রসিক চোর : সত্যজিৎ বিশ্বাস
প্রকাশিত:
২২ এপ্রিল ২০২১ ২১:৪৩
আপডেট:
২২ এপ্রিল ২০২১ ২১:৪৭

আহ্ কী সুগন্ধ ...
ফারুক সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরে হাত মুখ ধুয়ে ড্রইংরুমে বসতে না বসতেই গন্ধটা পেলেন। মনে মনে বললেন, আসলেই বউয়ের তুলনা হয় না। এমন সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে সারা ঘরে!
না, না ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আপনারা যে গন্ধ শোঁকার জন্য নাক বাড়িয়েছেন, এ সুগন্ধ সে সুগন্ধ না। এটা মিসেস লায়লার চুলের তেলের গন্ধ না। এমন কি, তার অঙ্গ থেকে আসা বিদেশি সেন্টের গন্ধও না। এ হলো বাতাসে ভেসে আসা খাঁটি দেশি সুস্বাদু খাবারের গন্ধ। সে গন্ধ যেন রান্নাঘর থেকে ভেসে এসে ফারুক সাহেবকেই ডাকছে। কিছু ডাক নিশি ডাকের মতো। কিছুতেই এড়ানো যায় না। গন্ধ শুকতে শুকতে রান্নাঘরে ঢুকলেন ফারুক সাহেব।
- কি রান্না করছ গো, পোলাও? ওমা, ওটা কি? মুরগীর মাংস নাকি? যা গন্ধ বের হচ্ছে না।
- ‘হয়েছে, হয়েছে আর পাম দিয়ে ফুলাতে হবে না। এই গরমের মধ্যে যন্ত্রণাটা না দিলেও পারতে’, গলা বেয়ে নামা ঘাম শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন মিসেস লায়লা।
- আমি! যন্ত্রণা দিলাম মানে?
- আর মানে মানে করতে হবে না। তোমার গেস্ট কখন আসবে তাই বলো?
- আমার গেস্ট আসবে মানে?
- কেন, তোমার কোন পরমাত্মীয় নাকি খাবে সে জন্য পোলাও চাল আর মুরগী কিনে পাঠিয়ে দাওনি সকালে?
- পোলাও চাল, মুরগী কিনে পাঠিয়েছি? না তো। কাকে পাঠাবো?
- কাকে আবার? তোমার অফিসের পিওনকে পাঠাওনি?
- আমার পিওনকে? আমি পাঠালে আমি জানব না?
- তাহলে দুপুরে যে লোক দুই কেজি পোলাও চাল আর দুটো মুরগী দিয়ে গেল, সে কে?
- নির্ঘাত আমার শ্বশুর বাড়ির দিকের কোনও পরমাত্মীয়। যাহোক, এসে কি বলল, তাই বলো?
- এসে বলল, কাকে নাকি দাওয়াত করেছ, অনেকদিন পর বিদেশ থেকে এসেছে সে। আমার হাতের রান্না খেতে চায়।
- ওরে বাবা, দারুণ ব্যাপার তো। আচ্ছা দাঁড়াও, দাঁড়াও ভুল করে পাশের ফ্ল্যাটের বাজার আমাদের দিয়ে যায়নি তো?
- আরে না, পাশের বাসার হবে কেন? সে তো তোমার ল্যাপটপও নিয়ে গেল। বলল, কি নাকি জরুরী ডকুমেন্ট আছে ল্যাপটপে। তাই অফিসে নিয়ে যেতে হবে ল্যাপটপ।
- ল্যাপটপ নিয়ে গেছে? স-র্ব-না-শ হয়েছে। হায় রে হায়, কি বেকুব মহিলা রে। কে না কে এসে বলল আর তুমি দিয়ে দিলে?
- মুখ সামলে কথা বলবে। আমি বেকুব? এর আগেও তো কতবার পিওনকে দিয়ে বাজার পাঠিয়েছ। পাঠাওনি?
- ওদের কেউ এসেছিল?
- তোমার অফিসের সব পিওনের চেহারা আমি মনে রেখে বসে আছি নাকি? তোমার সমস্যাটা কি? আমাকে জেরা না করে ওদের ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে পারো না? বউয়ের সাথে তেজ দেখানো ছাড়া এ জীবনে আর কিছু পেরেছ?
উত্তর দিতে গিয়েও হা করা মুখ বন্ধ করে নিলেন ফারুক সাহেব। বউদের সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। আর হলেও দিতে হয় না। ঝড়ের বেগে মোবাইল হাতে নিয়ে অফিসের সব ক’জন পিওনকে ফোন দিলেন। তারপর দেওয়ালে কয়েকবার মাথা ঠুকে কপাল ফুলিয়ে জিডি করতে বের হয়ে পড়লেন থানার উদ্দেশ্যে।
মিসেস লায়লা দেখেও না দেখার ভান করে রান্না চালিয়ে যেতে লাগলেন। মন খারাপ করে রান্না শেষ করে পোলাও, মাংস টেবিলে রাখতে না রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো লোকটি ব্যস্ত হয়ে বলল, থানা থেকে এসেছি। তাড়াতাড়ি আলামতগুলো দিন।
- আলামত মানে? কীসের আলামত? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মিসেস লায়লা।
- দারোগা সাহেব বলে পাঠিয়েছেন আলামত পাঠিয়ে দিতে। ফারুক সাহেবও বসে আছেন।
- দারোগা সাহেব পাঠিয়েছেন মানে? ফারুক আসেনি কেন?
- উনি তো ওখানে বসা। উনিই তো বললেন, আপনাকে বললেই আপনি সব গুছিয়ে দেবেন।
- গুছিয়ে দেব কী করে? পোলাও চাল, মুরগি সব তো রান্না হয়ে গেছে।
- রান্না হয়েছে তো কী হয়েছে? রান্না গুলোই দিয়ে দিন।
মিসেস রহমান পাঁচ বাটির বিশাল টিফিন বাটিতে পোলাও, মাংস সব ঢেলে দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারটা তুলে দিলেন লোকটার হাতে।
ঘন্টাখানেক পর বিষণ্ণ মনে ঘরে ফিরলেন ফারুক সাহেব। এ দীর্ঘজীবনে কত মানুষই তো তাঁকে ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়েছে। কই, তাদের জন্য তো এত খারাপ লাগেনি। কেন জানি, স্বজন হারানোর চেয়েও তীব্র শোক হতে লাগল ল্যাপটপটার জন্য। বেশ কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ল্যাপটপের সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির ভান্ডারে ঘোরাঘুরি করলেন। তারপর ধুত্তোরি বলে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে গিন্নীর দিকে তাকালেন। ল্যাপটপটা তো গেল। আবার কবে হবে কে জানে? এবার দাও তো, চোরটার মুরগী, পোলাও খেয়ে কিছুটা উসুল করি।
মিসেস লায়লা হা হয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে।
- ‘কী হলো এভাবে তাকাচ্ছ কেন? কপাল কি বেশি ফুলে গেছে?’ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন ফারুক সাহেব।
- কত মানুষ আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ হয়ে আসে আর উনি এসেছেন কপাল ফুলিয়ে গাব গাছ হয়ে। তা, কপাল ফুলিয়ে বাংলা সিনেমার মতো স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছ নাকি?
- তারমানে?
- ‘টিফিন বাটিতে রান্না করে সব পাঠালাম না?’ মুখ ঝামটা দিয়ে প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মিসেস লায়লা।
- কি পাঠালে?
- কী আবার, আমার মাথা।
- তাহলে তো বেঁচেই যেতাম।
- কি বললে?
- বললাম, যদি রান্না করেই পাঠালে তাহলে তোমার ঘাড়ের উপরের খোমাটা কার, মুরগীর?
- মুখ সামলে কথা বলবে, বললাম। নিজেই পাঠাতে বলে, এখন আবার পাঠার মতো ব্যা ব্যা করছে।
- আমি পাঠাতে বলেছি! কোথায় পাঠাতে বলেছি?
- কোথায় আবার? থানায়।
- অ্যাঁ? থানায়? কাকে দিয়ে পাঠালে?
- থানা থেকে যে এলো, তাকে দিয়ে।
- কে এলো? এ আবার কোন বাটপার?
- ক্ষেপে যাচ্ছ কেন বুঝলাম না? তুমিই তো লোক পাঠালে থানায় সব পাঠিয়ে দেয়ার জন্য।
- আমি বলেছি ! কখন?
- থানায় যাবার মিনিট পনের পরই তো এলো লোকটা। বলল, চুরির আলামত হিসেবে নাকি ওগুলো দরকার।
- তারপর?
- বড় টিফিন বাটিটায় সব ভালো করে প্যাক করে দিয়ে দিলাম।
ফারুক সাহেবের মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল। সপ্তম আশ্চর্যের কোন নিদর্শন যদি চোখের সামনে দেখতে পান ঝাড়া পাঁচমিনিট অপলক তাকিয়ে থাকবেন। আজ মনে হয় সেই বাসনা পূরণের দিন। স্থির দৃষ্টিতে লায়লা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লায়লা বেগমও যে ছাড়ার পাত্রী, সেটাই বা কে বলল?
দুজন দুজনের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। যেন, যে আগে পলক ফেলবে সেই হেরে যাবে।
জানালার পর্দা হালকা ফাঁক করে এ দৃশ্য দেখে কে যেন ফিক করে হেসে কেটে পড়ল।
---
সত্যজিৎ বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
বিষয়: সত্যজিৎ বিশ্বাস
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: