সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

অমাবস্যার রাতে : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১৮ মে ২০২১ ২০:২০

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫৫

 

গ্রামের নাম তালদিঘি। চারপাশে না আছে না আছে তালগাছ, না কোনো দীঘি। কথাটা তুলতেই প্রিয়ঙ্কর রেগে গেল৷ ক্ষোভের গলায় বলে উঠলো, সবসময় যে নামের সঙ্গে জায়গার মিল থাকবে তার কোনো মানে নেই। তাহলে তো হাতিবাগানের চারপাশে হাতিদের ঘোরাফেরা করতে হয়, আর শ্যমবাজারের পাঁচমাথায় কেষ্টঠাকুরকে বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দীপ্য আর বেশি চটালো না, সে জানে প্রিয়ঙ্কর তার গ্রাম নিয়ে খুব পজেসিভ। যদিও সে কলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে কিন্তু এই গ্রাম হল প্রিয়ঙ্করের প্রাণ। দীপ্য কলকাতায় বাবা-মায়ের সাথে নিজের বাড়িতে থাকে। হোস্টেলের ছেলেদের নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়, আর হবে নাইবা কেন ! চব্বিশ ঘন্টা একসাথে থাকা, খাওয়া, শোওয়া, কিন্তু যেকোনো ভাবেই হোক প্রিয়ঙ্করের সাথে দীপ্যর গলায় গলায় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে৷ দীপ্য আজ প্রিয়ঙ্করের গ্রাম ঘুরতে এসেছে। গত একবছর ধরে চলতে থাকা প্যান্ডেমিক জীবনটাকে নিমপাতা চিবনোর মত তেতো করে দিয়েছিল। চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থেকে ভালোভাবে শ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিল। মার স্কুল, বাবার অফিস, নিজের অনলাইনের ক্লাস সব ওই আড়াইখানা ঘরে। দিন দিন সবাই কিরকম খিটখিটে হয়ে উঠছিল! অকারণে রাগ, বিরক্তি, অশান্তি সব ওই হাজার স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের মধ্যে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছিল৷   ট্রেন চলা শুরু হলে প্রিয়ঙ্করের সাথে প্ল্যান করে কথাটা বাবা-মায়ের কাছে পেরেছিল দীপ্য। প্রথমে তো দুজনেই এককথায় না করে দিয়েছিল। পরে অনেক কান্নাকাটি, খাওয়া বন্ধ, কথা বন্ধ ইত্যাদি পর্বের মধ্যে দিয়ে একসময় বাবা-মা নিমরাজি হয়েছিল। আর সেই নিমরাজির ফাঁক গলে আজ সকালে দীপ্য প্রিয়ঙ্করের গ্রামে এসে পৌঁছেছে।

প্রিয়ঙ্করও এখানে একদম ভালো ছিলোনা, যদিও বাড়িতে তার জ্যেঠতুতো দাদা আর বোন আছে; কিন্তু স্কুল আর হোস্টেলের সেই স্বাধীনতা আর মজা খুব মিস করছিল। তাছাড়া এখানেও ঘরবন্দি জীবন৷ স্বাভাবিক সময়ে গ্রামের বাড়িতে এলে যে খুশির হাওয়া বয়ে যায়, এবারে তার অনেকটাই অভাব ছিল। এমতাবস্হায় দীপ্য এখানে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলে প্রিয়ঙ্কর নেচে উঠেছিল। আজ সেই দিন, সকালবেলা দীপ্য এই তালদিঘিতে এসে পৌঁছেছে।

