সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

মাথিন ট্র্যাজেডি: আমাদের বিস্মৃতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা : সিরাজুল ইসলাম জীবন


প্রকাশিত:
১৮ মার্চ ২০২১ ১৮:৫৩

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৭

 

(পর্ব দুই)

 ব্রাহ্মণপুত্র ধীরাজকে পারিবারিক ঐতিহ্য বা ধর্মীয় বাধা, কলকাতা-চট্টগ্রামের নাগরিক জীবন কিংবা মিসেস মুলান্ডের স্মৃতিকাতরতা কোনো কিছুই মগ-নন্দিনী মাথিনের মায়াময় রূপের সামনে প্রতিবন্ধকতা সষ্টি করেনি। এক মাথিনপ্রেমে ধীরাজ পুরোপুরি আচ্ছন্ন। পৃথিবীর সব সৌন্দর্যই ধীরাজ খুঁজে পেয়েছে মাথিনের চোখে...ভালোলাগা এবং ভালোবাসার আবেগঘন বিবরণ সত্যিই নান্দনিক, ধীরাজ লিখেছেন, “ভোর হবার আগেই বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসি, মাথিন আসে। পরস্পরের দিকে চেয়ে দু'জনে সম্ভব অসম্ভব নানা কল্পনার রঙিন জাল বুনে চলি। অন্য মেয়েরা আসে, হাসাহাসি করে, গা টেপাটেপি করে, ভ্রক্ষেপ নেই। পরে ভিড় বেশি বেড়ে গেলে অনিচ্ছায় জল নিয়ে মাথিন চলে যায়, আমিও উঠে পড়ি। মুখের ভাষা না বুঝলেও দুজনের মধ্যে চোখের ভাষার পরিচয় ততোদিনে বেশ ঘনীভূত হয়ে এসেছে। আমি সন্ধ্যেবেলায় আবার আসবার মিনতি জানাই, সেও সানন্দে সম্মতি দিয়ে চলে যায়। আবার সন্ধ্যেবেলায় চলে ঐ একই খেলার পুনরাভিনয়। সবাই জল নিয়ে চলে গেলে মাথিন আসে, দুজনে দুজনার দিকে চেয়ে থাকি যতোক্ষণ দেখা যায়। পরে সন্ধ্যার আঁধার গাঢ় হয়ে আসে, কাছের মানুষও ভালো দেখা যায় না। জল নিয়ে ধীরে ধীরে মাথিন চলে যায় আর ওর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখেও সমস্ত বিশ্ব-সংসার অন্ধকার হয়ে আসে। রাত্রে ঘুমুতে পরি না। মাথিনের কথা ভাবি, কল্পনায় মাথিনকে দেখি। বুঝলাম, আমার জীবনে প্রথম বসন্ত এল এই সুদূর টেকনাফে। মাথিনকে আমি ভালোবেসেছি। অনেক কষ্টে ঘুম এলেও স্বপ্নে দেখি মাথিনদের কাঠের দোতলায় আধ হাত চওড়া জানালায় মুখ বাড়িয়ে আমি আর মাথিন হাটে মগদের বিচিত্র বেচাকেনা দেখছি। মুখ ফেরাতে গিয়ে মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যায়, দু'জনে একসঙ্গে হেসে উঠি। ঘুম ভেঙে যায়, ততোক্ষণে ভোর হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠে বাইরে চেয়ারে গিয়ে বসি।

এমনি করে চোখে চোখে থাকার দিনগুলি আমার কেটে যাচ্ছে; মনে হয়, এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না। সেদিনও যথারীতি বারান্দায় বসে আছি, হরকি এসে কাছে বসলো। কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললাম---আমায় মগী ভাষা শিখিয়ে দিবি হরকি?

কিছুক্ষণ হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে থেকে হরকি বললে---ভাষা না শিখেই যা করছেন বাবু এর পর ভাষা শিখলে টেকনাফের সুন্দরী মেয়ে আর একটাও বেঁচে থাকবে না, সব মরে যাবে। মগী রসিকতায় হা হা কর হেসে উঠলো হরকি।

রাগ হল না, বললাম---ঠাট্টা রাখ, সত্যিই আমি শিখবো।

তার চেয়ে এক কাজ করেন না বাবু, মাথিনকে বিয়ে করে ফেলুন, ওই আপনাক শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে।

জিজ্ঞাসা করলাম---আচ্ছা, ওদের বিয়ের নিয়ম-কানুনগুলো কি রকম?

হরকি বললে---খুব সোজা। বিয়ের ব্যাপারে অভিভাকদের কোনও হাত নেই, যা করবে মেয়ে। মেয়ের যদি ছেলে পছন্দ হয় তাহলে সে যৌতুক চাইবে। ধরুন, দু'ভরি সোনা। ছেলের যদি ক্ষমতা থাকে এনে দেবে। মেয়ের আত্মীয়স্বজন সবাই একসঙ্গে ক্যাংঘরের কাঠের মেজেতে বসে শুঁটকি মাছের গুঁড়ো দিয়ে ভাত খাওয়া হলেই বিয়ে হয়ে গেল। আপনার ভরণপোষণের সব ভার নিয় নিলো মেয়ে। আপনি নিশ্চিন্তমনে খেয়ে দেয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে দিন।

পাতকুয়োর দিকে চোখ পড়লো। দেখি, কৌতূহলী দৃষ্টি আমার দিকে মেলে দাঁড়িয়ে আছে মাথিন। হরকি বললে--- ঐ যে না এসে আর উপায় আছে? আমি বলছি বাবু, ওর আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে।"

হরকি শত ভাগ সত্য কথাই বলেছে। মাথিন ধীরাজকে এমন পছন্দই করেছে...যা জগতের দীর্ঘ প্রেমের ইতিহাসে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে। ধীরাজ-মাথিনের ভাবের রসায়নটা ক্রমাগত ঘনীভূত করতে প্রকৃত সহায়তাও করেছে এই হরকি বড়ুয়াই। কনস্টেবল হরকি বড়ুয়া মগ না হয়েও ইতঃমধ্যে অনেকটা মগ হয়ে ওঠেছে। তবে মগদের সঙ্গে ওর ধর্মীয় সাদৃশ্য রয়েছে। মগভাষা ওর পুরোপুরিই জানা। মগদের ধর্ম-বিশ্বাস, রীতি-নীতি সবই সে জানতো। আবার বাংলা ভাষাটাও ওর আয়ত্বে ছিল। হরকি ধীরাজ বাবুর একান্ত অনুগত হওয়ায় ধীরাজ-মাথিন সম্পর্কের মাত্রা একেবারে আকাশ-ছোঁয়া পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। মাথিনের জমিদার বাড়িতে হরকির নিয়মিতই যাতায়াত ছিল। ধীরাজ মগভাষা বুঝতো না আর মাথিন বাংলা জানতো না। তাই হরকিই ছিল তাঁদের একমাত্র বিশ্বস্ত অবলম্বন। হরকি ধীরাজ সম্পর্কে মাথিনকে বলতো---আর মাথিন সম্পর্কে ধীরাজকে বলতো--- দারুণ এক প্রেমের চিত্রনাট্য মঞ্চায়ন হতে লাগলো পাতকুয়োর দুধারে। বলা চলে রীতিমতো দূতিয়ালি এবং দোভাষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো হরকি। ধীরাজ হরকিকে পেলেই মাথিনের মানস-ধর্ম-রীতি সব কিছুই জেনে নিতে উদগ্রীব, এমনকি মগভাষা শিখতেও ধীরাজ হরকিকে ব্যস্ত করে তুলেছে। হরকি-ধীরাজের কথোপকথনে এসবের প্রমাণ মেলে---“আপনি বিশ্বাস করেন বাবু, বিয়ে না করলে মগী মেয়েরা কাউকে জাত দেবে না। মুহূর্তের ভুলে কেউ যদি সেকথা ভুলে যায়, আর ধরা পড়ে, তাহলে ভগবান বুদ্ধও তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন না। মুখে ঠাট্টা ইয়ার্কি সব করবে। কিন্তু আসলে খুব হুঁশিয়ার।

