সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশে বৈশাখ : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০২২ ০০:৩৯

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৩২

 

যেহেতু‌ বাঙালির একমাত্র সর্বজনীন উৎসব পয়লা বৈশাখ, তাই এই উৎসবটি বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, বর্ণের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে হইহই করে পালন করেন। এখানে ধর্মের কোনও সংকীর্ণতা নেই। আর সেই কারণেই বাংলা মাসের প্রথম দিনের এই উৎসবটি এতটা ব্যাপক আর প্রাণবন্ত।

শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানেই বাঙালি আছে, সেখানেই পালিত হয় এই পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ।

বিদেশের কোন দেশে কীভাবে পালিত হয় পয়লা বৈশাখ, সেটা জানার জন্যই আমি যোগাযোগ করেছিলাম বিদেশে বসবাসকারী স্বনামধন্য বাঙালিদের সঙ্গে। 

পয়লা বৈশাখ নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম আফ্রিকা মহাদেশের লেসথো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্যান্সার ক্লিনিকের পেলিয়েটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং আফ্রিকার লেসথোর বাংলাদেশ পোয়েট্রি কর্ণারের সমন্বয়ক হাসান মাসুমের কাছে। তিনি পহেলা বৈশাখ নিয়ে বললেন, লেসথো আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণে  অবস্থিত একটি স্বাধীন দেশ। লেসথোর চারিদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সীমান্ত, এ জন্য লেসথোকে বলা হয় 'লেয়ার লক' কান্ট্রি। এর অন্য নাম মাউন্টেইন কিংডম।

লেসথো'র অরায় দুশো বাংলাভাষী পরিবার বসবাস করেন।

এ ছাড়া আরও অনেক বাংলাভাষী মানুষ আছেন যাঁরা দেশে পরিবার রেখে এখানে এসে চাকুরি বা ব্যবসা করেন। লেসথো'তে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয় ১৪ই এপ্রিল। তবে কখনও ১৫ এপ্রিলও বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়।

গত দু'বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়নি। কিন্তু এর আগে পর্যন্ত প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ পালন করা হতো ব্যক্তি উদ্যোগে অথবা কখনও সমষ্টিগত ভাবে। 

বিগত বছরগুলোতে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় সমষ্ঠিগতভাবে লেসথো'র রাজধানী মাসেরু'তে। কখনও লেসথো গলফ ক্লাবের বিশাল মাঠে অথবা মাচাবেং ইন্টারন্যাশনাল কলেজের উন্মুক্ত অডিটোরিয়ামে। 

পহেলা বৈশাখের এই দিনটিতে লেসথো'র বিভিন্ন জেলা থেকে বাংলাভাষী মানুষেরা সপরিবার চলে আসেন রাজধানী মাসেরুতে। পহেলা বৈশাখের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে অংশ  নিতে। 

এই অনুষ্ঠান আরম্ভ হয় সকাল দশটায়। উদ্বোধনে আমন্ত্রণ জানানো হয় লেসথো'র সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের। বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। উদ্বোধন পর্বে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং একই সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন প্রবাসী বাঙালিরা। 

তারপর শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে--- এসো হে বৈশাখ এসো এসো... গানটি দিয়ে। সেই সঙ্গে নৃত্যের তালে তালে মেতে ওঠে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা। সংগীত ও নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে চলে নানা ধরনের পিঠা-পুলি খাওয়া।  

তারপর আরম্ভ হয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। ছোটদের এবং বড়দের আলাদা আলাদাভাবে। 

চলে পান্তাভাত, ইলিশ মাছ ভাজা-সহ অন্যান্য খাদ্য সমভিব্যাহারে মধ্যাহ্ন ভোজন। বিকেলে আবার সংস্কৃতি অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী থাকে।

সন্ধ্যার আগে আগে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে নববর্ষ-বরণ অনুষ্ঠানের।

আমার আর এক দীর্ঘ দিনের বন্ধু, নরওয়ে থেকে প্রকাশিত একমাত্র বাংলা পত্রিকা 'সাময়িকী'র প্রধান সম্পাদক ভায়োলেট হালদার থাকেন বার্গেন শহরে। তিনি জানালেন, কোনও পহেলা বৈশাখ যদি সোম থেকে শুক্রবারের মধ্যে পড়ে, তা হলে ওই দিনটি উদযাপন করা হয় তার পরের শনিবার বা রবিবারে। কারণ পহেলা বৈশাখ পালন করার জন্য এখানে কোনও ছুটি পাওয়া যায় না। এখানে মূলত বাঙালিরাই অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের জন্য কোনও কমিউনিটি হল ভাড়া নেওয়া হয়। সাধারণত বেলা বারোটা থেকে বিকেল চারটে অথবা বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যা ছ'টা-সাতটা অবধি অনুষ্ঠান চলে। মূলত নাচ, গান, আবৃত্তি।

