সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বাজার সদাই : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
৬ জুলাই ২০২২ ০৫:২৭

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৭

 

সেই কখন থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ় মাস, আবহাওয়া ভালো না হলে কাল হয়তো বাজারে কিছু পাওয়া যাবেনা। বাজারে যাব যাব চিন্তা করে এই নিয়ে তিনবার কাপড় পাল্টালাম। নাহ্ এবার যাই। বাসার সামনে একটুকরো উঠোন, আধভাঙ্গা পাঁচিলের প্লাষ্টার খসে পরা ইটগুলোর দাঁতাল হাসি উপেক্ষা করে সাবধানে পা বাড়াই। পুরো উঠোন কাঁদা, পানিতে মাখামাখি বলে পরপর দুটো করে ইট সাজিয়ে রাস্তা পর্যন্ত চলাচলের সাময়িক ব্যবস্হা। ইট গুলোতে এরই মধ্যে শ্যাওলা ধরেছে, পা পিছলে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। মনে মনে বলি, এ বয়সে কোমর ভাঙ্গলে সারা জীবন আর উঠে দাঁড়াতে হবে না! তা পাঁচিল যেমনই হোক পাঁচিলের পা ঘেঁষে একধারে দুটো বেলি ফুলের গাছ ফুলে - কুঁড়িতে ছেয়ে আছে আর ওধারে হাতের কাছে পাওয়া গেছে এমন গাছের ডাল, মিষ্টির বাক্স বাঁধার প্লাষ্টিকের দড়ি দিয়ে কোনোমতে একটা মাঁচা দাঁড় করানো। মাঁচায় কয়েকটি কচি ধুন্দুল উঁকি দিচ্ছে, এখনো তাদের নাভী থেকে হলদে রংয়ের মায়াবতী ফুলটি ঝড়ে যায়নি। মাঁচার নীচে কয়েকটি পুঁই এর ডাঁটা পুতে দিয়েছি দু সপ্তাহ আগে, সেগুলো এখনও সবল হয়ে উঠেনি। এমন বৃষ্টি হলে আবার পচে না যায়। এ বাড়িতে আমি ছাড়াও আরও দুটো পরিবার থাকে। সম্পর্কে তারা আমার নিকট আত্মীয় হলেও হাঁড়ি আলাদা। তাই নিজের পেটের ধান্ধা নিজেকেই করতে হয় আমাকে। আর আমিও কারো সাথে অতটা মাখামাখি পছন্দ করিনা, নিজের মত থাকতে চাই। কে শত্রু হলো কে বন্ধু হলো সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি এতকাল এখন এসবের মুখে দরজা এঁটে দিয়েছি। গেটের পাশে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি রিক্সার জন্য অপেক্ষা করব নাকি হেঁটে এগিয়ে যাব। প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে একটা রিক্সা পেয়ে উঠে পরি। গন্তব্য কাঁচা বাজার। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে বলে ছুটির দিন হলেও আজ বাজার তেমন জমেনি। আমি এক আঁটি পুঁইশাক কিনে পাশের সবজি ওয়ালার দিকে তাকাতেই দেখি বেশ ঢাউস সাইজের বেশ হলদে বর্নের একটি মিষ্টি কুমড়া আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটি হাসি দিল। আহা কি করে ফেলে যাই তাকে, ত্রিশ টাকা দিয়ে তার চিকন একফালি ব্যগে ঢুকাই।