একদম ছোটবেলায় প্রিয়ঙ্কর বাবা-মা দুজনকেই হারায়, যা কিছু স্মৃতি সব ফটো অ্যালবামে আটকে রয়েছে। সে জেঠা-জেঠিমার কাছে মানুষ। আরেকজন মানুষ আছেন যে তার খুব প্রিয়, তিনি হলেন ওর ঠাকুমা। যার কারণে এই গ্রামের বাড়ি তার কাছে আরও আকর্ষণীয়, আরও আপন। জ্যেঠু-জ্যেঠিমা তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, দাদা আর বোন তার বেস্ট ফ্রেন্ড, তবুও ঠাকুমার স্থান তার বুকে। যখন সে বাড়ি আসে তার একসপ্তাহ আগে থেকে ঠাকুমা তার পছন্দের খাবারের জোগাড়ে লেগে যায়। আর সবথেকে ভালো লাগে রাত্রে ঠাকুমার পাশে শুয়ে গল্প শুনতে, না-না.. রাক্ষস-খোক্কস, রাজা-রানী বা ব্যাঙ্গমা- ব্যাঙ্গমীর গল্প নয়, সে তার বাবা-মায়ের গল্প শোনে। গল্প করতে করতে ঠাকুমার দুচোখে জলধারা বয়ে যায়, প্রিয়ঙ্করেরও খুব কান্না পায় কিন্তু বাবামায়ের গল্প শোনার আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত হতে চায়না। জ্যেঠামশাই স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক, জেঠিমা গৃহবধূ। বোন নীলি জ্যেঠামশাইয়ের স্কুলেই ক্লাস নাইনে পড়ে, আর দাদা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে এম এ করছে।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা তিনজন গ্রাম দেখতে বেরোলো। গ্রামের বাড়িতে এলে নীলি দাদার পিছু ছাড়েনা। গ্রামটি বেশ বর্ধিষ্ণু, দক্ষিণে দুলে পাড়া পেরিয়ে ধু ধু মাঠ, মাঠের মাঝখানে গ্রামের একমাত্র শ্মশান। একটা বড় অশ্বত্থ গাছ তার বিরাট গুঁড়ি আর অজস্র শাখা-প্রশাখা নিয়ে শ্মশান এলাকাটি ঘিরে রয়েছে। দিনের বেলাতেই জায়গাটি কেমন নিঝুম আর অন্ধকার। ওরা শ্মশান পেরিয়ে আলপথ ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল। হঠাৎ ভোজবাজির মত এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা পোড়ো বাড়ি দেখা দিল। দীপ্য জানলো এটা এককালে জমিদার বাড়ি ছিল, এখন আর কেউ বাস করেনা। শরীকেরা অনেকে মারা গেছে, আর যারা বেঁচে আছে তারা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গত পঞ্চাশ বছরে এবাড়ির চৌকাঠ কেউমাড়ায়নি। বেশ কিছু বছর ধরে কাজের লোক মধুদা বাড়ি আগলে পড়ে ছিল, সেও বছর কুড়ি আগে মারা গেছে। সেই থেকে এবাড়ি ভূতের বাড়ি হয়ে গেছে।

শ্মশান পেরোনোর পর থেকেই দীপ্য খেয়াল করেছে নীলি বারবার প্রিয়ঙ্করকে এদিকে আসতে বারণ করছিল। সূর্য ডুবে গেছে, গ্রাম বলে গোধূলির আলোয় এখনও সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দীপ্য দেখলো জমিদার বাড়ির অধিকাংশটাই ভেঙে পড়েছে। সামনের বিশাল বিশাল থামগুলোর মধ্যে দুয়েকটা দাঁড়িয়ে থাকলেও, মাথার দিক থেকে ভেঙে পড়েছে। গোটা বাড়ি, দেওয়াল, ছাদ জংলী গাছপালায় ভরে গেছে। ঢোকার পথ এমনভাবে গাছপালায় আটকে গেছে যে একটা বিড়াল ঢুকতে গিয়েও বাধা পাবে। হঠাৎ প্রিয়ঙ্কর বলে উঠল, “জানিস দীপ্য এবাড়িতে ভূত আছে !” দীপ্য হো হো করে হেঁসে ওঠার আগেই প্রিয়ঙ্কর আবার বলে উঠল, “নীলির আবার ভূতে খুব ভয়। তুই আছিস বলেই ও এসেছে। তানাহলে...”৷ নীলি প্রিয়ঙ্করের পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলল, “আহা কি আমার বীরপুরুষ রে !”  দীপ্য দেখল নীলির মুখ-চোখ সত্যিই শুকনো হয়ে গেছে। দাদাকে কিল মারলেও বাঁ হাত দিয়ে দাদার শার্ট আঁকড়ে ধরে আছে। প্রিয়ঙ্কর চোখ নাচিয়ে বলে, কি ব্রেভহার্ট ! মনে মনে কিছু প্ল্যান ভাঁজছো নাকি ! দীপ্য কিছু একটা বলতে গিয়েও নীলির মুখ দেখে চুপ করে গেল। এবার সত্যিই চারপাশ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। অনেকটা পথ

পেরিয়ে এসেছে, তাই কথা না বাড়িয়ে ওরা বাড়ির দিকে ফিরে চলল।

এখানে কয়েকটা দিন পাখির ডানায় ভর করে কেটে গেল। প্রিয়ঙ্করের জেঠা-জেঠিমা, বিশেষ করে ঠাকুমার আদর যত্নে দীপ্য অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। ক্ষেতের সব্জি, বাড়ির গরুর দুধ, ফল-পাকড় খেয়ে দীপ্যর তো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তবে সবকিছুর মধ্যেও দীপ্য জমিদার বাড়ির প্রতি একটা টান অনুভব করছে। এখানে আসার পর থেকেই অনেক আজব আজব কথা শুনেছে। সন্ধ্যের পর অনেকেই ওই বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখেছে, বিভিন্ন অপার্থিব শব্দও নাকি শোনা যায়। কেউ কেউ অস্বাভাবিক কিছু দৃশ্যও দেখেছে। এখানকার লোকেদের বিশ্বাস অমাবস্যা আর পূর্ণিমার রাত্রে ওই বাড়ির পুরোনো অধিবাসীরা জীবন্ত হয়ে ওঠে। দীপ্য যত শুনেছে ততই তার আকর্ষণ বেড়ে গেছে। এমনিতে সে খুব ডাকাবুকো ছেলে, ভুত-প্রেতে তার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। বিজ্ঞান নিয়ে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, আর বিজ্ঞান বলে প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব মেনে নেওয়া ভীরুতার লক্ষণ। প্রিয়ঙ্করেরও বিশ্বাস ওই বাড়িতে কিছু একটা আছে। সন্ধ্যে হওয়ার পর গ্রামের মানুষজন শ্মশান পেরিয়ে পারতপক্ষে ওদিক মাড়ায় না। দীপ্যর প্রবল ইচ্ছা পূর্ণিমা বা অমাবস্যার রাত্রে ওই বাড়িতে সরেজমিনে যাওয়া।

