শুভমিতা : শাহানারা পারভীন শিখা
প্রকাশিত:
২৯ জুলাই ২০২১ ২০:০৬
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৫:৫৪

শুভর সাথে আমার হঠাৎই দেখা। দেখা বললে ভুল হবে। আমিই দেখেছি ওকে। গাড়িটা শাহবাগ মোড় পার হয়ে ইউনিভার্সিটির মধ্যে ঢুকে পড়ে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার বলল,সামনে অনেক জ্যাম সেইজন্য।
ঢুকেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। মাঝখানে ঘেরাও করে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। বড় রাস্তাটা কেমন সরু হয়ে গেছে।
টিএসসির চত্বরের কাছে বসে আছি। ভীষণ জ্যাম। প্যাচ লেগে গেছে। টিএসসির ভেতর কোন অনুষ্ঠান আছে হয়তো। ইচ্ছে হচ্ছিল একটু নেমে চা খাই। অস্বাধারন লিকারের চা পাওয়া যায় এখানে।
আমি আর শুভ কত খেয়েছি। সকাল দুপুর সন্ধ্যা।সময়ের কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না তখন। শুভ মজা করে বলতো, এই মিতা হলুদ মরিচ আদা রসুন সবই আছে কোনটা খাবি বল!
"আফা! কয়েকটা কদমফুল নেন না গো আফা"। গ্লাসে আলতো টোকার শব্দে চমকে উঠি। সচকিত হয়ে উঠি।
হাতের ইশারায় না করি। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি এখনো হচ্ছে।।
ইস ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েগুলো কত কষ্ট করেই না বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফুল বিক্রি করছে। একটু মায়া হয়।
আমি জানালার গ্লাসটা সামান্য নামিয়ে মেয়েটাকে খুঁজতে থাকি।
স্যার! স্যার! এই ফুলগুলা নেননা স্যার। আফায় খুব খুশি হইবো।
এই মিতা কিনে নে না ফুলগুলো। কি সুন্দর!
তুই যদি কিনে দিস তাহলে নেব।
আমার কাছে টাকা নেই।
তাহলে থাক।
তুই না! এ্যাই মেয়ে সব ফুল তোর আপাকে দে।
চল বৃষ্টিতে ভিজি।
শুভ তোর কি মাথা খারাপ হয়ছে? আমাকে বাসায় ফিরতে হবে না!
আমার কথা কানে না তুলেই আমার হাত ধরে টিএসসি র খোলা জায়গায় নিয়ে আসে। ঝুম বৃষ্টিতে দুজন ভিজি মনের আনন্দে।
ম্যাডাম জানালার গ্লাস টা তুলে দেন।
বৃষ্টিতে ভিজে যাবেন তো।
আমি গ্লাস টা উঠিয়ে দিই।
"ম্যাডাম গিট্টু বেশ ভালোই লাগছে মনে হয়। আল্লাহই জানে কখন জ্যাম ছাড়বে। " ড্রাইভারের স্পষ্ট বিরক্তি।
আনমনে শুভর সাথে কাটানো সময়গুলো ভাবনায় চলে আসে।
গাড়ির ঝাঁকুনি খেয়ে চমকে উঠি।
দুকদম আগালোই না আবারও থেমে থাকা।
বৃষ্টিটা বেশ কমে গেছে।
জানালার গ্লাস একটু নামিয়ে এদিক ওদিক তাকাই।
কতো প্রিয় এই জায়গাটা। শুভর সাথে প্রেমটা তো এই ক্যাম্পাসেই। এই টিএসসিতেই। প্রথম দেখাতেই নাকি আমার প্রেমে পরেছিল। কবি মানুষ। হৃদয়টা প্রেমে পরিপূর্ণ। আমার কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে শুভ।
আমরা নাকি খুব ভালো বন্ধু। শুভমিতা। দুজনের নামের মাঝে নাকি একটা সেতু আছে। সেটা ভালোবাসা।
আমদের সময়গুলো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছিল। ক্লাস পরীক্ষা। শুভর আবৃত্তির অনুষ্ঠান আর আমি মুগ্ধ শ্রোতা।
এরপর কেন যেন আমাদের সে মুগ্ধতায় ভাটা এলো। শুভর সংসার বিয়ে এগুলোর প্রতি খুব বেশি টান ছিল না। জানতাম কোন বাঁধনে বেঁধে থাকার ছেলে শুভ নয়।আমাদের সম্পর্ক নির্দিষ্ট গন্তব্যে হয়তো পৌঁছবে না।
তবুও কেন জানিনা খুব ভালোবাসতাম ওকে। খুব করে চাইতাম দুজন এক হয়ে সারাজীবন কাটাতে।
খোঁজ পেলাম মাধবী নামের একজনের সাথে ইদানীং ওর দারুণ সম্পর্ক। রীতিমতো লেখিকা। দারুণ সব কবিতা লেখে। শুভর দরাজ কণ্ঠে সেসব কবিতা প্রাণ পায়।
আমাদের মাঝে যে দেয়াল তৈরি হয়েছে। ইচ্ছে হয়নি সে দেয়াল সরিয়ে নেয়ার।
দেয়ালের ওপারে শুভর বাস। এপারে আমার। পাশ করার পর আমার বিয়ে হয়ে যায়।
শুভর কথা বাড়ির সবাই জানতো। ওর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাই। আমি অমত করিনি।
সোহান আমার হাসব্যান্ড। ডাক্তার। ভীষন রকম ভালোমানুষ। শুভ আর আমার সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনেই বিয়ে হয়েছে আমাদের। আজ দশবছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি একটা ব্যাংকের চাকুরিতে আছি। আমাদের মাইশা নামের সাত বছরের মেয়ে আছে।
ছুটির দিন। আজকে আমাদের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা। রাতে খেয়েই ফিরবো বাসায়। ওকে মেডিকেল থেকে ইঠিয়ে নিতেই এপথে আসা।
মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। বৃষ্টি ঝরে এসেছে। আমি জানালার গ্লাসটা খুলে দিই। বাইরে তাকাই। হঠাৎ চোখ যায় টিএসসির ঐ জায়গাটাই। যেখানে আমার আর শুভর প্রথম দেখা হয়েছিল। ঠিক সেখানেই দাড়িয়ে আছে শুভ।
দশ বছর পার হয়ে গেছে।
এখনো ঠিক আগের মতোই আছে। হাতের ব্যাগটা মাথার উপরে ধরে আছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে।
কারো জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। সেই কদমফুল বিক্রি করা ছোটো মেয়েটা। মেয়েটার হাত থেকে সবগুলো ফুল কিনে এদিক ওদিক তাকায় শুভ।
দ্রুত জানালার গ্লাস উঠিয়ে দিই। গাড়ি চলতে শুরু করে। মেয়েটা জেগে গেছে। মেয়ের দিকে তাকাতেই মাইশা বলে,
মা! মা! তুমি কাঁদছো নাকি!
তোমার চোখে পানি কেন মা!
চোখ মুছে বলি, না মা।
জানালা খুলে বৃষ্টি দেখছিলাম তো।তাই হয়তো পানি লেগেছে।
আর কত দেরি মা!
এইতো চলে এসেছি।
তোমার বাবা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেই কখন থেকে।
আজ আমরা অনেক মজা করবো তাই না মা।
হ্যা মা।
মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরি।
গাড়ি ছুটে চলে সামনে।
পিছনে পড়ে থাকে আমার ফেলে আসা অতীত।
শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক
বিষয়: শাহানারা পারভীন শিখা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: