সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

ছোট্ট পাখির নীড় ও একটি ডাকবাক্সর গল্প : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:২৬

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৩১

 

আমরা তথাকথিত সভ্য মানবজাতি, ধারাবাহিক ভাবে উন্নয়ন নামক মুখোশের আড়ালে নির্বিচারে ধ্বংস করে চলেছি প্রাকৃতিক সম্পদ। গাছ কেটে, জলাভূমি বুজিয়ে মেতে উঠেছি নগরায়ন এবং শিল্পায়নের নির্লজ্জ নেশায়, আর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি গ্রীনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধিজনিত
বিশ্ব উষ্ণায়নের ভয়াবহ ফল। দুই মেরুপ্রদেশের বরফ গলতে শুরু করেছে, খরা, বন্যা, আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মহাঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অধুনা প্রায় বাৎসরিক ঘটনায় রূপান্তরিত।
একদম হাতের সামনে টাটকা উদাহরণ একটার পর একটা সাইক্লোন কীভাবে আছড়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গে। আগে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য এই ঝড়ের হাত থেকে আমাদের যেভাবে রক্ষা করত, অরণ্য ধ্বংসের পরিণামে সেই রক্ষাকবচ থেকে আমরা নিজেরাই নিজেদেরই বঞ্চিত করেছি। অবিবেচক শিকার আর বন্যপ্রাণির প্রাকৃতিক বাসভূমি ধ্বংসের মাধ্যমে যে আমরা কত শত প্রাণিকুলকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছি, আরও কত শত যে বিলুপ্তির অদূরে দাঁড়িয়ে আছে, তা বর্ণনা করা এই স্বপ্ল পরিসরে অসম্ভব। মানুষ কিন্তু কখনও একা বেঁচে থাকতে পারে না, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের মাধ্যমে মানুষ নিজেকেই অনিবার্য অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে।

তবে সবটাই তো অন্ধকার নয়, বহু সচেতন মানুষ এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সচেতন ভাবে লড়াই করে যাচ্ছেন বলেই আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে, পৃথিবীটা বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে যায়নি এখনও। এ রকমই একটা ভালো খবরে চোখ রাখা যাক।

সেদিন বিকেলে তিনটে নাগাদ, ইংল্যান্ডের, ‘সাফোক’ কাউন্টির, ‘অরফোর্ড’ পোস্টঅফিসের কর্মচারী, ‘ফিল অ্যান্ডারসন’, ‘জেডগ্রেভ’ রোডের, ‘অরফোর্ড’ ডাকবাক্স থেকে চিঠি আনতে গিয়ে দেখেন, অবাক কাণ্ড, ডাকবাক্সের মধ্যে একটা ছোট্ট পাখির বাসা! সকালে মেইল ক্লিয়ারেন্সের সময় যখন তিনি এসেছিলেন তখনও তো ওটা এখানে ছিল না, মানে কয়েক ঘন্টার মধ্যে বাসাটা বানানো হয়েছে, কে জানে হয়তো কিছু কাজ বাকি আছে এখনও, বাসার মালিকেরা তখন সেখানে নেই। ‘ফিল’ ততক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছেন, বাসাটা বাঁচাতে হবে, এই ডাকবাক্সের ব্যবহার এখনই যেভাবে হোক বন্ধ করতে হবে।
তাড়াতাড়ি চিঠিপত্র বার করে নিয়ে ফোন করলেন পোস্ট মাস্টারকে, তিনি অনুমতি দিলেন, বললেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি কথা বলে নেবেন, “তুমি এখন যা করলে ভালো হয় সেটা করো।” ‘ফিল’ খবর দিলেন, ‘সাফোক’ ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টকে। তারা সঙ্গে সঙ্গে নজরদারি শুরু করল। ডাকবাক্সটিতে একটি নোটিস ঝুলিয়ে দিয়ে বলা হল, ‘এই ডাকবাক্সটিতে পাখির বাসা আছে, বাসাটি বাঁচাতে এটি ব্যবহার করবেন না, ধন্যবাদ।’
পরের দিনই রয়্যাল মেইলের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে জানালেন,
‘সকলকে অবগত করা হচ্ছে, ‘জেরগ্রেভ’ রোডের ‘অরফোর্ড’ ডাকবাক্সটিতে পাখিতে বাসা বেঁধেছে, বাসাটি রক্ষা করতে অনুগ্রহ করে আপাতত এটি ব্যবহার করবেন না, ‘অরফোর্ড’ পোস্টঅফিসে এসে চিঠি পোস্ট করুন, এই অসুবিধার জন্য আমরা দু:খিত।’
‘সাফোক’ ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ওই ডাকবাক্স থেকে তারপর থেকে চিঠির বদলে ট্যুইট পাওয়া যাচ্ছে, মানে পাখিদের কিচিরমিচির। পাখির ডাক থেকে তারা ধারণা করেছিলেন এটি, ‘ব্লু টিট’ অথবা ‘গ্রেট টিট’ প্রজাতির পাখি। তবে পাখিদের বিরক্ত করা হবে না বলে ডাকবাক্স খুলে কিছু দেখা হয়নি। ডাকবাক্সটির অবস্থান ছিল গাছপালার মধ্যে, সম্ভবত পাখিরা ডাকবাক্সটিকে প্রকৃতির অংশ ভেবে নিয়েছিল। একজন সচেতন পোস্টম্যান, ‘সাফোক’ ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট আর ‘রয়্যাল মেইল’ কর্তৃপক্ষের যৌথ প্রচেষ্টায় পক্ষি দম্পতির সংসার রক্ষা পেল, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্ত ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে এই পৃথিবীর বুকে।
আর একজন মানুষও যদি পৃথিবীর কোনও এক কোণে, এই ভালো খবরের দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়ার সম্ভাবনা একটু হলেও বৃদ্ধি পাবে; সেটাই হবে পরম পাওয়া।

 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top