করা, অবসর সময়ে রেশমি লুঙ্গি বোনা, তামাক থেকে বর্মা চুরোট তৈরি করা এসব কাজ তো আছেই, তাছাড়া আবার সময়মতো পতিদেবতাকে ক্যাংঘর থেকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দেওয়াও আছে। 

মগর মুলুক কথাটা এতোদিন কানেই শুনে এসেছিলাম আজ স্বচক্ষে দেখে জীবন ধন্য হল। 

মগদের জীবনযাত্রার এই বিচিত্র কথা শুনতে শুনতে এক পা দুইপা করে ঢুকে পড়লাম মগপল্লীতে। পাতার ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট ঘর, ক্যাংঘরের মতো উঁচু মাচার উপর তক্তার মেজে। তপাত শুধু ক্যাংঘরের চারদিকে খোলা, আর এগুলো চেরা বাঁশ আর নারকেল বা সুপারি পাতার মতো একরকম পাতা দিয়ে ঘেরা। এক-একটি পরিবার ছেলেপুলে নিয়ে ঐ ছোট্ট একখানি ঘরে দিব্যি বাস করে। ওরই মধ্যে রান্না, খাওয়া দাওয়া, হাত মুখ ধোওয়া সব চলে। তক্তার ফাঁক দিয়ে জল এঁটো ভাত তরকারি সব পড়ে মাচার নিচে। তক্তা মুছে নিয়ে তার উপর বিছানা পাতে, শোবার ঘর হয়ে যায়। দেখলাম মাচার নিচে নোংরা আবর্জনা, পঁচা ভাত আর জল পড়ে পড়ে নরককুণ্ডু হয়ে গিয়েছে; ভাপসা দুর্গন্ধে কাছে যেতেও ঘেন্না করে।  

মগ পল্লীতে আর একটা জিনিস পেলাম, একটা বিকট উগ্র দুর্গন্ধ যাতে পেট ঘুলিয় ওঠে, শুনলাম ওটা শুঁটকি মাছের গন্ধ। চেয়ে দেখি প্রায় প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে দূরে দূরে দুটো বাঁশের খুঁটিতে দড়ি বাঁধা। আর তাতে ঝোলানো রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় সমুদ্রের মাছ। হরকি বললে---বড় বড় মাছ সাধারণতঃ ওরা মাটিতে পুঁতে রাখে, তারপর রোদে শুকায়। এটা হল শুঁটকি মাছের সীজন। এ সময় দ্বীপে কোনো অসুখ বিসুখ বড় একটা হয় না, শুঁটকি মাছের গন্ধ নাকি খুব স্বাস্থ্যকর। ওখান থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। একটু এগিয়ে দেখি, সামনে একটা ছোট মাটির পাহাড়, নানা রকম গাছ ও আগাছায় ঢাকা। ওরই মধ্যে দিয়ে একটা সরু পথ এঁকে-বেঁকে প্যাঁচিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। হরকি বললে---ওপরে রয়েছে নানা কারুকার্য করা কাঠের একটি বৌদ্ধ মন্দির, মগেরা বলে জাদিমুরা।"

টেকনাফ ধীরাজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখানকার উদাম প্রকৃতি ও মানুষ তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। মানুষগুলো শান্ত প্রকতির মতোই সহজ-সরল আবার টর্নেডোর মতো বিধ্বংসীও। টেকনাফ থানার সামনেই রয়েছে পাতকুয়া। পুরো টেকনাফ দ্বীপের মধ্যে ঐ একটিই পাতকুয়া। মগ-মেয়েরা সকাল-বিকেল দল বেঁধে কলসী নিয়ে পাতকুয়া থেকে জল নিয়ে যায়। এই জল নেয়া ওদের রীতি ও সংস্কৃতিরই অংশ। ধীরাজ এই জল নেয়ার দৃশ্য দেখে অভিভূত। থানার সামনে চেয়ারে বসে পুরোনো পত্রিকা পড়ার ছল করে মগ-মেয়েদের অদ্ভুত সাজ-সজ্জা আর অকৃত্রিম সরল-সৌন্দর্য তাঁকে ক্রমাগত এক রূপকথার জগতে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরের দুনিয়া ও জীবন ধীরাজ প্রায় ভুলেই গেছে। মগ-মেয়েদের পাতকুয়ায় আসা-যাবার দৃশ্য ধীরাজের চোখে ধরা দিয়েছে এভাবে, “পরদিন সকালে একাধিক নারীকণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ঘুম ভাঙলো! প্রথমে মনে হল, জনবহুল কোনো শহরের একটি বিয়ে বাড়িতে শুয়ে আছি। চোখ পড়লো ঘরের চেরা বাঁশের বেড়ার দিকে আর কানে ভেসে এল বে অব বেঙ্গলের চাপা হুঙ্কার। রুঢ় বাস্তবে ফিরে আসতে দেরি হল না। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠেই দরজা খুলে থানার দিকের ছোট বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, পঞ্চাশ-ষাটটি মগী যুবতী রঙ বেরঙের লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে পাতকুয়োর চারধারে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে থানা প্রাঙ্গণ মুখরিত করে তুলেছে। বেশির ভাগই গরীব মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, পোশাক দেখে অন্ততঃ তাই মনে হল। সুঠাম সুন্দর দেহ, গায়ের রং ফর্সা, গোলাকৃতি মুখ, চাপা নাক আর ছোট্ট চোখ। অনেকটা বর্মী ধরনের মঙ্গোলিয়ার চেহারা। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে দেখবার জিনিস হচ্ছে ওদের খোঁপা। এ রকম সুন্দর খোঁপা এর আগে কোথাও দেখিনি। দেখলাম, প্রত্যেকের হাতে বা কাঁধে রয়েছে একটা মাটির কলসী; দু'একটা পিতলের কলসীও দেখলাম। আমায় দেখে ওদের মধ্যে চাপা হাসির ঢেউ খেলে গেল তাও বেশ বুঝতে পারলাম।"

