সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বিপন্ন অস্তিত্বে প্রাণের স্পন্দন : শরীফ উদ্দীন


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২১ ২০:৩৭

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:০১

 

দু’ভাইবোনের বয়সের পার্থক্য আট বছর। মা-বাবার দেয়া নাম তাসনিয়া ও তাহসিন হলেও প্রতিবেশীদের মুখে মুখে তাসনি-তাসু হয়ে গেছে। বোন তাসনি বকা দিতে থাকলে বন্ধু মানিক-সজলের নাম করে আট বছর বয়সী অবুঝ বালক তাসুর সরল যুক্তি, ‘আমার একার কোনো দোষ নেই। বিশ্বাস কর, ওদেরকে করতে না দেখলে অমন কাজ আমি করতামই না।’

তাসুর সরল যুক্তিতে এবারে রাগ ভুলে গিয়ে তাসনি মৃদু হেসে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এসবের মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে টানাটানি করছিস কেনো?’

বোনের মুখে হাসি দেখে ভয় কেটে যাওয়ায়  তাসু গতরাতের স্বপ্নের কথা খুলে বলতে লাগল, ‘বাড়ি আসার পথে দেখলাম, মানিক-সজল পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রসাব করছে। ওদেরকে দেখে আমিও শুরু করে দিলাম। কেনো যে, ওদেরকে স্বপ্নের ভিতর দেখতে পেলাম! বিছানা ভিজিয়ে দেয়ার কথা কাউকে বলবি না, তাসনিবু। তা নাহলে আমাকে বন্ধুরা সবাই রাগাবে।’

বুবু কথাটি পুরো না বলে তাসু সংক্ষেপে তাসনিবু ডাকে। ভোরের সূর্য উঠে গেছে। পুকুর ঘাটে যাবার উদ্দেশ্যে তাসনি কাঁথা-চাদর হাতে নিয়ে তাসুকে বলল, ‘তাসু, তুইও চল। গোসল করতে হবে। তোর গা দিয়ে প্রসাবের গন্ধ বের হচ্ছে। আমাকেও করতে হবে।’

তাসুর গোসল করা শেষ। বোনের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় তাসুর সেই স্বপ্নের বন্ধু মানিকের মায়ের পুকুর ঘাটে আগমন। দু’ভাইবোনকে খুব সকালে গোসল করতে দেখে প্রশ্ন করে বসল, ‘তোরা কোথাও যাবি না-কি? এতো সকালে গোসল করছিস?’

তাসনি মানিকের মায়ের প্রশ্নের উত্তরে হাসতে হাসতে বলল, ‘চাচি, আমার লক্ষী ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। তোমাদের মানিক-সজলের কারণে আমাদের দু’ভাইবোনকে এতো সকালে গোসল করতে হচ্ছে।’

গতরাতে তাসু স্বপ্নের ভিতরে বিছানা ভেজানোর জন্য মানিক-সজলকে দায়ী করার কারণ বলতেই মানিকের মাও সজোরে হাসতে শুরু করল। দু‘জনের হাসির মাঝখানে তাসু চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘তোকে বার বার মানা করলাম তবুও স্বপ্নের কথা বলে দিলি? ডাইনি কোথাকার!’

বোনের মৃত্য কামনার পাশাপাশি রাক্ষুসী থেকে শুরু করে যতগুলো বিশেষণ মাথায় এলো বোনের উদ্দেশ্যে সেগুলো প্রয়োগ করতে করতে তাসু একাই বাড়ি অভিমুখে চলল।

 

ছয় বছরের মতো হবে। শুধু সন্দেহের উপর ভিত্তি করে একটি পরিবার তছনছ হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান খুব বেশি। হয়তবা সেই কারণে সাইদুর রহমানের গত এক বছর ধরে পুরুষত্ব যতবেশি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে আঠারো বছর ধরে সংসার করা বউয়ের প্রতি ততবেশি সন্দেহবাতিক হয়ে উঠছে। নিজের দেবর নেই। চাচাতো দেবর তো দূরের কথা প্রতিবেশী ভাসুর-চাচা শ্বশুর সম্পর্কের কারো সাথে বউ মিনা বেগম প্রয়োজনে কথা বললেও সেটা সাইদুর রহমান সহ্য করতে পারে না।

তাসুর বয়স তখন দু’বছর। তাসনি স্কুলে। বাড়ির উঠোনে পা দিতেই ঘরের মধ্যে বউ মিনা বেগম আর আফজালের হাসাহাসির শব্দ শুনে রাগে কাঁপতে লাগল। আফজাল সম্পর্কে মিনা বেগমের চাচাতো দেবর। সাইদুর রহমান উঠোনে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডাকলে আফজাল বেরিয়ে এলো। ভাবি-দেবর সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক থাকলে পাশের বাড়ির লোকজন শুনতে পাবে এতোটা জোরে দু’জনে কথাবার্তা ও হাসাহাসি করত না—এই সামান্য বোধটাও সাইদুর রহমানের মাথায় ঢুকল না। রাগান্বিত কণ্ঠে আফজালকে বলল, ‘তুই কখনও আমার বাড়ি আসবি না। আজ থেকে মিনার সাথে তোর কথা বলা বন্ধ। আমার কথার অন্যথা হলে দু’জনের ভাগ্যেই খারাপ আছে।’

প্রায় বাপ বয়সী চাচাতো ভাইয়ের হঠাৎ এমন ব্যবহারে আফজাল কী বলবে ভেবে না পেয়ে নিজের মান-সম্মান আর মিনা ভাবির কথা চিন্তা করে নিরবে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। কেন এ বাড়িতে ঢুকেছিল সাইদুর রহমানকে সেটাও বলার রুচি আফজালের হল না।  

