সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

গোয়েন্দা অপ্সরা ও ধাঁধাল পত্র (পর্ব পাঁচ) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২১ ১৯:৫৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৮:৫৫

 

অপ্সরা সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল তার ডান হাতের বেগুনি ব্রেসলেটের দিকে; এটি তার জন্য অসম্ভব আত্মবিশ্বাসের উৎস। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠল-আলিম সাহেবের স্মৃতিবিজড়িত বই এবং জ্যাকলিনের দেওয়া ফর্মুলার সমন্বয়েই করা যাবে রহস্যভেদ। চিঠিটি একপাশে খুলে রাখল অপ্সরা। তাতে লেখা:

৩০     ১১      ০৩     ০৪
০৬     ৩০     ০৭     ০২
৫৬     ২৪     ০৬     ০৫
৭১     ০৩     ০৫     ০১

অপ্সরা ‘কপালকুণ্ডলা’ বইটির জন্য সংখ্যাগুলোকে এভাবে ধরে নিয়ে এগোতে চায়, প্রতিটি লাইনের-

- প্রথম সংখ্যা: বইটির কততম পৃষ্ঠা, তা নির্দেশ করে
- দ্বিতীয় সংখ্যা: ওই পৃষ্ঠার কততম বাক্য, তা নির্দেশ করে
- তৃতীয় সংখ্যা: ওই বাক্যের কততম শব্দ, তা নির্দেশ করে
- চতুর্থ সংখ্যা: ওই শব্দের কততম বর্ণ, তা নির্দেশ করে

চিঠির সংখ্যাগুলোর ক্ষেত্রে এই সূত্র প্রয়োগ করে প্রথমে কী বেরিয়ে আসে, তা দেখতে চায় অপ্সরা। প্রথম লাইনে লেখা ৩০-১১-০৩-০৪। অপ্সরা কপালকুণ্ডলা বইয়ের ৩০ নম্বর পৃষ্ঠার ১১তম বাক্যের তিন নম্বর শব্দটি খুঁজে পেল ‘নবকুমার’; যার চতুর্থ বর্ণ ‘মা’। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অপ্সরা। ‘মা’ আসায় অপ্সরার মন বলছে, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে। মা-কে নিয়ে হয়তো আলিম সাহেব ও মিথির জীবনে কোনো স্মৃতি আছে।

দ্বিতীয় লাইনে লেখা ০৬-৩০-০৭-০২। কপালকুণ্ডলা বইয়ের ০৬ নম্বর পৃষ্ঠার ৩০তম বাক্যের সাত নম্বর শব্দ ‘বিলাপ’; শব্দটির দ্বিতীয় বর্ণ ‘লা’। চিন্তার মৃদু রেখা দেখা দিল অপ্সরার কপালে। মা এবং লা একসঙ্গে হয় ‘মালা’। এক্ষেত্রে সূত্র একদমই অন্য পথে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো মালা, হতে পারে পুঁতির মালা বা মূল্যবান পাথরের মালা এমনকি ডায়মণ্ডের মালা নিয়ে কোনো ঘটনা বোঝানো হচ্ছে! তবে সংখ্যার আরও দুটো লাইন বাকি। লাইন দুটো না ভেঙে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না।

চিঠির তৃতীয় লাইনের সংখ্যাগুলো ৫৬-২৪-০৬-০৫। বঙ্কিমের বইটির ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় চলে গেল অপ্সরা। সেই পৃষ্ঠার ২৪ নম্বর লাইনের ষষ্ঠ শব্দ ‘শোনামাত্রই’। সূত্র অনুসারে এর পঞ্চম বর্ণ নিতে হবে। তাহলে দাঁড়ায় ‘ই’। অর্থাৎ এ পর্যন্ত প্রাপ্ত মা, লা এবং ই নিয়ে পাওয়া যাচ্ছে ‘মালাই’। অর্থ আরও একবার পাল্টে গেছে! মা, মালা, মালাই সম্পূর্ণ আলাদা অর্থ নির্দেশ করে। তাই অপ্সরা দেরি না করে চিঠির চতুর্থ লাইন ডিকোড করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

চিঠির চতুর্থ লাইনে লেখা ৭১-০৩-০৫-০১। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা বইয়ের ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় চলে গেল অপ্সরা। তিন নম্বর লাইনের পঞ্চম শব্দ ‘চারদিকে’। এখান থেকে প্রথম বর্ণ নিলে পাওয়া যায় ‘চা’! অপ্সরা বিস্মিত হয়ে মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘ইউরেকা’। ঠিক তখনই রুমে ঢুকলেন আলিম সাহেব। অপ্সরা আস্তে বললেও তা তার কানে গেল। তিনি হাসিমুখে নিজের চেয়ারে বসলেন।

আলিম সাহেব বললেন, ‘তাহলে রহস্য উদঘাটিত হলো, অপ্সরা হোমস!’
‘শুধু অপ্সরা বললে খুশি হব।’
‘ওঃ, সরি।’
‘ইটস ওকে। ভাইয়া, আপনাদের দুজনের কি মালাই চা নিয়ে কোনো স্মৃতি আছে?’