ছোট বেলায় বাবার সাথে বাজারে যেতাম। বাবা কেবল শুক্রবারেই বাজার করতেন। বাসা থেকে বাঁশের চিকন শলা দিয়ে তৈরী খাড়ই নিয়ে বাজারে যেতেন তিনি। আজকাল আর খাড়ই এর চল নেই, সহজলভ্য পলিব্যাগের অত্যাচারে পাটের ব্যাগ, কাগজের ঠোঙ্গার ত্রাহি অবস্হা। মাছের বাজারে এখনও যদিও নাইলনের ব্যাগের ব্যবহার আছে তবে বিশ টাকা দিয়ে একবার ব্যবহারের জন্য একটা ব্যাগ কিনতে গায়ে লাগে। তার থেকে অন্য সদাইয়ের সাথে ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর থেকে যেসব কাপড়ের ব্যাগ আসে সেগুলো ব্যবহার করা ঢের ভালো। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে মাছের বাজারে এসে দাঁড়িয়েছি খেয়াল নেই। পরিচিত মাছ ওয়ালা রহিম আজ আসেনি, তার জায়গায় আজ অন্য লোক। ঝুড়িতে রাখা মাছের মধ্যে উঁকি দেই, সব্জিতে দেয়ার জন্য নদীর ডিমা চিংড়ি খুঁজি। নাহ নেই হতাশ হয়ে একটু জোরেই বলে ফেলি। মাছ ওয়ালা উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করে," কি মাছ নাই, এই দেহেন কত্তো মাছ। নদীর পোয়া আছে, টেংরা আছে নেন। চাইরদিকে যে বইন্যা কাইল থিকা মাছ পাওয়া কঠিন হইব। " পোয়া মাছের দাম হাঁকছে আট' শ টাকা কেজি। শুনে কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। এ মাছ সাড়ে ছয়'শ টাকা কেজি ছিল সপ্তাহ দুই আগে। তবে চকচকে টেংরা মাছের চেহারা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না, এককিলো কেটে দিতে বললাম।এ মাছটির সাথে বড্ড বেশী সখ্যতা আমার। দেড় কিলো সস্তার মাছ তেলাপিয়াও নিলাম দুঃসময়ে কাজে দেবে এই ভেবে। মাছ কাটতে দিয়ে আমি এদিক ওদিক দেখি, নানা জনের নানান কথা শুনি। ইন্টারনেটে আবহাওয়ার খবর যা পাওয়া যাচ্ছে তা শুনে শঙ্কিত হই। বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, সিলেট শহরে পানি ঢুকে পড়েছে, সুরমা নদীর পানি স্বাভাবিকের তুলনায় চুয়াল্লিশভাগ উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মাছ কাটুনি পান মুখে দিয়ে পাশে বসে থাকা পোষা কুকুরটির সাথে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। তার হাত আর মুখ সমান তালে নড়ে চলছে। কুকুরটিও মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে খানিক বাদে বাদে লেজ নাড়াচ্ছে। মাছ কাটুনি বলছে," এমন গাদলা দিনে দ্যাশে গামছা পাতলে অনেক গুড়া মাছ পাওয়ন যায়..., দ্যাশে থাকলে তোর আর আমার খাওনের অভাব হইতো না, যামু গিয়া, কি কস? দ্যাশে গিয়াও খাইডা খামু, এহনও খাডি; তয় দ্যাশে মরলে কব্বর হইব আর এহানে মরলে বেওয়ারিশ। তুইও বেওয়ারিশ আমিও বেওয়ারিশ, মাডি পাইতাম নারে, মাডি পাইতাম না.... "। কি গভীর উপলদ্ধি! এভাবে তো কখনও চিন্তা করি নাই। এর মধ্যেই আরেক মাছওয়ালা ঝাঁকা ভর্তি কুঁচো চিংড়ি নিয়ে পাশে এসে বসে। সবুজ কলাপাতার উপরে রুপালি কুঁচু চিংড়ি গুলো যেন হাসতে থাকে। আমি দাম জিজ্ঞেস করিনা সংকোচে। আজ বেশী টাকা নি য়ে বের হয়নি। তা ছাড়া যাওয়ার পথে ডিম আর টকদই নিতে হবে। মাছ কাটুনি চিংড়ি মাছওয়ালার উদ্দেশ্যে বলে " এমন কুঁচো চিংড়ির বড় এক ঝুড়ি আগে পাঁচ টাকায় পাওয়ন যাইত।" পাশে দাঁড়ানো একটা চ্যাংড়া ছেলে প্রায় সাথে সাথেই বলে ওঠে, " কাকু হেইডা তো হেই ঈশা খাঁ'র আমল আছিলো, যহন কিনা ট্যাকায় আট মন চাইল পাওন যাইতো।" আশে পাশে খুক খুক হাসির শব্দ ক্ষীণ হয়ে যেতে যেতে শৈশবের বর্ষার দিনগুলো মনে পড়ে, রান্না ঘড়ে তাওয়ায় কুঁচো চিংড়ি টেলে শুকনো মরিচ আর বেশী করে পিয়াজ দিয়ে পাটায় পিসে ভর্তা বানাতেন জরিনা খালা। আহা সে ভর্তা দিয়ে হাপুসহুপুস একপ্লেট ভাত খাওয়া যেত। খেতে খেতে নাকের জল চোখের জল এক হলেও মনে হত আর একটু চাই। কোনও কোনও দিন হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে, সিদ্ধ আলু হাতে ভেঙ্গে দিয়ে ঝোল রান্না হত, আহা সেটা ছিল অমৃত। মা ছোট ছোট বাটিতে করে আমাদের সবার জন্য ডিমের সালুন বেড়ে দিতেন, ছোট বোন করুনা বেছে বেছে সবচেয়ে বড় ডিমটা নেবার বায়না ধরত। সেই সব আর কত দিন আগের কথা, এইধর চল্লিশ বছর, ঈশা খাঁর আমলতো নয়! মাছ কাটুনির কাছ থেকে মাছ নিয়ে আধাকিলো কুঁচো চিংড়ি ব্যাগে ভরে দুইহালি হাঁসের ডিমও কিনে ফেলি। বাজার শেষে রিক্সা নিব বলে রাস্তার মাথায় এগিয়ে লাইটপোস্টের নীচে শাকওয়ালীর ত্রিপোলের নীচে দাঁড়াই। শাকওয়ালী একগাল হেসে জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছেন খালা?ভাল ডাঁটা আছে খালা, এক্কেবারে কচি, নিয়া যান"। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে একমুঠি ডাটা কচ করে ভেঙে বাগে ঢুকিয়ে দেয়। আমি বলি ডিমা চিংড়ি পাই নাই, ডাঁটা কি দিয়ে খাব? টেংরা দিয়ে ডাঁটা রান্না হবে? " হইব না মাইনে, কয়ডা কাঁঠালের বীচিও ন্যান"। আমি হায় হায় করে উঠি কাঁঠালের বীচি কে বাছবে কে পরিস্কার করবে?
"এইডা আবার কষ্ট কি? হালকা গরম পানিতে খাওনের সোডা দিয়া কাঁঠালের বীচি ভিজাইয়া থুইয়া ডাঁটা কাইট্টা লইবা। এরপর বীচি হাত দিয়া ডলা দিলেই দেখবা এক্কারে ক্লিয়ার। " আমি ওর ক্লিয়ার বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলি, জিজ্ঞেস করি আর রান্না করবো কেমনে? " মাছ হলদি নুনে মাইক্খা তেলে ভাইজা নিবা। ডাঁটায় মশল্লা কম দিবা। পিয়াজ কুচি আর রসুন ছেইচ্চা অল্প হলুদ, মরিচ,ধনিয়া গুড়া হাতে ভাল কইরা কচলাইয়া ডাঁটা কাঁঠালের বীচি আলগা কইরা মাইক্খা হাতধোয়া পানি দিয়া নিভা জ্বালে বসাইবা। হইয়া আইলে মাছগুনা ছাইড়া দিয়া নাগা মরিচ ভাইঙ্গা ঢাকনা দিয়া দিবা। রান্ধন শ্যাষ। নাগা মরিচ আছে, দেই দুইডা?" শাকওয়ালীর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রিক্সা ডাকি। রাস্তার দুই ধারে বৃষ্টির পানি জমে যাচ্ছে, আজকাল আর তেমন কেউ বৃষ্টির পানি ধরে রাখেনা। আগে দেখতাম ডাল, ভাত রান্নার জন্য বড় বড় মাটির মটকিতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হত। রান্না ঘরের দরজার পাশেই থাকতো সেসব মটকি। এখন মানুষ এসিড রেইন এর কথা চিন্তা করে, এসব ছোটখাট গৃহস্হালির আয়োজন আস্তে আস্তে চর্চা থেকে বাদ পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে।