মন অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল, বললাম---আজ সন্ধ্যাবেলায় মাথিন জল নিতে এল না কেন?
দুষ্টুমি হাসি হেসে হরকি বললে---আসবে কি করে? আমি এতোক্ষণ ওদের ওখানেই ছিলাম যে। অনেক কথা হল। বখশিস দেন তো বলি।
বললাম---দু'টাকা বখশিস---বল কি কথা হল।
খুশি হয়ে মহা উৎসাহে হরকি বললে---আপনার কথা বলাতেই মাথিন বলে উঠলো, থানাগিরি কুং কুং রে এ এ এ এ...।
রীতিমতো রেগে গিয়ে বললাম, ঠাট্টা রাখ, সত্যি বল কি বলবে?
ভগবান বুদ্ধের দিব্যি বাবু, মাথিন ঐ কথাই বললে। ওর মানে হল---থানার বাবুকে চমৎকার দেখতে।

সমস্ত শরীরে একটা আনন্দের শিহরণ খেলে গেল। বললাম---আচ্ছা হরকি, মাথিনের সঙ্গে যদি কোনো দিন কথা কইবার সুযোগ পাই, যদি ওকে বলত চাই--- তোমায় চমৎকার দেখতে। তহলে মগী ভাষায় কি বলতে হবে?
দ্বিরুক্তি না করে হরকি বললে---মাগো কুং কুং রে এ এ এ এ...।
জিজ্ঞাসা করলাম---যদি বলতে চাই---মাথিন, তুমি যে কোনো যৌতুক চাও তাই দিয়ে তোমায় আমি বিয়ে করবো---তা হলে?
হরকি বললে---মাগো জাই ফলেয়ু মাগোঙা নিজ্জামে এ এ এ এ এ। শেষের কথাটা একটু টেনে বলতে ভুলবেন না বাবু।
হেসে বললাম---না, ভুলবো না। মগী কথার উচ্চারণ হয়তো ভুল হবে---কিন্তু শেষের অক্ষরটা মাইল খানেক টেনে নিয়ে যেতে কোনো দিনই ভুল হবে না।
পাছে ভুলে যাই, একটা কাগজে কথাগুলো লিখে নিলাম। আরও অনেকগুলো চলতি কথাও ঐ সঙ্গে টুকে রাখলাম।
হরকি বললে---মেয়েটা আপনার জন্য একেবারে পাগল। বলে কি জানেন? বাবু যদি কোনও দিন আমাকে বিয়ে করতে চায়, আমি যৌতুকই চাইবো না।
অবাক হয়ে বললাম---সে কি!
সত্যি বাবু। কোনো সুন্দরী মগমেয়ে যদি কাউকে বলে---তুমি যদি আমায় বিয়ে করো আমি কোনো যৌতুকই চাইবো না। এটা যে পুরুষের পক্ষে কত বড় সম্মান ও গৌরব তা আপনি হয়তো বুঝবেন না বাবু। কোনও মগের ছেলে হলে আহ্লাদে দম ফেটেই মরে যেতো।
দম ফেটে মরিনে সত্যি, কিন্তু খুশি হইনি একথা বললে মিথ্যা বলা হবে। একটু চুপ করে থেকে বললাম---কাল তুই এক ফাঁকে ওকে বলে দিস হরকি, ও যেন দু'বেলাই জল নিতে আসে। ওকে না দেখলে সে দিনটাই আমার বিশ্রী লাগে।

হরকি বললে---তার চেয়ে এক কাজ করুন বাবু। আর সাত-আট দিন বাদেই চৈত্রসংক্রান্তি। জাদিমুরায় ভগবান বুদ্ধের উৎসব। ঐদিন সকাল থেকেই অবিবাহিত ছেলেমেয়ের দল সেজেগুজে মন্দিরে গিয়ে জড়ো হবে। তারপর ভগবান বুদ্ধের মূর্তির সামনে পরস্পর প্রেম নিবেদন করে বিয়ের প্রস্তাব করবে। আপনি আর মাথিনও চলুন না বাবু।
বললাম---কিন্তু ওদের ঐ পবিত্র ধর্মমন্দিরে আমাকে ঢুকতে দেবে কেন?
হরকি হেসে ফেললে---আপনি কিছুই জানেন না বাবু। একমাত্র মুসলমান ছাড়া সব জাতই ওখানে ঢুকতে পারে আর বিয়ের প্রস্তাবও করতে পারে।
মনে পড়লো প্রথম দিন হরকিকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড় দেখেছিলাম, তার উপরই হল বুদ্ধের মন্দির---জাদিমুরা। এখনও মনে আছে কেমন একটা শান্ত মৌন স্তব্দতা পাহাড়টার চারদিকে বেড়ার মতো ঘিরে রয়েছে।
মহা উৎসাহে হরকি বলে চললো---সারা বছর ধরে মগী ছেলেমেয়েরা ঐ দিনটির পানে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে। সকাল থেকে মেয়েরা দামী রেশমি লুঙ্গি ফতুয়া ওড়না পরে যত্ন করে বাঁধা খোঁপায় রঙ বেরঙের ফুল গুঁজে ঐ আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকে। সঙ্গে থাকে নতুন পোশাকপরা স্বাস্থ্যবান মগী যুবার দল, চাইলে চোখ ফেরানো যায় না বাবু।

অবশেষে তাই ঠিক হল। হরকিকে শুধু বলে দিলাম কথাটা এখন গোপন রাখতে। এমনকি মাথিনকেও বলতে মানা করে দিলাম। ঠিক হল চৈত্র-সংক্রান্তির দুই দিন আগে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে হরকি একটা নতুন রেশমি লুঙ্গি আর ফতুয়া এনে দেবে আর মাথিনকেও জানিয়ে দেবে। আমার একান্ত ইচ্ছা চৈত্র-সংক্রান্তির আগে ব্যাপারটা কেউ না জানতে পারে, বিশেষ করে সতীশ। কি জানি হয়তো সব ভণ্ডুল করে দেবে, ওর অসাধ্য কাজ নেই।"

উল্লিখিত সতীশ হচ্ছে কনস্টেবল সতীশ ব্যানার্জি। এতদিনে ধীরাজ-মাথিনের পুরো বিষয়টা ভালোভাবেই বুঝে গেছে সতীশ। কিন্তু সে যে কী পরিমাণ ভয়ঙ্কর ও পরশ্রীকাতর ধীরাজ তা বুঝে ওঠতে পারেনি। সতীশ পর্দার অন্তরালে দাবার চাল দিতে ব্যস্ত। ধীরাজ-মাথিনের মাঝখানে সত্যিই সতীশ খলনায়োকচিত ক্রিয়া-কলাপের অভিনয় শুরু করে দিয়েছে। ধীরাজ একটুও টের পায়নি। সমগ্র বিশ্ব সাহিত্য খুঁজলে এই সতীশের কাছাকাছি আসতে পারে একমাত্র শেক্সপীয়রের ইয়াগো চরিত্র। ইয়াগো অবশ্য নাটকের খলচরিত্র হিসেবে স্বীকৃত। আর সতীশ হচ্ছে নিরেট বাস্তব জীবনের সত্যিকারের ইয়াগো। শেক্সপীয়রের ইয়াগো নাটকের শেষ প্রান্তে ধরা পড়ে যায়, কিন্তু সতীশকে ধরা পড়তে হয়নি। তাই শেক্সপীয়রের ইয়াগোর চেয়েও ভয়ঙ্কর খলচরিত্র হচ্ছে সতীশ ব্যানার্জি। এদিকে মাথিনকে নিয়ে ধীরাজ ক্রমাগত স্বপ্নজাল বুনে চলেছে। সেই স্বপ্নের কিছুটা ধীরাজের মুখেই শুনে নিই---“বিছানায় ছটপট করছি, ঘুম আর আসে না। কখনও ভাবি বিয়ের পর মাথিনকে আমি শেখাবো বাঙলা আর মাথিন আমায় শেখাবে মগী ভাষা। সে যা মজা হবে! আবার ভাবি, এখানেই সারা জীবন কাটিয়ে দেবো কিসের জন্য? মাথিনকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাবো। চোখের সামনে ফুটে উঠলো আমাদের ছোট্ট মধ্যবিত্ত সংসার। উৎসাহে একটু ভাটা পড়লো। বাবা-মা মাথিনকে ভালো মনে গ্রহণ করবেন কি? মা পারবেন না এটা ঠিক। চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাবার শান্ত সৌম্য মুখখানা---বুকে খানিকটা বল পেলাম। বুঝলাম বাবার আশীর্বাদ থেকে আমরা বঞ্চিত হবো না।"

ধীরাজের স্বপ্ন-সাধ ক্রমাগত ডালপালা মেলছে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনা-আশঙ্কা সবই তাঁর কল্পনায় ঢেউ খেলছে। কিন্তু সব সমস্যা একদিকে রেখে এক মাথিন ছাড়া অন্য কিছু ধীরাজ হিসেব করতে চাইছে না। ঠিক ঐ সময়কার ধীরাজের প্রেমিকমন কতটা চঞ্চল ও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেছে তা তাঁর বর্ণনা ছাড়া বুঝানো অসম্ভব। রোমান্টিক ধীরাজের সোনালি সময়ের প্রতিটা ক্ষণ ফ্রেমে বাঁধাই করার মতো, যেমন--“রোজ সকালের আলো-অন্ধকারের মধ্যেই মাথিন আসে, যতোক্ষণ থাকা সম্ভব পরস্পরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বেলা বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়ে। অনিচ্ছায় জল নিয়ে মাথিন চলে যায়। আমিও ঘরে গিয়ে বিছানার উপর শুয়ে পড়ে চোখ বুজে মাথিনকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখি। বিকেলে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সবাই চলে গেলে সে আসে। রাতের আঁধার যখন গাঢ় হয়, কাছের মানুষও দেখা যায় না, তখন আস্তে আস্তে সে চলে যায়। মাঝে মাঝে হরকি এসে ঠাট্টা করে, দু'একটা কথা বলে, ভালো লাগে না। নীরব চোখের ভাষায় যেখানে কাজ চলে সরব মুখের ভাষা সেখানে অবান্তর ও অবাঞ্ছিত মনে হয়। টেকনাফে সবাই জেনে গিয়েছে আমাদের এই বিচিত্র প্রেমের কথা। আড়ালে আবডালে কানাঘুষাও চলে, গ্রাহ্য করি না। সবার জীবনে এরকম বেপরোয়া উদ্দামতা আসে কি না বলতে পারবো না, কিন্তু আমার জীবনে এসেছিল। মাথিনের ব্যাপারে এসব নিন্দা অপবাদ ভয়ের বহু উর্ধ্বে চলে গিয়েছিলাম আমি।

চৈত্রসংক্রান্তির আর মাত্র তিন দিন বাকি। সকালে নিয়মমতো মাথিন চলে গেল, বিকেলে এল না। পাগলের মতো ঘর আর বার করে করে পা দুটো ধরে এল, তবুও মাথিনের দেখা নেই। ভাবলাম অসুখ বিসুক কিছু হল নাকি? সটান বেরিয়ে পড়ে বাজারের পথ ধরলাম। মনে মনে ঠিক করলাম নিবারণ বাবুর দোকানের সামনে মাথিনের দোতলার ঐ আধ হাত চওড়া ফোকরের দিকে চেয়ে সারা রাত কাটিয়ে দেবো। ভুলেও কি সে একবার উঁকি দেবে না?

অতো দূরে যেতে হল না। মাঝপথে হরকির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, বাজারের দিক থেকেই সে আসছিল। অপেক্ষাকৃত একটু নির্জন স্থানে গিয়ে বললে, ‘বসুন বাবু।' কোনো দিকেই না তাকিয়ে পথের পাশে ধুলোর উপরেই বসে পড়লাম, সামনে উবু হয়ে বসলো হরকি।

সোজা জিজ্ঞাসা করলাম---আজ সন্ধ্যাবেলা মাথিন এল না কেন?
আসবে কি করে! ঘরে বন্ধ করে রাখলে কেউ আসতে পারে? কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো ফুলে গিয়েছে মেয়েটার।
প্রথমটা বিস্ময়ে কথা কইতে পারলাম না। একটু পরে বললাম---ঘরে বন্ধ করে রেখেছে! কে? কেন?
একটু চুপ করে থেকে হরকি বললে---এখনও বুঝতে পারেননি বাবু? সব কিছুর মূলে আছে ঐ শয়তান বেটা সতীশ।
সতীশ মাথিনকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে? 
এতো দুঃখের মধ্যেও হেসে উঠলো হরকি। বললে---না, আপনি দেখছি পাগল হয়ে যাবেন। সতীশ বন্ধ করবে কেন? সতীশ ব্যাটা আজ ক'দিন থেকেই আপনাদের লক্ষ্য করছিল। আজ সকালে মাথিনের বাবা ওয়াংথিনের সঙ্গে দেখা করে সব বলে এসেছে। আরও বলেছে আপনার স্বভাব চরিত্র নাকি খুব খারাপ। চট্টগ্রামে কি একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি করেছিলেন, যার জন্য বড় সাহেব রেগে আপনাকে এখানে বদলি করেছেন। শালা ভালো কারুর করবে না, মন্দ করতে পেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে যায়।
খুন চেপে গেল মাথায়। বললাম---আমায় একটা মগী লম্বা দা যোগাড় করে দিবি হরকি? ওকে আমি কেটেই ফেলবো।

উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ধরে বসিয়ে দিয়ে হরকি বললে---কি সব ছেলেমানুষী করছেন বাবু। আগে সবটা শুনুন। মাথিনের বাবাকে আমি সব খুলে বলে এসেছি যে, বাবুর আমাদের কোনো খারাপ মতলব নেই। চৈত্রসংক্রান্তির দিন জাদিমুরায় মাথিনকে উনি বিয়ের প্রস্তাব করবেন। তারপর একটা ভালো দিন দেখে বিয়ে করবেন। এসব বলার পর তবে ঠাণ্ডা হল। কিন্তু মাথিনকে আর জল নিতে আসতে দিবে না।

অসহায়ভাবে বললাম---তাহলে উপায়?
ভালোই হল বাবু। ক'টা দিন কোনো রকমে চোখ কান বুজে কাটিয়ে দিন, তারপর চৈত্রসংক্রান্তির পর যখন-তখন ওদের বাড়ি যেতে পারবেন। সতীশ ব্যাটা তখন জ্বলে পুড়ে মরবে।
থানায় চলে এলাম। রাত্রে শুয়ে ঘুম এল না। সতীশ তাহলে মিসেস মুলাণ্ডের ব্যাপারটা বিকৃত করে মাথিনের বাবাকে লাগিয়েছে। মাথিনের কানেও ব্যাপারটা নিশ্চয় পৌঁছেছে। সে কী ভাবছে কে জানে। ঠিক করলাম বিয়ের পর সবার আগে মাথিনের ঐ ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতেই হবে।

 আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলা অনেক বেলায়। উঠবার তাড়া আজ আর নেই। চোখ বুজে শুয়ে গত রাত্রের বিচ্ছিন্ন ঘটনার জটগুলো খুলতে শুরু করে দিলাম। আচ্ছা, হরকি যে বললে---বিয়ের প্রস্তাব করলে এবং মাথিন মত দিলে যখন-তখন ওদের বাড়ি যেতে পারবো। গিয়ে কি করবো আমি? ওদের বাড়ি গিয়ে মাথিনের মুখের দিকে নীরবে চেয়ে বসে থাকাটা ঠিক হবে কি? ভাষা জানি না, কিছু জিজ্ঞাসা করলে জবাবও দিতে পারবো না। উপায়? প্রথম প্রথম কয়েক দিন হরকিটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। ইন্টারপ্রেটারের কাজ করবে। সহজ মীমাংসায় মন খানিকটা হাল্কা হল।

সতীশ মিসেস মুলাণ্ডের ব্যাপারটা শুনলো কি করে? তখনই মনে পড়লো সারা চিটাগাং শহর যে খবর জানে, সতীশের মতো ধড়িবাজ লোকের পক্ষে সেটা শোনা মোটেই আশ্চর্য নয়।"

সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠেছে ধীরাজ। প্রেমরাজ্যের মুকুটহীন একচ্ছত্র সম্রাট তিনি; তাঁর দেয়া বর্ণনা থেকে অন্তত এটুকু বুঝতে সমস্যা হয় না। ধর্ম-বর্ণ-ভাষা সবই আলাদা হতে পারে কিন্তু প্রেমের ধর্ম একই। এই ধর্মের বহিঃপ্রকাশ ভাবনার ক্রিয়াকলাপের তারতম্যে, তবে ধরন কখনো ভিন্ন ভিন্ন হয় না। ধীরাজের সঙ্গে মাথিনের এ পর্যন্ত সরাসরি একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি। প্রশ্নও আসে না, কেউ কারো ভাষাই তো বুঝে না। কিন্তু এক চোখের ভাষায় কী এক কালজয়ী প্রণয়োপাখ্যানই তৈরি হয়ে গেল। কুমারী মাথিনের অন্তর্জগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ধীরাজ-হরকির কথোপকথনে বেরিয়ে এসেছে এভাবে---"একটু চুপ করে থেকে হরকি বললে---ওর সব ছেলেমানুষী দেখলে হাসি পায়। আজ আমি যেতেই হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেল উপরে। তারপর চুপি চুপি বললে---হরকিদা,' তোমাদের থানার নতুন বাবু তো বাঙালী হিন্দু। ওদের মেয়েরা তো শাড়ি পরে।

অবাক হয় বললাম---হ্যাঁ, তাতে কি হল?
মাথিন বললে---ভাবছি, আমাদের লুঙ্গি বাবুর যদি পছন্দ না হয়, তাহলে?
আমি গম্ভীর হবার ভান করে বললাম---তাই তো, সত্যিই ভাবনার কথা।

মাথিন বললে---তুমি আমার একটা উপকার করবে হরকিদা'? আমায় লুকিয়ে একখানা শাড়ি কিনে এনে দেবে? এখানে দিনের বেলায় শাড়ি আমি কিছুতেই পরতে পারবো না, সবাই ঠাট্টা করবে। রাতে সবাই ঘুমুলে ঐ শাড়ি পরে আমি ওঁর কাছে যাবো। দেখো কিন্তু কথাটা কাউকে বলো না। তোমাদের নতুন বাবুকেও না। বিয়ের দিন রাত্রে শাড়ি পরে ওর কাছে গিয়ে ওঁকে চমকে দেবো।

এই বলে একখানা সিল্কের রুমালে বাঁধা পাঁচটা টাকা আমায় দিয়ে বললে---এই দেখুন বাবু।
রুমালের খুঁট খুলতে দেখা গেল পাঁচটা চকচকে রূপোর টাকা। চোখে জল এসে গিয়েছিল। অন্ধকারে হরকি দেখতে পেল না। ধরা গলায় বললাম---বলতে মানা করেছিল যদি, বললি কেন?