‘কী বলো! রবীন্দ্র সরোবরে এক মা তার মেয়েকে নিয়ে মালাই চা বিক্রি করে। ওদের কাছ থেকে মালাই চা আমি প্রায়ই খাই। তাছাড়া নীলক্ষেতে তন্ময় উপহার বিতানে গেলে রবীন্দ্র সরোবরে যাওয়া মিস হয় না আমার। আর রবীন্দ্র সরোবরে যাওয়া মানেই মা-মেয়ের সেই মালাই চা! মিথিকে আমি প্রায়ই ওখানকার মালাই চায়ের গল্প করতাম। তাই কয়েক বছর আগে ওখানেই দেখা করার পরিকল্পনা করে মিথি আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে মা-মেয়ের চায়ের দোকানে দুজনে আলাদা কাস্টমার হিসেবে গেছি; সেখানে হঠাৎ দেখা হয়েছে এমনভাবেই কথা শুরু করেছি। তারপর প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে মালাই চা, ফুচকা, চটপটি খেয়েছি। গল্প করেছি। মা একটু রুক্ষ মেজাজের হলেও মেয়েটা বেশ চটপটে।’

‘মেয়েটার নাম কী?’
‘ওর নাম মালা।’
‘বাহ্; সূত্রটা যে তৈরি করেছে, সে তাতে মা, মালা, মালাই, মালাই চা সবই রেখেছে! কমপ্লিট জিনিয়াস।’

‘সত্যি বলতে এ বিষয়টায় আমার বেশ নার্ভাস লাগছে। এত কঠিন ধাঁধা তো হওয়ার কথা না! এসব ধাঁধা মিথির তৈরি না, আমি সেন্ট পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিতে পারি।’

‘সেই গ্যারান্টি আমিও দিতে পারি। হয়তো মিথি আপু আপনাকে ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য কোনো জিনিয়াস ছেলেকে কাজে লাগিয়েছেন! হতে পারে, ওই ছেলেই তন্ময় উপহার বিতানে চিঠি দিয়ে গেছে!’
‘আর বোলো না। এসব ভাবলেই ভালো লাগছে না।’ 
‘ওকে।’
‘অপ্সরা, কিছুক্ষণের মধ্যে লাঞ্চ হয়ে যাবে। তুমি লাঞ্চটা সেরে নাও। আমি রবীন্দ্র সরোবর থেকে ঢুঁ মেরে আসি; দেখি মালাদের কাছে কেউ কোনো চিঠি দিয়ে গেছে কিনা।’

‘প্রশ্নই উঠে না, চিঠি আনতে আমি যাব।’
‘কেন!’
‘আমার কাজ আমি নিজেই করতে পছন্দ করি।’
‘তোমার অনেক বেশি খাটনি হয়ে যাচ্ছে।’
‘কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমি এনজয় করছি। একদম অন্যরকম একটি ঘটনা।’

‘আচ্ছা, আমার একটা কথা অন্তত রাখো। দুপুরের খাবার তৈরি হতে আর পনেরো-বিশ মিনিট লাগবে। এসো, দুজনে মিলে আগে লাঞ্চটা সেরে নিই। তারপর একসঙ্গে রবীন্দ্র সরোবরে যাব। মালার কাছে যদি চিঠি থেকে থাকে, তাহলে ওখানে বসেই পত্রধাঁধার রহস্যভেদ করা যাবে।’

‘এটা ভালো প্ল্যান।’

কিছুক্ষণ পর আলিম সাহেবের বাসার কিশোর ছেলেটি এসে খবর দিল, নিচে খাবার দেওয়া হয়েছে। আলিম সাহেব অপ্সরাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন। ড্রইংরুমের একপাশে ভেতরের দিকে ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুমে ঢুকে অপ্সরা অবাক হয়ে গেল। একেবারে বিয়েবাড়ির মতো আয়োজন! টেবিলে দেওয়া হয়েছে পোলাও, রোস্ট, খাসির রেজালা, ডিমের কারি, সঙ্গে বোরহানি। অপ্সরার সবচেয়ে ভালো লাগল একপাশে সেই পান দেখে। অপ্সরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলিম সাহেব বললেন, ‘কী হলো? হাত ধুয়ে খেতে বসো।’

অপ্সরা বলল, ‘এত আয়োজন কেন, ভাইয়া!’‘এ আর এমন কী।’