স্বামী সাইদুর রহমানকে যেন ক্ষেতের কাজ করে এসে ক্লান্ত শরীরে আবার দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে হবিগঞ্চ বাজারে তাসুর পাতলা-পায়খানার ওষুধের জন্য না যেতে হয় তা ভেবে আফজালকে পাঠিয়েছিল। তাসুর সেই ওষুধ দিতে আফজাল এসেছিল।

আফজাল চলে যাওয়ার পরেও থামে না। সাইদুর রহমান সমানে বউকে গালিগালাজ করে যাচ্ছে।

সন্দেহবাতিকগ্রস্থ স্বামীর অনেক ভর্ৎসনা নিরবে সহ্য করে গেলেও আফজালকে অন্যায়ভাবে হেনস্তা করাটা মানতে পারল না। আফজাল কেন এসেছিল তা বলা শেষে দরজায় দাঁড়িয়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে সজোরে মন্তব্য করল, ‘আঠারো বছর ধরে আপনার সংসার করছি। আমি ভালো না-কি মন্দ তা আপনার চেয়ে কারও বেশি জানার কথা নয়। তবুও সন্দেহ করা! আমরা খারাপ না। আসলে খারাপ আপনার মন—নোংরা। এজন্য কারও সাথে আমার কথা বলার মধ্যে আপনি মন্দ কিছু খুঁজে বেড়ান।’

বউয়ের মুখে নোংরা শব্দটা শোনা মাত্র সাইদুর রহমান হিতাহিত জ্ঞান হারালো। ছুটে গিয়ে গোয়াল ঘরে ঢুকল। গোয়াল ঘরে ভাঙা টেবিলের একটা পায়া আছে। কাস্তে-হাঁসুয়া-দা ধার দিতে কাজে লাগে। সেটা খুঁজে না পেয়ে গোয়াল ঘরের নিকট থেকেই হাতে থাকা ধান কাটার কাস্তেটা বিশ-বাইশ হাত দূরে দাঁড়ানো বউকে উদ্দেশ্য করে সজোরে ছুঁড়ে দিল। কাস্তের ডগায় হয়তবা আজরাইল ফেরেস্তা বসে ছিল। পাঁজরের হাড়ে বাধা না পেয়ে কাত হয়ে পাঁজরের দুই  হাড়ের ফাঁক দিয়ে সোজা মিনা বেগমের ফুসফুস অবধি বিঁধে যায়। মিনা বেগম দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়ল কিন্তু কয়েক সেকেন্ড না যেতেই যন্ত্রণায় সেখানেই শুয়ে পড়ে কাতরাতে লাগল, ‘আপনি এটা কী করলেন? আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। একটু পানি।’

 

এতোক্ষণ যে প্রতিবেশীরা উঠোনের গলির কাছে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর তর্কাতর্কি শুনছিল এক গ্লাস পানি দেয়ার পরিবর্তে সবাই তাড়াহুড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

সাইদুর রহমান কী করবে বুঝতে না পেরে বুক থেকে কাস্তেটা একটানে বের করতেই সেখান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়া শুরু হলো। মারা গেলে খুনের অভিযোগের ব্যাপার। থানা-পুলিশের ঝামেলা এড়াতে কোনো ভ্যান-রিকশা রাজী হল না। থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের এ্যাম্বুলেন্স যখন এলো তখন সব শেষ। এ্যাম্বুলেন্সের লোকজন দেখেই বলল, ‘হাসপাতালে নিয়ে যাবার দরকার নেই। নিঃশ্বাস নিতে না পারা আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য বেশ কয়েক মিনিট আগেই মারা গেছে।

দু’ভাই। সাইদুর রহমান ছোটো। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে যাবার আগে তাড়াহুড়া করে বড়ভাই মিজানুর রহমানকে গিয়ে বলল, ‘একটা দফারফা না হওয়া অবধি আমার ছেলে-মেয়ে দুটোকে তোমার হাওয়ালে রেখে গেলাম।’

স্বামী যখন স্ত্রীকে খুন করে তখন সেই সাথে নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতও খুন হয়ে যায়। তারপরও খবর কিংবা পেপার খুললেই দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই এদেশে তাসনি-তাসুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ভাইয়ের হাতে দুই ছেলে-মেয়ের ভার দিয়ে গা-ঢাকা দিতে বেরিয়ে পড়ল। লাভ হল না। কিছুদিন না যেতেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। তিন বছর ধরে মামলা চলার পর রায়ে সাইদুর রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো।

দিনে দিনে যতই বড় হতে লাগল বোন ছাড়াও তাসুর বুকে তাসনি মায়ের আসন পেতে থাকল। পুকুর ঘাটে বন্ধু মানিকের মাকে বিছানা ভিজিয়ে দেয়ার কথা বলাতে তাসু বাস্তবিকই খুব রেগে গিয়েছিল কিন্তু পেটে টান পড়া যতই বাড়তে থাকল বোনের উপর তাসুর মনের সেই রাগ ততই উবে যেতে লাগল। সকাল এগারোটা পার হতে চলল, পেটে কিছু পড়েনি। বেশি সকালে ঘুম থেকে উঠায় ক্ষিধে যেন বেশি ধরেছে। বন্ধুদের সাথে আঙিনায় খেলার ফাঁকে ফাঁকে খেতে বলবে আশায় বাড়ি এসে বড়মা জমিলা বেগমের সামনে দু’বার ঘুর ঘুর করে গেছে। লাভ হয়নি।

বড়মা জমিলা বেগম কোনো কাজের ফরমায়েস না করায় সুযোগ পেয়ে তাসনি বিছানায় বসে পড়ছিল। কয়েক দিন পরে এসএসসি পরীক্ষা। দু’ভাইবোনের দায়িত্ব নেয়ার সাথে সাথে ছোটোভাইয়ের প্রায় দু’বিঘা তিন শতক দোফসলি জমিতে চাষ করার সুযোগও পেয়েছে এ কথা তাসনি-তাসুর বড়আব্বা মিজানুর রহমানের স্মরণে থাকলেও বড়মা জমিলা বেগম কখনো মনে করার চেষ্টা করে না। দু’জায়ের মধ্যে কখনও সম্পর্ক ভালো ছিল না। হয়তবা সে কারণেই জমি আর পানের বরজ থেকে নিজেদের লাভের কথা ভুলে গিয়ে শুরু থেকেই তাসনি-তাসুকে বোঝা মনে করে আসছে। লোকে কানাঘষা করে, সাইদুর রহমানের জমি আর পানের বরজ না পেলে মিজানুর রহমান তার দুটো ছেলেকেই শহরে রেখে কলেজে পড়াতে পারত না।

সৃষ্টিকর্তার দান বলে যদি কিছু থাকে তা হলো তাসনি-তাসুর মেধা। এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকেও জেএসসি পরীক্ষায় তাসনির ফলাফল স্কুলের সুনাম বাড়াতে কাজে লাগার মতো। জমিলা বেগমের ইচ্ছে ছিল না, সমাপনী পরীক্ষার পর তাসনি পড়ালেখা করুক। তাসনির সামনেই প্রায়ই স্বামীকে ঝাঁঝের সাথে বলতে ছাড়ে না, ‘শুধু চেহারা থাকলেই হয় না। খুনির মেয়ে।  শিক্ষিত পাত্র ঘুরেও তাকাবে না। খামোখা স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। খুনির বেটিকে কোনো ভ্যানচালক বিয়ে করবে কি-না তার ঠিক নেই। তাসনিকেও বলি, করবি তো মূর্খের ঘর সেখানে নিজে শিক্ষিত হওয়ার জন্য টাকা-পয়সা নষ্ট করার কোনো মানে হয়?’

জমিলা বেগমের কথা শুনে তাসনি দুঃখ-কষ্ট-লজ্জায় মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাসনির অবস্থা বুঝতে পেরে বড়আববা মিজানুর রহমান কোনো একটি ফরমায়েসের উছিলায় তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। জমিলা বেগম মাঝে মাঝে তাসনির বিষয়ে স্বামীকে যুক্তি দেখায়, ‘তোমার ছেলে দুটো একেবারে ছোটো নেই। একটা উঠতি বয়সী মেয়েকে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখতে দেখতে কখন কী ভুল করে বসে তার ঠিক আছে?’

জেলখানায় দেখা করতে গেলে বড় ভাইয়ের কাছে ছোটো ভাইয়ের ঘুরে ফিরে কাতর স্বরে একই অনুরোধ, ‘তুমি বেঁচে থাকা অবধি আমার ছেলে-মেয়ে দুটোর পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয়, ভাইজান। রাগের মাথায় জানোয়ারের মতো কাজ করে ফেলেছি। আমার জন্য সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’

ছোটোভাইয়ের অনুরোধ রক্ষার্থে বড়ভাই মিজানুর রহমান বউয়ের কথা কানে তুলে না। এছাড়াও মিজানুর রহমান ভালো করেই জানে, ভাতিজি-ভাতিজার পিছনে বছরে যত টাকা ব্যয় হয় দু’বিঘা জমির ধান আর সাত-আট শতাংশের পানের বরজ থেকে আয় তার চেয়ে অনেক বেশি। দু’বিঘা জমিতে চাষাবাদের সুযোগ আর পানের বরজের লোভে তাসনি-তাসুর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিবে এমন আত্মীয় পেতে বেশি খোঁজাখুঁজির দরকার পড়বে না।

সকাল পেরিয়ে যাচ্ছে তবুও জমিলা বেগম তাসুকে চোখের সামনে দেখেও খাওয়ার কথা বলল না। তাসুর একমাত্র ভরসা এখন তাসনিবু। বিছানায় বসে পড়ছে এমন সময় শুষ্ক মুখে ঘরে ঢুকে তাসু ভয়ে ভয়ে বিছানায় উঠে বোনের পাশে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাসনিবু, সকালে পুকুর ঘাটে আমি অমনটা করায় তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?’

তাসনি কৃত্রিম রাগের স্বরে উত্তর দিল, ‘হ্যা, রাগ করে আছি। পুকুর ঘাটে তুই আমাকে ডাইনি-রাক্ষুসী-শাকচুন্নি ছাড়াও আমার মরণ কামনা করলি। রাগ করব না?’

বোনের মুখের কথা শুনে মুহূ্র্তের মধ্যে তাসুর শুষ্ক মুখটা মলিন হয়ে পড়ল। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তাসুর অভিযোগ, ‘সবাই আমার উপর রাগ করে। কেউ ভালোবাসে না।’

কথা শেষ করে তাসু উঠে দাঁড়াতেই তাসনি ডান হাত ধরে এক ঝটকায় তাসুকে কোলের উপর টেনে নিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তুই আমার কলিজা। আমি কি তোর উপর রাগ করতে পারি?বোকার হদ্দ! মজা করে রাগ করার কথা বললাম, আর কি-না সাথে সাথে চোখে পানি টলমল করতে শুরু করল?’

