সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চৈত্র সংক্রান্তি : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৪৫

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:১৭

 

বাংলার চিরায়ত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। মনে করা হয়, চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। সাধারণত বাংলা দিনপঞ্জি বিবেচনায় মাস গণনার শেষ দিনটিকে সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে। তাই চৈত্র মাসের শেষ দিনটি হলো চৈত্র সংক্রান্তি। ‘সংক্রান্তি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো সূর্য বা গ্রহাদির এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন, সঞ্চার; ব্যাপ্তি।
মানুষ মনে মনে বসন্ত বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে যা চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে পরিণত হয়েছে কালক্রমে। এর পরের দিনই নতুন বছরের প্রথম দিন হওয়ায় চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবও বেশ গুরুত্ববহ। মোটের উপরে চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে বিগত বছরকে বিদায় দিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনে সকলকে শুভেচ্ছা জানানো হয় নতুন বছরের যেখানে সকলের মঙ্গল কামনাই মূল উদ্দেশ্য। যেহেতু বাংলা মাস গণনার ক্ষেত্রে চৈত্র মাস বছরের শেষ মাস এবং চৈত্র সংক্রান্তি বছরের শেষ দিন সেহেতু অন্যসব দিনের চেয়ে এর গুরুত্ব অনেকটাই বেশি। প্রাচীনকাল থেকে সাধারণ জনগণ যারা বিশেষত কৃষির সঙ্গে জড়িত তারাই চৈত্র সংক্রান্তিতে নানাবিধ পূজা-পার্বণ, মেলা, লোকাচারসহ সবমিলিয়ে বিশেষ উৎসব পালন করে থাকে। কার্যকারণ বিবেচনা করলে এটিকে বিশেষ লোকউৎসব বললে অত্যুক্তি হবে না। অন্য অর্থে, সম্প্রদায়গত আচার বিবেচনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ বিশেষ উৎসব হিসেবে এটি পালন করে থাকে এবং উপবাস, ব্রতাচার, দান ও স্নান পুণ্যলাভের জন্য শুভপ্রদ মনে করে পালন করে থাকে যেমন, চড়ক, গাজন, উপবাস, ভিক্ষান্ন ভোজন প্রভৃতি। শিবের গাজন ও ধর্মের গাজন নামে পালাগানও অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। গাজন মূলত কৃষকদের উৎসব। চৈত্রের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির জন্য চাষীরা পালার আয়োজন করে থাকে যা গাজন নামে পরিচিত। লোকউৎসব হিসেবে চড়ক পূজা বেশ পরিচিত। এটি চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেটা শৈব অনুষ্ঠান হিসেবেও পরিচিত। চড়ক উপলক্ষে যে আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে তা অনেক এলাকায় গাজন, গম্ভীরাপূজা বা নীলপূজা নামে পরিচিত।
লোকমাধ্যমে কথিত আছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বাণরাজা যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই বাণরাজা ছিলেন একজন শিব ভক্ত। শিব উপাসক-ভক্ত এই বাণরাজা যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ভগবানের নিকট অমরত্ব লাভের প্রার্থনা জানায়। কিন্তু তাঁর প্রার্থনা জানানোর প্রক্রিয়া ছিল আলাদা। তিনি শিবভক্তিসূচক গীত অভিনয় আকারে উপস্থাপন করে তাঁর আর্জি জানায় এবং অবশেষে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এই কারণেই যারা শিব ভক্ত বা যারা শৈব সম্প্রদায়ের তারা এই উৎসব পালন করে থাকেন। যদিও শিবের আরাধনাই উৎসব পালনের প্রধান উদ্দেশ্য তারপরও এতে আরও দুই দেবতার প্রসঙ্গ এসে যায়। একজন নীলপরমেশ্বরী আর অন্যজন কালাকরুদ্র। নীলপরমেশ্বরীর আরেক নাম নীলচন্দ্রিকা। সাধারণ জনগণ একে নীলাবতী বা নীল নামেও ডাকে। কোনো কোনো এলাকায় নীল এবং গম্ভীর এই দুইটি যেহেতু শিবেরই অন্য নাম তাই এই দুই পুরুষ দেবতার নামে পূজাচার পালিত হতে দেখা যায়। সাধারণত কালাকরুদ্র নামক দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়া