টেকনাফের জমিদার ওয়াংথিনের একমাত্র আদুরে মেয়ে হচ্ছে মাথিন। থানার পাতকুয়ার জল আনার ফাঁকেই ধীরাজের চোখে ধরা পড়ে অনিন্দ্য সুন্দর এই মগ-নন্দিনী। সভ্য দুনিয়ার স্মার্ট যুবক ধীরাজ ভট্টাচার্য প্রকৃতি-কন্যা মাথিনের মাঝে খুঁজে পেলেন প্রেমের চিরন্তন যাদুকরী ছোঁয়া। প্রকৃতপক্ষে মাথিনের তুলনা মাথিন নিজেই। এরকম অতুলনীয় সৌন্দর্যের আধার সভ্য সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। সিনেমার ভিলেন ধীরাজ এখন বাস্তবের নায়ক; সত্যিই অসাধারণ জীবন্ত মেলোড্রামা। প্রথম মাথিন-দর্শন ধীরাজের মুখেই শোনা যাক, “দু'তিন দিন পরের কথা। এখন আমার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ হল দু'বেলা বারান্দায় চেয়ারে বসে কাগজ পড়ার ভান করে মগী যুবতীদের জল তোলা দেখা। ওদের ওই দুর্বোধ্য ভাষার কিচির মিচির কানে মধু বর্ষণ না করলেও বেশ লাগে। সেদিন একটু সকালে ঘুম ভঙলো। যথারীতি চেয়ারে বসে ডিউটি দিচ্ছি। পাতকুয়োর ধারে সবেমাত্র তিন চারটি যুবতীর জটলা শুরু হয়েছে, অন্যান্যরা এখনও এসে জড়ো হয়নি। হঠাৎ কিছু দূরে নজর পড়লো, চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ে। কাঁখে ঝকমকে একটা পেতলের কলসী; পরনে সিল্কের দামী লুঙ্গি, গায়েও দামী রেশমী ফতুয়া। মেয়েটি ধীরে ধীরে এসে পাতকুয়োর ধারে কলসী রেখে দাঁড়ালো। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এরকম রূপযৌবনে লাবন্যময়ী মেয়ে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নাক-চোখ-মুখ সুন্দরী বাঙালী মেয়েদের মতোই নিখুঁত, তার উপর ঐ নয়নমনোহর খোঁপা। মনে হল, সমুদ্র থেকে কোনো জলপরী উঠে এসেছে টেকনাফের পাতকুয়ো থেকে জল নিতে। স্থান কাল পাত্র ভুলে বিমুগ্ধ চোখে হা করে চেয়ে আছি। মেয়েটি দু'একবার আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবেই কাটলো। পা টিপে টিপে দুষ্টু হরকিটা যে কখন এসে পড়েছে খেয়াল হয়নি। একটু হেসে হরকি বললে---আর কতোক্ষণ চেয়ে থাকবেন বাবু, মাথিনের জল নেওয়া আজ আর তা'হলে হবে না। 

বেশ একটু বিরক্ত হয়েই বললাম---মাথিন! মাথিন আবার কে? 

 ---ঐ যে মেয়েটি আপনার চাউনির ধাক্কা সামলাতে না পেরে লজ্জায় লাল হয়ে পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে ঐ তো মাথিন। এখানকার জমিদার ওয়াংথিনের একমাত্র আদুরে মেয়ে। 

লজ্জায় মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম---আচ্ছা, ওকি রোজ কুয়ো থেকে জল নিতে আসে? 