খাবার সময় দু’ভাই-বোনের এক সাথে ডাক পড়ে। আজ জমিলা বেগম ডাকছে না। গতরাতে বড়আব্বা-বড়মার মধ্যে খিটমিট বেধেছিল। তাসনি ভাবল, বড়আব্বার উপর রাগ করে বড়মা হয়তবা সকালে রান্না করেনি। কয়েক মুহূর্তের নিরবতা ভেঙে তাসনি জিজ্ঞাসা করল, ‘খুব ক্ষিধে পেয়েছে, তাই না? তাসু, আমি আছি না? কোনো ব্যাপারে কখনও মন খারাপ করবি না। তোর মন খারাপ দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। মনে থাকবে?’

বছর দুয়েক আগে নবম শ্রেণিতে উঠার পর প্রতিবেশী কয়েকজনের প্রাইমারি পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে সন্ধ্যার সময় তাসনির কাছে প্রাইভেট পড়তে আসে। এ কারণে তাসনিকে এখন আগের মতো তেল-সাবানের টাকার জন্য বড়আব্বা মিজানুর রহমানের কাছে হাত পাততে হয় না।  প্রাইভেটের জমানো টাকা থেকে তাসুর হাতে পনেরো টাকা দিয়ে তাসনি বলল, ‘দোকান থেকে পাউরুটি কিনে খাবি।’

বোনের কথা শুনে তাসু প্রশ্ন করল, ‘তোকে ছাড়া আমি একা খাব? তোর জন্যও নিয়ে আসব।’

তাসু ঘর থেকে বের হবে এমন সময় জমিলা বেগম দুজনের নাম ধরে ডাক দিয়ে বলল, ‘হেঁসেলে ভাত বেড়ে ঢেকে রেখেছি। দুজনে এসে খেয়ে নে।’

পিছনে ফিরে তাসনির নিকট তাসুর আবদার, ‘আমি কিন্তু এই পনেরো টাকা ফেরত দিব না, তাসনিবু।’

তাসনি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল, ‘ঠিক আছে। তবে হাবিজাবি কিছু খাবি না। এখন আমার সাথে আয়।’

রাতে তাসনি এসে পাশে শুতেই তাসু জিজ্ঞfসা করল, ‘তাসনিবু, মায়ের মুখ তোর মনে পড়ে? আমার পড়ে না, ছোটো ছিলাম কি-না। মায়ের মুখ দেখতে কেমন ছিল রে?’

তাসুর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাসনি পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘এ কথা মনে হবার জন্য বিকেলে পেয়ারা তলায় বসে  মাটির উপর মেয়েদের মুখ আঁকাচ্ছিলি, তাই না? মা হাসলে গালে টোল পড়ত তখন না-কি আরও সুন্দর লাগত। আমার অল্প অল্প মনে পড়ে, সজলের দাদা মাকে টোলবিবি ডাকত। টোল পড়া কাকে বলে  কাল দিনে বলব। এখন ঘুমানোর চেষ্টা কর।’

বাইরে কয়েকটি কুকুর এক সাথে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। অপরিচিত কেউ হয়তোবা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। তাসুকে কথায় পেয়েছে, ‘আচ্ছা, তাসনিবু, আব্বা কি ইচ্ছা করে মাকে মেরে ফেলেছে?’

কঠিন প্রশ্ন। তাসুর জীবনের সব চেয়ে বড় দুর্বলতা কী তাসনি জানে। তাসু যাতে এ বিষয়ে আর কখনও প্রশ্ন না করে সেজন্য কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ‘বাচ্চা ছেলে হয়ে বড়দের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আমি কিন্তু মনে খুব কষ্ট পাব, তাসু। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের কখনও বড়দের বিষয়ে কথা বলতে নেই।’

বোনের মুখভার করে থাকাটা তাসু সহ্য করতে পারে না। কথা না বাড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল।

স্যারদের বাসায় গিয়ে তাসনি ব্যাচে প্রাইভেট পড়ত। তাসনি-তাসুর দুর্ভাগ্যের কথা কারও অজানা ছিল না। কোনো স্যার প্রাইভেটের টাকা নিতেন না। তাসনিও স্যারদের আশা পূরণে নিজের চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। এসএসসি পরীক্ষায় প্রাণপণ খেটেছে।

জীবনটা এমনভাবে গড়িয়ে গেলেও অসহায় দু’ভাই-বোনের বুকের ভিতরে কষ্টের পরগাছা একরাতের মধ্যে লকলকিয়ে বেড়ে উঠত না। বিপত্তি দেখা দিল, তাসনির এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার চার-পাঁচদিন পর।

সত্য চাপা থাকে না। মাঝে মাঝে ছোটোভাই সাইদুর রহমানের সাথে দেখা করতে তার দু’একজন বন্ধু জেলখানায় যায়। তাসনিকে মামার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ছোটোভাইয়ের কানে এ কথা পৌঁছালে তাসনি-তাসুর দেখাশুনার দায়িত্ব অন্য কাউকে দেয়ার সাথে সাথে জমি আর পানের বরজ কেড়ে নিবে এটাই স্বাভাবিক। সবকিছু বুঝতে পারা সত্বেও শেষ অবধি সংসারের শান্তি বজায় রাখতে মিজানুর রহমানকে বউয়ের জেদের কাছে হার মানতে হলো।

 