উল্লেখযোগ্য হল, এ দিন মহিলারা সবাই শাড়ি পরেন। বাঙালিরা ছাড়াও নরওয়েজিয়ানদের আমন্ত্রণ জানালে তাঁরাও আসেন। কয়েকজন নরওয়েজিয়ান অবশ্য বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তাঁরা প্রতি বছরই অতি উৎসাহে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে আসা লোকজনদের জন্য আমরা নিজেরাই যে যার মতো বাড়ি থেকে নাড়ু, চালভাজা, দই, জিলাপি, রসগোল্লা  বানিয়ে নিয়ে যাই। আনুষঙ্গিক যা খরচ হয় সেগুলো আমরা সবাই মিলে বহন করি।

এই প্রসঙ্গেই মুখ খুললেন আমার আর এক দীর্ঘদিনের বন্ধু, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মেলবোর্ন ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক, ‘গভারন্যান্স অ্যান্ড এডমিনিস্ট্রেশন ইনোভেশন নেটওয়ার্ক’-এর প্রেসিডেন্ট ও সিইও, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া স্টেটের আন্তঃসংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা  ড. শরীফ আস্-সাবের। তিনি বললেন, প্রবাসে বাঙালিদের সব চাইতে বড় উৎসব বাংলা নববর্ষ।

প্রতি বছর বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় উদযাপিত হয় বাঙালির এই প্রাণের উৎসব। অস্ট্রেলিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। সবচেয়ে বড় দুই শহর, সিডনি এবং মেলবোর্ন-সহ দেশের অন্যান্য শহরে এই উৎসবটি বেশ ঘটা করেই পালন করা হয়।

এই উপলক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিটি বড় শহরে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সিডনির বৃহত্তম বৈশাখী উৎসব অনুষ্ঠিত হয় শহরের অলিম্পিক পার্কে। মেলবোর্ন সিটি কাউন্সিলের সহযোগিতায় মেলবোর্নের সব চাইতে বড় এবং বর্ণাঢ্য বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ কালচারাল এক্সচেঞ্জ।

বছরের একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই নতুন বছরকে বরণ করা হয়। তাই এই বৈশাখী অনুষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে, ‘দক্ষিণ এশিয়া উৎসব’। মেলবোর্ন শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে ফেডারেশন স্কোয়ার সংলগ্ন বিরারুংমার মাঠে আতশবাজি পুড়িয়ে, ফানুস উড়িয়ে উৎসবের শুরু হয়। মেলায় অজস্র দোকানীরা তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেন। বিক্রি হয় শাড়ি, চুড়ি, খেলনা, বই-সহ আরও কত কি।

এ ছাড়াও শিশুদের বিনোদনের জন্য থাকে নানা বিনোদন ও খেলাধূলার আয়োজন। আর থাকে পিঠা পুলি, ফুচকা, চটপটি থেকে শুরু করে রকমারি খাবারের স্টল। সেই সঙ্গে স্টেজে চলে বৈশাখের গান, নাচ, আলোচনা।

মেলবোর্নের আরও অনেক সংগঠন আলদা আলাদা ভাবে বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন প্রতি বছর গ্লোরিয়া পাইক নেটবল কমপ্লেক্সে খুব বড় করে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে থাকে। 

বহু দিন ধরে বিদেশের মাটিতে থাকা শুধু এই তিন জন বিশিষ্ট বাঙালিই নন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে থাকা আমার আরও অনেক বন্ধুর সঙ্গেই আমি কথা বলেছি। পয়লা বৈশাখ নিয়ে তাঁরাও জানিয়েছেন তাঁদের আবেগ, ভালবাসা, প্রস্তুতিপর্ব এবং অভিজ্ঞতার কথা। এবং সে সব শুনে আমি এটাই বুঝতে পেরেছি যে, সে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই হোক না কেন, সেখানে যে কোনও ভাষারই প্রাধান্য থাকুক না কেন, যেখানে অন্তত দু'জন বাঙালি আছে, সেখানে খুব ছোট করে হলেও, উদযাপিত হয় বাংলা ক্যালেন্ডারের এই প্রথম দিনটি।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top