হয়ে থাকে। নীলপূজা উপলক্ষে গ্রামের বাইরে ঠিক শ্মশানের ঘাটে হাজরা ঠাকুর বা দানো বারণো নামে আরও এক দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন হয় নীলপূজা আর পরের দিন হয় চড়ক পূজা। কোন কোন গবেষক পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে এই চড়ক পূজার প্রচলন বলে মনে করেছেন কিন্তু ভারতীয় উপহাদেশের চড়ক পূজার নৃতাত্ত্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এতে এমন কিছু উপাদান আছে যেগুলি আর্যপূর্ব সভ্যতার চিহ্ন বহন করে। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, ‘সামাজিক জলতত্ত্বের দৃষ্টিতে ধর্ম ও চড়ক পূজা দুই-ই আদিম কোম সমাজের ভূতবাদ ও পুনর্জন্মবাদ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত; প্রত্যেক কোমের মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জন্মের কামনাতেই এই পূজার বার্ষিক অনুষ্ঠান।’ তবে বড়শি কিংবা বাণ সন্ন্যাসের মাধ্যমে নরবলি প্রথার চিহ্ন আছে বলেও অনেকে মনে করে থাকেন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। মেলায় সকল ধরনের পণ্যই বিক্রি হয়ে থাকে। মেলায় কাঠের তৈজসপত্র, মাটির তৈরি নানা জিনিসপত্র, খেলনা, কাঁসা পিতলের বাসন-কোসন, পূজার নৈবেদ্য আর মিষ্টান্ন বিক্রি হয় দেদারসে। তবে সাধারণত খাবার জিনিসই বেশি বিক্রি হয়। আর কিছু রূপসজ্জার জিনিসও বিক্রি হয়। কারণ, যারা চড়ক উপভোগ করতে আসে তারা কোনো ধর্মের বাঁধনে আবদ্ধ নয়। কৃষিজীবী সমাজ ব্যবস্থায় আচার পালনের ক্ষেত্রে নারী বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সারা বছরের অন্যান্য সংক্রান্তির মতো চৈত্র সংক্রান্তি পালিত হয় না। এসময় প্রকৃতি থাকে রুক্ষ, আশেপাশে বৃষ্টি হওয়ার কোনো পূর্বলক্ষণ থাকে না, কৃষিজমির মাটি পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়, নব্যতা সংকটে নদীর পানি চলে যায় তলদেশে- তাই সংক্রান্তির উৎসবে আনন্দের অন্তরালে থাকে শুভাশুভ বোধ কামনায় আচার-ক্রিয়া।
চৈত্র সংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক মিলিয়ে রান্না হতে দেখা যায় এবং এতে অতি অবশ্যই তিতা স্বাদের গিমাশাক থাকতে হবে। অবস্থাপন্ন বাড়িতে ঘি দিয়ে গিমাশাক রান্নার রেওয়াজ আছে। চৌদ্দ রকমের শাক খাওয়ার পাশাপাশি তিতা স্বাদের খাবার গ্রহণের ব্যাপারে একধরনের লোকাচার প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকায় নানা রকম খাবার গ্রহণের রীতি প্রচলিত আছে। তিতা স্বাদের খাবারের মধ্যে নিমপাতা ভাজা শুক্ত অন্যতম। তবে ঘি দিয়ে ভাজা নিমপাতার সঙ্গে আলু ভাজা, কুমড়া ভাজা, বেগুন ভাজা, করলা ভাজা ও পটল ভাজা খাওয়া হয়ে থাকে। বনজ ঔষধি লতাপাতা ও সবজি সহযোগে পাঁচন রান্নার প্রথার কথাও শোনা যায়। অনেক বয়স্ক লোকের মতে চৈত্র সংক্রান্তির পাঁচন রান্নায় গ্রীষ্ম ঋতুতে পাওয়া যায় এমন সকল রকম সবজিই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র সংক্রান্তিতে নানা লোকাচার পালন করে থাকেন। মুসলমানরা মেলায় যোগ দেয় উৎসবের আমেজে। মেঘ, বৃষ্টি, জল কামনায় কৃষিজীবীরা আচার-ক্রিয়া পালন করে, ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করে, সমাজের একটি অংশ শিবের গাজন উপভোগ করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তাগুলি বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজুর মতো উৎসবগুলি পালনের প্রস্তুতির দিন হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তিকেই বেছে নেয়। চৈত্র সংক্রান্তি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলে পালন করে থাকে যা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। চৈত্র সংক্রান্তির আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত হোক।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top