হরকি বললে--- প্রায়ই তো আসে, তবে খুব সকালে। অন্য মেয়েরা জল নিতে আসবার আগেই ও জল নিয়ে চলে যায়। জল নিতে আসা ওর একটা শখ; বাড়িতে পাঁচ-ছটি চাকরাণী রয়েছে, তবু ওর জল নিতে আসা চাই। ওর বাপ মেয়েঅন্ত প্রাণ, তাই কোনো কিছুতেই আপত্তি করে না। 

 

কথায় কথায় বেলা হয়ে উঠলো। চেয়ে দেখি পাতকুয়োর ধারে ভিড় বেশ জমে উঠেছে কিন্তু তাদের মধ্যে মাথিন নেই। কোন্ ফাঁকে জল নিয়ে সে সরে পড়েছে জানতেও পারিনি।"

ধর্ম-বর্ণ-জাত-কূল এবং ভাষা কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াল না মাথিন-ধীরাজের মধ্যে। কোনো বাক্য বিনিময় নয় শুধু চোখাচোখিতেই ওদের হৃদয়যমুনায় জোয়ার ওঠেছে। এ এক আশ্চর্য প্রেম; Human Psychology-র অদ্ভুত রূপায়ণ। মগ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি এবং বিবাহ সম্পর্কিত নিয়ম-কানুন সভ্য দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওরা জন্মগতভাবেই সত্যবাদী এবং ভীষণ সহজ-সরল। কিন্তু যৌন বিষয়ে ওদের ধারণাটা খুবই আশ্চর্যজনক এবং ক্ষেত্র বিশেষে মর্মান্তিকও! বইয়ের বর্ণনাতেই আছে যেমন---“এই মগ জাতটার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট লক্ষ্য করেছেন দারোগাবাবু? অসম্ভব সরল এরা। ঠাট্টা-তামাসা, ঘোর-প্যাঁচ কিছুই এরা বোঝে না। আর এদের যৌন ব্যাপারটা আরো অদ্ভুত। ব্যাভিচার বলে কিছু এদের মধ্যে নেই। যদি কদাচিৎ কেউ অবিবাহিতা কুমারী বা পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় আর তা হাতে নাতে ধরা পড়ে, তাহলে আর রক্ষে নেই। ঐ ধারালো চকচকে দা'দিয়ে মেয়েটির অভিভাবক বা স্বামী দু'জনকেই কেটে টুকরো টুকরো করবে, পুলিশের বিচারের তোয়াক্কা না করেই। তারপর নিজেই এসে থানায় হাজির হবে শাস্তির জন্য। জেল, ফাঁসি, দ্বীপান্তর যা হয় হাসিমুখে মাথা পেতে নেবে, পালাবে না।"

মগ-সংস্কৃতির প্রায় পুরোটাই এখন ধীরাজের সামনে পানির মতো পরিষ্কার। মাথিনবিহীন কোনা চিন্তাই ধীরাজের চেতনায় আর অবশিষ্ট নেই। আর মাথিনও চিরন্তন নারী-হৃদয়ের স্বপ্নজাল বুনে বিশেষ পুরুষের আকাঙ্ক্ষায় অধীর হয়ে ওঠেছে। পুরো ব্যাপারটাই ঘটে চলেছে দুজনের চেতন-অবচেতনের মিথস্ক্রিয়ায়। ধীরাজ বেশিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং মাথিনের বাড়িও আবিষ্কার করে ফেলে একদিন। সেই জমিদার বাড়ির চিত্র ধীরাজের বর্ণনায় এরকম--- “বাড়িটা কাঠের হলেও দোতলা। মোটা শালগাছের গুঁড়ির উপর পুরু তক্তার মেজে, দেওয়ালও তক্তার। উপরে টিনের ছাউনি। ছবির মতো সুন্দর বাড়িটা। দোতলায় হাটের দিকে এক হাত লম্বা ও আধ হাত চওড়া একটা ফোকর বা জানালা। বাড়ির চার পাশে অনেকখানি জায়গা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যে নানা রং-এর ফুলের গাছ। মোটকথা গৃহস্বামী যে সঙ্গতিসম্পন্ন এবং রুচিবান বাড়িটার দিকে এক নজর চাইলেই বেশ বোঝা যায়। দোতলার সেই ফোকরটার দিকে উৎসুক ও ব্যাকুল চোখ মেলে চেয়ে আছি, যদি একবার মাথিন উঁকি দেয়। দিলো না।"

 

চলবে...

 

সিরাজুল ইসলাম জীবন
প্রভাষক(বাংলা),  
নজরুল গবেষক, সাহিত্য সমালোচক, কবি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top