বউয়ের যুক্তি, ‘তাসনি-তাসু যেমন তোমার ভাতিজি-ভাতিজা তেমনি তাদের মামাদেরও ভাগ্নি-ভাগ্নে। ওদের বড়মামা না হয় বোনের খুনের বাদী হয়ে তোমার ছোটোভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা লড়েছিল। ওদের আরও দু’মামা আছে তাদের কি ভাগ্নি-ভাগ্নের উপর কোনো দায়িত্ব নেই?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে জামিলা বেগম বাকি কথা শেষ করল, ‘রবিউলকে পাঠিয়েছিলাম। কাজও হয়েছে। ওদের মেজো মামা তাসনির দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছে। তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি আর রবিউল দু’জনে মিলে করব। সম্পর্কে রবিউল তোমার চাচাতো শ্যালক হলেও তুমি যে তাকে পছন্দ কর না তা আমি জানি। তাসনি দিনে দিনে সেয়ানা হচ্ছে। রফিক-শফিকের মধ্যে যদি কেউ ভুল করে বসে তখন কী হবে? নিজের সন্তান দুটোর ভাবনা আমার কাছে সবার আগে। মিজানের জমি আর পানের বরজ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তাসনিকে ওর মেজো মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার কথা মিজানের কানে গেলে তখন না হয় ফিরিয়ে নিয়ে আসব।’

‘রবিউল যে পছন্দ হবার মতো ছেলে নয় তা তুমিও জানো। সুযোগ পেলেই নিজের ছেলে দুটোকে তাসনি তাদের নিজের বোনের মতো এমন উপদেশ দিয়ে সুপথে রাখা যায় না? সবকিছু তোমার টালবাহানা।’—বলে উঠে দাঁড়িয়ে দেরি না করে মিজানুর রহমান নিড়ানি হাতে নিয়ে পানের বরজের উদ্দেশে রওনা দিল।

তাসনি-তাসুর মেজো মামার উঠতি অবস্থা। স্বামীর আয়-উপার্জন অবৈধ পথে হুহু করে বাড়তে থাকলে সেই সাথে তাদের স্ত্রীদেরও শরীর ভারি হতে শুরু করে। সার্বক্ষণিক কাজের লোক না রাখলে তখন চলে না।

জমিলা বেগমের চাচাতো ভাই রবিউল গিয়ে তাসনি-তাসুর মেজো মামাকে তাসনির দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করলে স্বামী মতামত দেয়ার আগেই তাসনির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে মেজো মামি এক পায়ে খাঁড়া। স্বামী আপত্তি করতে গেলে ইশারায় স্বামীকে নিষেধ করল। সবাই বিদায় নিলে স্বামীকে ভর্ৎসনা করে চিকন বুদ্ধির মামি মোটা লাভের হিসাব দেখিয়ে দিল, ‘তিনবেলা খাওয়া আর বছরে দুটো জামা-পায়জামা-ওড়নার বিনিময়ে কাজের মেয়ের মতো সার্বক্ষণিকভাবে কাউকে কাছে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বোকা না হলে এমন সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করে? তুমি না গেলে তাসনিকে নিতে আমিই যাব।’ 

তাসুকে দেখতে পেয়ে বড়মা বলল, ‘তাসনিকে দেখছি না! তুই ও’কে গিয়ে আমার নাম করে বল, ডাকছে। জরুরী দরকার আছে।’

জমিলা বেগম জানে, এখন থেকে মেজো মামার বাড়ি থাকবে এ কথা হঠাৎ করে তাসনিকে বলা যাবে না। না যাবার জেদ ধরে কান্নাকাটি শুরু করলে বাড়া ভাতে ছাই পড়তে পারে।

তাসুর মুখে সংবাদ পেয়ে তাসনি সাথে সাথে জমিলা বেগমের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাসনির উদ্দেশে নরম কণ্ঠে বলল, ‘কয়েকদিন মাথায় তেল দেয়া হয়নি। আমার চুলে একটু তেল দিয়ে দিবি, মা?’

 

সচরাচর এমন নরম কণ্ঠে জমিলা বেগম তাসনির সাথে কথা বলে না। জমিলা বেগমের মুখ থেকে মা সম্বোধন কানে আসা মাত্র তাসনির বুকের ভিতরে একমুঠো আনন্দ দোলা দিয়ে উঠল। তাসনি হাসি হাসি মুখে উত্তর দিল, ‘কী যে বলো, বড়মা। দিয়ে দিব না কেন?’

জমিলা বেগমের মুখ থেকে শেষ কবে মা সম্বোধন শুনেছে তাসনির মনে পড়ে না। তাসনি নিজেই হেঁসেলে ঢুকে পিঁড়ে নিয়ে উঠোনের যে জায়গায় পাশের বাড়ির নিমগাছের ছায়া পড়েছে সেখানে পেড়ে দিয়ে খুশিতে গদগদ কণ্ঠে বলল, ‘তেলের বোতলটা নিয়ে এসে তুমি এখানে বসো। আমার বসার জন্য তাসুর  টুলটা নিয়ে আসি।’

তাসুর পড়ার জন্য আলাদা টেবিল না থাকায় বিছানাকে টেবিল বানিয়ে টুলে বসে লেখালেখির কাজটা সেরে নেয়।

তেল দেয়ার শেষের দিকে বড়মা নিজের মনের মধ্যে সাজিয়ে রাখা কথাগুলো বলতে থাকল, ‘আমরা যেমন তোর চাচা-চাচি তেমনি ওরাও তোর মামা-মামি। মামা-মামি সমস্যায় পড়ে তোর সাহায্য চাইলে সেটা করা উচিত কি-না বল? তোর মেজো মামির কোমরে কি যেন হয়েছে। কাজ করতে পারে না। সংসারের কাজে সাহায্য করার কেউ নেই।  আগামীকাল তোর মেজো মামা নিতে আসবে। কয়েকদিনের জন্য যাবি, মা? মুখ রাখা বলেও একটি কথা আছে।’

জমিলা বেগম অতি সামান্য বিষয় নিয়ে তাসনিকে অনেক ভর্ৎসনা করেছে। মুখ বুজে শুনে যায়। কখনও পাল্টা উত্তর দেয় না। যাবার ইচ্ছা না থাকার সত্বেও বলল, ‘তোমরা যেটা বলবে সেটাই করব। আমার সাথে তাসুকে নিয়ে যাবে না?’

বড়মা কিঞ্চিত বিস্মিত হওয়ার ভান করে উত্তর দিল, ‘সেকি! তুই কী আর বেড়াতে যাচ্ছিস? অসুস্থ মামিকে সাহায্য করতে তোর যাওয়া। তাসু গিয়ে কী করবে? আমরা কি তাসুর যত্ন-আত্ত্বি করি না? এতো দিনে তোর এটাই মনে হয়েছে?’

জমিলা বেগমকে তাসনি ভয় করে। জানে, তিলকে তাল করতে জুড়ি নেই। তাসুকে ছেড়ে থাকা তাসনির জন্য ভীষণ কষ্টকর। শুষ্ক কণ্ঠে কোনো রকমে উত্তর দিল, ‘আমি সেটা বলিনি। তাসু গেলে ওর বাইরে যাবার কাপড়-চোপড় আজই পরিষ্কার করতাম কি-না? বড়মা, আমাকে মেজো মামার বাড়িতে কতদিন থাকতে হতে পারে?’

তাসনির প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে তাগাদা দিয়ে বলল, ‘কথা না বলে তাড়াতাড়ি কর। আমার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।’

তাসুর জগৎ হচ্ছে তার তাসনিবু। রাতে ঘুমানোর আগে তাসু মলিন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তাসনিবু, আজকের পরে তোর সাথে আবার কবে ঘুমাবো তার কোনো ঠিক নেই, তাই না? তুই পাশে না থাকলে আমার ঘুমই আসবে না। বড়মা যদি তোর সাথে আমাকেও যেতে দিতেন! সন্ধ্যার সময় জয়নাল বলল, কাল থেকে সে না-কি আমার কাছে ঘুমাবে।’

জয়নাল পাশের বাড়ির কামলা। নিলফামারির ছেলে। রাতে মালিকের ছেলের ঘরে মেঝেতে ঘুমায়।

 

কী বলে সান্ত্বনা দিবে তাসনি তা খুঁজে পাওয়ার আগেই তাসু কেঁদে দিয়ে বলল, ‘তাসনিবু, আমার জন্য তোর কষ্ট হবে না? মামাকে কাল তোর সাথে আমাকেও নিয়ে যেতে বলবি? তা নাহলে তোকে ছাড়া আমার দিন কাটবে না।’

ছোটোভাইয়ের আকুতিতে তাসনির চোখ ফেটে জল আসার যোগাড় হলেও অনেক কষ্টে সামলে নিল। কয়েক মিনিট নিরব থেকে তাসুকে আশ্বস্ত করল, ‘তুই চিন্তা করিস না, তাসু। কয়েক দিনের জন্য না গেলে বড়মা-বড়আব্বা মামা-মামি সবাই দুঃখ পাবেন। মামির অসুখ কি-না। কয়েক দিন থেকেই আমি চলে আসব। আমি না থাকলে তোকে প্রতিদিন পড়াবে কে? কাল সকালে আমি যে পড়াগুলো দিয়ে যাব সেগুলো করে রাখবি। আমার কথার উপর তোর বিশ্বাস থাকলে এখন থেকে আর কাঁদবি না।’

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। একেবারে যে বোঝে না তা কিন্তু নয়, দু’ভাইবোনের দায়িত্ব নেয়ায় বড়আব্বার আয়-ব্যয় বিয়োগ করলে ফলাফল কী হতে পারে  বুঝেও তাসনি জমিলা বেগমের চেঁচামেচির ভয়ে সে কথা ভুলেও মুখে আনে না।

পরদিন  দুপুর বারোটার দিকে মামিকে সাথে নিয়ে মামাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তাসনি কিছুটা বিস্মিত হলো। মনে মনে বলল, মামি না-কি অসুস্থ!

তাসনি এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে মামা-মামিকে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে আসতে লাগলে বড়মা ধমক দিয়ে বলল, ‘ওদিকে নিয়ে যাচ্ছিস কেন? রফিক-শফিকের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দে। বিছানা ঠিকঠাক করা আছে। দূর থেকে আসছে। হাত-পা ধুয়ে একটু জিরিয়ে নিক। তুই হেঁসেলে গিয়ে নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে আয়।’

কাজের সময় তাসনির পিছু পিছু ঘুরঘুর করার জন্য ইতোমধ্যে একবার বড়মার বকা খেয়েছে কিন্তু তাসু নিরস্ত হয়নি। তাসনিবুকে ছাড়া এ বাড়িতে একাই থাকতে হবে তাসু সেটা কল্পনাতেও নিতে পারছে না। সুযোগ পেলেই বোনকে ফিসফিস করে বলছে, ‘তাসনিবু, মামা-মামিকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বল। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারি? রাতের বেলা তুই ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে না খাওয়ায়ে দিলে আমার নিজের হাতে খেতেই ইচ্ছা করে না।’

আসেপাশে বড়মা জমিলা বেগমকে দেখতে না পেয়ে তাসুকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকে মামিকে বলল, ‘মামি, আমাকে ছাড়া তাসু থাকতে পারে না। আমার সাথে তাসুকেও যদি নিয়ে যেতেন?’