ঠাকুমার কাছ থেকে জানা গেছে আগামী পরশু রবিবার অমাবস্যা। এরমধ্যে বহু কষ্টে প্রিয়ঙ্কর আর নীলিকে রাজি করিয়েছে৷ তড়িঘড়ি কয়েকটা জিনিস জোগাড় করে ফেলল-একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ, হ্যারিকেন, কেরোসিন, দড়ি, একটা মাদুর, কয়েকটা লাঠি, একটা থার্মো ফ্লাস্ক, ছুরি, কয়েকটা খবরের কাগজ, মোমবাতি, দেশলাই ইত্যাদি। তাদের অভিযান শুরু হল রোববার রাত পৌনে বারোটায়। দীপ্য আর প্রিয়ঙ্কর এক ঘরে শোয়, তাদের কোনও অসুবিধা হলোনা কিন্তু নীলি শোয় ঠাকুমার ঘরে। তবে কদিন সে গরমের অজুহাতে দোতলার একটা ঘরে একলা শুচ্ছে। এ বাড়িতে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, তাই তাদের বেরোতে সমস্যা হলোনা।

বাইরে আলকাতরা অন্ধকার, তারা নিজেদেরকেও দেখতে পাচ্ছেনা। তবে যাই হোক, শ্মশান পর্যন্ত আলো জ্বালা চলবে না। কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে কে বলতে পারে৷ নিজেদের হাত ধরে অন্ধকারে ঠোক্কর খেতে খেতে আলপথ ধরে এগিয়ে চললো। নীলি শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছে এই অভিযান বন্ধ করার। এখন দীপ্য অনুভব করছে তাকে ধরে থাকা নীলির হাতটা উত্তেজনা আর ভয়ে কাঁপছে। আন্দাজে বুঝলো তারা শ্মশানের কাছে পৌঁছে গেছে, বাঁদিকে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকারের মধ্যে আরেকটা জমাট অন্ধকার বন্য জন্তুর মতো ওত পেতে বসে আছে। বুঝলো এ সেই অশ্বত্থ গাছটার কারসাজি। যতটা পারলো ত্বরিত পায়ে তারা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চললো। হঠাৎ করে দীপ্যর হাতে টান পড়লো। প্রিয়ঙ্কর দাঁড়িয়ে গেছে, ফিসফিস করে বললো, “একটা আলো, বাড়ির দোতলায় একটা আলো দেখলাম”। দীপ্য পায়ের নিচে রাস্তা নিয়েই এত ব্যস্ত ছিল যে অন্য কোনোদিকে তাকানোর ফুরসত পায়নি৷ প্রিয়ঙ্করের কথা শুনে নীলি প্রায় কেঁদে ফেলল, “দীপ্যদা প্লিজ ফিরে চলো, আমার খুব ভয় করছে। মন বলছে ও বাড়িতে গেলে আমাদের বিপদ হবে”। দীপ্য ওদের ভয়কে পাত্তা দিলোনা। সে এত সহজে হার মানার ছেলে নয়, সে বলে উঠলো, “আরে ওটা চোখের ভুল। ভয় পেলে এমন ইল্যুশন হয়। ওই পোড়ো বাড়িতে আলো জ্বালাবে কে! আর ভূত নিজেই আলোকে ভয় পায়। ভুত কখনও আলো জ্বালাবেনা”। প্রিয়ঙ্কর বলে ওঠে, “কিন্তু ভুত না হয়ে যদি কোনো বদমাশ লোকজন থাকে, তাহলে তারা তো আমাদের ক্ষতি করতে পারে!” হ্যাঁ এদিকটাও ভেবে দেখেছি দীপ্য, সে গলায় আরোও জোর এনে বললো, “তাহলে তো আরও গিয়ে দেখতে হয় ওখানে কি চলছে”৷ প্রিয়ঙ্কর আর কোনও কথা বললোনা। বাড়ির সামনে এসে ওরা হ্যারিকেনটা জ্বালালো, হঠাৎ করে শ্মশানের দিক থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে এলো। একটা ঠান্ডা হাওয়া আসছে শ্মশানের দিক থেকে।  একটা শিরশিরানি অনুভূতি খেলে গেল নিকষ অন্ধকার জুড়ে। দীপ্য ব্যাগ থেকে ছুরিটা বের করলো, ঢোকার মুখে যেভাবে আগাছা হয়ে আছে, কতকগুলো আগাছাকে কেটে সাফ না করলে ভেতরে ঢোকা যাবেনা।

