সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষণিকের অতিথি : রওনক খান


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০২:৫২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১৫

 

সেবার আমি আর আম্মা ঢাকা থেকে প্রায় মাসখানেক পরে বগুড়ার বাড়িতে ফিরেছি। সময়টা ছিল সম্ভবত ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ। রংবাহারী ফুলেরা তখনও প্রসন্ন চিত্তে চারিপাশ আলো করে প্রস্ফুটিত হচ্ছে । আমাকে আম্মা বাড়ির মূল দরজা থেকে হাত ধরে শোবার ঘরে ঢুকতে না দিয়ে সোজা উঠানে এনে দাঁড় করালেন। আমি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে উঠানের বাম পাশে তাকিয়ে দেখছি বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে একটি চমৎকার ফুলের বেড অজস্র ছোট ছোট সাদা, বেগুনি, ফিকে বেগুনী রং এর ফুলে ছেয়ে আছে। গাছগুলো মাটিতে ছড়ানো। অনেকটা সরষে ক্ষেতের মত। আম্মা মিটিমিটি হেসে বললেন,
"কি রে সুন্দর না? "
আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলাম "এ কান্ড কবে করে রেখেছিলে? কি অপূর্ব লাগছে”।
আম্মাও খুব খুশি হয়ে বললেন, "ঢাকায় যাবার আগে আগেই এখানে বেড করে বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, তুই কিছুই দেখিসনি। তুই স্কুলে চলে গেলেই সেই ফাঁকে আমি এই কাজটা করেছি।
আমি সেই সেদিনের ফুলেল চমকটা আজও ভুলিনি। ফুলগুলোর নাম আমার ঠিক মনে পড়ছে না । সম্ভবত পন্সি বা এই জাতীয় কোন নাম হবে।
শীতের ফুল। শরতের শেফালীর মতন ঠিক একরাতের অতিথি না হলেও এরাও অত্যন্ত স্বল্পায়ু। তাতে কি, যে ক দিন ফুটে থাকে বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যের অখন্ড মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে। প্রকৃতির এক অতি ক্ষুদ্র সৃষ্টির কি বিশাল দক্ষযজ্ঞ । আমার সৌখিন বাগানী মা ঠিক হিসেব করে বীজ ছড়িয়ে রেখেছিলেন।তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই ঐ বেডটি ফুলে ভরে উঠবে। মা মেয়ের নিবিড় আনন্দযোগে সেদিনের বিকালটি হয়ে উঠেছিল একান্তই পন্সিদের ( হয়তোবা)।
ফুলের বাগানে শীতের অতিথিদের আনাগোনা শুরু হয়ে নভেম্বরের শুরু থেকেই। মধ্যবিত্তের স্বল্প পরিসরের বাগানে তখন থেকেই মাটিফুঁড়ে চারা হয়ে মাথা উঁচু করতে শুরু করে কসমস, ডালিয়া, জিনিয়া,চন্দ্রমল্লিকা, পন্সি, হলিহক, রকমারি গাঁদা এবং একঝাঁক পিটুনিয়া। ঠিক যেন আকাশ থেকে এক দল প্রজাপতি তাদের রঙীন ডানা মেলে মাটিতে নেমে এসেছে। ইদানীং আরও কিছু ভিন্ন প্রজাতীর ফুলেরাও শীতের আগমনে নিজেদের রংবাহারী পাপড়ি ছড়াতে শুরু করে।
ডায়ান্থাস, ভারবেনা, কারনেশন, ফক্স এরকম আরও কত বিচিত্র ফুলের সমাহার শীতের আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। গোলাপও বোধহয় ঠান্ডা আবহাওয়া বেশ পছন্দ করে। তাই সারা বছর ফুটলেও শীতেই তারা বেশি পরিপুষ্ট। কত রং এর বাহারী গোলাপ চোখে পড়ে এই সময়টায়।
আহা শীত। হিম হিম ভোরে কুয়াশার চাদর ভেদ করে চোখে পড়ে শুধু ফুল আর ফুল। লাল, নীল, বেগুনী কত রং, কত রূপ, কত নামের বাহার। চারিদিকে শুধু ফুলের মেলা। কোনটাকে রেখে কোনটাকে দেখি। পথের পাশে সামান্য মাটিতে ফুটে থাকা সূর্য মুখী, গাঁদার হলুদ বর্ণ যেন সমগ্র জগতকে হলুদ আভায় ভরিয়ে রাখে।
এই সুন্দর দর্শন ফুলদুটির চাষ পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ হওয়ায় শীত ঋতুতে কারো বাগানে আর কোন ফুল না থাকুক দুচারটে গাঁদা, সূর্য মুখী থাকবেনা এমন দৃশ্য বিরল।