 হাল্কা হাসি দিয়ে পরে হরকি বললে---এসব কথা ও আপনাকে বলতে বারণ করে দিয়েছিল। তার মানে দেখা হলেই যেন বলি। বুঝলেন না বাবু? আবার হাসে হরকি।
চুপ করে থাকি, কথা খুঁজে পাই না। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করি---তুই বিয়ে করেছিস হরকি?
---হুঁ।
---ছেলে পিলে আছে?
---হুঁ এক ছেলে এক মেয়ে।
---কোথায় তারা?
---কেন বাড়িতে, বাব-মা'র কাছে।
আবার চুপ করে থাকি। কিছু পরে হঠাৎ আবার জিজ্ঞাসা করি---তোর বিয়ের সময় বউ কি যৌতুক চেয়ছিল রে?
চিৎকার করে হেসে উঠলো হরকি। একটু পরে হাসির বেগ কমলে একটু রেগেই জিজ্ঞাসা করি---হাসির কথাটা কি বললাম।
গম্ভীর হয়ে হরকি বললে---আপনি আমাকে কি ভেবেছেন বলুন তো? মগ?
অবাক হয়ে বলি---হ্যাঁ! নয়তো কি?
হরকি বললে---আমি বাঙালী। বাড়ি আমার চট্টগ্রাম জেলায়। তবে হ্যাঁ, ধর্মটা আমাদের এক। মগদের সঙ্গে শুধু ঐটুকু আমাদের মিল। নইলে আচার-ব্যবহারে, ভাষায়, সামাজিকতায় কোনো দিক দিয়েই মেলে না। আর একটি কথা জেনে রাখুন বাবু। মগদের মধ্যে ‘বড়ুয়া' পদবী নেই।
একেবারে বোকা বনে গেলাম। এতোদিন হরকিকে আমি মগ বলেই জেনে এসেছি। তাছাড়া এই সেদিন সতীশও ওকে মগ বলেই আমার কাছে বলেছে। বললাম---কিন্তু হরকি, মাথিনের ব্যাপারে সেদিন সতীশ পরিষ্কার বললে---
মুখের কথা একরকম কেড়ে নিয়ে হরকি বললে---জানি বাবু, ব্যাটা আমাকে রাগাবার জন্য মগ বলে সবার কাছে পরিচয় দেয়। প্রথমত আমি মগী ভাষা ভালোরকম জানি, তারপর এখানকার মগ ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমি অবাধ মেলামেশা করি। সবাই পছন্দও করে। সতীশ ব্যাটা হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরে।
যাক, এতোদিন পরে একটা বিশ্রী ভুলের সংশোধন হল।
রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। খাওয়া দাওয়া করতে হরকি উঠে গেল। আমি ঠায় অন্ধকারে চেয়ারটার উপর বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে রমেশ খাবার জন্য ডাকতে এল। উঠত যাবো---দেখি কোলের উপর পড়ে আছে মাথিনের সেই ছোট্ট সিল্কের রুমালখানা, টাকা পাঁচটা হরকি নিয়ে গিয়েছে। একবার ভাবলাম হরকি সত্যি এটা নিতে ভুলে গিয়েছে না ইচ্ছে করেই---! যাই হোক রুমালটা যত্ন করে পকেটে রাখলাম। 

রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে সেই ছোট্ট রুমালটা বুকে নিয়ে শুয়ে কল্পনায় শাড়ি পরা মাথিনের দিকে অপলক চোখে যতোক্ষণ পারি চেয়ে থাকি। গাঢ় ঘুমে ক্লান্ত চোখের পাতা দুটো আস্তে আস্তে বুজে আসে।"
 চৈত্রসংক্রান্তির আর মাত্র দুদিন বাকি। ধীরাজের কল্পনার ফানুস ক্রমশ ফুলে ওঠেছে। জাদিমুরার চূড়ায় ওঠে মাথিনকে পাবার মাহেন্দ্রক্ষণ একটা ঘোরের ভেতর ডুবিয়ে রাখছে ওকে। কিন্তু ভগবানের লীলা বোঝা বড়ই কঠিন। গ্রীক ট্র্যাজেডির নিয়তি ধীরাজ-মাথিনের মাঝখানে এসে দাঁড়ল। অদৃশ্যে বসে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি সব কলকাঠি নাড়ছে। অফিসার ইন চার্জ মহেন্দ্র বাবুর নির্দেশে ধীরাজকে একটা কেস তদন্ত করার জন্য অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ধীরাজ ভেবেছিল দুদিনের মধ্যে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলো দুদিন নয় ছয়-সাত দিনেও ফিরে আসা সম্ভব নয়। ধীরাজের এক সহকর্মী সাব-ইন্সপেক্টর আবদুল মজিদ সাহেবের বর্ণনায় ঐ তদন্ত যাত্রার দূর বঙ্কিম পথের বিবরণ এরকম---“মজিদ সাহেব উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন---কেমন জলের মতো আমায় বুঝিয়ে দিলে দশ-বারো মাইল পথ, একদিনের মধ্যেই কাজ শেষ করে চলে আসতে পারবেন। এখন শুনছি এই নীলার আবগারি আফিস থেকে মরিআলা ষাট মাইলেরও বেশি পথ। তার মানে চার রাত্রি অবিশ্রাম হাঁটলে তবে আমরা পঞ্চম দিনে মরিআলায় পৌঁছবো, কী ভয়ানক! এমন জানলে আমি চাকরি ছেড়ে দিতাম, তবু কখনই এই অসভ্য জংলি মুলুকে প্রাণ দিতে আসতাম না।"

ধীরাজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পাথর হয়ে গেল। এক-সময়ে তাঁদের তদন্ত অভিযান শেষ হয়। ততক্ষণে বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর অকল্পনীয় সব ঘটনা-বাস্তবের স্মৃতি অনুষঙ্গ করে ধীরাজ টেকনাফে ফিরে আসে। ইতঃমধ্যে চৈত্রসংক্রান্তি পেরিয়ে গেছে। তবু ধীরাজের সন্দেহাতীত প্রত্যাশা মাথিন অপেক্ষার প্রহরই গুনছে। এরকম স্বপ্ন-কল্পনার অনুষঙ্গ নিয়ে ধীরাজ টেকনাফ থানার কোয়াটার্সে ফিরেই তাঁর বাবার লেখা একখানি চিঠি পেয়ে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। অতপর চিঠি পাঠ করে ধীরাজের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা হয়। চিঠির মাঝামাঝিত বাবা লিখেছেন, “আজ ক্ষণিক উত্তেজনার বশে তুমি যদি ব্রাহ্মণের অস্পৃশ্য এক মগের মেয়েকে বিবাহ কর, তাহা হইলে সমাজ ও অগণিত শিষ্যের নিকটে আমার মুখ দেখানোই দুষ্কর হইয়া উঠিবে।"

বড় ভয়নাক কথা বলেছেন চিঠির একেবারে শেষ প্রান্তে, “এই পত্র পাওয়ার পূর্বেই যদি তুমি বিবিহ করিয়া থাক, তাহা হইলে আর আসিবার প্রয়োজন নাই। আমি মনে করিব আর একটি পুত্র হারাইলাম। খুব কষ্ট হইলেও সহ্য করিবার ক্ষমতা আমার আছে।"