ভিতরে ঢুকেই ওরা বুঝতে পারলো দীর্ঘদিন এ বাড়ির অন্দরে কেউ পা দেয়নি। মেঝেতে কয়েক ইঞ্চি পুরু ধুলো, দেওয়াল জুড়ে মাকড়শার জাল তাদের হাতে মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে। দীপ্য টর্চের আলো ফেলে বুঝলো এটা একটা বড় দালান। পিছন দিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি৷ ছাদের দিকে তাকাতে চোখে পড়লো বেশ কয়েকটা বাদুর উল্টোমুখে ঝুলে আছে। দীপ্যর প্ল্যান হল, কোনো একটা মন্দের ভালো ঘর বেছে নিয়ে রাত্রিটা কাটানো। তবে অবশ্যই ভোর ভোর ফিরে যেতে হবে। তার মাঝের সময়টিতে যদি ভূতেদের সাথে একটু আলাপ-সাক্ষাৎ হয়, ক্ষতি কি? নিচে সুবিধা হলোনা, তাই ওরা স্থির করলো দোতলায় উঠবে। সিঁড়িটা নোংরা হলেও অক্ষত। কয়েকটা সিঁড়ি টপকেছে এমন সময় এক অপার্থিব আওয়াজে তিনজনই কেঁপে উঠলো। হ্যারিকেনটা ছিল প্রিয়ঙ্করের হাতে। ভয় পেয়ে এমন চমকে উঠলো যে তার হাত থেকে হ্যারিকেন পড়ে গেল। সিঁড়িতে ড্রপ খেতে খেতে মেঝেয় পড়ে থামল। কাঁচ ভেঙে চুরমার, শিখাটা দপ দপ করতে করতে নিভে গেল। তিনটে ছেলেমেয়েকে ঘিরে এই প্রাচীন প্রেতপুরী এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে ডুবে গেল। দীপ্য টর্চ জ্বালাতেও ভুলে গেল।

