সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ঋণ : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২১ ২০:১৭

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৪৩

 

“ভাইয়া ওঠ, উঠে পড়, যু্দ্ধ থেমে গেছে..!” ধড়মড় করে উঠে বসল মিরাজ। বোন সোফিয়া ওকে জাগিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে গেল। বাইরে অনেক মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে৷ চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার কাছে গিয়ে দেখল, আব্বু, আম্মু, পাশের বাড়ির হারুন চাচা, বিলকিস চাচী, নানী, আরোও অনেক মানুষ উঠোনে জড়ো হয়েছে। সবাই আনন্দে দুহাত তুলে লাফাচ্ছে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে আর চিৎকার করে বলছে, "যুদ্ধ থেমে গেছে, যুদ্ধ থেমে গেছে!"। মিরাজ কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা, একটা যুদ্ধ যুদ্ধ আওয়াজ কদিনই বড়দের মুখে শুনছিল। ও ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা ভাবেনি, বরঞ্চ নতুন পরিস্থিতিটা খুব উপভোগ করছিল। আব্বু, চাচুরা হঠাৎ কাজে যাওয়া বন্ধ করলো, সবাই কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। কেউ জোরে কথা বলেনা, দরজা জানালা সবসময় বন্ধ রাখে, আর দিনের মধ্যে দশবার সাইরেনের আওয়াজ শুনলেই বাড়ির পিছনে খোঁড়া গর্তের মধ্যে গিয়ে লুকোয়। মিরাজের তো দারুন লাগে! প্রথমে ভেবেছিল ছোট-বড় সবাই মিলে বোধহয় লুকোচুরি খেলা হচ্ছে। পরে শুনেছিল না এটা যুদ্ধের কারণে হচ্ছে। ইহুদীরা নাকি আকাশ থেকে বোমা ছুড়ে তাদের মারতে চাইছে, তাই এই লুকোচুরি। মিরাজ খুব চাইছিল ছাদ থেকে বোমারু বিমানগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, কিন্তু ও বাচ্ছা বলে যখনই হুটার বেজে ওঠে কেউ না কেউ নড়া ধরে গর্তে ঢুকিয়ে দেয়।

মিরাজ এমনিতে লক্ষী ছেলে। ওকে যেখানেই নিয়ে যাওয়া হোকনা কেন ও নিজের মতো একটা জগৎ খুঁজে নিজের মনে থাকে। ট্রেঞ্চে থাকতে থাকতে সেখানেও সে নিজের বলয় তৈরি করে নিয়েছে। তার কাছে এখন সবথেকে মূল্যবান হলো বিশটা মার্বেল। যেটা সে কদিন আগে সাঈদার সাথে খেলে জিতেছে। তবে সবটা খেলে জিতেছে বলা ভুল। আসলে মেয়েটা ছিঁচকাঁদুনে, খেলতেও ছাড়বেনা আবার হেরে গেলেও কেঁদে-কেটে একশা করবে। সেদিন এমনিতেই মিরাজের মনমেজাজ ভালো ছিলনা; পড়া পারেনি বলে সাতসকালে আব্বুর হাতে চড়থাপ্পড় খেয়েছিল, তার ওপর হেরে গিয়েও সাঈদা বারবার হুড়কেপনা করে আবার চাল নিচ্ছিল। যখন মিরাজ প্রায় সব মার্বেল জিতে নিয়েছে, সাঈদার হাতে চারটে মার্বেল আছে তখন এক দানে একসাথে চারটে মার্বেলই জিতে নেওয়ায় সাঈদা সব গুলিগুলো কোর্ট থেকে তুলে নিয়ে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলো। মিয়াজের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো, সে সাঈদাকে মাটিতে ফেলে জোর করে মার্বেলগুলো কেড়ে নিয়ে বাড়ি চলে এল। সাঈদার আকাশ ফাটানো কান্না শুনে ফিরতে ফিরতে বুঝতে পারল সন্ধ্যেবেলা আব্বুর হাতে আরও একবার পেটানি কপালে নাচছে। কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যা থেকেই কি যেন সব হয়ে গেল, গোটা পাড়া হঠাৎ নিঝুম হয়ে পড়ল। সন্ধ্যার পর রাস্তায় আলো জ্বলেনা, কেউ কারোর বাড়ি যায়না, নিজেদের ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকে। আর সাইরেন বাজলেই যে যেখানে থাকুক দুদ্দাড়িয়ে ট্রেঞ্চে গিয়ে সেঁধোয়।

ট্রেঞ্চের একদম ভিতরে দেওয়াল ঘেঁষে খড়-বিচালির ওপর কম্বল পেতে আম্মু মিরাজ আর সোফিয়ার জন্য বিছানা করে দিয়েছে। যখন ট্রেঞ্চে থাকে মিয়াজ মার্বেলগুলো নিয়ে খেলা করে, আবার বেরিয়ে আসার সময় ট্রেঞ্চের দেওয়ালে একটা গর্তের মধ্যে রেখে তার উপর খড়বিচালি গুঁজে দেয়, যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে। তার ভয় যেকোনো সময় সাঈদা তার আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে মার্বেলগুলোর দখল নিতে আসবে। আব্বুর কানে গেলে মার্বেল তো ফেরত দিতে হবেই তার সাথে ফ্রিতে জুটবে পেটানি। তাই মার্বেলগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সে ভীষণ চিন্তিত। এখন যুদ্ধ থেমে যাওয়ার খবর পেতেই তার বুকে ধড়াস করে ধাক্কা লাগল। এতদিন যুদ্ধ তাকে রক্ষা করেছিল, কয়েকটি বাড়ির তফাৎ হলেও সাঈদা তার আব্বাকে নিয়ে এর মধ্যে আসেনি। এখন যুদ্ধ থেমে গেছে, এবার নিশ্চয়ই সাঈদা তার মার্বেল ফেরত নিতে আসবে। এই মুহূর্তে মার্বেলগুলো নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারলোনা মিরাজ। বড়দের মুখে শুনেছে যুদ্ধ থেমে গেলে গর্তগুলো বুজিয়ে দেওয়া হবে। এরকম ধর্মসংকটে আর কখনো পড়েনি সে। অবশেষে সবাইয়ের নজর এড়িয়ে ট্রেঞ্চ থেকে মার্বেলগুলো বের করে নিজের পকেটে রাখাই সাব্যস্ত করল। মনে মনে ভাবলো সাঈদা এলে দেখা যাবে, কিন্তু ট্রেঞ্চ বুজে গেলে মার্বেলগুলো চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে।

বড়রা আস্তে আস্তে বড়রাস্তার দিকে এগোচ্ছে। ওখানে এখনও ফিলিস্তিনি পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, একটু দূরে গেলে সীমান্ত বরাবর ইসরায়েলি সৈন্যদের বাড়াবাড়ি উপস্থিতিও চোখে পড়বে। যুদ্ধ থেমে গেলেও কোনো দলই তাদের সৈন্য বাহিনী সরিয়ে নিয়ে যায়নি। কাল রাতে কাছে পিঠে একটা বোমা পড়েছে, কোথায় পড়েছে, কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটার সন্ধানেই বড়রা উদগ্রীব। ছোটরা বাড়ি ছেড়ে বেরোবার অনুমতি পায়নি। মিরাজের আম্মু মুখ ধুইয়ে মুড়ির বাটি ধরিয়ে বলে গেছে, "এতদিন কিস্যু পড়াশোনা হয়নি, খেয়ে বই নিয়ে বস, আমি আসছি"৷ এই হল যুদ্ধ থামার আরেক অশান্তি। আবার সেই স্কুল, মাস্টারমশাইদের বকুনি, পড়াশোনা, পরীক্ষা শুরু হবে। মিরাজ মনে মনে যে যুদ্ধ থামিয়েছে তার ওপর ভয়ংকর রেগে গেল। কিছুক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এলো। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে রান্নাঘরে এসে মিরাজ দেখলল আম্মু আব্বুর হাত ধরে থরথর করে কাঁপছে আর নানী রান্নাঘরের একপাশে বসে চোখে আঁচল চাপা দিয়েছে। আব্বু আম্মুর হাত ছাড়িয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে উনুন নিভিয়ে একটা চাদর গায়ে আর মাথায় জড়িয়ে আম্মু একহাতে মিরাজকে আর অন্যহাতে শ্বাশুড়ীর হাত ধরে রাস্তায় বেরিয়ে এল। বড় রাস্তা পেরিয়ে যে গলিতে ঢুকলো সেটা সাঈদাদের বাড়ি যাওয়ার গলি। মিরাজ শঙ্কিত হয়ে উঠলো, তাহলে কি আম্মু মার্বেলগুলো ফেরত দেওয়ার জন্যে মিরাজকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য নানীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে কেন আর দুজনে মিলে কাঁদবেই বা কেন! সাঈদার মা জুনেদা আপ্পা নানীর মেয়ে। আরোও অনেককে গলি দিয়ে যেতে দেখল মিরাজ। সবাইয়েরই চোখমুখ থমথম করছে। এবার সত্যি সত্যি ওরা সাঈদাদের বাড়িতে এসে পৌঁছলো। কিন্তু একি! বাড়ি কোথায়! সাঈদাদের বাড়িসমেত আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ি স্রেফ নেই হয়ে গেছে, আর সেই শূন্য জায়গাটা আগুনে পোড়া ঝামার মত পড়ে আছে। পোড়া জায়গাটায় সারি সারি সাদা কাপড় ঢেকে দশ-বারোজন মানুষ শুয়ে আছে। তাদের সামনে আলখাল্লা পরিহিত একজন বৃদ্ধ মানুষ হাঁটুমুড়ে বসে পূব আকাশের দিকে তাকিয়ে দোয়া জানাচ্ছে। উপস্থিত সবাই ওনাকে অনুসরণ করে প্রার্থনায় যোগ দিল। মিরাজ কিছু না বুঝে একটু এগিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তে হালকা হাওয়ায় সবচেয়ে কাছের শায়িত মানুষটার মুখের চাদর সরে গেল। মিরাজ চমকে দেখলো সাদা চাদর চাপা দিয়ে সাঈদা শুয়ে ঘুমোচ্ছে। মিরাজের অদ্ভুত লাগলো, সূর্য প্রায় মাথার ওপর উঠতে চলল, সাঈদা এখনও ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ হাওয়ার বেগ বেড়ে গেলো, পুড়ে যাওয়া কালো অঙ্গার বাতাসে পাক খেতে লাগল, আর একে একে শুয়ে থাকা সমস্ত মানুষগুলোর মুখের ঢাকা মিরাজের চোখের সামনে খুলে গেল। শুধু সাঈদা নয়, পাশাপাশি শুয়ে আছে সাঈদার ভাই জাফর, দাদা আজিজুল, আম্মা, আব্বু আরও অনেকে। এবার মিরাজের অস্বস্তি শুরু হল, ও বুঝতে পারলো ভয়ানক কিছু একটা ঘটে গেছে। এতগুলো মানুষ একসাথে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে পারেনা। সে পিছন ফিরে আম্মুকে খুঁজল, কিন্তু মা অনেক পিছনের সারিতে বসে প্রার্থনায় যোগ দিয়েছে। হঠাৎ সব নিস্তব্ধতাকে খান খান করে নানী উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে গোটা ব্যাপারটা মিরাজের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। ও বুঝলো, সাঈদা মরে গেছে, মনে মনে স্বস্তি পেল মার্বেলগুলো আর ফেরত দিতে হবেনা। কিন্তু নানীর কান্নার সাথে উপস্থিত মহিলাদের কান্নায় মিরাজের চোখগুলো ভিজে উঠলো। বুকের ভেতর থেকে অনেকটা কান্না একসাথে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এইসময় যাকে সবচেয়ে বেশি পাশে দরকার সেই আম্মুও পিছনের সারিতে বসে আছে৷ পকেটের মার্বেলগুলো হঠাৎ ভীষণ ভারী হয়ে উঠল, মনে হল বুঝি পকেটটা ছিঁড়ে যাবে। মিরাজ ভয়ে ভয়ে সাঈদার মুখের দিকে তাকালো, মুখে কোনো আবেদন, আপত্তি, অভিযোগ, বিদ্বেষ খুঁজে পেলনা৷ অপার্থিব এক শান্তি সারা মুখ জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। তবুও মিরাজের কিরকম ভয় হতে লাগলো। মনে হল এক্ষুনি সাঈদা ঘুম ভেঙে উঠে কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়া করতে করতে মার্বেলের ভাগ চাইবে। চারদিকে চোখ তুলে তাকায় মিরাজ। সবাই বৃদ্ধ মানুষটার মত উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে দোয়া প্রার্থনা করছে। মিরাজ এই ফাঁকে উঠে পকেট উপুড় করে সমস্ত মার্বেলগুলো সাঈদার বিছানায় রেখে এল। ঠিক তখনই নানীর সাথে উপস্থিত সকল নারীদের সমবেত কান্না পোড়া মহল্লার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, পরিসীমা জুড়ে মাথা কুটে মরতে লাগলো।

 সমাপ্ত

 

ডঃ গৌতম সরকার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top