সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

তিন পাহাড় : ড. ময়ূরী মিত্র 


প্রকাশিত:
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৫৬

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০২:২৯

 

উঁহু! তিন পাহাড়ে পরস্পরে কোনো মিল নেই । না ধাপের আঁক কষায় না পাহাড় থেকে নদী দেখায়। পাঠক মিল পেলে ভালো। না পেলে  বলি- বেশ তো হে! তাও ভালো! 

 

এক

সেবার - ব্রিজের ওপর দুপুর। চাকা চাকা রোদ্দুর। বেশ ম্যাচ করে গেছে আমার কটকটে হলুদ শাড়িতে। বাস থেকে দেখলাম একটি সবুজ গাছে ভরা ভাঙা বাড়ি। বেশ কবছর ধরে বাড়িটা ভাঙার নোটিশ ঝুলছিল। ভাঙা পড়েছে তাও দেখেছি যাতায়াতের পথে। জানি না শুধু ভাঙার পরও ভাঙা অংশটার সবুজে ভরে ওঠার গল্পটাকে।

ছাদ ভাঙা হয়ে গিয়েছে। ঘরগুলোর দেয়াল ক্ষয়ে আসছে। তবু সে দেয়ালে ছেয়ে যাচ্ছে অটুট সবুজ। বর্ষা নেই। তাও এত লতাগুল্ম !  প্রতি ঘরের দেয়ালকে এমন আপনজনের মত ঘিরেছে, মনে হচ্ছে এরা সব একটি একটি গাছঘর। ওপরে রাংতার মত চকচকে আকাশ। কী সুন্দর! কী সুন্দর! 

ভাবলাম নামি। কে আর দেখবে ? ঢুকি সবুজের ঘর - দুয়ারে! সেখানে হয়ত দাঁড়িয়ে বেরং এক পুরুষ। ভয় হল। নাহ! আমিই বড় বেমানান। যান চলল গন্তব্যে। থাক  শ্যামল ছায়ায় সে।

ছুটল কাল। কালক্ষয় হল।

এবার – সল্টলেক। সুন্দর বাগানে সাজানো বাড়ি। সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ। পরিচয় আছে। জানি গাছ খুব ভালোবাসেন। মাঠের মাঝে শপিং মল গজালে খুব রাগ করেন। নাহ -তাঁর এই গাছ ভালোবাসায় কোনো কপটতা নেই। কিংবা আমিই জানিনি বৃক্ষপ্রেমীর মন মাঝারের ক্ষেতটুকু কতটা সত্য ছিল! 

দেখলাম - তাঁর মালি একটি বড় সবুজ দেবদারু গাছের মাথা ছাঁটছে। কেশবতী কিশোরীর একলা বৈধব্যের মত দেখাচ্ছে অনেক সবুজের মাঝে ক্রমশ ছোট হতে থাকা সবুজ গাছ। বললাম - কাটছ কেন ? পাতাগুলো ছিঁড়ছ কেন খামোখা ? মালী বললে - বেশি পাতা হয়ে ঝাঁকড়া হয়ে গেছে গাছটা! কেটে সুন্দর করে দিচ্ছি। 

মালিক। মুখে চিত্রকরের বুঝদার হাসি ---" গাছ খানিক বাড়ালেই হবে ? দেখতে সুন্দর লাগবে --মানুষের চোখ আরাম পাবে- সেটুকু গাছই রাখতে হয় বাগানে!" 

ওহ!  ভ্যানগখ! তুমি এক সূর্যমুখীর কেশর ছড়িয়ে সারা মাঠটাকে করে ফেল লক্ষ সূর্যের মাঠ। একালের চিন্তাশীল ভাইরাসের  রেগুলার খাদ্য হয়েও গাছ গেলেন। গপাগপ করে খান গাছ, গাছের পাতা, ডালপালা। একেবারে শেকড় অব্দি। গলগল ঢেউ দিয়ে মানুষের পেট বেয়ে নামে  সবুজের ধারা । বোধহয় খাদক হয়ে ওঠার শেষ অহমিকায়। বা অতিমারীর  খাদ্য হয়ে ওঠার  লজ্জা ঢাকতে। তাই বুঝি নিজের পছন্দে গাছের হাত মটকে  সে সুন্দর করে  নিজ আবাস!  

সুন্দর --তাও সে কেবল আমার ?  নির্ধারণ আমার!  রক্ষণ আমার! শেষ করাও আমার ? 

না বাবা! আমি থাকি গাধি হয়ে। প্রাণপণ  জড়িয়ে রাখি অঙ্কহীন  বিশালকে! হঠাৎ লম্বা হওয়া জঙ্গল এক সে। ও সেই  আমার মাথাভর্তি চুলওয়ালা  BABY রে! 

 

দুই

বড় হতচ্ছাড়া আমি। সবাই  দেখে পূর্ণচাঁদের সমুদ্র - যে সমুদ্র লাফায় প্রখর জোছনায়। আর আমি মেঘলা দিনের সমুদ্র - আকাশের ছায়া কাঁপে যে সাগরে। লক্ষ্য করেছি বারেবারে, মেঘা দিনে সমুদ্রের ঢেউয়ে কেমন পায়রার পাখার রঙ ধরে! কী  যে ভালো লাগে!  