চিঠি পড়া শেষে ধীরাজের চোখ বেয়ে শ্রাবণের ধারা নামলো। আসলে ধীরাজ-মাথিনের পথের কাঁটা হয়ে আছে শেক্সপীয়রের খলচরিত্র ইয়াগোরূপী কনস্টেবল সতীশ ব্যানার্জি। সেই-ই বেনামীতে ধীরাজের পিতার নিকট চিঠি লিখে সব খবর জানিয়ে দেয়। বাবার চিঠি পড়ার পরের মুহূর্তগুলো কেমন কেটেছে তা ধীরাজের মুখ থেকেই শোনা যাক---“অপলক চোখে চেয়ে এক ভাবে বসে রাত কাটিয়েছেন কেউ কোনো দিন? আমি কাটিয়েছিলাম সে রাত খাটের উপর ঠায় বসে। কত রাত, ক'টা বাজে, কোনো খেয়াল ছিল না। দরজা খোলাই ছিল, ইচ্ছে করেই খিল দিই নি।
এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলো সতীশ। আমাকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে বললে---এই যে, মরিআলা থেকে ফিরেছেন দেখছি। নাঃ সত্যি পুন্যাত্মা লোক বলতেই হবে। তা না হলে অতোগুলো বিপদের ভিতর থেকে সুস্থ শরীরে ফিরে আসা---

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম---আমার সঙ্গে তোমার বিশেষ কোনো দরকার আছে কি?
একটু আমতা আমতা করে সতীশ বললে---আজ্ঞে, আমার মানে---মহেন্দ্রবাবু ডাকছেন আপনাকে। একটু পরেই সামলে নিয়ে গলায় মধু ঢেলে বললে---আর একটা কথা হুজুর, মাথিনের সঙ্গে বিয়ের দিন কবে ঠিক করলেন?
চলে যাচ্ছিলাম, ফিরে দাঁড়ালাম। সতীশের বীভৎস মুখের দিকে মিনিট খানেক চেয়ে থেকে ঈষৎ হেসে বললাম---যে দিন মেয়েঘটিত ব্যাপারে মগদের ঐ ধারালা সাড়ে তিন হাত দা' তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করবে, সেই দিন।
অপ্রত্যাশিত উত্তরে ভ্যাবাচাকা খেয়ে একেবারে থ' হয়ে গেল সতীশ। আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
উঠোনে পাতকুয়োর ধারে জ্বরে ধুঁকতে ধুঁকতে বালতি করে জল তুলছে হরকি। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হরকি বললে---কাল রাতে যখন ডাকাডাকি করছিলেন, আমি তখন জেগে। বড্ডো জ্বর বলে উঠে আসতে পারিনি।
বললাম---থাক, সেজন্য তোমার লজ্জা পেতে হবে না, এখন কেমন আছো?
হরকি বললে---এখন জ্বর একটু কম, আবার বিকেলের দিকে না এলেই বাঁচি।
দেরি হয়ে যাচ্ছিলো। বললাম---হরকি অনেক কথা আছে। বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করো।

থানা-ঘরে ঢুকে দেখলাম, মহেন্দ্রবাবুর পাশে একটি সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় মগ বসে সিগারেট খাচ্ছেন। পরনে দামী সিল্কের লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া, মাথায় সিল্কের রুমাল। বয়স পঞ্চাশের উপর। মাথার চুল শাদা, ভুরু শাদা। প্রকাণ্ড চওড়া মুখখানাতে দুটি বিরাট গোঁপ, তাও শাদা। লোকটার চোখে-মুখে সব সময় প্রচ্ছন্ন হাসি লেগে আছে---দেখলে শ্রদ্ধা হয়।
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। মহেন্দ্র বাবু বললেন---বসো। ইনিই এখানকার জমিদার ওয়াংথিন সাহেব, আর এই ধীরাজ।
হাত তুলে নমস্কার করলাম।
খুশি হয়ে প্রতি-নমস্কার করে ওয়াংথিন মগি-বাংলায় বললেন---বালো, বালো। নাম শুনেছিলাম, দেখলাম। বেটীর আমার পছন্দ খুব বালো---কি বলেন থানাগিরি?
অনিচ্ছায় শুকনো হাসি হেসে জমিদারকে খুশি করেন মহেন্দ্রবাবু---আজ্ঞে, তাতো বটেই, তাতো বটেই।
চুপ করে বসে আছি।
মহেন্দ্রবাবু বললেন---ধীরাজ, তুমি হরকিকে নিয়ে এর মেয়ে মাথিনকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলে?
বললাম---হ্যাঁ।
মহেন্দ্রবাবু বললো---কথাটা ভালো করে ভেবে দেখেছিলে কি? তুমি বামুনের ছেলে হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মের একটি মেয়েকে বিয়ে করলে তোমার সমাজ, তোমার বাবা-মা মত দেবেন কি?
আমি কিছু বলবার আগেই ওয়াংথিন বললেন---থাক, থাক, এতো বেস্তো হোবার কিছু নাই, তি-চার দিন ভাবিয়ে পরে উত্তর দেবেন। আমার ঐ একটি মেয়ে। যদি বুঝেন সমাজ আপনাকে লিবে না, এইখানে থাকিয়ে যান। আমার জমি-জমা যা আছে আপনারই হোবে। আর যদি বুঝেন, ওকে লিয়ে গেলে গোলমাল হোবে না---লিয়ে যাবেন। আমার কোষ্ট হোবে---হোবে--- ও তো সুক পাবে।
ওয়াংথিন সাহেব যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আমরাও উঠে নমস্কার জানালুম। হেসে প্রতি-নমস্কার করে নিভে-যাওয়া চুরোটটা ধরিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেলেন তিনি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো।
মহেন্দ্রবাবুই প্রথম কথা বললেন---চট করে একটা কিছু করে বসো না। বেশ করে ভেবে-চিন্তে ঠিক করো, কি করবা? বিয়ের পর মাথিনকে নিয়ে কলকাতায় যাবে না এখানেই থাকবে।বললাম---ভাববার দরকার হবে না। আমি কি করবো ঠিক করে ফেলেছি।
মহেন্দ্রবাবু বললেন---কি ঠিক করেছো?
গলা একটুও কাঁপলো না। বললাম, বিয়ে করবো না।"