আওয়াজটা এসেছে ওপর থেকে। কিন্তু কিসের আওয়াজ বোঝা গেলনা। একবার হয়েই আওয়াজটা থেমে গেছে, এক গম্ভীর স্তব্ধতা ফিরে এসেছে গোটা প্রাসাদ জুড়ে। দীপ্য টর্চ জ্বেলে আবার সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। এবার দুদিক থেকে দুটো হাত এসে তার পরনের শার্ট টেনে ধরলো। প্রিয়ঙ্কর আর নীলি দুজনেই ওই ভয়ংকর আওয়াজের পর কোনো মতেই ওপরে উঠতে রাজি নয়। দীপ্য বলল, “তাহলে তোরা থাক, আমি দেখে আসছি”। একথা শুনে ওরা আরও জোরে দীপ্যকে আঁকড়ে ধরলো। দীপ্যর জেদের কাছে হার মেনে বাধ্য হয়ে ওরা ওপরে উঠতে লাগলো। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে বাঁক নিয়ে ওরা যখন প্রায় দোতলায় উঠে পড়েছে তখন এক ভীষণ আওয়াজে গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠলো। মনে হলো যেন কোনো এক মহাদৈত্য দুহাত দিয়ে বাড়িটা ধরে ঝাঁকানি দিচ্ছে। ওরা টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়িতে পড়ে গেল। কাঁপুনি থামতে দৌড়ে নিচে নেমে দেখল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। দোতলার একটা অংশ ভেঙে ঢোকার দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। নীলি উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো। প্রিয়ঙ্করের আর্তস্বর, “এ ভুতের কাজ, বলেছিলাম না যে বাড়িতে ভূত আছে। দ্যাখ কেমন ওরা এবাড়িতে আমাদের আটকে দিল। আমরা আর বাড়ি ফিরতে পারবো না। দীপ্য, সব কিছু তোর জেদের জন্য হল। এবার কি হবে!” সত্যি কথা বলতে কি দীপ্যও একটু ভড়কে গেছে। ঠিক ভয় নয়, তবে এরকম সঙ্গী নিয়ে অভিযানে এলে ভরসা যোগানোর বদলে প্রতি মুহূর্তে আত্মবিশ্বাস কমে যাবে। কয়েক মুহূর্ত কি ভেবে আবার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলো। ওপরের অবস্থা মন্দের ভালো। যদিও অধিকাংশ ঘরেই দরজা নেই, তার মধ্যে একটা ঘরে দরজায় শিকল লাগানো। প্রিয়ঙ্কর বললো, এই ঘরটায় মনে হয় হরি কাকা থাকতো।  বাড়িটার চারপাশে প্রচুর গাছপালা। তাই নিচের গেট বন্ধ হয়ে গেলেও বাইরে বেরোনো আটকাবেনা। এবার ওরা হরিকাকার ঘরের শিকলি খুলে ভেতরে ঢুকলো। ঘরটা অন্য ঘরগুলোর তুলনায় পরিচ্ছন্ন। খুঁজে পেতে ঘরের কোণে একটা ঝাঁটাও পাওয়া গেল। ঘর পরিষ্কার করে মাদুরটা মেঝেতে পাতলো। এঘরে ঢুকে প্রিয়ঙ্কর আর নীলির ভয় কিছুটা কমেছে। নীলি কাঁপা কাঁপা হাতে মোমবাতি জ্বালালো। দীপ্য আয়েশ করে মাদুরে বসে বললো, চল এককাপ করে কফি খাওয়া যাক। নীলি শুধু কফি নয়, বাড়ির লোকেদের নজর এড়িয়ে কয়েকটা স্যান্ডউইচও বানিয়ে  এনেছে। কফিতে চুমুক দিয়েছে কি দেয়নি একটা জোলো হাওয়া ঘরে ঢুকে ওদের কাঁপিয়ে দিল, আর মোমবাতিটা দপ্ করে নিভে গেল। ঘরে ঢুকে দীপ্য টর্চটা কোথায় রেখেছে খুঁজে পেলোনা। এরকম বীভৎস অন্ধকার তারা জীবনে কখনও দেখেনি। তিনজনই অন্ধকারে টর্চ হাতড়াতে লাগলো। এমন সময় তিনজনেরই চোখ খোলা দরজায় আটকে গেলো। নিকষ অন্ধকার ফুঁড়ে দুটো ভয়ানক দুটো লাল চোখ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ব্যাপারটা এতটাই ভয়াবহ এবং আকস্মিক যে তিনজনে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। গোটা ঘরে দমবন্ধ একটা অখন্ড স্তব্ধতা। সেই রক্ত রাঙা চোখ অন্ধকারের সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তাদের থেকে কয়েক ফুট দূরে এসে থামলো। এবার ডানদিকে থেকে একটা আওয়াজ কানে এল...ভূ ভূ ভূ......., প্রিয়ঙ্করের কথা আটকে গেছে, ভয়ে 'ভূ' ছাড়িয়ে 'ত'-য়ে পৌঁছতে পারছেনা। ভয় দীপ্যও যথেষ্ট পেয়েছে, তবে প্রাণপন চেষ্টা করছে যাতে বুদ্ধিলোপ না ঘটে। এই মুহূর্তে কি করা উচিত ভাবতে চেষ্টা করতেই বাঁদিক থেকে একটা ধপ করে আওয়াজ পেলো। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে বুঝলো, নীলি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আর কিছু না ভেবে উঠে দাঁড়ালো দীপ্য, ওই আগুন গোলা চোখগুলোর দিকে কয়েক পা এগোতেই তার পায়ে লেগে টর্চটা মেঝেতে গড়িয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে টর্চটা তুলে উঠে দাঁড়াতেই দেখলো সামনের চোখগুলো গায়েব হয়ে গেছে। টর্চ জ্বেলে আগে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে নীলির জ্ঞান ফেরালো। হাতে-পায়ে লেগে সবার কফির কাপই উল্টে গেছে। দীপ্য আবার মোমবাতি জ্বালালো, দরজাটা বন্ধ করলো। এখন দেখলো দরজার ভিতরে একটা খিলও আছে, খিল লাগিয়ে ভিতরে এসে নীলিকে গরম কফি খেতে দিলো, নিজেরাও খেল। নীলি যখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে ঠিক তখনি ছাদে একটা আওয়াজ শুরু হল, মনে হলো কে যেন ভারী একটা কিছু ছাদের এপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার একটা হুড়মুড় আওয়াজ, এবার আরও জোরে ঘরটা কেঁপে উঠলো, আর তার সাথে শুরু হলো বাসন পড়ার ঝন্ ঝন্ আওয়াজ। বাড়ির মধ্যে যেন শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তার সাথে একটা জান্তব গর্জন শুরু হয়েছে। কে যেন তাদের এই অনুপ্রবেশে সাঙ্ঘাতিক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। নিরন্তর কাঁপুনি, গর্জন, থালাবাসনের আওয়াজ…. কোনো এক অপশক্তি যেন তিনটে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েকে নিশি ডাকে ভুলিয়ে এই মৃত্যুপুরীতে টেনে এনে কয়েদ করে রেখেছে। এখান থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। কিছুক্ষণ পর কম্পন কমলো, কিন্তু মোমবাতিটা আবার নিভে গেল। আর সেই পৈশাচিক অন্ধকারের মধ্যে তারা শুনতে পেল বন্ধ দরজায়, টক টক টক টক শব্দ। ভীষণ ভয় পেয়ে অন্ধকারের মধ্যে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। এই নির্জন পুরীতে দরজায় টোকা মারছে কে! ভূত কি টোকা মেরে ঘরে ঢোকে? বাইরে তুমুল ঝড় শুরু হয়েছে.... একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ যেন পরজন্ম থেকে ভেসে আসছে। এদিকে দরজায় আওয়াজ বেড়েই চলেছে। বাইরে যে আছে সে যেন ধৈর্য হারিয়ে প্রাণপনে আওয়াজ করে চলেছে। দরজা না খুললে এবার দরজা ভেঙেই ঘরে ঢুকে পড়বে।

প্রচন্ড আওয়াজে বাজ পড়ল। রুপোলি আলো ছিটকে এই শতাব্দী প্রাচীন কোঠাবাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এভাবে তো গলা ভর্তি আতঙ্ক নিয়ে অনন্ত প্রহর অপেক্ষা করা চলে না... নীলির গলা পাওয়া গেল, “এই ভোর রাত্রে নির্জন পুরীতে কে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে !” কারোর কাছে কোনও উত্তর নেই। প্রিয়ঙ্করের মাথা এবাড়িতে ঢোকার আগে থেকেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, এখন দীপ্যরও সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সে চেষ্টা করতে লাগলো মোমবাতিটা আবার জ্বালাতে। কিন্তু ভিজে হাওয়ায় বারুদ নরম হয়ে গেছে, অনেকগুলো কাঠি নষ্ট করেও আলো জ্বললো না। এর মধ্যে দরজায় ধাক্কাটা মুহুর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি৷ টর্চটা জ্বেলে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকেই দুজনে আতঙ্কে চিৎকার করে বারণ করতে লাগলো। দীপ্য কিছু না বলে এগিয়ে গেল। দরজার খিলে হাত দিয়ে পিছন ফিরে বললো, “ভয়ের কিছু থাকলেও তাকে সামনাসামনি মোকাবিলা করতে হবে, তা না করে অন্ধকারে বদ্ধ ঘরে দমবন্ধ করে বসে থাকবো !”। এই বলে দরজা খুলে ফেললো। খোলার সাথে সাথে বাইরের প্রবল ঝড় ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিমেষের মধ্যে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিল। ঝড়ের সাথে ধুলো চোখে-মুখে ঢুকে গেল। ঘরের জিনিসপত্র পাগলা হাওয়ার ঘূর্ণিস্রোতে ঘরময় উড়ে বেড়াতে লাগলো। বহু চেষ্টা করেও সেই দস্যু হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে পারলোনা দীপ্য। ঘরের ভিতর অন্ধকারে প্রিয়ঙ্কর আর নীলির আর্ত চিৎকার ক্রুদ্ধ হাওয়ার সাথে মিশ দেওয়ালে দেওয়ালে মাথা কুটতে লাগলো। হাওয়ার সাথে কুস্তি লড়তে লড়তে দীপ্য পড়ে গেল। ঠিক সেইসময় সব শব্দকে ছাপিয়ে এই বাড়ির কোনো ঘর থেকে একটি বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। পড়ে গিয়ে দীপ্যর কনুইয়ে চোট লেগেছে, এখন চোট ভুলে সে খোলা দরজার বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে ৰকান্নার উৎস খুঁজতে লাগলো। অদ্ভুত! এ বাড়িতে কি তাহলে মানুষ থাকে? তানাহলে বাচ্ছা আসবে কোথা থেকে! নীলি আর প্রিয়ঙ্করের আর্ত চিৎকার থেমে গেছে। দীপ্য কষ্ট করে উঠে পড়ল, ঘরের মাঝে ওরা দুজন একটা অন্ধকার পিন্ড হয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, নড়াচড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। দীপ্য ওদের কাছে এসে বলল, “তোরা শুনলি, বাচ্ছার গলা ! চল দেখে আসি। বলা তো যায়না, কেউ হয়তো বিপদে পড়েছে”৷ থরথর করে কেঁপে উঠল অন্ধকার পিন্ডটা। এখন তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে, দীপ্যর পাগলামিতে সাড়া দিয়ে কি ভুল করেছে। তবে দীপ্যকে ছাড়া এঘরে অন্ধকারে বসে থাকার কথা ভাবতেই দুজনে আতঙ্কে হিম হয়ে উঠল। দুজনে দীপ্যর দুটো হাত ধরে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে টর্চের আলোয় কিছু চোখে পড়লোনা, ঝড়ের দাপটে যত রাজ্যের নোংরা এসে সারা মেঝে ভরিয়ে তুলেছে। দোতলাতেও সারি সারি ঘর, ওরা এগিয়ে চললো৷ বাঁদিকের ঘরগুলোতে বাইরে থেকে টর্চের আলো ফেলে কিছু দেখতে পেলোনা। হঠাৎ পিছনে ধড়াম করে একটা আওয়াজ হলো, তাকিয়ে দেখল হরিকাকার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল ওদের অগোচরে কেউ ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। দীপ্য দৌড়ে গেল, দরজায় ধাক্কা দিয়ে বুঝলো ভিতর থেকে কেউ ছিটকিনি আটকে দিয়েছে। নীলি আর প্রিয়ঙ্কর পিছন পিছন এসেছে। নীলি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “দীপ্যদা, প্লিজ এবাড়ি থেকে পালিয়ে চলো, এখনও সময় আছে। এরপর বড় ধরনের বিপদ হলে, বাড়ির লোক আস্ত রাখবে না”। দীপ্য বললো, “ঘরের ভিতর আমাদের জিনিসপত্র আছে, ফেলে চলে যাবো ?”

