সিডনী মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিষন্ন এক পিতা : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
৮ মে ২০২১ ১৮:৪৫

আপডেট:
১৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:০৩

ছবিঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

"কন্যাদায়গ্রস্তা পিতা" এই কথাটি আমাদের বাঙালী তথা ভারতীয় সমাজে খুব পরিচিত একটি কথা| যুগ যুগ ধরে কন্যাকে ঠিক সময়ে পাত্রস্থ না করতে পারলে অথবা পাত্রস্থ করার পর কন্যার অপরিসীম দুর্দশাময় জীবনের কথা ভেবে কাতর হয়ে পড়েন অনেক পিতাই|এমনকি এই একবিংশ শতাব্দীতেও মেয়েরা যেখানে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বহু সাফল্যের নিদর্শন দেখিয়েছে, সমাজ এখনো ভ্রুকুটি করতে ছাড়ে না| কিন্তু যে বিশ্বকবি লিখেছিলেন"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার? " যাঁর নানা লেখনীতে তিনি নারীর প্রতিভা, স্বকীয়তার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন বাল্যবিবাহ, শিক্ষার অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে, কেমন ছিল নিজের তিনকন্যার প্রতি তাঁর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি? বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃহৃদয় কি ততটাই বলিষ্ঠ ছিল তাঁর লেখনীর মত?

 রবীন্দ্রনাথের তিনটি কন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা ও মীরা| ১৮৮৬ খৃস্টাব্দে ২৫শে অক্টোবর কলকাতায় কবির প্রথম সন্তান মাধুরীলতা জন্মগ্রহণ করেন| কবির সবচেয়ে প্রিয় সন্তান ছিলেন বেলা বা মাধুরীলতা| মাধুরীলতা ছিলেন অপরিসীম সুন্দরী| রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থে লিখেছেন" আর সব ছেলেমেয়েদের থেকে বাবা দিদি কে বেশি ভালোবাসতেন| দিদির বুদ্ধি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি তা মানতে আমাদের লজ্জাবোধ হত না|" জমিদারীর কাজে রবীন্দ্রনাথ একবার উত্তরবঙ্গে গেছেন, সেইসময় কলকাতার জোড়াসাঁকো থেকে স্ত্রীর চিঠির সাথে ছোট্ট মেয়ে মাধুরীলতাও বাবাকে নিজের কচিহাতে চিঠি লিখে পাঠালেন| মেয়ের চিঠি পড়ে মুগ্ধ কবি তাঁর স্ত্রীকে লিখেছিলেন"আমার মিষ্টি বেলুরাণীর চিঠি পেয়ে তখনি বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছিল|আমার জন্য তার আবার মন কেমন করে--তার তো ঐ একটুখানি মন, তার আবার কী হবে? তাকে বোলো আমি তার জন্য অনেক 'অড'আর জ্যাম নিয়ে যাব|' বাবার আদরের বেলা যখন সবে কিশোরী, রবীন্দ্রনাথ কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎচন্দ্রের সাথে তাঁর বিবাহ দিলেন মাত্র পনের বৎসর বয়সে| প্রশ্ন জাগে এতো প্রগতিশীল লেখনীর জনক হয়েও তিনি এই বাল্যবিবাহে সম্মতি কিভাবে দিলেন? শুধু তাই নয় এই বিবাহে তিনি দশহাজার টাকা যৌতুক ও দিয়েছিলেন জামাইকে| বরপক্ষের দাবি ছিল কুড়িহাজার টাকা যৌতুক, কবি অনেক অনুরোধের পর যৌতুক কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন| যিনি তাঁর রচিত একাধিক গল্পে বাল্যবিবাহ ও পণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সমাজের এই কুপ্রথা গুলি উপেক্ষা করতে পারেন নি| কবির অসহায়তা এখানেই থেমে থাকে নি| সামান্য পারিবারিক মতান্তরের জন্য শরৎচন্দ্র তাঁর শ্বশুরবাড়ীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলেন| কবির বড় আদরের বেলা মন:কষ্টে বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হলেন| কবির কাছে খবর আসামাত্র কবি সব কাজ ফেলে শান্তিনিকেতন থেকে ছুটে গেলেন বেলার শ্বশুরবাড়ীতে| জামাইয়ের দুর্ব্যবহারের জন্য তিনি প্রতিদিন তাঁর জামাই আদালতের কাজে বেরিয়ে গেলে মেয়ের কাছে যেতেন, মেয়ের মাথার কাছে বসে তাঁকে অনেক গল্প শুনিয়েছেন মন ভালো করার, শুশ্রুষা করেছেন| বাবার সব আশীর্বাদকে ব্যর্থ করে মাধুরীলতা ১৬ই মে ১৯১৯সনে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন|

 কবির দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকা বা রানী| রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই দ্বিতীয়া কন্যাটিকে একটু বেশি পছন্দ করতেন কেননা ছোট থেকেই রেণুকার নিজস্বতা ছিল সব ব্যাপারেই| পরিবারের অনান্য মেয়েদের মত সাজসজ্জা, আড়ম্বর ইত্যাদি একদম পছন্দ ছিল না| কবি বলতেন"ও হলই বা একটু আলাদা রকমের, তাতে ক্ষতি কী? " রেণুকার কাছে বাবা ছিলেন বটগাছের মত আশ্রয়, বাবা ছাড়া তিনি কিছু বুঝতেন না| কিন্তু ১৯০১ সালে মাধুরীলতার বিবাহের অল্প কিছুদিনের পরেই কবি রেণুকার বিবাহ দিলেন ডাক্তার সত্যেন্দ্র ভট্টাচার্যের সাথে| রেণুকার তখন মাত্র দশ বৎসর বয়স| এতই ছোট যে বিবাহে ফুলশয্যার অনুষ্ঠান হয় নি| বিবাহের পর সত্যেন্দ্র বিলাত চলে গেলেন| রেণুকার আর তাঁর স্বামীর সাথে দেখা হয় নি| বিবাহের কয়েক মাস পরেই রেণুকা যক্ষা রোগে আক্রান্ত হলেন| কবি তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে এসে চিকিৎসা করালেন| এমন কি ডাক্তারের পরামর্শে ১৯০৩ সালের মে মাসে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মেয়েকে নিয়ে হিমালয়ের স্বাস্থ্যকর অঞ্চলে গেলেন| নিজের হাতে মেয়ের শুশ্রুষা করেছেন, তাঁর শিয়রে বসে মেয়ের মন ভালো রাখার জন্য অনেক গল্প, গান শুনিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে কবির আদরের রানী বিদায় নিলেন|

কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর যখন ১৩ বৎসর বয়স কবি তাঁর বিবাহ দেন নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির সাথে|জামাইকে কবি নিজের খরচায় বিলাত পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য| কিন্তু নগেন্দ্র কোনোদিকেই সুবিধা করতে পারেন নি| কবি তাঁকে শান্তিনিকেতনের কাজে লাগিয়েছিলেন সেখানেও তিনি তাঁর অদক্ষতার পরিচয় দেখিয়েছেন| এমন কি কবি কন্যা মীরার সাথে তাঁর দ্বন্ধ ও মতবিরোধ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল| যদিও নগেন্দ্র ও মীরার একটি পুত্র ও একটি কন্যা হয় কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়|মীরা দেবী তাঁর সন্তান দের নিয়ে কবির কাছে চলে আসেন|

 একথা ভাবতে খুব আশ্চর্য লাগে যে কবি সারা জীবন ধরে বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেছেন তিনি তাঁর নিজের কন্যাদের ক্ষেত্রে এই নীতিকে মেনে নিলেন| কি ছিল কারণ? উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার বাঙ্গালী সমাজে প্রগতিশীলতা ও মননশীলতার ধারক ও বাহক ছিল| সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী পর্দানসীন প্রথা ভেঙ্গে স্বামীর সাথে বিলাতে গিয়েছিলেন এবং বাঙালী মেয়েদের প্রথম পার্সী স্টাইলে শাড়ি ও তৎসহ সেমিজ, জ্যাকেট পরার প্রথা চালু করেন| কাদম্বিনী দেবী(জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যপ্রতিভা বিকাশের অনুপ্রেরণা হয়েছিলেন, কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সমস্ত অলংকার বিক্রয় করে অর্থ সাহায্য করেছিলেন| কিন্তু এইসব গ্লামারের অন্তরালে সাধারণ পরিবারের মত মেয়েদের জীবনে লুকিয়ে ছিল অনেক বঞ্চনা, বিষাদ| বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা পরিবারের অনিবার্য নীতি ছিল| পরিবারের একজন হিসাবে কবি এই নীতি অগ্রাহ্য করতে পারেন নি| হয়তো বা শান্তিনিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কবি এত ব্যস্ত ছিলেন যে তাঁর তিন কন্যার তাড়াতাড়ি বিবাহ দিয়ে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন| কিন্তু এই বিবাহের ফল ভালো হয়নি| কবি শেষ জীবন অবধি আক্ষেপ করে গেছেন তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য| তাঁর তিনকন্যার জীবনী পর্যালোচনা করলে এইকথাই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে যে এক অসাধারণ জ্যোতির্ময় বিশ্ববন্দিত মহাকবির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিষণ্ণ স্নেহময় কন্যাদায়গ্রস্ত চিরকালীন পিতা|

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top