তাসুকে সাথে নিয়ে যাবার ব্যাপারে তাসনি হয়তবা মামিকে অনুরোধ করে আরও কিছু বলত কিন্তু জমিলা বেগমকে ঘরে ঢুকতে দেখে কথা বাড়াতে সাহস পেল না।

মামি একরাশ বিস্ময় নিয়ে চোখ কপালে তুলে তাসনির অনুরোধের জবাব দিল, ‘সে কী রে!  তাসু যাবে না কেন? একশবার যাবে। তুই আজ আমাদের সাথে যাবি, কয়েক দিন পর তোদের বড়আব্বার সাথে তাসু যাবে।‘

মামির নিখুঁত অভিনয়। তাসুকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য তাসনি জেদ ধরলে কী বলতে হবে তা বড়মা আগেই মোবাইল করে শিখিয়ে দিয়েছে।

 

মামির কথা শুনে তাসনি নিজের কষ্ট বুকে চেপে রাখতে পারলেও, তাসু পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

মামা কান্না বন্ধ করার জন্য সান্ত্বনা দিতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু জমিলা বেগম হাত ইশারা করে থামিয়ে দিয়ে প্রথমে কাজের উছিলায় তাসনিকে হেঁসেলে পাঠিয়ে দিয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাসুর কান্না থামাতে লাগলেন।

বুকের ক’ফোটা রক্তে এক ফোটা চোখের জল হয় তা উপলব্ধি করার মতো ঘরে কেউ নেই। অসহায় দু’ভাইবোনের আলাদা থাকার কষ্ট বুঝবে কী করে?

তাসনিকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে জমিলা বেগম বলল, ‘তোর মামা-মামিরা আসায় বাজার করতে খুব দরকারি টাকা খরচ করতে হয়েছে। যাবার আগে উপবৃত্তির জমানো টাকা থেকে তিনশত টাকা রেখে বাকিটা আমাকে দিয়ে যাস।’

তাসনি বড়মার কথার উত্তরে বলল, ‘উপবৃত্তির টাকা দিয়ে তাসুর নতুন স্কুল ড্রেস বানাতে দিয়েছি। সামান্য যে ক’টা টাকা আছে সেখান থেকে তাসুকে একশত টাকা দিয়ে বাকিটা আমার লাগবে।’

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ। চারটায় ট্রেন। তাসনিকে নিয়ে মামা-মামির বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাসনির নিজের ঘর থেকে বের হতে দেরি দেখে বড়মা রুক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে ডাক দিল।

ঘর থেকে বের হবার সময়  তাসুর হাতে একশত টাকা দিয়ে বলল, ‘যখন যা খেতে ইচ্ছে করে খাবি। কয়েক দিনের মধ্যে আমি চলে আসব।’

রিকশায় বাড়ি থেকে স্টেশন দশ-বারো মিনিটের রাস্তা। মামা-মামি-তাসনিকে এগিয়ে দিতে স্টেশনে মিজানুর রহমান-জমিলা বেগমের সাথে তাসুও এসেছে। জমিলা বেগমের তাসুকে সাথে নেয়ার ইচ্ছা ছিল না। তাসনির জেদে নিতে বাধ্য হয়েছে।  উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ায় রেগে আছে। জমিলা বেগমের মুখ থেকে সত্য কথাটা রাগের মাথায় বেরিয়ে পড়ল। তাসনির হাত থেকে কাপড়-চোপড়ের ব্যাগটি হাতে নিয়ে খুলেই রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘সে কী রে! তুই তো কিছুই নিসনি। তোর আর সব কোথায়? এখন থেকে তোকে মামা-মামির কাছেই থাকতে হবে। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। আমি দু’একদিনের মধ্যে তোর আর যা কিছু আছে রবিউলের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিব।’

কাল রাত থেকে তাসু অনেক কেঁদেছে। জমিলা বেগমের মুখ থেকে তার তাসনিবু আর এখানে থাকবে না শুনে তাসু কেঁদে উঠল না। হয়তবা জমিলা বেগমের কথা শুনে আট-নয় বছর বয়সী একটা শিশু অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়ায় কাঁদতেও পারছে না কিন্তু তাসনি কেঁদে দিয়ে মামির পা ধরে বলতে থাকল, ‘আমার সাথে তাসুকেও নাও, মামি। আমাকে যেটা খেতে দিবে আমরা দু’ভাইবোন সেটাই ভাগ করে খাব।’

অবস্থা বেগতিক দেখে মনের চিন্তা মনে পুষে রেখে তাসনির মাথায় হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে মামি বলল, ‘পাগলি মেয়ে! তোর মামার কী অতিরিক্ত একজনকে মাস-বছর ধরে টানার ক্ষমতা আছে? কোমরের ব্যথায় উঠবস করতে পারি না বলে কয়েক দিনের জন্য তোকে নিয়ে যাচ্ছি। ব্যথাটা কমলে আমি নিজেই তোকে রেখে যাব। তোর বড়মা বললেও কি আমাদের তোকে ভরণ-পোষণের ক্ষমতা আছে?’