 প্রিয়ঙ্কর বলে উঠলো, “ছাড় তোর জিনিসপত্র, এখন প্রাণটা নিয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারলে বাঁচি”। দীপ্য কঠিন গলায় বললো, “না আমি এর শেষ না দেখে এখান থেকে যাবোনা”। প্রিয়ঙ্কর রেগেমেগে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই প্রচন্ড শব্দে একটা বাজ পড়লো, আর তিনটি বালক-বালিকাকে আরোও আতঙ্কিত করে সেই রক্ত লাল রঙা চোখ দুটো ছাদের সিঁড়ি বেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো৷ নীলির ভয়ার্ত চিৎকার বজ্রপাতের আওয়াজ ছাড়িয়ে সেই কাল নিশি খানখান করে তুললো। নীলি এতক্ষন প্রিয়ঙ্করের পাশেই ছিল, হঠাৎ কেউ একজন নীলিকে টেনে হিঁচড়ে অন্ধকারের কালগহ্বরের দিকে টেনে নিয়ে গেল। প্রিয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠলো, “নীলি...ই...ই..ই…”৷ বহুদূর থেকে নীলির 'দাদা...দাদা' ডাক ভগ্নপ্রেত প্রাসাদের আরোও ভয়ান্ধ আবর্তে পাক খেতে খেতে কোন সুদূরে হারিয়ে গেল। দীপ্য বুঝে উঠতে পারলোনা কি করবে! এই অন্ধকারে, এই অচেনা পোড়ো বাড়ির কোথায় কি কিছুই তারা জানেনা, কিভাবে কার পিছনে দৌড়োবে ! এদিকে বন্ধ দরজার ভিতরে কে আছে তারও কোনো সমাধান হলোনা৷ কিন্তু নীলির কি হলো সেটা আগে দেখা দরকার। সে কিছু করার আগেই, দীপ্য ‘বোন বোন’ বলে চিৎকার করতে করতে কোনোদিকে না তাকিয়ে পাগলের মতো অন্ধকারের বুকে ঝাঁপ দিলো। দীপ্য আর সময় নষ্ট না করে প্রিয়ঙ্করের পিছনে দৌড়োলো। সামনে কি আছে, কিচ্ছু জানেনা, যেকোনো মুহূর্তে কোনো কিছুতে ধাক্কা লেগে হাত, পা, এমনকি মাথাতেও চোট লাগতে পারে। কিন্তু এসব ভাবার এখন সময় নেই। সামনে প্রিয়ঙ্করের পায়ের আওয়াজ শুনে চোখ বন্ধ করে দৌড় লাগালো। কিছুক্ষণ পর প্রিয়ঙ্করকে হারিয়ে ফেলল, বুঝলো একদম বাড়ির পিছনের দিকে চলে এসেছে। বাইরে থেকে যেটুকু আবছা আলো আসছে সে একটা বড় হলে দাঁড়িয়ে আছে, যার মাথার একদিক ধসে পড়ে কালো আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘঢাকা আকাশে একটা তারাও চোখে পড়লোনা। হঠাৎ করে পায়ের তলা কাঁপতে শুরু করলো, দীপ্য ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সে চিৎকার করে, প্রিয়, নীলি-র নাম ধরে ডাকতে ডাকতে হলঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মুহূর্তের মধ্যে গগনবিদারী আওয়াজ তুলে হলঘরের ছাদ- মেঝে ধসে পড়লো। দীপ্য কোনো দিকে না তাকিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল প্রাণপণে দৌড়তে লাগলো, আর চিৎকার করে প্রিয়ঙ্কর আর নীলির নাম ধরে ডাকতে লাগলো। এমন সময় অন্ধকারে কারোর সঙ্গে প্রচন্ড ধাক্কা লেগে নোংরার মধ্যে ছিটকে পড়লো। যার সঙ্গে ধাক্কা লাগলো সেও ভয় পেয়ে উল্টো দিকে দৌড় দিল। বেশ ভয় পেয়ে গেলেও দীপ্য বুদ্ধি হারালো না। সে বুঝলো এ বাড়িতে কেউ বা কারা আছে। যার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে, সে নীলি বা প্রিয়ঙ্কর নয়। সে চটপট উঠে পায়ের আওয়াজ অনুসরণ করে পিছু ধাওয়া করল। অন্ধকারে বুঝলো, আগেরজন থেমে পড়েছে, সে ও বুঝে নিতে চাইছে পিছনে কেউ আসছে কিনা ! দীপ্য চিৎকার করে বললো, “কে আছো এই বাড়িতে ! আমরা এখানে আটকে পড়েছি। আমার সঙ্গী দুজনকে খুঁজে পাচ্ছিনা”। তার আওয়াজ শুনে সামনের জন আবার দৌড়তে শুরু করলো। দীপ্যও গতি বাড়ালো। এদিকটার ছাদ ধসে পড়েছে। আবছা আলো এসে পড়েছে ভিতরে। আবছায়ায় দীপ্য দেখলো কালো একটা চেহারা বাঁক নিয়ে করিডোরের ওপাশে হারিয়ে গেল। দীপ্য প্রাণপনে পৌঁছতে চাইল, এদিক দিয়েও ছাদে যাওয়ার একটা সিঁড়ি উঠে গেছে।