অপ্সরা আর কথা বাড়াল না। খাওয়ার সময় আলিম সাহেব একটু পরপর কথা বলতে থাকলেন। কিন্তু অপ্সরা কোনো কথা বলল না; শুধু শুনে গেল। তবে খাওয়ার টেবিলে তিনি ভুলক্রমে একবারও ব্যক্তিগত বিষয়টি নিয়ে কিছু বললেন না। অন্য নানা ঘটনা বললেন। বেশ ভালো সময় কাটল অপ্সরার। তবে সে মিস করছে জ্যাকলিনকে। উত্তরা থেকে এত দূর আসা মেয়েটির জন্য কষ্টকর হয়ে যেত; তাই আজ আর তাকে আসতে বলেনি অপ্সরা। ভোজনপর্ব শেষ করে দিলখুশ পান মুখে পুরে দিল অপ্সরা। আজকে অপ্সরার কাছে পানটি আরও বেশি তৃপ্তিকর লাগল।

আলিম সাহেব ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললেন। অপ্সরাকে নিয়ে রওনা দিলেন ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরের উদ্দেশে। রবীন্দ্র সরোবরে পৌঁছে দেখলেন বেশ ভিড়। কোনো উৎসব চলছে। একপাশে আয়োজন করে মালাই চা বিক্রি করছে মালা ও তার মা। আলিম সাহেব ও অপ্সরা তাদের কাছে যেতেই মা-মেয়ে আলিম সাহেবকে চিনতে পারল। মালা কিশোরী; বেশ চটপটে। প্লাস্টিকের একটি চেয়ার খালি ছিল। কোথা থেকে আরেকটি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এল মালা। অপ্সরা ও আলিম সাহেব বসলেন।

মালার মা বলতে শুরু করল রাজ্যের কথা, ‘স্যার, বেচাবিক্রি তেমুন নাই। সকাল থেইকা পাঁচ শ টাকারও চা বেচতে পারি নাই।’

মহিলার কথার ধরনে অপ্সরা বুঝতে পারল যে আলিম সাহেব মালাই চা খেতে এলেই এই পরিবারটিকে বাড়তি টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। আলিম সাহেব দুই কাপ মালাই চা দিতে বললেন; সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন কেউ কোনো চিঠি দিয়ে গেছে কিনা। মালা বলল, ‘জে স্যার, আপনার জন্য এক পোলায় চিঠি রাইখ্যা গ্যাছে।’

আলিম সাহেব বললেন, ‘কোথায়, দেখি চিঠিটা!’
মালা বলল, ‘চিঠি বাসায় রাইখা দিছি।’
‘কী বলিস! তোর বাসা কোথায়?’
‘দশ মিনিট লাগব। নিয়া আসমু?’
‘যা, তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।’
অপ্সরা বলল, ‘মালা, তোমরা কি অনেক বড় বিল্ডিংয়ে থাকো?’
‘জে ম্যাডাম, সবচাইতে উঁচা বাড়িতে থাকি।’
‘ঠিক আছে, যাও। তাড়াতাড়ি চিঠিটা নিয়ে এসো।’

মালা রওনা দিল। রবীন্দ্র সরোবরের চারপাশে বড় বড় অট্টালিকা ছাড়া কিছু নেই। তাই অপ্সরার বুঝতে বাকি নেই, মালার বাবা কাছাকাছি কোনো বিল্ডিংয়ে কেয়ারটেকার হিসেবে আছে। সেই বিল্ডিংয়ের নিচে এই পরিবারটির থাকার ব্যবস্থা আছে। মালার মা নিজেদের যতটা অসহায় হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছে, ততটা অসহায় তারা না। তাছাড়া মালা বা তার মায়ের পোশাক-আশাক দেখলেও বোঝা যায়, তারা দুঃখে-কষ্টে নেই। মালাই চা বিক্রি তাদের বাড়তি আয়ের উৎস।

অপ্সরা ও আলিম সাহেব মালাই চা খেতে লাগলেন এবং রবীন্দ্র সরোবরের মূল চত্বরে চলমান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে থাকলেন। মালার মা কয়েকবার নিজের অসহায়ত্ব বর্ণনার চেষ্টা করল কিন্তু তাতে অপ্সরা বা আলিম সাহেবের আগ্রহ নেই দেখে চুপ হয়ে গেল। তাছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আওয়াজের কারণে এই পরিবেশে কথা চালানো সহজ ব্যাপার না। আধঘণ্টার মধ্যে মালা চিঠি নিয়ে ফিরল। আলিম সাহেব চিঠি হাতে নিলেন এবং বিদায় নেওয়ার সময় মালার মায়ের হাতে পাঁচ শ টাকার একটি নোট দিলেন। কিন্তু মহিলা এতেও তুষ্ট হলো বলে মনে হলো না।

অদূরে পার্ক করা গাড়িতে উঠে আলিম সাহেব বললেন, ‘চিঠিতে কি লেখা আছে দেখব?’
অপ্সরা জবাব দিল, ‘অবশ্যই।’

চলবে

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top