সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

'এলো খুশির ঈদ' গানের নেপথ্যকথা : আহমেদ জহুর


প্রকাশিত:
১৩ এপ্রিল ২০২২ ০১:৩৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১২:৩৫

 

ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার সাথে সাথে ঘরে ঘরে বেজে ওঠে, 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ'। কিন্তু গানটি কাজী নজরুল ইসলাম কেনো এবং কোন্ প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন, তা আমরা অনেকেই জানি না।

একদিন 'শ্যামা সঙ্গীতের' রেকর্ডিং শেষে বিদ্রোহীকবি কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে তাঁর পথ আগলে ধরেন সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীন। কবিকে বিনয়ের সাথে জানালেন একটা আবদার নিয়ে এসেছেন তিনি। আবদারটি না শোনা পর্যন্ত নজরুলকে তিনি এগুতে দিতে চান না। তখন নজরুল বলেন, 'বলে ফেলো কী তোমার আবদার?' আব্বাস উদ্দীন বলেন, 'কাজীদা, একটা কথা আপনাকে বলবো বলবো করেও বলা হচ্ছে না। দেখুন না, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল- এরা কী সুন্দর সব উর্দু কাওয়ালি গেয়ে চলেছেন। এসব এখন অনেক জনপ্রিয়। বাংলায় ইসলামি গানতো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামি গান গাইলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার জয়গান হবে।'

বাজারে তখন শ্যামা সঙ্গীতের জয়-জয়াকার। শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে সবাই রীতিমত বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পী হিন্দুনাম ধারণ করেছেন। মুনশী মোহাম্মদ কাসেম হয়ে গেছেন ‘কে. মল্লিক’ এবং তালাত মাহমুদ হয়েছেন ‘তপন কুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সঙ্গীত গাইলে গান চলবে না। নজরুল নিজেও শ্যামাসঙ্গীত লেখেন, সুর দেন। গানের বাজারের যখন এমনই দৈন্যদশা তখন আব্বাস উদ্দীনের এহেন আবদারের জবাবে নজরুল কী বলবেন? 'ইসলাম' শব্দের সাথেতো তাঁর কত আবেগ ও অনুভূতি জড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন, পবিত্র কোরআন শিখেছেন, এমনকি তাঁর নিজের নামের সাথেওতো ‘ইসলাম’ আছে।

নজরুল ভাবলেন, গান না হয় তিনি লিখবেন। তবে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে গান লিখলেন তা রেকর্ড করবে কে? গান রেকর্ড করতে হলেতো বিনিয়োগ করতে হবে, সরঞ্জাম লাগবে। এগুলোর জন্য ভগবতী বাবুর কাছেই যেতে হবে। ভগবতী বাবু হলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন চার্জ। একটু দম নিয়ে নজরুল বললেন, 'আগে দেখ, ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে পারো কিনা।' আব্বাস উদ্দীন ভাবলেন, যাক, কাজীদার কাছ থেকে অন্তত সবুজ সংকেত পাওয়া গেল। এখন ভগবতী বাবুকে কিভাবে রাজী করাতে হয়, সেই চেষ্টাই করতে হবে।

একদিন ইতস্ততা কাটিয়ে ভগবতী বাবুর কাছে গিয়ে আব্বাস উদ্দীন অনুরোধ করলেন। কিন্তু বাবু ঝুঁকি নিতে রাজী না। মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে। আব্বাস উদ্দীন যতই অনুরোধ করছেন, ততই তিনি বেঁকে বসছেন। কিন্তু আব্বাস উদ্দীনও নাছোড়বান্দা, অনুরোধ করেই চলেছেন। এভাবেই পার হয়ে গেল ছয় মাস। একদিন ভগবতী বাবুকে ফুরফুরে মেজাজে দেখে আব্বাস উদ্দীন বললেন, 'একবার এক্সপেরিমেন্ট করেই দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ক্ষতি কী?' ভগবতী বাবু বললেন, 'নেহাতই নাছোড় আপনি। আচ্ছা যান, করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।'

কবি নজরুল চা আর পান পছন্দ করেন। এক ঠোঙা পান আর চা নিয়ে আব্বাস উদ্দীন গেলেন নজরুলের রুমে। পান মুখে নজরুল খাতা কলম হাতে নিয়ে একটা রুমে ঢুকলেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বাস উদ্দীন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন আর পায়চারী করছেন। প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেলো। এরপর বন্ধ দরজা খুলে নজরুল বের হলেন। পানের পিক ফেলে আব্বাস উদ্দীনের হাতে একটা কাগজ দিলেন। আব্বাস উদ্দীন কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন- 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।'
---
আব্বাস উদ্দীনের চোখ আনন্দে ছলছল করছে। একটা গানের জন্য তাকে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সেই গান এখন তার হাতের মুঠোয়। তিনি কি জানতেন, ওই গানটি একদিন ইথারে ইথারে পৌঁছে যাবে? ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে টিভি, রেডিও, মোবাইল ফোনে ভেজে উঠবে-'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।'

তথ্যসূত্র : আব্বাস উদ্দীনের আত্মজীবনী- ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা'।

 

আহমেদ জহুর
কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top