স্কুলে একশো মিটার স্প্রিন্টে গত চারবছর তাকে কেউ হারাতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে সিঁড়ির মুখে পৌঁছে গেল। সমস্ত ঘটনা ঘটতে লাগলো ঘন অন্ধকারের মধ্যে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা, কি করছে বুঝতে পারছেনা। সে ওই অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলো। এমন সময় ছাদের ওপরে পায়ের আওয়াজ পেলো, শিকারকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার ছেলে সে নয়। অন্যদের চিন্তা সাময়িক মুলতুবি রেখে ওই অন্ধকারের মধ্যে দুটো তিনটে করে সিঁড়ি টপকে উঠতে লাগলো, যদিও কোথায় যাচ্ছে সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা, ছাদের মুখে যখন প্রায় পৌঁছে গেছে, তখন কপালে একটা প্রচন্ড আঘাত লাগলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।

হঠাৎ করে চারপাশের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পৃথিবীতে আলো বলে কোনো বস্তু আছে সেটা যেন ভুলতে বসেছিল। এখন সে কোথায় সেটাও বুঝে উঠতে পারলোনা। আলোটা সয়ে যেতে আস্তে আস্তে আশপাশ পরিষ্কার হল। অনেকগুলো আবছা রেখার আঁকিবুকি তার দৃষ্টি জুড়ে ছুটে বেড়াতে লাগলো। আস্তে আস্তে ভাসতে থাকা রেখাগুলো একে ওপরের সাথে জুড়ে কয়েকটা মুখের আদল পেলো, তার বিছানার পাশে উদগ্রীব মুখে বসে আছে প্রিয়ঙ্করের জেঠু-ঠাকুমা-জেঠিমা, এমনকি তাদের পাশে প্রিয়ঙ্কর আর নীলিকেও শুকনো মুখে বসে থাকতে দেখলো। আর বিছানার ডানপাশে গম্ভীরমুখে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, যাকে দীপ্য চেনেনা, তবে গলায় স্টেথোস্কোপ দেখে পরিচয়টা বুঝতে পারলো।

ট্রেন ছেড়েছে বহুক্ষণ। প্রিয়ঙ্কর নীলি আর মায়াঙ্কদা তাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল। কটাদিন খুব আনন্দে কাটলো। বাড়ি ফিরে আবার সেই কয়েদি জীবন। মজাও কিছু কম হলোনা তালদীঘিতে। সুস্থ হওয়ার পর একচোট বকুনি জুটেছিল জ্যেঠুর কাছ থেকে, তবে বেশি বকুনি খেয়েছে প্রিয়ঙ্কর আর নীলি। আর সমস্ত বকুনিকে ছাপিয়ে মজা আর তাদের বোকামি নিয়ে বাড়ি এমনকি পাড়াও কদিন সরগরম ছিল। তাদের অভিযানের রাত্রে এই অঞ্চলে বেশ কয়েকবার মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। যারা পোক্ত, কোঠা বাড়িতে ছিল তারা ঘুমের মধ্যে সেভাবে টের পায়নি। কিন্তু ওই ধসে পড়া জমিদার বাড়ি সেই কম্পনে থরথর করে কেঁপেছে। আর ওই পোড়ো বাড়িতে প্রচুর ভামবিড়াল আর হনুমানের উৎপাত। এবার আপনারা বাকিটা ভেবে নিন। কদিন সবাই মিলে যা মজা করেছে, লজ্জায় একদম মাথা হেঁট। আপনারা আর অনুগ্রহ করে দীপ্যর লজ্জা বাড়াবেননা। আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, দীপ্য এখন রীতিমতো একজন জেন্টলম্যান। সে সেন্ট জনস্ স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে আর গত চার বছর একশো মিটার স্প্রিন্টে স্কুল চ্যাম্পিয়ন।

 

ডঃ গৌতম সরকার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত     

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top