সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামের মানুষ প্রাণের মানুষ : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৩:০৩

আপডেট:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৩:০৬

    ছবিঃ গ্রামের চায়ের দোকানের আড্ডায় লেখক

 

গ্রামের মানুষদের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে এরা মুখে এবং মনে সবসময়ই একই কথা বলে। মানে যেটা সে অন্তরে ধারন করবে মুখেও সেটাই বলবে তা শুনতে যতই তিক্ত লাগুক না কেন। আপনার কোন আচরন তাদের পছন্দ হল না সেটা আপনার সামনেই ঠাস করে বলে দিবে। আবার আপনার কোন কিছু ভালো লাগলেও সেটাও অসংকোচে সকলের সামনেই প্রকাশ করবে। এবং আপনি যদি কোন কারণে তাদের মন একবার জয় করতে পারেন সে সারাজীবনের জন্য আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকবে। তবে অনুভূতিগুলো প্রকাশের ভাষাটা হয়তো ব্যাকরণশুদ্ধ হবে না। কিন্তু সেই ভাষাটা তার মায়ের ভাষা যেটা সে জন্মের পর থেকে তার মায়ের মুখে শুনে এসেছে। যে ভাষাতে সে তার মায়ের কাছে বায়না ধরেছে, যে ভাষাতে তার মা তাকে শাসন করেছে। কিন্তু শহরের মানুষজন খুব সুন্দর, পরিমার্জিত ও ব্যাকরণশুদ্ধ ভাষায় সামনা সামনি আপনার প্রশংসা করবে আর আপনি পিছন ফিরলেই এমন ভাষায় আপনাকে গালি দিবে যেটা গ্রামের ঐ মূর্খ মানুষদের ভাষার চেয়ে হাজারো গুন খারাপ ভাষা। আর যদি আপনি তার স্বার্থে সামান্যতম ভাগ বসান, সুযোগ পেলেই আপনার তেরোটা, চৌদ্দটা বাজানোর তালে থাকবে তা আপনি যতই তার কাছের মানুষ, আত্মীয় বা বন্ধু হন না কেন। যদি কোন প্রতিযোগিতায় আপনি তার প্রতিযোগী হন তাহলে তো কথায় নেই সে আপনাকে খুন করতে পর্যন্ত দুই পায়ে খাড়া।
শৈশবে আমার কাছে সবচেয়ে মধুর ডাক ছিলঃ “শালা”। কারণ আমার দাদির বাবারা সাত ভাই আর তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই দশটা, বারোটা করে ছেলেমেয়ে। আমাদের পাড়ার আশেপাশে যে বাকি ছয়টা পাড়া ছিল তার এক একটা ছিল উনাদের দখলে। আর আমার সেইসব দাদারা আমাকে সবসময়ই শালা বলে সম্বোধন করতো। দেখা হলেই কান ধরে বলে উঠতো শালা দূলাভাই বল, নাহলে কান ছাড়বো না। আমি বলতাম আমারতো বোন নাই। বোন নাই তো কি হয়েছে আগে দূলাভাই বল তারপর অন্য কথা। তারপর দূলাভাই বলে তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেতাম। এছাড়াও দেখা হলে বলতো দূলাভাই বল, তাহলে চকলেট পাবি। এবং দূলাভাই বললে সত্যি সত্যি তাঁরা চকলেট দিত। দাদারা আমাকে কেউ আমার নাম ধরে ডেকেছে বলে আমার মনে পড়ে না। আমি হয়ে গিয়েছিলাম গণশালা। আহা কি মধুর সেই ডাক, কতদিন শুনি না?
পাড়ার দাদিরা এবং দাদার বউয়েরা (তাদেরকেও আমি দাদি বলে সম্বোধন করতাম) আমাকে সম্বোধন করতো “মিনসে” বলে। দেখা হলেই বলতো, কিরে মিনসে? বউ নিবি না? শুনে আমার কালো কান খয়েরি বর্ণ ধারণ করতো। কান খয়েরি হওয়ার আরো একটা কারণ ছিল সেটা হল আমার এইসব গ্রাম্য দাদিরা একজনের থেকে একজন ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। শৈশবে আমার খেলার এবং সকল অপকর্মের সাথি ছিল আমার ফুপাত ভাই আনোয়ার। আমরা দুজনে মিলে পাড়ায় একপ্রকার ত্রাস সৃষ্টি করেছিলাম। আবার উল্টো দিক থেকে দেখলে আমরা দুজন ছিলাম সবচেয়ে আদরেরও। আমরা কি কি অপকর্ম করেছিলাম সেগুলো ভদ্র সমাজে শেয়ার করতে চাচ্ছি না। শুধু একটা শাস্তির বর্ণনা দিলে বুঝা যাবে আমরা উনাদেরকে কি পরিমাণ বিরক্ত করতাম। একবার সেজো বড় আব্বার তিন বেটার বউ আমাদের দুজনকে খড়ের পালার মধ্যে ঠেসে ধরে রান্নার পাতিলের কালো তলা আমাদের সারা মুখে ঘসে আমাদের দুজনকে মা-কালীর পুরুষ ভার্সন বানিয়ে দিয়েছিল। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর আমার আর খুব বেশি গ্রামে যাওয়া হয়নি। কিন্তু যে কয়েকবারই গেছি দাদিদের একই প্রশ্ন ছিল বরাবর, কি রে মিনসে এখনতো বড় হয়ে গেছিস, এখনও বউ নিতে ভয় পাস না কি? দুর্গভাগ্যবশতঃ বউ নেয়ার পর আর গ্রামে যাওয়া হয়নি, যেতে পারলে বলতাম বউ হিসেবে তোমারাই ভালো ছিলে, ঢের ভালো!

 ছবিঃ গ্রামের মানুষের আতিথেয়তায় লেখক


গ্রামের প্রায় সকল বাড়ির বাইরেই খানকা বাড়ি বলে একটা আলাদা ঘর থাকে যেখানে বাইরের লোকজন বা আত্মীয়রা আসলে তাদের মধ্যের পুরুষ মানুষদের সেখানে অর্ভ্যথনা জানানো হয়। তাছাড়াও রাস্তা দিয়ে যে সকল লোকজন আসা-যাওয়া করে তাঁরা বিনা নোটিসে সেখানে বিশ্রাম নেয়। যারা একটু অভাবী তাদের আলাদা ঘর না থাকলেও একটা ঘরের এক কোণ ফাকা রেখে সেটাকে খানকা ঘর হিসাবে ব্যবহার করেন। সকালে বিকালে বাড়ির এবং পাড়ার মুরুব্বী পুরুষেরা সেখানে বসে খোশগল্প করেন আর পাড়ার কার বাড়ির কি অবস্থা সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। বিশেষকরে মাতব্বরের বাড়ির খানকাঘরে প্রতিদিনই সকালে ও বিকালে পাড়ার সব মুরুব্বীরা একত্রিত হয়ে পাড়ার বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সমস্যা ও ঝগরা-বিবাদ মিটানোর জন্য নির্ধারিত দিনের বৈঠকতো আছেই। সকালে বিকালে আড্ডার ফাঁকে যদি কেউ রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করে তাহলে মুরুব্বিরা আগ বাড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, কে যায় গো? তারপর সে কাছে আসলে ও তুমি অমুকের বেটা না? আচ্ছা ও তো আমার অমুকের অমুক হয়, আবার সে আমার অমুক আত্মীয়ের আত্মীয়। এভাবে সেই লোকটা চির অপরিচিত হলেও তার সাথে একটা আত্মীয়তার বন্ধন খুজে বের করবেই। এই ব্যাপারটা আমাকে খুব ছোটবেলা থেকেই মুগ্ধ করতো। ঊনারা কত মানুষকে চিনেন, কত কিছু জানেন। আম কাউকেই চিনি না, কিছু জানিও না।


প্রত্যেক পাড়াতে মাতব্বরের নেতৃত্বে সমাজ বলে একটা সংগঠন ছিল, যারা পাড়ার সকল ভালো-মন্দ দিক দেখতো। প্রত্যেক ঈদের দিন বিকেলে পাড়ার তে-মাথায় (তিন রাস্তার মোড়) সিন্নি বিলি করা হত। এই ব্যাপারটাও খুবই আনন্দের এবং ধনী-গরীব সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার একটা ভালো মাধ্যম ছিলো। পাড়ার সব বাড়ি থেকে গামলা (টিনের তৈরি বড় আকারের বাটি) তে করে খিচুড়ি (সিন্নি) নিয়ে আসা হত তারপর সেগুলো আরো বড় একটা পাত্রে নিয়ে ধনী-গরীব সবার রান্না এক করে দেয়া হত যাতে করে কোনভাবেই বোঝা না যায় কোনটা কার বাড়ির রান্না। তারপর প্রতি বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চাগুলাকে গোল একটা বৃত্তের আকারে বসিয়ে বিলি করা হত। সাধারণতঃ গরীব মানুষদের অনেক ছেলেপিলে থাকে, তাই তাঁরা অন্যের সমান সিন্নি নিয়ে এলেও ফেরার পথে নিয়ে যেত অনেক বেশি সিন্নি। এতে তাদের প্রায় সপ্তাহখানেকের অন্নের সংকুলান হয়ে যেতো। কিছুদিন আগেও আমাদের বর্তমানের শহরতলীর এই গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় সিন্নি বিলির ব্যাপারটা ছিল, এখন আর নেই। কোরবানীর ঈদের সময়তো ব্যাপারটা আরো ভালো ছিল। গরীব মানুষরা সাধারণতঃ সারা বছর মাংশ কিনে খেতে পারে না এবং তাঁরা কোরবানীও দিতে পারে না। কোরবানীর ঈদে সবার বাড়ির কোরবাণির গরু-ছাগল-ভেড়া-মহিষ সবই গৃহপালিত, যেগুলোর এক একটা পরিবারের এক একজন সদস্য ছিল এতদিন সেগুলোকে একত্র করা হত তে মাথাতে। তারপর পাড়ার মসজিদের হুজুর এসে একে একে সেগুলোকে জবেহ করে চলে গেলে গ্রামের গরীব মানুষগুলা কাজে লেগে যেত। প্রতিবেশি হিসেবে তাদের ভাগের বাইরে মজুরি হিসাবে তারাও আরো কিছুটা মাংশ ও টাকা পেত। যেটা তাদের খাবার তরকারি হিসাবে চলত বেশ কয়েকদিন।
গ্রামের ছেলেমেয়েরদের মধ্যে আরো একটা ব্যাপার প্রচলিত ছিল সেটাকে পরবর্তি জীবনে এসে বন্ধুত্ব বলে জানলাম। গ্রামে একেবারে ঘটা করে এক মেয়ের সাথে অন্য আর একটি মেয়ের বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়া হত যেটাকে গ্রামের ভাষায় “সই” পাতানো বলা হত। আবার ঠিক একইভাবে এক ছেলেকে অন্য আর একটি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়া হত যেটাকে “মিতি” পাতানো বলা হত। তবে সাধারণভাবে একই নামের ছেলে হলে মানে দুজনের নাম একই হলে তাদের মধ্যে এমনিতেই না কি মিতি পাতানো হয়ে যেত। আমার মায়েরও একজন সই ছিল। আমি জীবনে তাঁকে শুধুমাত্র একবারই দেখেছি, আমরা গ্রাম ছেড়ে শহরতলিতে চলে আসার পর আর উনার সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় নাই। আমার আব্বার অবশ্য তেমন আলাদা করে কোন মিতি ছিল না। এর বাইরে আরো একটা সম্পর্ক ছিল, ধর্মের ভাই, ধর্মের বোন। আমার দাদির এমন একজন ধর্মের ভাই ছিল। উনার কথা এখনও আমার মনে আছে। ভদ্রলোক প্রথম যেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন সেইদিন দূর্ভাগ্যবশতঃ আমাকে আর ফুপাতো ভাই আনোয়ারকে মাঠে খেলতে দেখে আমাদের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি আর আনোয়ার বললাম আরে ঐটা তো আমাদেরই বাড়ি, আসেন আমাদের সাথে। এরপর আমি আর আনোয়ার ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে সোজা আমাদের বাড়ির দিকে হাটা শুরু করলাম। উনিও সাইকেল কাঁধে নিয়ে আমাদের পিছু পিছু আসা শুরু করলেন। বাড়িতে আসার পর উনার ফর্সা চেহারা একেবারে ঘেমে নেয়ে লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছিল। আর সেইদিন দাদি আমাদের অনেক রাগ করেছিলেন। তোরা শয়তান, পাজির দল আমার ভাইটাকে রাস্তা দিয়ে না নিয়ে এসে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে সারা রাস্তা সাইকেল কাঁধে করিয়ে নিয়ে এসেছিস। উনার ছেলেমেয়ের বিয়েতে দাদি যেতেন আবার আমার চাচা ফুপুর বিয়েতে উনি অনেকবার এসেছেন।


গ্রামের মানুষদের এই নিঃসার্থ সম্পর্কের বিষয়টি আমার মনে একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছিল যেটা এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান। আমি খুব সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করি, যদিও ঠকেছি অনেকবার। তবে আমার জীবনের যত অর্জন সবই এইসকল পূর্বে পরিচয় না থাকা মানুষের উপকারের ফসল বলে আমি মনে করি। আমি একজীবনে এত মানূষের ভালোবাসা পেয়েছি যে আমি যদি তার কৃতজ্ঞতা শিকার করতে যায় তাহলে আমাকে আরো কয়েকবার এই পৃথিবীতে আসতে হবে। এইসকল সহজ সরল মানুষগুলা আমার মুখের উপরই আমার সকল কিছুর ভালো মন্দ বলে দিতেন কোন রাখঢাক করতেন না। তবে সত্যি কথা বলতে গেলে এদের সবারই এমন আচরনের কারণ তাঁরা গ্রামে তাদের শৈশব কৈশর কাটিয়েছে তাই তাদের আচরণের মূলে আছে সেই গ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবন যাপন পদ্ধতি। এর বাইরে খুব সামান্য মানুষের কাছ থেকেই মুখোশধারি আচরন পেয়েছি যাদের কথা আমি কখনই মনে রাখতে চাই না। তবে ইদানিংকার শহুরে শিক্ষিত প্রজন্মকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগে এদের বন্ধুত্ব, গলায় গলায় ভাব, আচার আচরণে মাখামাখি সবই লোক দেখানো। এদের না আছে নিজের উৎস সম্পর্কে জ্ঞান, না আছে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য জানাশোনা, এরা না করে বড়দের শ্রদ্ধা, না করে ছোটদের স্নেহ, না এরা নিজেদের মা-বোনকে সম্মান দেয় না অপরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠদের। কি এক অলীক নেশায় এরা ছুটে চলেছে জীবনের পথে যার শেষ কোথায় এরা নিজেরাই জানে না? আমি বলছি না যে এর ব্যতিক্রম নেই, কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রমই উদাহরণ নই। আসলে এদের দোষ দিয়েই বা কি লাভ? খুব ছোট বেলা থেকেই ক্লাসে ভালো ফল করার, অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ করে তোলার প্রতিযোগিতায় এদের মায়েরা তাদের এই পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে এখনতো আর তাঁরা শত চেষ্ট করেও সেটা থেকে বের হতে পারে না। তাই আসুন আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে স্মার্ট এবং অলরাউন্ডার বানানোর পাশাপাশি কিছুটা মানুষ বানানোর শিক্ষাটাও দেয়।

 

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top