বেছে বেছে বর্ষা দেখেই একবার গিয়েছিলাম পুরীতে। শহরের থেকে একটু দূরে থাকার জায়গা। সমুদ্রের তীরটা ফাঁকা ফাঁকাই থাকত। শূন্যকূলেই  দেখা পেয়েছিলাম যুগলের । উৎকলী বর আর বৌ। বর বৌ দুজনেরই তখন অনেক বয়স। জিজ্ঞেস করে জানলাম  বরটি পুরী মন্দিরের  পান্ডা। মহিলাটি কিন্তু কিছুতেই আমার সাথে সহজ হতে পারলেন না। কেবলই এড়িয়ে গেলেন। যত এড়াতে লাগলেন  ততই পুরুষটি অপ্রস্তুত চোখে হাসতে লাগতে লাগলেন মহিলার দিকে তাকিয়ে। অপ্রস্তুত কিন্তু মায়ায় কাদা হয়ে যাওয়া  চোখ। 

গা ভর্তি ভারী সোনার গয়না, উজ্জ্বল জরি শাড়িতে শরীর জড়ানো বুড়ি বউ ম ম কর্পূরের গন্ধে আমার সামনে গুটিসুটি মেরে যাচ্ছিলেন কেমন। অস্বস্তি হতে লাগল। হঠাৎই মনে হল আমার- এঁরা স্বামী স্ত্রী নন। আসেনও দুজনে দুজায়গা থেকে। কিন্তু আসা চাইই।  

সেবার প্রতিদিনই কমবেশি বৃষ্টি নামছে সমুদ্রে। তাও যে কদিন ছিলাম একদিনও কামাই দেখিনি। বরের আলাপে জানলাম, রক্তে শর্করা বেড়ে গেছে বউয়ের। ডাক্তার হাঁটতে বলেছে নিয়মিত। বউ কিছুতে হাঁটতে চান না আর বর হাঁটাবেনই। কী নিবিড় আদরে যে না হওয়া বর তাঁর না হওয়া বৌয়ের মোটা আঙুলগুলোকে জড়িয়ে নিতেন! ঢুকিয়ে নিতেন একদম মুঠি করে।  

চলে আসার দিন আকাশ জুড়ে মেঘ। মেঘের নীচে সাগরে ঝাপটায় লাখ পায়রা। ফেনায় লুটোয় পালক। তীর ধরে ছাতা মাথায় হাঁটছে বর বৌ। সেদিন হাঁটবে না বলে পণ করেছে বুড়ি বৌ। একহাতে ছাতা সামলাতে সামলাতে তাকে বইছে বুড়ো বর। এ দৃশ্যে কোনো মহান কিছু আবিষ্কার করিনি। কিন্তু আজো আকাশে যখন মেঘ উপচোয় পায়রাসাগর দুমদাম আসে আমার সমুখে। কিনারায় দু পুতুল। সুখ আর দুখ। জীবন হয় না বিমুখ।

 

তিন

আমি মহান নই। সে সাধ্যি কৈ আমার। সাধ আছে কেবল চলার পথে ছোট ছোট ভালোগুলোকে খুঁজে বেড়াবার। আর তারপর সেই খুঁজে পাওয়া ভালো মানুষ আর ভালো ঘটনাকে স্তূপ করে একটি ভালোপাহাড় বানাবার। 

দুপুর  রোদে  হনহনিয়ে যাচ্ছিলাম সল্টলেকে মায়ের বাড়ি। পথের ওপর একটি সদ্য তৈরি হওয়া প্রাসাদ। বাড়িটির সারা গায়ে গণেশ হনুমানের মূর্তি দেখে নাক মুখ কুঁচকে পালাচ্ছিল ঘোর নাস্তিক ময়ূরী। ঈশ্বর খোঁজার আগ্রহটুকুও  যার তৈরি হয়নি। হঠাৎ দেখলাম নীচে একটি বিরাট পরিষ্কার জালা। পাশে সেই বাড়ির মারওয়ারী মালিক। এই অব্দি চেনা দেখা দৃশ্য আমাদের। অবাক হলাম - যখন দেখলাম একই  জালার জল তিনি হাঁকডাক করে বিলিয়ে চলেছেন ভদ্র অভদ্র সবাইকে। ভদ্র অভদ্র মতে মানে আমাদের চালিত মতে। দুচারটে মুসলিম মিস্ত্রীকেও দেখলাম বেশ যত্ন করে জল খাওয়াচ্ছেন ভদ্রলোক। 

খচরামো করব বলেই জিজ্ঞাসা করলাম - কে শেখালে আপনাকে এসব ? 

- কী সব ?
- এই যে আপনার এই কায়দা মেরে অসাম্প্রদায়িক থাকার চেষ্টা!
- বোন আমার চেষ্টা কেবল তোমাদের সবাইকে এই গরমের দুপুরে পেটপুরে জল খাওয়ানো। শিখিয়েছেন আমার ঈশ্বর।  

এতো সাবলীল উত্তর শুনে ঝোঁক চাপল ভদ্রলোককে আরো অপ্রস্তুত করার। পাপীর পুন্যদৃশ্য অস্বীকার করার ইচ্ছে। বললাম –

- রাতে তো দোকানের গদিতে গিয়ে আটায় ভুষি মেলাবেন।
- মিলাব তো। ওউ ভি করি। এও করি। জল খেয়ে ঠান্ডা হলে তো তোমরা কজন মানুষ!            

আমার ভালোপাহাড়ে পাথর পড়লো আরো একটা। আমার একখন্ড রত্নপাথর।

পাহাড় গড়া শেষ হয়নি।

পাহাড় শেষ হয় না। 

পাথর দেয়াটা বাকি রয়ে যায়।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top