বাড়ির গেটে এসে রিক্সা থামাতেই আমার সহকারী শেফালী ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসে। বাজারের ব্যাগ নামাতে নামাতেই জানায় বাসায় মেহমান এসেছে। মনে মনে বলি অতিথি নারায়ণ। বারান্দায় পা রাখতেই ছোট্ট বেলার বন্ধু মিলি এসে জড়িয়ে ধরতে চাইলে চিৎকার করে উঠি, বাজার থেকে এলাম খবরদার ছুঁবিনা। কোভিডের পর অনেক সচেতন হয়ে গেছি আমরা সবাই। মিলি আমার পিছু পিছু বাথরুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। মিলির ছোট ছেলে শিপলু এসে সালাম দেয়। মিতু সিলেটে থাকে, সপ্তাহখানেক আগে বিশেষ একটা কাজে শিপলুকে নিয়ে বরিশাল গিয়েছিল। আজ সকালে ঢাকা ফিরে সিলেটে যাবার কথা। কিন্তু সিলেটে বন্যার যে অবস্হা তাতে কয়েকটা দিন ওদের আমার এখানে থাকতে হবে। আমি শুনে আহ্লাদিত হই, বন্ধুকে কয়েকটি দিন কাছে পাব বলে।কিন্তু শিপলুর দিকে তাকিয়ে আমার বাজারের কথা মনে হয়, কি সব হাবিজাবি কিনেছি আজ, ছোট মানুষ , ও কি এগুলো খাবে? শিপলুকে জিজ্ঞেস করি, হ্যাঁরে তোরা দুপুরে কি খাবি? শিপলু ঝটপট উত্তর দেয়, "কাবাব"। শেফালীকে ডেকে ফ্রিজে ফ্রোজেন কাবাব আছে কিনা দেখতে বলি। কিছুক্ষণ পরে এসে শেফালী জানায় কাবাব নাই, দুই পিস সসেজ আছে। সয়া নাগেটস আর ছোলার ডাল ভিজাতে বলি। কযেকদিন আগে সয়া নাগেটস, ছোলার ডাল আর বিফ সসেজ দিয়ে আমার নিজের রেসিপিতে একটা কাবাব বানিয়েছিলাম, মান রক্ষার্থে আজ সেটাই আবার বানাতে হবে। শিপলুকে ডেকে বলি, আয় অনলাইনে কিছু বাজার সদাই ওর্ডার করি। আমি ফর্দ টাইপ করি, কাবাব, পোলাউয়ের চাল, মুগডাল, মুশুরের ডাল, দুধ, বিস্কুট...। শিপলু আচমকা প্রশ্ন করে, "খালামনি খিচুরী হবে?" অবাক চোখের কচি মুখটির দিকে তাকিয়ে বলি, হবে সোনা। আমার ফর্দ লম্বা হয়... চকলেট, পাকা কলা, লেবু, চারটি মোরগ, দু' ডজন ডিম.....


সমাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top