কনস্টেবল হরকি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শুয়ে আছে। ধীরাজের আকস্মিক মত পরিবর্তন এখনো সে জানতে পারেনি। এদিকে ধীরাজের লেখা অনেক আগের দরখাস্তে চৌদ্দ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছেন মিঃ মুলাণ্ড। তাঁর সামনে এখন রাস্তা দুটো---হয় মাথিনকে বিয়ে করা নতুবা রাতের মধ্যে স্টীমারে করে টেকনাফ ত্যাগ করা। কাকতালীয়ভাবে স্টীমারও ছাড়বে রাতে। এবং এই স্টীমারটি মিস করলে টেকনাফ থেকে খুব সহজে বেরুবার রাস্তা নাই। ধীরাজ যেন নিয়তির হাতের ক্রীড়নক মাত্র। ঘটনাগুলো যেন ক্রামাগত একটার পর একটা ঘটে চলেছে বিশেষ পরিণতির লক্ষে। ঘটনার আকস্মিকতা ও নাটকীয়তা ভীষণ অবাক করার মতো। অফিসার ইন চার্জ মহেন্দ্রবাবুর পরামর্শ---“যাক, যা হবার হয়ে গিয়েছে। শোনো ধীরাজ, যদি বাঁচতে চাও তাহলে আজ রাতেই তোমাকে পালাতে হবে, দেরি করলে একথা পাঁচকান হয়ে জমিদার ওয়াংথিনের কানে পৌঁছবেই। তখন শত চেষ্টা করেও তোমাকে বাঁচানো যাবে না।
জিজ্ঞাসু চোখে মহেন্দ্রবাবুর দিকে চাইলাম।
বললেন---একটা বিষয়ে তোমাকে ভাগ্যবান বলতেই হবে। ছুটির দরখাস্ত এসে গেল, এদিকে এই অসময়ে স্টীমারও রেডি।
আপনা হতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল---স্টীমার? এখন?
মহেন্দ্রবাবু বললেন---হ্যাঁ, অনেক লেখালেখি করে বাজারের দোকানদাররা চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের জন্য মালপত্র বোঝাই একখানা স্টীমার আনিয়াছিলো। শুঁটকি মাছের চালান নিয়া আজ রাত্রে সেটা চিটাগাং রওয়ানা হবে। আজই সরে পড়ো তুমি। কাল সকালে আমি সবাইকে বলবো---হঠাৎ বাবার অসুখের সংবাদ পেয়ে তুমি দু'সপ্তাহের জন্য কলকাতায় চলে গিয়েছো।"

চোরের মতো ধীরাজ নিঃশব্দে টেকনাফ বিদায়ের জন্য প্রস্তত। একবারও ভাবলো না মাথিনের কথা কিংবা হরকির কি অবস্থা হবে? ঠিক এ পরিস্থিতির সমালোচনা ধীরাজ নিজেই নিজেকে করেছেন এভাবে, “অন্ধকারে চলেছি, ঝড়ো হাওয়া বেড়েই চলেছে, বৃষ্টির বিরাম নেই। অবশেষে ঐ দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে অক্ষতদেহে নিরাপদে ভীরু প্রাণটা নিয়ে স্টীমার ঘাটে পৌঁছলাম। বেডিং স্যুটকেস ওরাই কখন তুলে দিয়েছিলো। দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আজ আর ভয় বা কষ্ট হল না। স্টীমারে উঠে দেখি আমার দেহরক্ষীর দল অপেক্ষা না করেই নৌকা ছেড়ে নাফ নদীর মাঝখান দিয়ে চলেছে। আজ ওরা শেষ বিদায়ের স্যালুট পর্যন্ত করলো না, কেনই বা করবে? ওরা আজ জেনে গিয়েছে মানুষের চামড়ার আবরণে আমি একটা কাপুরুষ। ছোট্ট ভীরু খরগোস জাতীয় জানোয়ার ছাড়া আর কিছুই নই।

 স্টীমার ছেড়ে দিলো।"

বাবা-মার একান্ত অনুগত ধীরাজবাবু এখন কলকাতায়। পুলিশের চাকরি থেকে কীভাবে ইস্তফা দেওয়া যায় সেই ভাবনায় ব্যস্ত। কিন্তু সেই আমলে পুলিশের চাকরি ছাড়া অত সহজ ছিল না। ইতঃমধ্যে বাবার ঠিক করা পাত্রী নমিতার সঙ্গে ধীরাজের বিয়ে হবার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব ভেস্তে যায়। অর্থাৎ মেয়েপক্ষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে---পুলিশ-পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিবে না। এদিকে ধীরাজ টাইফয়েডরোগী সেজে পাকা অভিনয় করে বিলেতী ডাক্তারকে বোকা বানিয়ে তিন মাসের মেডিকেল ছুটি আদায় করে নিয়েছে। টাইফয়েডরোগী সাজতে গিয়ে তাঁর চুলে জট বেঁধেছে, দাঁড়ি লম্বা হয়েছে। বলা যায় একরকম আধা-সন্ন্যাসী হয়ে গেছে ধীরাজ। ঘটনাক্রমে ম্যাডন কোম্পানীর বিখ্যাত পরিচালক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলীর সহকারী জ্যোতিষ মুখার্জির সঙ্গে ধীরাজের সাক্ষাৎ ঘটে। এবং ‘কাল পরিণয়' ছবির নায়ক চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেয়া হয় তাঁকে। বিপরীতে নায়িকা সীতা দেবী। ছবির প্রয়োজনেই এরকম আধা-সন্ন্যাসী নায়কের প্রয়োজন; সুতরাং পরিচালক ভীষণ খুশি। ধীরাজের জন্য এ যেন শাপে বর হল। সব কিছুই চরম নাটকীয়তায় ঘটে চলেছে। ধীরাজের টোটাল জীবনটাই দাবার গুটির মতো; সময় বুঝে কোনো অদৃশ্য শক্তি চাল দিয়ে দিচ্ছে।

 ‘কাল পরিণয়' ছবির সুটিং-এর জন্য ধীরাজ ঘর থেকে বেরুতে প্রস্তুত। এমন সময় খামযুক্ত একটি চিঠি ধীরাজের হাতে আসে। খামের উপর টেকনাফের ছাপ। চিঠিটি পকেটে পুরে তিনি গাড়িতে গিয়ে বসেন। ধীরাজের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এদিকে আজ সুটিং-এ নায়িকা সীতা দেবীর সঙ্গে বিয়ের পর নায়করূপী মণীন্দ্রের অর্থাৎ ধীরাজের প্রথম ‘লাভসিন' ধারন করা হবে। ধীরাজ তখন মেক-আপ রুমে সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। বাকিটুকু ধীরাজের বর্ণনায় দেখি, “মেক-আপ হয়ে গেল। আরশির ভিতরে ‘কাল পরিণয়' নায়ক মণীন্দ্রের দিকে চেয়ে বসে আছি। আমার ভেতর মন তিরস্কার করে উঠলো---সামান্য চিঠিটা পড়বার সাহসও তোমার হচ্ছে না? চরম কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে কেমনে পালিয়ে আসতে পারলে! আর এতো দূরে এসেও সামান্য কয়েকটা কালির আঁচড়কে এতো ভয়? যা হয় হোক, মরীয়া হয়ে পকেট থেকে খামখানা বার করে ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলাম। ছোট্ট চিঠি, বারোদিন আগের তারিখ দেওয়া। এ,এস,আই যতীন লিখছে টেকনাফ থানা থেকে---

 “ভাই ধীরাজ---
 তুমি এখান হইতে যাওয়ার দু'দিন পরেই কি ভাবে রাষ্ট্র হইয়া যায় যে, তুমি বাবার অসুখের জন্য ছুটি লইয়া যাও নাই, মাথিনকে বিবাহ করিবার ভয়ে পালাইয়া গিয়াছ। আমার দৃঢ় ধারণা সতীশই এই সর্বনাশ করিয়াছে। খবর শুনিবার পর হইতে মাথিন অন্নজল ত্যাগ করিয়া শয্যা লয়। ওর বাবা ওয়াংথিন, আমরা সবাই, এমনকি সমগ্র টেকনাফবাসীর শত চেষ্টাও ওকে জল গ্রহণ করাইতে পারে নাই। গতকল্য সকালে মাথিন মারা গিয়াছে। ওয়াংথিন পাগলের মতো হইয়া গিয়াছে। তোমার ঠিকানা জানিবার জন্য ওয়াংথিন বহু চেষ্টা করিয়াছে ও এখনও করিতেছে, আমরা দিই নাই। এখন বুঝিতেছি তুমি পালাইয়া গিয়া ভালোই করিয়াছ। হরকিই যতো অনিষ্টের মূল জানিতে পারিয়া ওয়াংথিন তাহাকে মারিয়া আধমরা করিয়াছে। প্রাণে বাঁচিয়া থাকিলেও অনেক দিনের জন্য বিশ্রাম লইতে হইবে। মহেন্দ্রবাবু বদলি হইয়া গিয়াছেন, তাঁহার স্থলে মিঃ ভৌমিক আসিয়াছেন। আমরা ভালো আছি, তুমি---।"

 আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি।
 আর দরকার নেই। পড়বার প্রয়োজন আমার ঐ একটি লাইনেই ফুরিয়ে গিয়াছে,--- ‘গতকল্য সকালে মাথিন মারা গিয়াছে।' আমার অভিশপ্ত ভাগ্যের সামান্য ছোঁয়াচ লেগেই দুটো অমূল্য জীবন নষ্ট হয়ে গেল। মাথিন আর হরকি। কিন্তু আমার তো ভালো হল! কন্দর্পকান্তি তরুণ সিনেমার নায়ক! আরশির ভিতরের মানুষটার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বসে রইলাম।"

এই হচ্ছে ধীরাজ-মুখের কারুণ রসসিক্ত জবানবন্দি। মাথিনের মর্মান্তিক আত্মদান অতি সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টকর। মাথিনের ট্র্যাজিক পরিণতি, ধীরাজের স্মৃতি-বিলাপ সবকিছু মিলিয়ে পাঠকের হৃদয়ে করুণ রসের বন্যা বইয়ে দেয়। মাথিন-ধীরাজ এখন ইতিহাসের অংশ। অনেক অনুদঘাটিত বিষয় রয়ে গেছে। তাই ব্যাপক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। মাথিন-ধীরাজের প্রেম-পরিণতি আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গে কবি রুহুল কাদেরের ‘মাথিনপুরাণ' কবিতাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযাগ্য। কবিতাটির অংশ বিশেষ যেমন---

"রাতের আঁধারে যে পালায় নমিতার পরিণয় প্ররোচনায়
অবলীলায় মণীন্দ্র সেজে সাজঘরে ধীরাজ যখন
'কালপরিণয়' ছবির বাসররাত্রির মধুমিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ গুনে অস্থির
প্যানোয়ার হলুদ ফুল খোঁপায় গুঁজে চৈত্রসংক্রান্তিকালে
ছলস্মৃতি মুছে কেন
জাদিমুরার চূড়ায় ওঠে
অবুঝ কুমারী খুঁজে নাওনি কেন নহলিকুমার?

পুড়ে মরেছ মিছেমিছি অলীক মিলনের কারাল অনলে
মাথিন, প্রেমের মরা ডুবে যাওনি জলতলে।
তোমার প্রেমের স্মৃতিসৌধ পাতকুয়ার পবিত্র জল তুলে
অসংখ্য চোখদরিয়ায় শোকাতুর ঢেউ---
বানোয়াট স্মৃতিবিলাপ ‘যখন পুলিশ ছিলাম' পড়ে
পলাতক মনচোর ধীরাজের অক্ষমতা ক্ষমা করে না কেউ।

 একই বিষয় নিয়ে লেখা কবি অসীম সাহার ‘মাথিনের কূপ' কবিতার অংশবিশেষ যেমন---

"ধীরাজ নীরব মুখে মাথিনের কাছ থেকে দূরে চলে যায়,
 রাতের আঁধার এলে মাথিনকে ফেলে রেখে স্বদেশে পালায়।
 মাথিনের বুক ভাঙে, নোনা জলে ভরে যায় শোকার্ত বুক
মাথিন দীর্ণ হয়, দেহে তার বাসা বাঁধে কঠিন অসুখ
তারপর ধুকে-ধুকে নিঃশেষিত হয়ে যায় আদিবাসী মেয়ে
আহা! মৃত্যুর প্রবল হাওয়া তার দিকে আসে দ্রুত ধেয়ে।
ধীরাজ আসে নি আর, কাপুরুষ, ভালোবাসা পায়ে গেছে দলে
বেদনায় মাথিনের দেহখানি ঝরে গেছে মৃত্যুর কোলে। 
এখন মাথিন নেই। স্মতিটুকু পড়ে আছে অতি নিশ্চুপ
ধীরাজের নাম ধরে তবু আজো ডাক দেয় ‘মাথিনের কূপ'।"

টেকনাফ থানার সামনের সেই ‘মাথিনের কূপ' আজো মাথিন-ধীরাজের স্মৃতি-চিহ্ন বহন করে চলেছে। এই ‘মাথিনের কূপ' হতে পারে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বের প্রেম-পিয়াসী মানুষের তীর্থকেন্দ্র। সত্যিই আগ্রার তাজমহলের মতো ‘মাথিনের কূপ' দর্শন পর্যটকদের জন্য হয়ে ওঠবে অতি কাঙ্ক্ষিত এক স্থান। এ জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তব পদক্ষেপ। এমন কোনো গবেষক আছেন কি যাঁর অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে বের করবে মাথিন-ধীরাজের অজানা সব তথ্য? তা হলে তাঁকে আনন্দচিত্তে স্বাগত জানাই। একজন সত্যজিৎ রায় কি আছেন? যাঁর হাতে নির্মিত হবে মাথিন-ধীরাজকে নিয়ে অসাধারণ কোনো চলচ্চিত্র; যা বিশ্ব দরবারে বাংলা ছবিকে আবার অস্কার এনে দেবে। অনেক অসম্পূর্ণতা ও অতৃপ্তি আছে তবু স্বপ্নের দিগন্ত রেখায় চেয়ে রইলাম...।

সমাপ্ত

 

সিরাজুল ইসলাম জীবন
প্রভাষক(বাংলা),  
নজরুল গবেষক, সাহিত্য সমালোচক, কবি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top