 

তাসুর মলিন মুখ আর বেশি কান্নাকাটিতে ফুলে উঠা ভেজা চোখ তাসনির বুকের ভিতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। তাসনি আরও কয়েকবার তাসুকে সাথে নিতে মামা-মামিকে অনুরোধ করল। অবশেষে মামা-মামির মন গলে যায় বটে, তবে তা সিনেমা-নাটক-গল্পে ঘটে। বাস্তব বড় কঠিন। মামা-মামির মাথে তাসনিকে একাই ট্রেনে উঠতে হলো।

রাতে কথামতো পাশের বাড়ির কামলা জয়নাল তাসুর সাথে ঘুমিয়েছে। খাটুনির শরীর। বিছানায় পড়া মাত্র ঘুম। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তার তাসনিবু ছাড়া ঘুমায়নি। তাসনিবুর চলে যাওয়াটা তাসুর চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিছুদিন আগে স্বপ্নে বিছানা ভিজিয়ে দেয়ার কথা বন্ধু মানিকের মাকে বলাতে তাসনিবুর মৃত্যু কামনা করেছিল সেই কথা বেশি করে মনে হতে থাকায় আবারও ভেজাতে শুরু করলো। ক্রমেই তাসুর চোখের জলে বালিশ ভারি হতে লাগল।

এখান থেকে  চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের আরেকটি গ্রামে একটা অন্ধকার ঘরে ছোটোভাইয়ের কথা স্মরণ করে একই সময়ে আরেকজনের বালিশও ভিজে যাচ্ছে—যার একমাত্র সাক্ষী সৃষ্টিকর্তা।

তাসুর কাছে তার তাসনিবুবিহীন বাড়ি-ঘর অসহ্য ফাঁকা ঠেকায় সকালে বেরিয়ে দুপুর পার হতে চললেও এখনও বাড়ি ফিরেনি। ছিপ দিয়ে পুকুরে কয়েকজন মাছ ধরছিল। পাড়ে বসে তাসু তা দেখছিল। বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াতেই তাসুর চোখ চলে যায় বেশ কয়েকটি ক্ষেতের ওপারের রশিদ মেম্বারের বাড়ির দিকে। তাসু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। রশিদ মেম্বারের বাড়ি থেকে তার তাসনিবু বের হয়ে এদিকে আসছে।

মানুষ উড়তে পারে না কিন্তু এ মুহূর্তে যে কেউ দেখলে মনে হবে, তাসু তার তাসনিবুকে লক্ষ্য করে দৌড়ে নয়, যেন উড়ে চলেছে।

তাসনিবুকে নাগালে পেতেই তাসু জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করল, ‘তুই সত্যি সত্যি ফিরে এসেছিস, তাসনিবু? কার সাথে এলি?’

তাসনি মৃদু হেসে উত্তর দিল, ‘কারও সাথে আসিনি। পালিয়ে এসেছি। তোর জন্য।’

মামা বাড়ি থেকে তাসনির লাপাত্তা হবার সংবাদ মামি আগেই জমিলা বেগমকে মোবাইল করে জানিয়ে দিয়েছে। ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বাড়িতে ঢুকতেই জমিলা বেগম হেঁশেল থেকে বেরিয়ে ধমক দিয়ে থামিয়ে চিৎকার করে তাসনিকে ভর্ৎসনা করতে লাগল।

তাসুকে ছেড়ে এক রাত কাঁদতে কাঁদতে পার করার যন্ত্রণা যেন তাসনির মানসিক বয়স দশ বছর বাড়িয়ে ষোল থেকে ছাব্বিশে পৌঁছে দিয়েছে। বড়মার চেয়ে দ্বিগুণ জোরে দৃঢ় কণ্ঠে তাসনি বলে উঠল, ‘আমাদের ভরণ-পোষণের চিন্তা আর তোমাদেরকে করতে হবে না। জমি আর পানের বরজ আজই ফেরত দিবে। আমাদের ব্যবস্থা আমরাই করব। আমার বয়সী ছেলেরা যদি পারে তাহলে পানের বরজের প্রতিদিনের কাজ আমি কেন করতে পারব না? ধান ক্ষেতের টুকটাক কাজ নিজে করব আর ভারি কাজের জন্য কামলা নিব। আসার সময় রশিদ মেম্বারকে সব বলে এসেছি। কাজের মেয়ে হিসাবে আমাকে মেজো মামার বাড়িতে পাঠানোর কথাও। আজ বিকেলে লোকজন নিয়ে রশিদ চাচা আসবেন। কালই উঠোনের মাঝখান দিয়ে মা বেঁচে থাকতে যেমন ছিল ঠিক সেই ভাবে বেড়া দিয়ে দিব।’

ঘরের চৌকাঠে মিজানুর রহমান বসেছিল। ছোটোভাই সাইদুর রহমানের বাল্যকালের খেলার সাথী রশিদ মেম্বারের আসার কথা শুনে অতি রাগে সেখান থেকেই বউ জমিলা বেগমের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, ‘আগেই বলেছিলাম, লেবু বেশি টিপলে তেতো হয়ে যায়। রফিক-শফিককে শহরে রেখে পড়ালেখা করানোর খরচের ব্যবস্থা এখন থেকে তোমাকে করতে হবে। নিজের যেটুকু জমি আছে সেটুকুতে চাষ করা ছাড়া এ শরীরে অন্যের জমিতে আমি আর কামলা খাটতে পারব না।’

তাসনি আর স্বামী মিজানুর রহমানের কথায় জমিলা বেগমের মুখটা দেখার মতো হয়েছিল কিন্তু সেদিকে খেয়াল না করে দু’ভাইবোন গিয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকল।

 

সমাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top