শৈশবে আম্মাকে দেখেছি, শীতের শেষে যখন এই ঋতুভিত্তিক ফুলগুলো ঝরে পড়ার মুখে তখনই শুকিয়ে যাওয়া ফুল থেকে বীজ সংগ্রহ করে রেখে দিতেন আগামী বছরের জন্য। জীবনের আরেক নাম বোধহয় প্রত্যাশা, বা আকাংখা বা স্বপ্ন। সেই বীজগুলো ছিল আমার মায়ের আগামী বছরের জন্য জমিয়ে রাখা কিছু রঙীন স্বপ্ন। তিনি আবার আগামী শীতে উঠানের একপাশে সুচারু একটি শীত বাগান গড়ে তুলবেন এমনি একটি প্রত্যাশা মনের কোণে সযত্নে লালন করতেন। তাতে ফুটে থাকবে নানা রংএর কসমস, ডালিয়া, জিনিয়া, বা চন্দ্রমল্লিকা। অথবা, হলিহক, পপি (বর্তমানে এই ফুলটির বোধহয় চাষ নিষিদ্ধ)। তার চোখে তখন একটাই স্বপ্ন, আগামী শীতের একেকটি হিম মাখা ভোর যেন হয়ে ওঠে হীরকের মত দ্যুতিময়। সাদা বা বেগুনী কসমসের ফিনফিনে পাপড়িগুলোেতে জমে থাকা শিশিরকণাগুলো নবীন সূর্যের স্পর্শে যেন হীরের মতই চকচকে হয়ে ওঠে। উজ্বল নানা রংএর নানা প্রজাতীর ফুলে সেজে উঠবে তার উঠান বাগান। আহা! কি সামান্য প্রত্যাশা নিয়ে আরও একটা বছরের আকুল অপেক্ষা এক ছাপোষা গৃহিণীর। ফুল ফোটানোতেই ছিল তার নিরেট আনন্দ।ঠিক যেমন করে কৃষক জমিয়ে রাখে আগামীবছরের জন্য ফসলের বীজ। তার চোখেও তখন জড়িয়ে থাকে মাঠ ভরা সোনালী ফসলের স্বপ্ন।
শীতকালীন ফুলগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের উজ্বল রং। প্রকৃতির বিমর্ষতা কাটাতেএই বিবিধ বর্ণের ফুলগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শীতের নরম সূর্যালোক থেকে সাত রঙ ছেনে তারা হয়ে ওঠে রংবাহারি। তবে এদের অধিকাংশই গন্ধ বিহীন। যেমন বর্ষায় ফোটা অধিকাংশ ফুলই হয় সাদা রং এর কিন্তু তীব্র গন্ধযুক্ত। এখানেই শীত এবং বর্ষায় ফোটা ফুলের একটা ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
পিঠাপুলি, নতুন গুড় আর নবীন ধানের ম ম করা গন্ধে যখন ঘ্রাণেন্দ্রিয় সদা জাগ্রত ঠিক সেই সময়টাতে আমাদের চোখেও লাগে রং এর ছটা।
এবারের শীত প্রায় বিদায় নেবার অপেক্ষায়। আর কিছুদিন পরেই প্রকৃতিতে শোনা যাবে পর্ণমোচী বৃক্ষের হাহাকার। তবে সে হাহাকারও ক্ষনস্হায়ী।রুক্ষ শুষ্ক প্রকৃতি যখন রং এর দৈন্যতায় প্রায় দিশেহারা তখনই উঁকি দেবে গাছে গাছে কচি কিশলয়। আরও একটি ফুলেল ঋতুর আগমনী বার্তা। পাতাঝরা শেষ হলেই যে বসন্ত।। পলাশ, শিমুল বা অশোকের হিঙুল আভায় নতুন করে রং ছড়াবে প্রকৃতি। গৃহবাসী শীতের আড়মোড়া ভেঙে দুয়ার ঠেলে প্রকৃতির দেয়ালে হেলান দিয়ে দেখবে নিত্য নতুন রংএর হোলিখেলা।

 

রওনক খান
কবি ও লেখক, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়: রওনক খান


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top